একত্রিংশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
সকাল থেকেই মেঘ করেছে। কয়েকদিনের প্রানান্তকর অস্বস্তির পরে শেষ রাত থেকে বেশ হাওয়া দিচ্ছে,নরম নরম।পরিবেশটিও কোমল। চোখটা লেগে গিয়েছিল ভোরের বেলায়, আজকাল অল্পেই বড়ো ক্লান্ত লাগে। তাছাড়া শরীরটাও আজকাল আর সঙ্গ দিচ্ছে না,সময় ঘনিয়ে এলো প্রসবের।
মা বলেছে, সঙ্গে নিয়ে যাবে। যদিও বাবা নেই, তবু বাবার বাড়ি শহরে হওয়ায় যোগাযোগের সুবিধে-সুযোগ এখানকার চাইতে ঢের বেশি, এই বিবেচনায় এবাড়ির মানুষ জনেরও তাতে তেমন আপত্তি নেই। অগত্যা …
খুশি হওয়ারই কথা,সব মেয়েই এসময় মায়ের কাছে থাকতে চায়; কারণ, সন্তান জন্মাবার আগে পর্যন্ত কোন শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের নিজের বাড়ি হয়ে ওঠেনা।
তাছাড়া,সেখানকার জীবন অনেক নির্ভার।একে তো আজন্মের পরিচিত পরিবেশ, বন্ধুবান্ধব;তায় সেখানে কোন দায়দায়িত্ব নেই,খোলামেলা আবহাওয়া, বাড়িতে প্রচুর বইপত্র,ভাই-বোন-ঠাকুমা…খুশি থাকতে আর কি চাই!
তবু মন মানেনা যেন নতুন বৌটির। এবাড়িতে আসার পর থেকে যে মানুষটির নিবিড় স্নেহে কেটেছে গৃহিণী জীবনের প্রাথমিক দিনগুলি, তাঁর এমন অসুস্থতার সময়ে তাঁকে ছেড়ে…
ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছাড়লে অহনা।বাইরে তখন পাখী ডাকছে, জানলায় রোদের আলপনা। তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলে,বড়ো জায়ের ইতিমধ্যেই স্নান সারা হয়ে গিয়েছে।ওকে দেখে বলে উঠলে বড়োবৌ,
-’উঠে পড়েছ? তাহলে এবার ওঘরে গিয়ে আগে পিসিমাকে চা বিস্কুট খাইয়ে দাও।তারপরে,স্নান সেরে পুজোর জোগাড়ে যাও। আমি অফিসের ভাতটুকু নামিয়ে তোমার সঙ্গে লাগছি।মনে আছে তো,আজ জয় মঙ্গলবার!’
মনে না থাকার কারণ নেই, জৈষ্ঠ্যমাস পড়া অবধি প্রতি সোমবারের বিকেলে গুণে গুণে আঠাসখানি করে কাঁঠাল পাতা,দূর্বাঘাস,যবের ছাল ছাড়ানো,ধানের খোসা ছাড়িয়ে চাল,গোটা মুগডাল ইত্যাদি ইত্যাদি জোগাড় করে খিলি বানানো, পঞ্চফল,মুগ ভেজানো এবং ফুল সাজিয়ে বাটা বানানোয় সে সাহায্য করেছে বড় জা’কে।কাজ করতে করতে শুনেছে ব্রতটির মাহাত্ম্য কথা;
মায়ে ঝিয়ে মঙ্গলবার করে,
যে যার মঙ্গল সে তার করে।
ব্রতের কথায় আছে,চাঁদ সওদাগরের স্ত্রী খুল্লনার ঐকান্তিক মাতৃ বন্দনার কথা,পথের এবং জীবনের অজস্র বিপদ থেকে স্বামীকে রক্ষা করার জন্য অর্ধাঙ্গিনীর নিরন্তর পূজা উপচার,যাঁর নামেই পরে নাকি বাংলাদেশের খুলনার নাম,অথবা কবে যেন কোন সওদাগরপুত্রের সঙ্গে সওদাগর কন্যার প্রণয় এবং বিবাহ আখ্যান;জীবন পথে চলতে চলতে বিপদে আপদে জয়দেব-জয়াবতীর কল্যাণময়ী দেবী মাতৃকার পদে অচলা ভক্তি,সর্ববিপদে তাঁর আশীর্বাদে উদ্ধার লাভের গল্পকথা;অথবা তারই মতো আরও অনেক সাধারণ মেয়ে বৌদের অনুচ্চারিত প্রেমলালিত যাপনকথা…মনে মনে আওড়ায় ব্রতের শ্লোক,
“সোনার মঙ্গলচন্ডী রূপোর থালা
কেন মা মঙ্গল চন্ডী এতো বেলা
হাসতে খেলতে তেল সিন্দুর মাখতে
