উসপেনস্কি সাবর
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬৮
বিজন সাহা
কাশিরা
এবার আমরা চললাম মস্কোর পথে। পথের ধারে একের পর এক শস্যপূর্ণ জমি। প্রায়ই চোখে পড়ছে সূর্যমুখীর ক্ষেত। মনে পড়ল ২০১৪ সালের কথা। সেবার আমরা আবখাজিয়া গেছিলাম গ্রীষ্মের ছুটিতে। এর আগে সাধারণত ইউক্রেন, ক্রিমিয়া, ককেশাস ছিল আমাদের ছুটি কাটানোর জায়গা। সাধারণত দুই তিন দিনের জন্য কিয়েভ বা ওদেসা ঘুরে যেতাম ক্রিমিয়ায়। সেখানে সপ্তাহ খানেক সমুদ্র স্নান করে ককেশাসের পর্বত শ্রেণী ঘুরে মস্কো ফিরতাম। তবে ২০১৪ সালে দনবাসে যুদ্ধ শুরু হলে আবখাজিয়া, ককেশাসের মধ্যেই আমাদের ঘোরাফেরা সীমাবদ্ধ রাখি। সেবার আদিগেইয়ার কামিন্নোমস্তিনস্কি থেকে ক্রাস্নোদার আসার পথে দেখেছিলাম এরকম সূর্যমুখী ক্ষেত। তবে বাস ফেল করতে পারি সেই ভয়ে আর নামা হয়নি। সেই দুঃখ রয়েই গেছিল। তাই এখানে সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। আমি আর দিলীপ নেমে গেলাম সূর্যমুখী ক্ষেতে। তবে সমস্যা একটাই। গাড়ি থেকে যত সুন্দর মনে হয়, নামার পরে ভিউটা আর সেরকম থাকে না। ফলে ঠিক যে ভিঊটা তুলব বলে নামা সেটা আর হয়ে ওঠে না। এর পরেও বেশ কিছু ছবি তুললাম দু' জনে মিলে।
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। আসলে এসব হাইওয়েতে দ্রুত না চলে উপায় নেই। হঠাৎ দিলীপ দেমিদকে বলল গাড়ি থামাতে। দেমিদ বুঝতে বুঝতে আমরা কয়েক কিলোমিটার রাস্তা চলে গেছি। দিলীপ একটু রেগেই গেল। কিন্তু দেমিদ বেচারার কী দোষ। এসব রাস্তায় চাইলেই গাড়ি থামানো যায় না। ঠিক হল আবার ফিরে যাব।
কী ঘটনা? তুমি কেন ফিরতে চাইছ?
ওখানে রাস্তার ধারে একটি ফ্যামিলিকে দেখলাম স্নান করতে। তাদের ছবি তুলতে চাই।
দেখ, এখন বেশ গরম। অনেকেই দীর্ঘ সময় ধরে জার্নি করছে। এখানে নেমে হয়তো একটু ফ্রেশ হচ্ছে। তুমি চাইলেই কি এরা ছবি তুলতে দেবে বলে মনে হয়? এরা খোলামেলা পোশাক পরে চলাফেরা করে, কিন্তু চাইলেই তোমাকে ছবি তুলতে দেবে সেটা মনে হয় না।
কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে তো পারি।
এই এক সমস্যা। আমাদের দেশের লোকজন অনেক সময় মনে করে ইউরোপিয়ানরা যেহেতু খুব খোলামেলা, তাই সহজলভ্য। এই ধারণা দেশে মানুষের মনে খুব ভালোভাবেই প্রোথিত। যাহোক আমাদের গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টদিকে যেতে হল। কিন্তু চাইলেই তো আর থামা যায় না, তাছাড়া গাড়ি ঘুরাতে হবে। তাই আমাদের অনেকটা রাস্তা এগিয়ে যেতে হল গাড়ি ঘুরাতে। আমরা আসতে আসতে ওরা ফ্রেশ হয়ে পথে নামার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। অনিচ্ছা স্বত্তেও দিলীপের পীড়াপীড়িতে ভদ্রলোককে ছবি তোলার প্রস্তাব দিলাম। তাও এমনি এমনি ছবি নয়, তার স্ত্রী সেখানে হাত মুখ ধোবে