জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ/ নির্মল বর্মন


বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ 
নির্মল বর্মন

'বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জগতে "কথাসাহিত্য'' পত্রিকা যথেষ্ট সম্মানজনক একটি নাম। এই পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক কথাসাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ। কথাসাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ ও সুসাহিত্যিক গজেন্দ্র নাথ মিত্র ''মিত্র ও ঘোষ''  প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন । সম্পাদক সুমথনাথ ঘোষ বাবুর উপন্যাস ও ছোটগল্প একত্রে করলে  প্রায় শতাধিক গ্রন্থ লিখেছেন । অনুবাদক সুমথনাথ ঘোষ ১লা সেপ্টেম্বর ১৯১২ সালে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। এবং ১০ই এপ্রিল ১৯৮৪ সালে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে উজ্জ্বয়িনীপুরে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
কথাসাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ এর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস সমূহ  :--
      "সুদুরের পিয়াসী"' (১৯৪১), ''বাঁকা স্রোত'' (১৯৪৩), ''সর্বংসহা"' (১৯৪৫), ''জায়া ও জননী'' (১৯৫৩) ইত্যাদি। গল্পগ্রন্থ -''প্রহরী'' (১৯৪৮), ''শ্রেষ্ঠগল্প'' প্রভৃতি। 
এবং প্রথম মুদ্রিত গল্প ' 'সচিত্র শিশিরে'' (১৯৩৫)।
শিশুকিশোরদের জন্য "মোহন সিং এর বাঁশি" সাড়াজাগানো। অনুবাদ গ্ৰন্থ:-"আলেকজান্ডার দুমার","থ্রি মাস্কোটিয়ার্স","আইভ্যান হো", "ডেভিড কপার ফিল্ড"।
                  বাংলা কথাসাহিত্যে সুমথনাথ ঘোষ আধুনিক দৃষ্টিসৃষ্টি ভাব গ্রহণ করে পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছেন। বস্তুতঃ আধুনিকতা মূলতঃ কাহিনি বয়ন ও‌ 'বিশ্লেষণাত্মক' বাচন ভঙ্গি । সুমথনাথ ঘোষের  ''বাঁকাস্রোত' সাধারণত' আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস হিসেবে সর্বজনমান্য। আত্মজৈবনিক উত্তেজনায় ভরপুর এই উপন্যাসের প্রধান নায়ক আলোক। আলোক বাবুর  জীবন কাহিনি সুন্দর ভাবে বিকশিত। "আপনা মাংসে হরিণা বৈরী" ঠিক তেমনি আলোক নিজের দোষেই যে তার জীবনে নানা রকম বিপর্যয় নেমে এসেছে, তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সে উপলব্ধি  করায়ত্ত করতে পেরেছে। সুতরাং বইটি কথাসাহিত্যিকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে সুবিদিত।

🍂

            সুমথনাথ ঘোষ এর 'সর্বংসহা'' উপন্যাসটিতে পল্লীভাবনার অভিজ্ঞতা জনসমক্ষে প্রকাশিত। কিন্তু তার শিল্পগত বাস্তবতা ও গঠন ভাবনা নগণ্য।
             কথাসাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ বাবুর ''রোশনাই'' উপন্যাসে ইতিহাসাশ্রিত রোমান্স ভাবনা র প্রচেষ্টা অব্যাহত। সম্রাট ঔরঙ্গজীব চরিত্র পাথেয় করে এই উপন্যাসের আত্মপ্রকাশ। সম্রাট ঔরঙ্গজীব  একসময় গান পছন্দ করতেন না। ফলতঃ গানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা স্বাভাবিক। এই নিষেধাজ্ঞা প্রতিক্রিয়া কে হাতিয়ার করে উপন্যাস গড়ে উঠেছে।গানের উপর নিষেধাজ্ঞা মেনে নেওয়া সহজ নয়।তাই গান অবরোধ অগ্রাহ্য করে ওস্তাদ ওসমান আলী খাঁ আরাবল্লী পাহাড়ের গহন  নির্জন অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সারাজীবন সংগীতশিল্পী ও  তার গুনমুগ্ধ সাকরেদ গুঞ্জন খাঁ'র স্থান অরণ্যাঞ্চল। অথচ বৃদ্ধ ওস্তাদ তমিজুন খাঁ'র একমাত্র মেয়ে রৌশন- সম্রাট ঔরঙ্গজীব এর গান নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেছিলেন। বিনিময়ে সম্রাটের কোপে পড়েন ও কারাগারে বন্দী। এইসব ঝালাপালা'র জন্য  ঔরঙ্গজীবের মানসিক যন্ত্রণাকে আরো প্রকটিত করেছিল।এই ইতিহাসের সূত্র ধরেই  ঔপন্যাসিক সার্থক এই উপন্যাস সৃষ্টি করলেও উপন্যাসের শিল্পমূল্য তেমন নেই বললেই চলে।
কথাসাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ এর ছোটগল্প বাস্তবিক আশাপূর্ণা দেবী'র মতোই বলা যেতে পারে। মধ্যবিত্ত বাঙালি  জীবন দর্শন। ঘোষ সাহেবের গল্প জীবনের দুঃখ বেদনার  অসহায় দিকটিই প্রকটিত। উদাহরণ -
          "পরিবারের দুঃখ দারিদ্র্যের ছবি ('চেঞ্জার'), অসহায় বার্ধক্যের রূপ ('বাড়ির কর্তা'), ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি ('ছায়াসঙ্গিনী'), মানুষের হৃদয়হীনতা ('প্রতিবেশী'), স্বামীকে জেনে শুনে অধঃপাতের দিকে ঠেলে দেওয়ার কথা ('কলহ'), নারী পুরুষের অহমিকা ('লেডিজ-সীট')"  ইত্যাদি।
সুমথনাথ ঘোষ বাবুর ''কুহু'' গল্পে নজর দিলে , পরিস্কার উপলব্ধি করা যায়, যেখানে আবেগ উচ্ছ্বাস ছাড়াই গরীবের জীবন দর্শনে হঠাৎ বসন্ত  সমাগম। 
 অন্য ''দুর্জেয়'' ছোট গল্পে  মনস্তাত্ত্বিক দিক প্রকাশিত। গল্পকারক সতীনাথের হৃদয়ে আলো-আঁধারি ভাবনা চমৎকার দক্ষতায়  উপস্থাপিত ।
 আবার ঘোষ বাবুর ''ওখানে পদ্মা এখানে গঙ্গা'' গল্পে গল্পকার বর্তমান সময় ও সমাজের জটিল রহস্যের উন্মোচন ঘটিয়েছেন। অধুনা বাংলাদেশ একদা পূর্বপাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের উত্থান-এর কাহিনি'র   সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মেলবন্ধন চিত্রিত ত্রকরেছেন ।
              কথাসাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ কথাসাহিত্যিকের অন্তর্দৃষ্টি থেকে পল্লীজীবন, মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনদর্শন, ও সেই জীবনায়নের  দুঃখ-দুর্দশাকে অঙ্কন করলেও কাল ও সমাজের রহস্যময়তায় আজ ভাবগম্ভীর রচনাবলী বিস্মৃতপ্রায়।তথাপি "কাহিনি বয়নে ও চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক রূপায়ণে " কথাসাহিত্যের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকার কথা থাকলেও পারিপার্শ্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কালের অমোঘ আকর্ষণে আজ বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ।

Post a Comment

0 Comments