জ্বলদর্চি

লঙ্কা /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৩৫
লঙ্কা

ভাস্করব্রত পতি

ননীলাল বাবু যাবে লঙ্কা; 
শ্যালা শুনে এল, 
তার ডাকনাম টঙ্কা।
বলে, 'হেন উপদেশ তোমারে দিয়েছে সে কে, 
আজও আছে রাক্ষস, হঠাৎ চেহারা দেখে 
রামের সেবক ব'লে করে যদি শঙ্কা।
আকৃতি প্রকৃতি তব হতে পারে জমকালো, 
দিদি যা বলুন, মুখ নয় কভু কম কালো 
খামকা তাঁদের ভয় লাগিবে আচমকা। । 
হয়তো বাজাবে রণডঙ্কা'।
(ননীলাল বাবু যাবে লঙ্কা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)

লঙ্কার ঝাঁঝের বিষয় আমাদের অজানা নয়। আজ বাঙালির হেঁসেলে লঙ্কা এক অতি পরিচিত মশলা। রান্নার অন্যতম উপকরণ। লঙ্কার যখন দাম বেড়ে যায়, আমরা সেই বৃদ্ধিকে তুলনা করি 'লঙ্কার ঝাঁঝ বেড়েছে' বলে। সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের বুকে লঙ্কা ১২০০ টাকা কেজি হিসেবেও বিকিয়েছে! ভারত থেকে লঙ্কা পাঠানো হলে সেখানে লঙ্কার দাম কমে। সৈয়দ মুজতবা আলি লিখেছেন, 'হিন্দুস্থান হৌসে লংকা ফোঁড়ন চড়লে চতুর্দিকে সিকি মাইল জুড়ে হাঁচিকাশি ঘণ্টাখানেক ধরে চলত'। ছড়ায় আছে --
'শাকের সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা, ডালের সঙ্গে ঘি
মাংসের সঙ্গে আদা, আর মেয়ের সঙ্গে ঝি'। 

অথচ লঙ্কা ছাড়া খাবারের স্বাদ আসেনা। বাংলা প্রবাদে আছে -- 'নুন লঙ্কা দিয়ে ভাত খাই / বেরালকে কাঁচকলা দেখাই'। আর 'কাটা ঘায়ে লঙ্কার গুঁড়ো' তো বহুল প্রচলিত কথা। আসলে কাটা ঘায়ে লঙ্কার গুঁড়ো ছেটালে জ্বলুনি মারাত্মক আকার নেয়। রামেশ্বর ভট্টাচার্যের 'শিবায়ন' কাব্যে লঙ্কার গুণকীর্তন করা হয়েছে -- 'চাষি বিনা চাষের মহিমা কেবা জানে / লঙ্কার বাণিজ্য বসি বাকুড়ির কাণে'। 
শুকনো লঙ্কা

তবে রাজা রাবণের রাজ্য লঙ্কা কিন্তু আলাদা। পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা তথা লঙ্কা নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রবাদের ছড়াছড়ি। সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রবাদ হল 'লঙ্কা কাণ্ড'। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ষোড়শীতে আছে 'দাদা কি শেষে একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধাবেন নাকি'। এছাড়াও আমরা লঙ্কা নিয়ে কথার মাঝে বলে থাকি -- 'অতি দর্পে হত লঙ্কা', 'যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ', 'কালনেমির লঙ্কাভাগ', 'মুখ পুড়িয়ে লঙ্কায় আগুন', 'লঙ্কা ডিঙিয়ে মুখ পোড়ান', 'সোনার লঙ্কা ছারখার', 'দুঃখি যায় লঙ্কা পার / তবু না ঘোচে কাঁধের ভার', 'লঙ্কায় গেলেন দরিদ্রা / নিয়ে এলেন হরিদ্রা', 'লঙ্কায় রাবন ম'লো / বেহুলা কেঁদে রাঁঢ় হ'লো / দেলকোর মাথায় দিয়ে হাত / কাঁদেন প্রভু জগন্নাথ', 'যদি থাকে মনে / তবে থাক গে লঙ্কার কোনে', 'মনে মনে লঙ্কাভাগ' (কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন, 'মনে মনে লঙ্কা ভাগ, আঁক দিয়া খড়ি'), 'লঙ্কা কত দূর', 'লঙ্কার ফেরত', 'লঙ্কার বানিজ্য ক্ষেতের কোনা' (রামেশ্বর ভট্টাচার্যের 'শিবায়ন'তে আছে 'লঙ্কার বানিজ্য বাসি বাকুড়ির কোনে'), 'লঙ্কায় সোনা সস্তা / তঙ্কায় তিন বস্তা' (দাশরথি রায়ের লেখায় আছে, 'দরিদ্রের মনোবাসনা লঙ্কায় গিয়ে আনি সোনা, সেটা মাত্র মনের বিকার') ইত্যাদি। 
কাঁচা লঙ্কা

