বিষাদের অশ্রুবিন্দু
অজিত দেবনাথ
‘What we call the beginning is often the end/And to make an end is to make a beginning/the end is where we start from.'
এলিয়টের এই পঙক্তি টেনে আজকের আলোচনার সূত্রপাত করা যাক। এই গণআন্দোলন সংবেদনশীল সত্তার এক নির্মল বহিঃপ্রকাশ। চিকিৎসা কেন্দ্রকে আমরা এতদিন আরোগ্য নিকেতন বলে ভেবে এসেছি।
কিন্তু আর জি কর হাসপাতালের নারকীয় হত্যাকাণ্ড আমাদের এই আত্মপ্রত্যয় উদ্বাস্তু শিবিরে পরিণত হয়েছে।এমনকি সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার শেষ প্রত্যয়টুকুও নিমজ্জিত হয়েছে পানাপুকুরের স্বখাত সলিলে। মমতাবিহীন খরস্রোতে ভেসে গেছে জীবনের প্রত্যয়বিন্দু। তাই অন্ধকারকে জনারণ্যে নিয়ে আসার এক অটুট প্রতীতি । প্রতিবাদের বীক্ষণ যেন স্বঘোষিত ঢেউয়ের অতন্দ্রপ্রহরীতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই পর্বান্তর কতটা সূর্য-উদয়ের ইঙ্গিত নিয়ে আসে তা এক বিস্তীর্ণ পরিসরে আলোচনা করা উচিত। নাকি যে পথে হেঁটে চলেছি সেখানেই কি বিসর্জনের ঢাক বেজে ওঠবে? সমস্ত হৃদয় জুড়ে এখন বিদ্রুপের ধারাজল, এই পথেই আসবে মুক্তির ঝিরঝিরে বাতাস, প্রশস্ত বুকে ঝরুক বৃষ্টির বিষাদ যন্ত্রণা! গভীর আত্মপ্রত্যয়ের এক নির্মোক দূরবিন যেখানে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একই সরলরেখায় আবর্তিত হয়ে দীপ্র চেতনার সন্ধান দেয়। বোধের এই অনুপঙ্খ শাসকের নির্ব্যূঢ় কাল চেতনার বিপ্রতীপে তৈরি করে অন্তর্বিক্ষোভের তীক্ষ্ণ আততি ইতিহাস যেখানে পোড়া জমি ও ফাঁপা মানুষের মর্মান্তিক ঊষরতার কিছু পুঞ্জ মেঘ নিয়ে আসে। মানুষ এখানে বড়ই অসহায়। খোঁড়া ও অন্ধ হতে হতে শ্রাবণসমেত মেঘের বাক্স ও পুঁটলি নিয়ে কখন যে ঢুকে পড়ে অন্ধকারের চাতালে। শঙ্খ ঘোষ আপাতত শান্তি কল্যাণ কবিতায় বলেছেন-
'এখন সবই শান্ত সবই ভালো
সত্য এবার হয়েছে জমকালো'
আমরা একদিকেই বিক্ষত, আবার নন্দিতও। কিংবা বলা যেতে পারে বিক্ষত হতে হতেই আমরা নন্দিত হচ্ছি। আমরা হট্টরোল থেকে বেরিয়ে নিজেদেরকে প্রচ্ছন্ন রাখার নৈঃশব্দ্যকে অর্জন করতে পেরেছি, নীরবে অনাবৃত করার সাহস অর্জন করেছি। প্রগাঢ় বহুস্বরিকতায় বলতে পেরেছি অন্ধকারের ভিতরে কেন এত অন্ধকার!
জীবনানন্দ দাস মহা ইতিহাস নামক কবিতায় বলেছিলেন-
'..... আঁধার দেখেছি, তবু আছে অন্য বড়ো অন্ধকার...'
