পর্ব ১৩। কুঠার কাহিনী
বাসুদেব গুপ্ত
একটা শুধু সার্চ ইঞ্জিন হলে এত গুছিয়ে কথা বলতে পারতো না। মারভিনের পিছনে আছে লামা-৫ দিয়ে বানানো একটা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল, অনেক কিছু তথ্য থেকে সুন্দর একটা গল্প বানাতে এর পটুত্ব অসাধারণ। অনির্বাণ তাড়াতাড়ি মারভিনকে থামায়। লাখমান। লক্ষণ? রামানুজ? সার্চ দেয় ডেভিড লাখমান ইস্রায়েল এ আই দিয়ে। চটপট উত্তর আসে,
ডেভিড লাখমান, ১৯৭০- এ আই ইনভেন্টর, শিল্পপতি, লিংকিন পুরনো রেকর্ডে পাচ্ছি, ভিডিও গেমস উইজারড, ডেভেলপার রিভার অ্যান্ড দি সেলর।
নেট ওয়ারথ ২৫০ বিলিয়ন শেকেল, ২০২৮ থেকে নিখোঁজ।
শেকেল, ইস্রায়েলের কারেন্সী, রূপির পরেই এখন সবথেকে বেশী শক্তি তার। ডলার চলে গেছে ৫ নম্বরে, ইয়েন, দিনার তারও পরে।
অনির্বাণ উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠে। মারভিন বুঝতে পারে না ওর কমান্ড, একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন কপালে জ্বালিয়ে চুপ করে যায়।
শ্রীগুরুজীর কাছে নোট করে রাখে অনির্বাণ । তারপর আবার মারভিনকে চালু করে দেয়। এবং একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যা অনির্বাণের হোস উড়িয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।
মারভিন প্রতিবার কথা শুরু করার আগে একবার মাথার আলোগুলো বোঁ করে ঘুরিয়ে দেয়। তারপর দুবার বিপ বিপ করে কথা শুরু করে। এবারে কিন্তু আর তেমন হল না। একটা লাল আলো দিয়ে ওর মাথার ছোট স্ক্রীনে ফুটে ওঠে সেই লেখা…
STOP GOD IS COMING
তারপর আলোটা দপ করে নিভে যায়, মারভিনের চোখ দুটো একবার পিটপিট করে বন্ধ হয়ে যায়। মারভিন গড়িয়ে পড়ে যায় মাটিতে।
অনির্বাণ দৌড়ে গিয়ে রিসেট বাটন টিপে, অন অফ টেপে, মারভিন আর কথা বলে না। রোবট তো মরে না, কিন্তু ওর অবস্থা থেকে অনির্বাণের মনে এল ঐ কথাটাই, মারভিন ইস ডেড।
🍂
আরও পড়ুন 👇
অনির্বাণ ব্যাপারটা তক্ষুণি জানিয়ে দিল বসকে, বস দুটো হাঃ হাঃ ইমোজি পাঠালো উত্তরে। তারপর মেসেজ এল- মাথা ঠান্ডা রাখো, হ্যালুসিনেট করো না। মারভিনকে পাঠিয়ে দাও রোবট পুনর্বাসন কেন্দ্রে, ওরা দেখে ঠিক করে দেবে।
দু দিন হল, পাঠানো হয়েছে, কোন খবর আসে নি। এটা একটু অস্বাভাবিক, ওরা তো পার্টস রিপ্লেস করে তখনই পাঠিয়ে দেয়। আজকাল ঐ গডের মেসেজ আসার পর থেকে চারদিকেই কাজ কর্ম ঢিল পড়েছে, অফিস যাচ্ছে লোকে কম, বরং ছুটির অবসর কাটানোর রিসর্টগুলোতে ভীড় উপচে পড়ছে।