সেই ছবি। ভাগ্যিস তিনি রাগ করেননি। বললেন তাদের তাড়া আছে আর তাঁর স্ত্রী এতে রাজি হবেন না। আমি আগেই জানতাম। কারণ আমার স্ত্রীকে এ রকম প্রস্তাব দিলে সেও রাজি হত না। মনে হয় কেউই রাজি হত না। কারণ সবাই একটু ফিটফাট হয়ে ভালো জামাকাপড় পরে ছবি তুলতে পছন্দ করে, কেউই চায় না সে যখন স্নান করছে, খাচ্ছে বা মুখ ধুচ্ছে তখন তার ছবি কেউ তুলুক। দিলীপের ধারণা ছিল দেমিদ যদি প্রথম বার গাড়ি থামাত, তবে ও ছবিটা নিতে পারত। তবে নামাটা যাতে মাঠে মারা না যায় তাই আমি আর দিলীপ রাস্তা ক্রস করে একটা জমিতে গেলাম। সেখানে ফসল তোলা হয়েছে। আর খর জাতীয় বস্তুগুলো বান্ডিল করে রাখা হয়েছে। আমাদের দেশে অবশ্য এরকম বান্ডিল করা হয় না, খরের পালা দেয়া হয়। আর বান্ডিলে আসে সূতা। আমাদের বাড়িতে সূতা রঙের কারখানা ছিল। তাই ছোটবেলা থেকেই এসব দেখে অভ্যস্ত।
ফসল কাটার পরে
গাড়ি চলছে। আমরা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি মস্কোর দিকে। বেলা বাড়ছে। বাড়ছে ক্ষিদে। একসময় দেখি কাশিরা বলে এক শহরে যাবার ডাক। মনে হল কাশিরস্কোয়ে শোচ্ছে বা কাশিরা এভিনিউয়ের কথা। দেমিদ ওদিকেই গাড়ি ঘোরালো। মস্কো ঢোকার আগে এটাই হবে আমাদের শেষ যাত্রা বিরতি। মস্কো থেকে ৯৩ কিলোমিটার দক্ষিণে ওকা নদীর ডান পাড়ে অবস্থিত এই শহর মস্কো রেজিওনের পুরানো শহরগুলির একটি। এই শহরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৩৫৬ সালে ইভান কালিতার পুত্র মস্কোর যুবরাজ দ্বিতীয় ইভানের দানপত্রে যেখানে তিনি নিজের পুত্র দ্মিত্রির নামে এই শহর উইল করে যান। এই ভাষ্য অনুযায়ী এই শহরের নামকরণ করা হয় কশিরা থেকে যা তুলা অঞ্চলের স্থানীয় ডাইলেক্টে ভেড়ার থাকার ঘর বোঝায়। অন্য এক ভাষ্য অনুযায়ী শহরের নামকরণ করা হয় কাশিরকা নদীর নামে। কাশিরকা নদী এখানে ওকার বাম তীরে মিলিত হয়েছে। ধারণা করা হয় এক সময় শহরটি ওকার বাম তীরে অবস্থিত ছিল। আরও একটি ভাষ্য অনুযায়ী শহরের নামকরণ হয় চুরস্কি কোশ শব্দ থেকে যার অর্থ কুঁড়েঘর বা কেশির শব্দ থেকে যার অর্থ নদী পারাপার কারণ ঠিক এই জায়গায় ছিল ওকা পার হওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক ও সুরক্ষিত ক্রসিং। ১৪৮০ সালে জার তৃতীয় ইভান তাতার খান আহমেদের আক্রমণ এড়াতে কাশিরা পুড়িয়ে দেবার নির্দেশ দেন। ১৪৮৩ সালে রিয়াজান ও মস্কোর রাজাদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে কাশিরা মস্কোর অধীনে চলে আসে। ১৪৯৮ সালে এখানে ত্রোইৎস্কি বেলোপেসৎস্কি মনাস্তির প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫১৭ সালে কাশিরা ক্রিমিয়ার তাতারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। পরবর্তী প্রায় ৮০ বছরে শহর বিশ বারের বেশি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ছিল ১৫৭১ সালের ক্রিমিয়ার তাতারদের আক্রমণ। ১৬১৮ সালের দিকে ওকার ডান তীরে কাশিরা পুনর্নির্মাণ করা হয়। তৈরি হয় নতুন ক্রেমলিন। ১৬১৮ সালে জাপারোঝিয়ার কসাকদের আক্রমণ প্রতিহত করা হয় কাশিরায়। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কাশিরা প্রতিরক্ষা শহর থেকে ধীরে ধীরে বানিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৭১৭ সালে কাশিরা শহর কাশিরা কাউন্টির কেন্দ্রে পরিণত হয়। উনবিনশ শতকের প্রথমার্ধে কাশিরা গুরুত্বপূর্ণ বানিজে কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৮৮৪ সালে তৈরি হয় নিকিতস্কি মেয়েদের মনাস্তির। ১৯১৮ সালের কাশিয়ার আশেপাশে কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৯৪১ সালের নভেম্বরে কাশিরা রণাঙ্গনে পরিণত হয়। জার্মান বাহিনী নিয়মিত কাশিরার উপর বিমান আক্রমণ চালালেও কখনোই এখানে থিতু হয়ে বসতে পারেনি।
রুটির দোকানএখানে আমরা ছিলাম খুব অল্প সময়ের জন্য। দুপুরের খাবার খেয়ে পাশেই উসপেনস্কি মনাস্তিরের কিছু ছবি নিলাম। অদূরেই ছিল জেলখানা আর একটি রুটির দোকান যার গঠন খুবই অন্য রকম। এরপর আমরা যাত্রা করলাম মস্কোর পথে। অরূপ পারিবারিক কাজে নিউ ইয়র্কে ছিল। নীচে ওর স্ত্রী কেতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি দিলীপকে অরুপের বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিলাম। তাড়া ছিল বিধায় বসে গল্প করা হল না। দিলীপ অনুরোধ করল আমি যেন এই দীর্ঘ ভ্রমণে তোলা ছবি এক বছরের আগে কোথাও প্রকাশ না করি। অবাক হলেও কথা দিলাম। কারণ এটা আমার জন্য শুধুই ভ্রমণ, ওর জন্য আরও বেশি কিছু। ভোলগা আর গঙ্গা নিয়ে ডকুমেন্টারি করার প্রোজেক্ট। এরপর আমি গেলাম স্পোরতিভনায়ায় বাসায়। বাচ্চাদের সাথে দেখা করে, ওদের জন্য আনা তরমুজ আর কি কি যেন দিয়ে দুবনার পথে রওনা দেই। এটা ছিল রবিবার। সোমবার আমার ক্লাস। কিন্তু ভেবে দেখলাম একে ক্লান্ত, তার উপর এখন দেমিদের সাথে না গেলে লাগেজ নিয়ে দুবনা ফেরা খুবই সমস্যাপূর্ণ হবে। তাই মাক্সিমকে অনুরোধ করলাম পরের দিন ক্লাস নিতে। আমরা গেলাম দুবনা। আমাকে রেখে দেমিদ চলে গেল ক্লিন শহরে রেন্ট করা গাড়িটা ফেরত দিতে। সেখান থেকে ও নিজের গাড়িতে ফিরে আসবে। এভাবেই শেষ হল আমাদের ভোলগা ভ্রমণ। তবে গল্প এখানেই শেষ নয়। এর পরে আমি আরও বেশ কয়েকটি ভোলগা তীরের শহরে ঘুরতে গেছি। তারপর আছে দুবনার গল্প যেখানে কাটছে আমার বর্তমান – তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। সেসব বিষয়ে না বললে ভোলগার কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই আমাদের ভোলগা ভ্রমণ চলতেই থাকবে।
কাশিরা
https://www.youtube.com/watch?v=KgzDoqZt8lc&t=9s
ছবিতে কাশিরা
0 Comments