সত্যিই এ বড় অন্ধকার। বিশ্বাস কোথাও নিজস্ব পরিসর খুঁজে পায় না, অনন্বয়ের কূটাভাস শুধু পীড়িত করে তোলে। রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী একটি কবিতা বলেছেন-
'হয়তো গন্তব্য ছিল সূর্যলোক কিংবা আরও দূর গ্রহান্তরে
ডেকে নিয়ে এলো তাকে আমাদের বিষণ্ণ পল্লব,
ভাবে নাই, অনভিজ্ঞ, এখানে ঝরনার কণ্ঠস্বরে গরল লুকিয়ে থাকে,
নরক ছড়ায় তিক্ত ফুলের সৌরভ'।
আত্মপ্রতারণার এই চতুর প্রকরণ যদি সামাজিক অনুশীলনে পরিণত হয় তখন আমাদের বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়, আত্মরতিতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, নান্দনিক ভাবনা গিলোটিনে বলি হয়। প্রগতি-সংস্কৃতির এই রক্তশূন্যতা মানব সমাজকে নিরন্ধ্র অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু প্রতিবাদী মনন সব সময় আপাতকালের দ্বান্দ্বিক উপলব্ধির বিন্যাসে আত্মদীপ্ত স্বতন্ত্রতা অর্জন করতে চায়। এখানেই প্রতিবাদ আরও অমোঘ হয়ে ওঠে, ভেঙে যায় প্রতিবাদের অভ্যস্ত শব্দবন্ধ। মনিভূষণ ভট্টাচার্য বলেছিলেন-
'অনেক ফুল তো ফোটানো হলো এই বাগানে
এবার কিছু ভুল করো........
উল্টো-পাল্টা শব্দ ভেঙে'।
সত্যিই তো আত্মপ্রত্যয়ের এই অনির্বাণ শিখা জ্বালাতে পারলে ধ্বংসের মধ্যেই নির্মাণের প্রকোষ্ঠ তৈরি হয়। নারীর জোরালো কণ্ঠস্বরে এই বিশ্বাস যেন ক্রমশ প্রতিবাদের শাণিত অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুখোশ কবিতায় লিখেছেন-
'হে যুবক, হে যুবতী, পৃথিবীতে তোমাদের কতটুকু দাম?
কান্নাকে শরীরে নিয়ে কার ঘরে কয়ফোঁটা দিয়ে গেলে আলো'?
এই চেতনার বিন্যাসে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত নেই, নেই মতাদর্শগত পার্থক্য। মানুষের পাশে থাকার এক শ্বাশত আহ্বান। না হয় আমরা আগলে রাখবো আমাদের দুর্দিনের পথ। আমাদের দুঃখ আমাদের একান্ত আশ্রয়।আর এই কলতানকে যদি আমরা অনধিগম্য হিমবাহ বলে মনে করি, নীরব নিরর্থকতার মোড়কে পুরে বিচ্ছিন্ন অনুষঙ্গের বিষাক্ত পরিমণ্ডল তৈরি করি, তাহলে সমাজ বিজ্ঞানীদের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরক্ষাব্যূহকে মান্যতা দিতে হয়-Man is alienated from himself, his aspirations separated from reality, his ideals from actuality.
