জ্বলদর্চি

প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন কবি, অনুবাদক, নাট্যকার


প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন কবি, অনুবাদক, নাট্যকার


ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

হয়তো কবি বলেই  স্বপ্ন দেখতেন, এগিয়ে ভাবতেন। তাঁর চিন্তাভাবনায় বারবার ধরা পড়েছে তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে চিন্তা, দুশ্চিন্তা। সমাজ বদলের কথা ভেবেছেন, উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু নতুন ভাবনা গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। তার প্রমাণ, তাঁকে নিয়ে দলের ভিতরে বাইরে বিস্তর বিতর্ক। উদ্দেশ্য মহৎ ছিল, হয়তো উপায় ছিল মন্দ। একক স্বপ্নকে বহু-র করতে যে সার্বিক চেতনা ও গণজাগরণের দরকার ছিল, তার ঘাটতি ছিল নিশ্চয়ই। কিংবা এমনও হতে পারে,  আমরা সবাই তেমন করে স্বপ্ন দেখি না! 
তাই স্বপ্ন সুন্দর হয়েও অধরা রইলো। হয়তো সাধারণ মানুষ তখন বুঝতে পারেনি-- "কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ" এই স্লোগানের মানে। ২০১১ সালে পঞ্চদশ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। গণতান্ত্রিক রীতি পদ্ধতিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হেরে গেলেন। এটা বাস্তব। তিনি হারলেন, না কি তাঁর দল তাঁকে হারিয়ে দিল! না কি তিনিই দলকে ডোবালেন!

২৮ নভেম্বর ২০০৩ সালে, সে সময়ের বুদ্ধিজীবী, লেখকদের পরামর্শ মেনে তসলিমা নাসরিনের লেখা বই 'দ্বিখণ্ডিত' নিষিদ্ধ করেছিলেন। পরে অবশ্য জানিয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে কোনও বই নিষিদ্ধ করার পক্ষে তিনি নন। তাহলে কি তিনি দল, প্রশাসন ও সমকালীন বুদ্ধিজীবীদের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি কখনও কখনও! ব্যক্তির সঙ্গে গোষ্ঠীর অদৃশ্য কোনও লড়াই ছিল! 

এই সব প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। 

তবে, ইতিহাস বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সবসময় সঠিক কথা বলে না। তবে কি সময়ই দেবে হারজিতের ব্যাখ্যা!
জন্ম : ১ মার্চ ১৯৪৪, উত্তর কলকাতায়। প্রয়াণ : ৮ আগস্ট ২০২৪। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর কাকা। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক হন। কলেজ জীবনে এন.সি.সি-র ক্যাডেট (নৌ শাখা) ছিলেন। ১৯৭৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও জনসংযোগ, তথ্য ও সংস্কৃতি, পুর ও নগর উন্নয়ন, স্বরাষ্ট্র (আরক্ষা), তথ্য প্রযুক্তি ইত্যাদি বিভাগের দায়িত্ব সামলেছেন। ১৯৯৯ সালে উপমুখ্যমন্ত্রী ও ২০০১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হন। ২০০৬ সালে ফের মুখ্যমন্ত্রী।

রাজ্য-রাজনীতির কাজকর্মের চরম ব্যস্ততার মধ্যেই করেছেন সাহিত্যচর্চা। ১৯৯৩ সালে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানবতার জয়গান গেয়ে 'দুঃসময়' নামে লেখেন নাটক। এরপর একে একে লেখেন ইতিহাসের বিচার, রাজধর্ম, ফ্রানজ কাফকার 'মেটামরফোসিস' অবলম্বনে লেখেন 'পোকা'। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাস অনুবাদ --'বিপন্ন জাহাজের নাবিক' উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনাগ্রন্থ 'পুড়ে যায় জীবন নশ্বর'(১৯৯৯)। প্রকাশিত 'স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা' — চীনের পরিস্থিতি নিয়ে লেখা বই। তাঁর কবিতার বই 'চেনা ফুলের গন্ধ'। এছাড়াও রয়েছে --'এই আমি মায়াকভস্কি', 'নির্বাচিত প্রবন্ধ', 'ফিরে দেখা', 'নাটক সমগ্র'(২ খণ্ড), 'বিদেশী লেখকের কবিতার অনুবাদ', 'প্রবন্ধ সংগ্রহ' ইত্যাদি বই। 
১৯৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলার উদ্বোধন করেছিলেন। তখন তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্র এবং তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের মন্ত্রী। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বাংলা আকাদেমির সভাপতি তথা সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ। ভাষণে বুদ্ধদেববাবু জানিয়েছিলেন কলেজ জীবনে তিনিও 'স্ফুলিঙ্গ' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন করতেন। অবশ্য পত্রিকার আয়ু ছিল স্ফুলিঙ্গের মতোই ক্ষণস্থায়ী। কিছুদিন বাদেই প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি এও উল্লেখ করেছিলেন, লিটল ম্যাগাজিনের মুদ্রণ সংখ্যা কম, এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব যদি ভালো ভালো লেখা বারবার পুনর্মুদ্রণ করা যায়। উল্লেখ্য, এই পরামর্শ আজও মানেন না অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক। তিনি  লিটল ম্যাগাজিন ভালোবাসতেন। জানতেন লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন। তাই তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, লিটল ম্যাগাজিনে সরকারি সহযোগিতা পরোক্ষে থাকাই শ্রেয়। কারণ, প্রত্যক্ষ যোগে লিটল ম্যাগাজিনের নিরপেক্ষতা নষ্ট হবে। নিয়মিত পেতেন জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো। হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও প্রাপ্তি ও পরামর্শ দিতেন নিজেই—টেলিফোন মাধ্যমে। ব্যস্ততার জন্য লেখালেখির সময় পাচ্ছেন কম, তা নিয়ে আক্ষেপ করতেন। 
জ্বলদর্চিতে লেখার জন্য আবেদন জানালেও তিনি সময় করে উঠতে পারেননি। কিন্তু উৎসাহ দিয়েছেন চিঠি মাধ্যমে। ফোন মাধ্যমে। টাইপ করা চিঠিতে প্রকৃত চিঠির স্বাদ থাকে না -- জ্বলদর্চির তরফ থেকে এ কথা জানালে তিনি পোস্টকার্ডে নিজের হাতে জানিয়েছিলেন শুভেচ্ছা (এখানে টাইপ করা ও নিজের হাতের চিঠি দুটি সংযোজিত হল)।

🍂

Post a Comment

0 Comments