বোধি পার্কে দীলিপ স্থানীয়দের সাথে
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬৪
বিজন সাহা
এলিস্তার বোধি পার্ক ও অন্যান্য
বুদ্ধ শাক্যমুনির স্বর্ণ ভবন থেকে ওল্ড টেম্পলে যাবার পথে এক জায়গায় রাস্তার নির্দেশকে একটা পার্কের কথা লেখা আছে। যদিও বোঝা যাচ্ছিল সেটা নির্মাণাধীন তবুও দেমিদকে বলে ওদিকেই গাড়ি ঘোরালাম। প্রথমেই চোখে পড়ল একটা ত্রিশূল – ঠিক শিবের ত্রিশূলের মত। অন্তত আমার সেটাই মনে হয়েছিল। পরে অবশ্য জেনেছি সেটা আসলে চেঙ্গিস খানের ত্রিশূল। এটা ছিল চেঙ্গিস খানের শক্তির প্রতীক। তবে সব কিছু মিলে সেখানে একটি দেশীয় ঘ্রাণ ছিল। এলিস্তা শহরের দক্ষিণ অঞ্চলে এই পার্ক অবস্থিত। অতীত কালে এই জায়গায় ছিল ঝর্ণা যেখানে কালমিকদের পূর্বপুরুষেরা বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রার্থনা এবং জল ও জমির যিনি মালিক তাঁর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ পূজা পার্বণ করার জন্য মিলিত হত। এই পার্কের প্রতিষ্ঠাতাগণ প্রাচীন ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত এবং স্তেপের নিম্নভূমিতে একটি থিম পার্ক তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। এখানে এসে লোকজন শুধু কালমিক সংস্কৃতির সাথেই পরচিত হতে পারবে না, শহরের কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির মাঝে সময় কাটাতে পারবে। শহর আর এই পার্কের মাঝে ছিল খোলা ভূমি যেখানে চড়ে বেড়াচ্ছিল অনেক গরু, ঘোড়া আর মেষ। এই পার্কে ঢোকার মুখেই একটি পাথরে লেখা ছিল
এলিস্তিনস্কোয়ে ওভা
ওভা - পাথরের তৈরি এই ধর্মীয় স্থাপনা স্থানীয় লোকদের আত্মার উদ্দেশ্যে, পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত – এটা এদের বাড়ি। সমৃদ্ধি লাভের জন্য প্রত্যেক পুরুষ নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে, নিজের গোত্রের পক্ষ থেকে এখানে পাথর স্থাপন করবে। ওভা – এটা মঙ্গোল জাতির প্রাচীন প্রতীক যা মানুষের সাথে পরিবেশ, পূর্বপুরুষ ও প্রকৃতির সম্প্রীতির প্রতিফলন।
গৃহযুদ্ধ ও পিতৃভূমির যুদ্ধের বীরেরা
পাথরের পাশে দাঁড়িয়ে যখন এই লেখাটি পড়ছি তখন স্থানীয় একজন তরুণ এসে আমাদের সাথে আলাপ করতে শুরু করল। ওর কাছ থেকে অনেক তথ্য পেলাম। জায়গাটা আমাকে আমাদের গ্রামের সমিতি ঘরের কথা মনে করিয়ে দিল। একাত্তরের যুদ্ধের পর যখন সমবায় সমিতি গঠিত হয় তখন অনবরত লোকজন সেখানে আসত, বসে গল্পগুজব করত। আলোচনা করত এর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এখানেও দেখলাম একটা তাবুতে বসে স্থানীয় কয়েকজন কথাবার্তা বলছিলেন। আমরাও যোগ দিলাম। নিঝনি নভগোরাদের উপকণ্ঠে মালিনভস্কায়ায় প্রাচীন পন্থী গির্জার পরে এই প্রথম কেউ উৎসাহ নিয়ে নিজেদের কথা বললেন। মনে হয় পুরুষ দুজন রুশ তেমন জানেন না, তাই মূল কথা হচ্ছিল উপস্থিত ভদ্রমহিলার সাথে। তিনি কালমিক জাতির বিভিন্ন ইতিহাস জানালেন। কালমিকরা প্রথমে চীনের অধীনস্থ আভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়ায় বসবাস করত। কিন্তু চীনের খানদের হাতে প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হত এদের পূর্বপুরুষেরা। এলাকার বিভিন্ন যাযাবর জাতির মত এরাও চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরি। চেঙ্গিস খান নিজে