রমাপদ চৌধুরী এখনই উপন্যাসে লিখেছেন-
‘সুখের লোভে, হারানোর ভয়ে শুধু মানিয়ে চলা, মেনে নেওয়া। সেটাই বোধ হয় এ যুগের আসল ট্র্যাজেডি। আমাদের জীবনে ছোট ছোট সুখের পালক আছে, আনন্দ নেই। দুঃখ আছে, কিন্তু গভীর বিষাদ নেই। আজকের জীবন ট্র্যাজেডিও না, কমেডি না।মিলন এবং বিচ্ছেদের এক সম্মিলিত সুর আসলেই এক ধরনের অ্যাডজাস্টমেন্ট'।
🍂
আরও পড়ুন 👇
আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি সমস্ত শুচি- সংস্কার ভেঙে। বলতে পেরেছি, এই তো জীবনের ডাক। ঘরের শৃঙ্খল ভেঙে নীরবতা গড়িয়ে পড়েছে পাথুরে রাস্তায়।এই অন্তঃপ্রেরণা যা ছিল বিচ্ছিন্ন, যা একলার, সেটাই এখন স্বতঃস্ফূর্ত অনুরণনে পরিণত হয়েছে। মেনে- নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার চক্রব্যূহকে আমরা আর প্রশ্রয় দিতে চাই না। জানি এই পথ সহজ নয়। চারিদিকে শুধু শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা। কিন্তু আশা- ভঙ্গ, প্রতিকারহীন ক্ষোভ আর তিক্ত আত্মদ্রোহ এমনকি বিপন্ন ও বিষাদ এই আন্দোলনের মৌল আধেয়। আমরা অন্ধকারকে খুঁড়ে চলেছি মৃতদেহের জন্য নয়, খুঁজে পেতে চাই আলোর প্রজ্বলিত শিখা। আত্মগ্লানির পাথর ভেঙে বেরিয়ে আসে বিশ্বাসের সুবাতাস। ভেঙে ফেলতে হয় যা কিছু দীর্ণ, অসাড়, যা প্রতিশ্রুতির পৃষ্ঠদেশে আঘাত হানে বারবার। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন-‘ভাঙা শিখতে হয়’। সত্যিই তো অনেক সময় ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন জিনিস গড়ে তুলি এবং তা ধীরে ধীরে মূল্যবান হয়ে ওঠে। নির্মল আবেগের সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ ঘটাতে পারলে সত্যের সন্ধান অনেকাংশে সহজ হয়ে পড়ে। আমরা কেউই বোকাবাক্স নই, আবার আমরা নিরস্র নই। আমাদের মধ্যে রয়েছে বিশ্বাসের আবহ সংগীত। সাদা পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে আমরা খুঁজে নিতে পারি সমাজের সমন্বয়বিন্দু। সমস্বরে বলতে পারি আমরা পালাতে চাই না, ফিরে দাঁড়াতে চাই। অন্যায়ের আচ্ছন্নতায় আমরা মুখ ফিরিয়ে নিতে চাই না জ্বলন্ত বাস্তব থেকে।
আর যারা যৌথ কন্ঠের স্বকীয়তার সঙ্গে কন্ঠ মেলাতে পারিনি, ক্ষুদ্র গণ্ডিবদ্ধতার স্বীকারোক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, বলতে পারিনি আমিও তো খুঁজে নিতে চাই আমার আত্মজকে। তারা আজ বন্দি অন্ধকারের নোলকে। এই ধরনের সমাজবিমুখতা, আত্মরতি ও মননহীনতা মিথ্যার ফানুস ওড়ানোকে সাড়ম্বরে পালন করে চলেছে। তারা শুধুমাত্র উপরিকাঠামোর রূপান্তরে বিশ্বাসী। কিন্তু এই অটল বিশ্বাস স্বল্পস্থায়ী আবর্তন তৈরি করে মাত্র। তাদের মধ্যে বহুস্তরাম্বিত সুক্ষ্ম আবহ তৈরি হয়নি। এই উদাসী মানুষের কানে কখনোই বেজে ওঠে না। 'কত রবি জ্বলে রে, কেবা আঁখি মেলে রে'। এর মধ্যে যে সংবেদনশীলতা ফুটে উঠেছে, ব্যক্তি সত্তাকে দীর্ণ করে সামাজিক মূল্যবোধের যে সংকেত নিয়ে আসে -তা আজ সবচেয়ে বিবেচ্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বস্তুত সাম্প্রতিকের দাবি মেটানোর জন্য যে ধ্বজদণ্ড বয়ে চলেছি তা যেন রক্তকরবীর রাজার মতো স্বরচিত জালে জড়িয়ে জড়িয়ে না ফেলি। বরং চেতনার দর্পণে এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে গভীরভাবে বুঝতে হবে। অবক্ষয়ের মারীবীজ আজ বিষাক্ত ক্যাকটাসের মত ছড়িয়ে পড়েছে যত্রতত্র। এই অবিনাশী কালো পাথর সরিয়ে দিয়ে শতজলঝরনার ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