সম্ভবত শ্রীলঙ্কা থেকে এই সব্জির আগমন ঘটেছিল, তাই এর নাম 'লঙ্কা'। এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তবে 'মরিচ' নামটি 'লঙ্কা' অর্থে বোঝায়। কেউ কেউ বলেন, এটি নাকি মাউরিটিয়াশ তথা মরিশাস দ্বীপপুঞ্জ থেকে এসেছে। তাই নামকরণ হয়েছে 'মরিচ'। তবে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের অভিমত, লঙ্কার আদিনিবাস আমেরিকা। বলা হয়ে থাকে, ৭৫০০ বছর আগে থেকেই আমেরিকানরা লঙ্কা ব্যবহার করে। ইকুয়েডরে ৬০০০ বছর আগে লঙ্কা চাষের প্রমাণ মিলেছে। ক্যারাবিয়ান দ্বীপে প্রথম লঙ্কার খোঁজ পান ক্রিস্টোফার কলম্বাস। তিনিই আমেরিকা থেকে লঙ্কা নিয়ে আসেন স্পেনে। পরবর্তীতে স্পেনের ব্যবসায়ীরা মেক্সিকো থেকে লঙ্কা রপ্তানি করে এশিয়ার ফিলিপাইন্স সহ ভারত, চিন, জাপান, কোরিয়ায়। অনুমান যে, ১৬৫০ সালে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ায় রান্নার অন্যতম মশলা হিসেবে লঙ্কার চাষ শুরু হয়েছিল। কারও কারও মতে, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে পোর্তুগীজরা ভারতে লঙ্কার আনয়ন করে। 

কোনও প্রাচীন শাস্ত্র, বেদ, সংহিতা কিংবা আয়ুর্বেদ পুঁথিতে লঙ্কার কথা কিছুই লেখা নেই। তাই এটির ব্যবহার এতদঞ্চলে তেমন প্রাচীন নয় বলেই অনুমান। একটি শ্লোকে পাওয়া যায় --
'ধান্য মরিচমিত্যাখ্যং লংকা যচ্চাপিকীর্ত্তিতম্। 
রসে তিক্তং কটুঃপাকে উষ্ণশ্চাপি বিদাহকৃৎ। 
অপকে হরিতং তৎতু পক্কে নারঙ্গী কান্তিমৎ। 
রসঃ স্যাৎ ফলশস্যস্য বহ্নিমান্দ্য হরঃ পরঃ। 
জর শ্বাসোদরে গ্রাহ্যং গ্রন্থিবাতে প্রলেপকে'।
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য এই কুলজিনামাটির অর্থ করেছেন -- 'ধান্য মরিচ এই নামে অথবা ধানি লঙ্কা নামে একটি ভেষজ আছে। এটি অপক্কাবস্থায় তিক্তরস এবং শীতবীর্য, পক্কাবস্থায় কটু ও উষ্ণগুণ এবং উষ্ণবীর্য, তখন বিদাহকরও। অপক্কাবস্থায় হরিৎবর্ণ (সবুজ রং, সবুজ শব্দটি ফারসী ভাষা), পাকলে নারঙ্গী লেবুর রং হয় (পাকা জামীরের রং), এর ফলের অপক্কাবস্থায় যে রস সেটি অগ্নিমান্দ্য দূর করে; এবং জ্বর রোগে, শ্বাস রোগে, উদর রোগে, গ্রন্থিবাতে (গেঁটে বাতে) এবং জ্বরের ভুল বকায় এর ফলের রসে উপকার হয়'। লঙ্কার কিন্তু অনেক উপকারিতা লক্ষ্য করা যায়। অবিরাম জ্বর কমাতে, অগ্নিবল বাড়াতে, পায়ের কড়া বা গুঁপো নিরাময়ে, গেঁটে বাত সারাতে, পুরোনো পেটের রোগ তথা কোলাইটিস সারাতে, অম্বলের রোগ নিরাময়ে লঙ্কার ব্যবহার খুব উপযোগী। 

