প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
পঁয়ত্রিশতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
তারপরে আর কি!জবাতলার পিছল পেরিয়ে,জল থৈ থৈ উঠোন পেরিয়ে বিরজা তো রাঁধতে গেলেন বেশ, গিয়ে দেখেন জানলা দিয়ে ঢোকা বৃষ্টির ঝাটে কয়লা থান ভিজে একাকার। ভাগ্যিস আগের রাতের রান্না সেরে আঁচ সাজিয়ে উনুনে চাপা দিয়ে রেখেছিলেন।তা নইলে রান্নাবান্না মাথায় উঠতো, এদিকে ঘরে এতগুলি মানুষ, নতুন অতিথি,ছেলের ছুটি…ভালোমন্দ খাওয়ার আয়োজন।
তখন শহর-বাজারে ঢালাই গুল উঠেছে সদ্য,দামও নিশ্চয়ই কয়লার তুলনায় বেশীই ছিল। তবু ভাইপো তাঁর সুবিধা হবে বলেই সেই গুলের ব্যবস্থা করেছিল,অবশ্য পাশাপাশি কয়লাও আনা হতো। সেসব কয়লা সময় অবসরে ভেঙে টুকরো করে রাখতে হতো,গুঁড়োগুলো গোবর আনিয়ে মেখে শুকিয়ে ঘরোয়াভাবে গুল বানিয়েও রাখতে হতো।গয়লা বাড়ি থেকে নিয়মিত দুধের সঙ্গে গোবর ও ঘুঁটের সরবরাহের ব্যবস্থাও ছিল শহরে।সকালের তাড়াহুড়োর বেলায় ঘুঁটে-গুলের রান্না,রাতের বেলা কয়লায়;এইভাবেই মধ্যবিত্ত গৃহস্থালি সামলাতেন সে যুগের গৃহিণীরা।বিরজা তো আবার সকালের রান্নার শেষে কয়লার কুঁচি ছড়িয়ে দেশ থেকে আনা মুগ, মুসুর বা খেসারি কড়াইও বসিয়ে দিতেন ঘটী চাপা দিয়ে বিকেলে মুড়ি খাওয়ায় জন্য। টিমটিমে ঢিমে আঁচে বেশ সুসিদ্ধ হয়ে থাকতো কলাই।কাঁচা লঙ্কা,কাঁচা পেঁয়াজ,কাঁচা তেল মাখিয়ে সেই আহার্যের বৈকালিক সুস্বাদ যেন এখনও মুখে লেগে আছে। সত্যিই বেশ ছিল স্বল্পকালীন সেই মেদিনীপুর বাস;ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরলেন বৃদ্ধা।
পাশের পেয়ারা ডাল থেকে একখানা ডাহুক উড়ে গেল কি!
মনে পড়লো, মেদিনীপুরে তাঁদের ভাড়া করা বাসাবাড়ির কুয়োতলার পাশেও একখানি পেয়ারা গাছ ছিল,তাকে জড়িয়ে লতিয়ে উঠতো কুঁদরীলতা।বছরভ’র থোকায় থোকায় ফলতো।প্রথম প্রথম পাখিরাই খেত,তারপরে একদিন পাশের বাড়ির দিদি দুপুরের অবসরে চুল শুকোতে শুকোতে শুধিয়েছিলেন,
-’দিদি, তোমাদের কুঁয়োতলায় এতো কুঁদরী ফলেছে,খাওনা কেন গো!’
-’ওমা!ওগুলো খেতে হয় বুঝি? আমি তো ভাবছিলাম বুনোফল।’
-’না না।ওগুলো তো কুঁদরী। তোমাদের আগে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা লাগিয়েছিলেন দেশ থেকে এনে, ওনাদের দেশ ছিল বিহার ঘেঁসা গ্রামে।আমাকেও এনে দিয়েছিলেন। আমরা তো খাই।ভালোই লাগে।’
-’ওমা!কেমন করে রাঁধে গো?’
অবাক জিজ্ঞাসা ছিল গাঙ্গেয় পলিমাটির দেশের গৃহিণীর। তখনও ঐ সবজীটি বাংলা হেঁসেলে পরিচিত হয়নি,মূলে আড়াই প্যাঁচ দিয়ে না লাগালে যে গাছ থেকে ফল পাওয়া যায় না,তাও জানা ছিলনা।জীবন ভরে কতো কিছুই তো শেখা হয়,শিখতে হয়… আর নিত্যনতুন রান্নাবান্না শেখা তো আনন্দের!
অতঃপর শিখে নেওয়া ভিনদেশী সবজীর ভিনদেশী রান্না।ঘী-গরমমশলা,আলু দিয়ে ডালনা, কালোজিরা -কাঁচালঙ্কা দিয়ে ছেঁচকি, সর্ষে পোস্ত দিয়ে ঝাল, আরও কতো কি!
মনে পড়ে, প্রথমবার খেয়ে ভাইপোর প্রতিক্রিয়া,
-’পিসিমা গো!এতো খানিক চিচিঙ্গের মতো খেতে গো! শুধু বীজ আছে দেখি।পরেরদিন কুঁচো চিংড়ি দিয়ে রান্না করবে?’
-’বেশ তো।’
তারপর থেকে সেই শুরু… গাছে খানিক পাকা কুঁদরী পাখির জন্য রেখে বাকি নিজেরাই খেতেন, বাড়িতে শিকড় এনে গাছও করেছেন। নতুন বৌমার তো পোয়াতি অবস্থায় পাকা পাকা লাল কুঁদরী লঙ্কাবাটা সর্ষে বাটা দিয়ে তৈরি তরকারীটি ছাড়া ভাতই রুচতো না। আচ্ছা! এখনও ওরা কুঁদরী খায়! পার্বণী ছাতু!