আমরা জানি না এই অপরাধের প্রকৃত বিচার হবে কিনা। অপরাধীরা প্রকৃতপক্ষে সাজা পাবে কিনা। তবুও সেই যন্ত্রণাকাতর মুখটির দিকে তাকিয়ে এই সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে। 'দেশপোড়া গন্ধ' নবারুণ ভট্টাচার্য বিখ্যাত উক্তি "এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না"। কিন্তু উনুনের ভিতরে প্রতিদিনই কত মানুষকে যে গলতে দেখি। চারিদিকে শুধু পোড়া গন্ধ। বুকের পাঁজরে চন্দ্রবোড়ার মতো বিষাক্ত সাপকে লুকিয়ে রেখে যদি দেশের কল্যাণ করতে চাই তাহলে আকাশের রামধনুও দুন্দুভি বাজিয়ে খসে পড়বে একদিন। তখন আদর্শবোধের বদলে বড় হয়ে ওঠে মোহময় চাতুর্য। ফলে গভীর আত্মপ্রত্যয়ের জায়গায় কিছু ফাঁপা বুলি নন্দনকাননে পরিণত হয় । আত্মিক নৈরাজ্য ক্রমশ মূল্যবোধকে গ্রাস করে ফেলে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি অনিবার্যভাবে হীনবল হয়ে পড়ে। তারপরে আত্মিক অবসাদ ও নেতিবাদ, এমনকি বিচ্ছিন্নতাবোধ সমস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কায়েম করে। জীবন ও সমাজের গভীর সমন্বয়তায় তাদের কোনো আস্থা নেই। অজ্ঞতাসারেই মেকি বুদ্ধিবাদের প্রশ্রয়ে নিজেদের সরিয়ে নেন স্বকপোললল্পিত রঙিন ফানুসের কার্নিভালে।
'রক্তকরবী' নাটকের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে আভাস দিয়েছেন, মাটি খুঁড়ে যে পাতালে খনিজ ধন খোঁজা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়; মাটির উপরিতলে যেখানে প্রাণের, যেখানে রূপের মৃত্যু, যেখানে প্রেমের লীলা, নন্দিনী সেই সহজ সুখের সেই সহজ সৌন্দর্যের।সমস্ত ‘রক্তকরবী’ নাটকে আমরা নন্দিনীর দৃপ্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। নাটকের প্রধান চরিত্রগুলোকে সে অত্যন্ত সংবেদনশীল ভাবে আমাদেরকে চিনিয়ে দেয়। এভাবেই নন্দিনী বিপ্লবের আলপনা এঁকে যায় পৃথিবীর নগ্ন মাটির উপরে। নন্দিনী শুধু বিশু পাগলের কণ্ঠে গান জোগায় না, সে বলতে পারে, 'আমারই হাতের মধ্যে তোমার হাত এসে আমাকে মারুক, মারুক, সম্পূর্ণ মারুক-তাতেই আমার মুক্তি'। এই নন্দিনী কিন্তু সমস্ত দুর্বলতাকে উপেক্ষা করে, রাষ্ট্রের দর্পকে ভেঙে দমকা হওয়ার বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। কত সাবলীল ভাবে বলেছিল, আমার অস্ত্র নেই, আমার অস্ত্র মৃত্যু। মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জাগাতে পারলে, কোনো বাঁধা-ই প্রগাঢ় শূন্যতার নিঃস্ব রিক্ত ঢেউ নিয়ে আসে না। পথের মধ্যেই পথকে খুঁজে নিতে হয় নীরবে।
স্বরচিত কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে এই আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাই।
'ভাঙাচোরা ইটগুলো শবের মতো পড়ে আছে
জীর্ণ ও অসুস্থ
কেউ কোথাও নেই
হাসপাতালের দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে লাল রক্ত
এত স্বতঃস্ফূর্ত অন্ধকার আমরা দেখিনি কখনো!"
0 Comments