স্থানীয় ধর্মে বিশ্বাস করতেন। অনেক পরে তাঁর উত্তরসূরিরা বিভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে। মূল অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও কালমিকরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার আগে কালমিকরা তেংগ্রিয়ান ধর্মের অনুসারি ছিল। তাদের ঈশ্বর ছিল আকাশ। পরে তারা পশ্চিম মঙ্গোলিয়া থেকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়। এটাকে এরা বলে লামাইজম। সপ্তদশ শতকের শুরুতে জারের আহ্বানে এদের একাংশ চীন ছেড়ে রাশিয়ায় চলে আসে। আরেক অংশ চীনে থেকে যায়। বর্তমানে তারা উইগুর এলাকায় বসসবাস করে। এখানে যে পার্ক তৈরি হচ্ছে তার নাম হবে বোধি পার্ক। কারণ এক সময় শ্রীলংকা থেকে বোধি বৃক্ষ এনে এখানে রোপণ করা হয়। ওদের কাছেই শুনলাম পথে দেখা সেই জলাশয় আসলে একটি কানাল। মরু এলাকা বলে এখানে জলের সমস্যা সব সময়ই ছিল। গ্রীষ্মে প্রায়ই খরা দেখা দেয়। আমরা যে ইউরতা বা তাবুতে বসে গল্প করছিলাম সেখানে চেঙ্গিস খানের একটি ছবি ছিল ঠিক যেমন বিভিন্ন অফিসে বর্তমানে দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর ছবি থাকে। যদিও আগে এরা যাযাবর জীবনযাপন করত তবে রাশিয়ায় চলে আসার পরে বিগত প্রায় সাড়ে চার শ’ বছর ধরে এরা স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করে। ইউরতা সম্পর্কে আমাদের প্রশ্নের উত্তরে তারা এ কথা জানায়। এখন আর কেউই ইউরতায় বসবাস করে না। এই ইউরতাগুলো এখানে স্থায়ী ভাবে তৈরি করা হয়েছে। এগুলো পরবর্তীতে মিউজিয়াম হবে। চেঙ্গিস খানের উত্তরসুরীরা বিভিন্ন জাতিতে ভাগ হয়ে গেছে। তাতার, কাজাখ, কিরঘিজ, মঙ্গোল, কালমিক সবাই নিজেদের চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরি মনে করে। রাশিয়ায় বর্তমানে দুই লাখের বেশি কালমিক বসবাস করে। তাদের নিজস্ব ভাষা আছে, আগে তাদের নিজস্ব বর্ণমালা ছিল আর লিখন পদ্ধতি ছিল চীনের মত – উপর থেকে নীচের দিকে। তবে বর্তমানে তারা রুশ বর্ণমালা ব্যবহার করে। ফলে চীনে অবস্থিত কালমিকদের কথা তারা বুঝতে পারলেও পড়তে পারে না, ঠিক যেমন ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাবীরা পরস্পরকে বুঝলেও একে অন্যের লেখা পড়তে পারে না। এদের জীবনযাত্রা এখন রাশিয়ার যেকোনো অঞ্চলের মতই। মানে শিক্ষা দীক্ষা ইত্যাদি। তবে অন্যান্য জাতির মত তাদেরও বিভিন্ন ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উৎসব আছে। সেসব উৎসব তারা অতীত ঐতিহ্য অনুসরণ করেই পালন করে। সেখানে অনেকক্ষণ থেকে চা বিস্কুট খেয়ে আমরা গেলাম সিয়াউকসুন সিউমে বা ওল্ড টেম্পলে যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে কথা বলে আমরা পাশেই স্থানীয় একটি ক্যাফেতে দুপুরের খাবার খেয়ে যাই উটের খামারে। সেই ক্যাফে আর উটের গল্প আমরা আগেই করেছি।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য গৃহযুদ্ধ ও পিতৃভূমির যুদ্ধের বীরদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত মেমোরিয়াল। ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই মেমোরিয়াল নির্মাণ করা হয়। শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, তবে শহরের বাইরে কিনা সেটা জানি না। বেশ বড় জায়গা নিয়ে এই মেমোরিয়ালটি তৈরি। আসলে রাশিয়ায় যুদ্ধের উপর সব মেমোরিয়ালই বেশ বড় জায়গা নিয়ে তৈরি আর প্রতিটি মেমোরিয়ালের আছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, নিজস্ব সৌন্দর্য। ১৯৪১ – ১৯৪৫ সালের যুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করে যারা এলিস্তা শহর শত্রু মুক্ত করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রয়েছে দেয়াল লিখন। স্টীলের তৈরি তিনটি উঁচু স্তম্ভ মনে হয় এই মেমোরিয়ালের কেন্দ্রীয় এক্সপোজিশন। অন্যদিকে লাল পাথরে খোঁদাই করা পাঁচ জন বীরের মূর্তি। এরা ১৯১৮ সালের গৃহযুদ্ধ ও ১৯৪১ - ১৯৪৫ সালের পিতৃভূমির যুদ্ধের বীরদের প্রতিকৃতি। যদিও এটাই এখানে স্বাভাবিক তবে আমি একটু অবাক হলাম মূর্তির মানুষগুলোর কালমিক রূপ দেখে। পরে একটু লজ্জিতও হলাম মনে মনে নিজের অজ্ঞতায়। এর সামনেই অনির্বাণ শিখা। সেখানে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে আমরা রওনা হলাম লেনিন স্কয়ারের দিকে।
লেনিন স্কয়ার - এটা এলিস্তার সেন্ট্রাল স্কয়ার। গত শতকের তিরিশের দশকে তৈরি হলেও এই স্কয়ার বর্তমান রূপ পায় নতুন রাশিয়ায়। সেখানে বিভিন্ন দর্শনীয় বস্তু রয়েছে। তাদের অন্যতম সাত দিনের প্যাগোডা। খোলামেলা। বাচ্চাদের নিয়ে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকেই। ২০০৬ সালে এলিস্তা দিবসে এর উদ্বোধন করা হয়। সামনে বিশাল দাবার কোর্ট। বিশাল বিশাল সব ঘুঁটি। একটু দূরে তিন পদ্মের ফোয়ারা। স্টীলের তৈরি ডগার মাথায় সোনালী রঙের তিন তিনটি পদ্ম। বেশ উঁচু। সেখান থেকে কিছু দূরে দক্ষিণ দ্বার। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জয়ের দুই শ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই গেট তৈরি করা হয় ২০১২ সালে। পাশেই এক বৃদ্ধের স্ট্যাচু। মনে হয় কালমিক জনগোষ্ঠীর কেউ। তার গলায় মালার মত ঝুলছে কাপড়ের টুকরো, হতে পারে সেসবই মনোবাসনা পূর্ণ করার আর্জি। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি – লেনিনের স্ট্যাচুও এখানে আছে। তবে চারিদিকে জাঁকজমকপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনার ভিড়ে এখন লেনিনকে চোখেই পড়ে না যদিও সোভিয়েত আমলে লেনিনের মূর্তিই ছিল যেকোনো জনপদের প্রধান আকর্ষণ।
সাত দিনের প্যাগোডা
১৯৯৮ সালে এলিস্তায় তেত্রিশ তম দাবা অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় আর সেই উপলক্ষ্যে তৈরি হয় চেস সিটি বা দাবার শহর। বর্তমানে এটা অফিস এরিয়া। বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানির অফিস এখানে। ২০০১ সালে এখানে দাবার জাদুঘর উদ্বোধন করা হয় যা বর্তমানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মিখাইল তালের নাম ধারণ করে। এই জায়গাটুকু একেবারেই অন্য রকম, যেকোনো ইউরোপিয়ান শহরের অফিস পাড়ার মত।
আমাদের কালমিকি ভ্রমণ এখানেই শেষ। পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে আমরা রওনা হলাম ভোলগাগ্রাদের উদ্দেশ্যে। পথে শহরের ভেতরেই চোখে পড়ল বেশ কিছু সুন্দর বাড়িঘর। মনে হল আমরা যেন জাপান বা কোরিয়ার কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি।
বৌদ্ধ শহর এলিস্তা
https://www.youtube.com/watch?v=PYBx7-UCH_Y&t=3134s
ছবিতে এলিস্তা
http://bijansaha.ru/album.php?tag=266
0 Comments