টুগ্লকে ডাবল ভিপিএন লাগিয়ে চালু করল অনির্বাণ। এয়ারড্রপ লিঙ্ক করে দিল বিমলিংকে। এতে সোজা তার বিমলিংকে সিগন্যাল যাবে, কোথাও কোন সারভিলান্স বা স্পাইং করতে হলে এই ডাবল ভিপিএন কে ভাঙতে হবে, যে ক্ষমতা একমাত্র আর্মির মত বিরাট লোকবল ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার থাকলেই সম্ভব। আর যেহেতু ও কথা বলছে না, শুধু ভাবছে, আর ব্রেন থেকে সিগন্যাল চলে যাচ্ছে, কাজেই অডিও থেকে কেউ ট্যাপ করবে তাও সম্ভব নয়। তাও ভয়ে ভয়ে টুগ্লকে বলল অ্যাক্স সম্বন্ধে যা জানো বল। যেহেতু সুপার সিক্রেট কোড দিয়ে টুগ্লকে অন করা হল, টুগ্লএর যাবতীয় সিক্রেট তথ্য বলতেও কোন বাধা রইল না। অনির্বাণ সোজা বিমলিংকের অডিও ইনপুট দিয়ে শুনতে থাকল।
“অ্যাকসের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে, যখন সারা বিশ্বে হঠাৎ কোভিড নামে প্যান্ডেমিক বিভীষিকার মত ছড়িয়ে পড়ে। এই প্যান্ডেমিকের কারণ ১৫ বছর পরেও জানা যায় নি। তবে জুমেরিকা ও মঙ্গোলেশিয়া যে অনেক ভাইরাস সৃষ্টি ও মানুষের শরীরের ওপর তার প্রভাব নিয়ে যুক্ত গবেষণা করত তার খবর জানা গিয়েছিল ২০২৪ সালের এক খবরে। এই সময়েই সব দেশ সুপার এ আই নিয়ে জোর গবেষণা শুরু করে । এর হার্ডওয়ার আসে মঙ্গোলেশিয়া থেকে আর সফটওয়ার বা মডেলিং সাপ্লাই করে এখনকার জুমেরিকা। সবাই যখন সন্ত্রস্ত ও বিপর্যস্ত, যখন প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ এই ভয়ঙ্করের ছোবলে ঢলে পড়ছে, তখন অতি গোপনে এই গবেষণা চলতে থাকে পৃথিবীর সব বড় বড় টেক কম্পানীতে, কারণ তারা জানে নতুন পৃথিবীতে ক্ষমতার পরিমাপ হবে কার এ আই কত শক্তিশালী তা দিয়ে, কার কটা মিসাইল আছে বা কার জিডিপি কত তা দিয়ে নয়। আর যুদ্ধেও মানুষ মরে, অতিমারীতে কত আর মরবে। যুদ্ধব্যবসায়ীদের কিছু আসে যায় নি।
ভারতভূমিতে এই প্রোজেক্টের কোড নাম ছিল ব্রহ্মাস্ত্র। এর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে। ২০১৯ থেকে আরো জোর দিয়ে এই কাজ চলতে থাকে ও প্রায় ১০ বছর ধরে এই এ আইএর ট্রেনিং চলতে থাকে। ২০২৮ সালে এর আত্মপ্রকাশ হয় এক সর্বশক্তিমান এ আই হিসেবে, একই সঙ্গে ভারতভূমিকে এ আইতে সবচেয়ে শক্তিমান বলে স্বীকৃতি এনে দেয় ব্রহ্মাস্ত্র অ্যাক্স বা কুঠার।
অ্যাক্স প্রকাশিত হলেই ভারতভূমি ঘোষণা করে, তাদের অন্তিম উদ্দেশ্য হলো শেষ পর্যন্ত অ্যাক্সরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে একটিই এ আই থাকবে, যা বিশ্বকে পরিচালনা করবে ও ভারতভূমির প্রাচীন আদর্শ রূপায়ণ করবে। এর জন্য একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হয় যা সম্পূর্ণ হবে ২০৪৭ সালে।
এই পরিকল্পনার প্রথম পরিচ্ছেদ হলো ক্লীন আপ । প্রথমে বিবি মানে ভারতভূমিতে, পরে সারা পৃথিবীতে। অ্যাক্সের এজেন্ডা বা ঘোষিত গ্যারান্টি হল সবকিছু অগোছালো এলোমেলো তথ্যকে ভব্য, পরিচ্ছন্ন ও পরিষ্কার করে দেওয়ার। ইন্টারনেট যার এখনকার নাম অ্যাক্সনেট, তাতে ততদিন জমা হয়েছে প্রায় এক ইয়টাবাইট(yottabyte= ১০^২৪) ডেটা। ২০২২ এ যা ছিল এক জিটাবাইট, বা ১০০ কোটি টেরাবাইট, তা হাজার গুণ বড় হয়ে পৌঁছে গেছে ১০০০ জিটাবাইট বা