ওগুলো তো তখনকার মেদিনীপুরে খুব পাওয়া যেত।খেতেনও ভালোবেসে।
আরও কয়েকটি নতুন খাবার মেদিনীপুরে গিয়ে খেতে শিখেছিলেন তাঁরা,মুরগির মাংস ও ডিম,কচ্ছপের মাংস ও ডিম।
🍂
আরও পড়ুন 👇
মেদিনীপুর তো চিরদিনই মুসলমান প্রধান এলাকা,ঘরে ঘরে মুরগি পোষা হতো। গরীব দুঃখী ঘরের বৌ-মেয়েরা দুপুরের দিকে ঘরে ঘরে বিক্রি করতেও আসতো। দেশে ঘরে তখনও মুরগির চল ছিল না;রামপাখি বলে ডাকলেও অন্তজরাও তেমন খেত না। কিন্তু আসন্নপ্রসবা নতুন বৌমাকে ডাক্তার পুষ্টির জন্য মুরগির ডিম খেতে বলেছিলেন প্রতিদিন।।শহরে সবাই খায়, তিনিও স্নানের আগে রান্না শেষে ডিম সেদ্ধ করে বৌমাকে খাইয়ে উনুন নিকিয়ে নিতেন।শেষের দিকে কয়েকবার মুরগির মাংসও রেঁধেছেন,খাইয়েছেন ওদের।নিজে খাননি রুচি হয়নি বলে।
তেমনই ওখানকার খোলা বাজারে শীতের সকালে বিক্রি হো’ত কচ্ছপের মাংস;ভাইপো একবার রবিবারের সকালে বাজার থেকে এনেছিল,কেমন যেন কালো কালো,মাটি পারা রূপ তার। তিনি রেঁধে দিয়েছিলেন বেশী রসুন দিয়ে কষিয়ে, কিন্তু ভালো লাগেনি তাদের। বরং কোন কোন দিন কচ্ছপের ডিম নিয়ে আসা হো’ত। পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে ঝুরোঝুরো ভাজা করলে গরম গরম তা নেহাৎ মন্দ লাগতো না খেতে। একবার বোধহয় তিনি খেয়েওছিলেন ছেলে-বৌমার চাপে।
আসলে, সেখানে তো দেশে ঘরের মতো ওতো অনুশাসনের কড়াকড়ি ছিল না,তায় ছেলেমানুষ বৌমাটি এসব নতুন খাবার বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেত। মাতৃহারা মেয়ে, তিনিও তাকে আগলে রাখতেন,আদর দিতেন। অগত্যা…
এখন সেই আহ্লাদী নববধূ মেয়েটি নিজেই পাকা গিন্নি।ঠাকুমা হয়ে গিয়েছে দুই দুইটি নাতি-নাতনীর! এখনও কি…
আহা ভালো থাক ওরা। স্হাণু শরীরে সচল মনটিকে পুনরায় সংসার বাস্তবে ফেরাতে ফেরাতে ভাবলেন বৃদ্ধা, সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো বৌমার দাদা সেই তরুণ ছেলেটির কথা…সেই যে সে রাতে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে চলে গিয়েছিল,বলে গিয়েছিল, আবার আসবে;আর এলো না তো!
বেঁচে আছে তো!নাকি…এতদিন তার কথা মনে পড়েনি কেন? ব্যাথার কাঁপন যেন চোখের পাতায়।পাশে বসেছিল ভাইঝিরা, পিসিমাকে দেখতে এসে বোনেদের সঙ্গে দেখা;যে যার নিজেদের সংসারের গল্পে মসগুল থাকলেও চোখ এড়াল না তা তাদের।কানের কাছে মুখ এনে অঞ্জলি শুধোলে,
-’কিছু বলছো পিসিমা!”
বলতে তো চাইছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে রোগিনীর মন তো অবচেতনের কোন অতলে হারিয়ে গেছে…সামনে ঘন বন, অনেক গাছ,নানানিধি রাঙবেরঙের ফুলে মনোরম,বেশ মিষ্টি মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে,এ গাছতলায়,ও গাছতলায় ইতস্তত মানুষজন তাদের মধ্যে গল্প গুজবে মত্ত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যেন চেনা…
-’ওমা!ঐ তো দাঁড়িয়ে বৌমার ভাই!যাই ডেকে আনি!কথা বলি!”
একী!হাঁটতে পারছেন না কেন!কিসের বাঁধন!হাত ছাড়াতে গিয়ে খেয়াল পড়লো,হাতে তো তাঁর চ্যানেল করা! তিনি যে অসুস্থ!কবে যেন…কবে যেন খাট থেকে পড়ে…কি জানি, সবকথা মনেও থাকেনা আজকাল,বুঝতেও পারেননা কিছু,তবে অতীতের ঘটনাক্রম মনে পড়ে বেশ; জলছবির মতো তা ভাসে চোখের সামনে,আধো জাগরণে,আধো তন্দ্রায় সেসব তাঁকে ডাকে। কখনও মনেহ য় চলে যাই, কখনও মনে হয়,আর কয়েকটা দিন থাকি! সামনেই প্রিয় ভাইপোটি বাবা হবে, নতুন বৌটির নবমাতৃত্ব বিভা…দেখতে সাধ হয়,বড়ো সাধ হয়;জীবন যে বড়ো সুন্দর!...(ক্রমশঃ)
0 Comments