লঙ্কাকে সংস্কৃতে কটুবীরা, তীক্ষনা, তীব্রশক্তি, হিন্দিতে লালমির্চি, তামিলে গোলকণ্ডা, তেলুগুতে মিরচাকয়া, ফার্সিতে কিকল ই সুর্খ, অসমিয়াতে কিলকিল, অহমর, ওড়িয়াতে লঙ্কা, ইংরেজিতে Red Pepper, Chili Pepper, 
Chilli, Cayene বলে। লঙ্কার মধ্যে রয়েছে -- Moisture ১০%; protein ১৬%; fat ৬.২%; carbohydrates ৩১.৬%; fibre ৩০%; mineral matter ৬.১%; vitamin A, C এবং E; fatty oil ১৩%; volatile oil ০.৩৯%; pungent principle (capsicin, capsaisin and solamine); colouring matter (capsanthin, capso rulein, zeaxanthin, lutein and cryptoxanthin) এবং xanthophylls।

লঙ্কা হল Solanaceae পরিবারের অন্তর্গত উদ্ভিদ। মূলতঃ Capsicum নামেই পরিচিত। লঙ্কার বিভিন্ন প্রজাতিগুলি হল --
Capsicum annuum Linn
Capsicum annuum var. glabriusculum
Capsicum annuum 'Bell'
Capsicum annuum 'Cayenne'
Capsicum annuum 'Jalapeno'
Capsicum annuum 'New Mexico Group' (New Mexico chile)
Capsicum annuum 'Poblano'
Capsicum chinense jacq
Capsicum chinense 'Habanero'
Capsicum chinense 'Scotch bonnet'
Capsicum frutescens Linn
Capsicum frutescens 'Peri-peri'
Capsicum frutescens 'Tabasco pepper'
Capsicum pubescens ruiz & pavon
Capsicum pendulum wild
লাল লঙ্কা

এগুলির মধ্যে Capsicum annum linn এর কয়েকটি প্রজাতি হল: আর-৪৪৯, ওয়ার্ল্ড বিটার, বেল পেপার ইত্যাদি। Capsicum frutescens linn এর কয়েকটি প্রজাতি হল -- জি ১, জি ৩, এন. পি. ৪১,এন. পি. ৪৬ ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গের বুকে চাষ হওয়া কয়েকটি প্রজাতি হল -- সূর্যমুখী, এন. পি. ৩৪, জি ১, এন সি ৪, এন. পি. ৪১, এন. পি. ৪৬, পুসা জ্বালা ইত্যাদি। যে লঙ্কার ঝাল বেশি, সেই লঙ্কার তেজ বেশি। চাহিদাও বেশি। পৃথিবীতে প্রায় ৫০ হাজার ঝাল লঙ্কার প্রজাতি রয়েছে। এরমধ্যে  সবচেয়ে বেশি ঝালযুক্ত লঙ্কার প্রজাতির স্বীকৃতি এখন ‘পেপার এক্স’ এর দখলে। ঝালের দিক থেকে এটি ক্যারোলাইনা রিপারকে হারিয়ে দিয়েছে। পেপার এক্সে ক্যাপসাইসিনের গড় পরিমাণ ২৬ লাখ ৯০ হাজার ইউনিট! আর ক্যারোলাইনা রিপারের ঝালের পরিমাণ ২.২ মিলিয়ন স্কোভিল হিট ইউনিট। ১৯১২ সালে ফার্মাসিস্ট উইলবার স্কোভিল ঝাল পরিমাপের এই পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছিলেন। ভারতের সবচেয়ে ঝাল লঙ্কার নাম ভূত জোলাকিয়া। যা উত্তর পূর্বের রাজ্য আসাম, মনিপুরে পাওয়া যায়। গ্রামে গঞ্জে চাষ হওয়া সূর্যমুখী বা ধানী লঙ্কার ঝালও মারাত্মক। বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝাল লঙ্কার নাম ডরসেট নাগা। 

বর্ষায় লঙ্কার ফলন সবচেয়ে বেশি। একবর্ষজীবি এই গাছগুলির ফল লম্বা লম্বা। পেকে গেলে লাল, হলুদ ও বেগুনি রঙের হয়। টিয়াপাখির খুব প্রিয় লাল লঙ্কা। মাঠে ঘাটে চাষ করা বাঙালি কৃষকদের প্রিয় খাদ্য নুন, লঙ্কা, মুড়ি। আজকাল তো লঙ্কা ছাড়া কোনও খাবারের স্বাদই আসেনা। আলু সেদ্ধর সাথে তেলে ভাজা লঙ্কার অতুলনীয় স্বাদ। ইদানিং অনেকেই কাঁচা লঙ্কার তরকারি বেশি পছন্দ করেন পেটের সমস্যা থেকে বাঁচতে। সুকুমার রায় তাঁর এক কবিতায় লিখেছেন --
'হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল 'হাঁসজারু' কেমনে তা জানি না। 
ও বক কহে কচ্ছপে- 'বাহবা কি ফুর্তি! 
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি'।
টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা'?

🍂

Post a Comment

0 Comments