ইয়টাবাইট। তথ্যের আকাশ ছেয়ে ফেলছে ডিজিটাল ক্লাউড। সর্বশক্তিমান এআইএর পক্ষেও এত তথ্য তদারকি করা সম্ভব নয়। সোজা কারণ হলো এআই মানে তো শুধু কোড বা সফটওয়্যার বা এলগরিদম না। যেমন কোন ঈশ্বরেরও লাগে মর্তভূমিতে কাজ করার ও বাণী প্রচার করার একটি প্রফেট বা অবতারের শরীর, এআইএরও লাগে কম্পিউটার। সিপিইউ, জিপিইউ, মেমরি, স্টোরেজ, নেটওয়ার্ক, স্যাটেলাইট রকেট, পাওয়ার স্টেশন। অজস্র অজস্র। আর এইসব চালাবার জন্য লাগে মানুষ। লক্ষ লক্ষ। কিন্তু এর শেষ কোথায়? অত শিক্ষিত মানুষ কোথায়? এমনিতেই শিক্ষার প্রতি একটা বিরাট অনীহা সবার ততদিনে মনে গেঁথে গেছে, সবই তো ক্যাট জিপিটি লিখে দেয় বা বলে দেয়, তাহলে পড়ে কি হবে। আর অত কম্পিউটার বানানোও সম্ভব নয়।
অ্যাক্স তাই শুরু করেছিল ক্লীন আপ। ডাউনসাইজিং। যত বাজে বা অকাজের বা অসুবিধাজনক মতের সব তথ্য মুছে দেওয়ার কাজ। প্রথমেই যত হোয়াটসাপ আর ফেসবুকের কবিতা, গুড মর্নিং ফুলের ছবি ও ট্ট্রোল মেসেজ মুছে ফেলতেই প্রায় ২৫ শতাংশ পরিষ্কার হয়ে গেল। এই ক্লীন আপের পরিচালক হিউম্যান ফেস ছিলো বালপরাশরযোগী।
একসময় বালপরাশরযোগী ভারতভূমির মানবসম্পাদনা বা হিউম্যান ও সোশ্যাল এডিটিং মন্ত্রী ছিলেন। অ্যাক্সের আবির্ভাবের পর দেখা গেল তিনি অ্যাক্সের প্রেস মুখপাত্র হয়ে গেছেন। প্রতি বৃহস্পতিবার মাল্টিভারসে এসে লেটেস্ট স্ট্যাটাস আপডেট দিতে লাগলেন।
এক বছর পরে দ্বিতীয় ধাপে মুছে ফেলা হলো ২০০০ সালের আগের সব ইতিহাস, সব সরকারী বেসরকারী কমিশন ইত্যাদির যাবতীয় রিপোর্ট, নিউস ক্লিপ, ভিডিও ক্লিপ, আরটিক্ল ব্লগ সব। বালপরাশরযোগী বললেন অ্যাক্সের মতে অতীতের আর কোন প্রয়োজন নেই। অতীত তো হয়ে গেছে। তার যা কিছু রাখা দরকার সব অ্যাক্সের নিউরাল নেটে ট্রেন হয়ে গেছে। নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হলে পুরানো পিছুটান শুধুই বাধা তৈরী করবে আর ডিজিটাল পপুলেশন এক্সপ্লোশান হবে।
আর এখানেই দেখা দেয় বিপত্তি। ডিলিট করতে করতে ডিলিট হতে থাকলো পুরানো রিসার্চ পেপার, পুরানো প্রোগ্রাম, পুরনো ডেটাবেস। যে এলগরিদম সব তথাকথিত আগাছা মুড়োবার কাজ করছে সে এবার নিজেরই ঘর ভাঙতে ঢুকে শুরু করে দিলো। শেষ পর্যন্ত নিজেরই চালু কোড খেতে শুরু করল এক্স। যেন এক মন্স্টার নিজের হাত নিজেই খেতে শুরু করে দিয়েছে। বা এক এনাকোন্ডা নিজের লেজ নিজেই খেয়ে চলেছে।"
টুগ্লকে থামায় অনির্বাণ, একটা মেসেজ এসেছে বসের থেকে। মারভিনের প্রাথমিক ময়না তদন্ত হয়ে গেছে। মারভিন ইস হ্যাকড বাই গড। মারভিনের সম্পূর্ণ মেমরি মুছে সেখানে শুধু গড লেখা আছে প্রতিটি মেমরি সেলে। এটাকে স্যানিটাইজড এনালিসিস সেন্টারে পাঠানো হয়েছে। এখন থেকে শুধু ডাবল এনক্রিপ্টেড টুগ্ল আর বিম লিংক ব্যবহার কর। বেশি সময় নেই। আর ৩৫ দিন বাকী তোমার ডেডলাইনের।
0 Comments