পাটের শাড়ি পরতে সোনার দোলায় দুলতে
হয়েছে এত দেরী।
নির্ধনের ধন দিতে কানাকে নয়ন দিতে
নিপুত্রের পুত্র দিতে খোঁড়ায় চলতে দিতে
হয়েছে এত দেরী।”
গুণগুণ করতে করতেই হয়তো প্রোষিতভর্তিকার মনের পটে ভেসে ওঠে আপন দাম্পত্যের খুনসুটি,আদর, ছেলেমানুষী;কর্মক্ষেত্রে দূরে থাকা প্রিয় মুখখানি,প্রিয় সম্ভাষণ,প্রিয় যাপন…
শহরে বড়ো হওয়া মেয়েটির গ্রামে বিয়ে হওয়ার আফশোস আস্তে আস্তে কমতে থাকে,যখন সে শোনে,ব্রতটি আপন স্বামীর মঙ্গলের জন্য পালনীয় হলেও, এবাড়ির একটি নারী,আপন স্বামী-সন্তান না থাকা সত্ত্বেও, পরিবারের প্রতিটি হিতসাধনে ওতপ্রোত জড়িয়ে থেকে আজীবন কর্তব্যকর্ম করে গেছেন,দেব পূজায় প্রিয় পূজার ছলে,অপরকে আপন করে…ঐ যেমন বাবা বলতো রবীন্দ্রনাথের কবিতায়,
“দেবতারে প্রিয় করি,প্রিয়েরে দেবতা”!
🍂
আরও পড়ুন 👇
হ্যাঁ,পিসিমার কথাই সবার আগে মনে পড়ে অহনার,কবে যেন এই বাড়ি আর পিসিমা সমার্থক হয়ে গিয়েছেন তার কাছে।এমনই কি হয়!
মনে ভাবে,পিসিমাই নাকি সবার জন্য এসব গুছিয়ে দিতেন, বিবাহাবধি দিদিভাই নাকি তাই দেখে এসেছে…এই বার তিনি অসুস্থ,তাই দায়িত্ব পড়েছে তাদের ওপর…
পরিবারের মঙ্গল-অমঙ্গলের দায়, আরও বড়ো করে দেখলে ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি রক্ষার দায়…এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে এভাবেই হয়তো বয়ে যায়,বয়ে নিয়ে যায় পরিবারের মেয়েরা…
মনে পড়ে পিসিমার ঘরে ঝুলোনো ফুল লতাপাতায় নক্সা করা হাতের কাজের শিল্পকর্মটির কথা,
“সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে…”
তখনকার মায়েদের চেতনায় এ বিশ্বাস অভ্রান্ত ছিল বলেই হয়তো অবসরের শিল্পকর্মেও তা পল্লবিত হ’তো…
হয়তো নারীবাদ এর অন্য অর্থ করলেও করতে পারে, কিন্তু জৈষ্ঠ্য প্রভাতের উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে আধুনিকা অহনার মনে হ’লো, পারস্পরিক দায়বদ্ধতার বন্ধন সুদৃঢ় না থাকলে এমন ভালোবাসা যায়!
বিশেষতঃ তার মতো একজন ভিন্ন রুচি ও সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মেয়ের প্রতিও যে সহমর্মিতা দেখিয়েছেন এবাড়ির মানুষেরা,তা আন্তরিকতার তীব্র টান ছাড়া সম্ভব হয় না।
আর এখানেই হয়তো বিদেশের সঙ্গে এদেশের পরিবার,সমাজ ও সম্পর্কের পার্থক্য।এই যে এতোদিনকার শিক্ষা ও চেতনার বাইরে বেরিয়ে গার্হস্থ্য পাঠের শিক্ষানবিশী চলছে তার, এই সব ব্রত পার্বন আপন মনে হচ্ছে ক্রমে ক্রমেই,তা গভীর ভালোবাসা ছাড়া সম্ভব হতো কি!
ভাবতে ভাবতেই বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে চাপাতি ফুটিয়ে নিয়ে গেলেন পিসিমার ঘরে,মাল কাকিমা ততক্ষণে তাঁকে পরিস্কার করে তার সেন্টারের কাজে বেরিয়ে পড়েছে…ধীরে ধীরে প্রবীণার
মুখে তুলে দিতে লাগলেন নবীনা গরম চা;সুধাভরনী তৃপ্তি, পিসিমা আজকাল তার হাতের চা খেতে বেশ পছন্দ করেন, তিনিও যত্ন করে ভালোবেসে কাজটি করেন,ভালো লাগে।সঙ্গে চলে এলোমেলো কথাবার্তা, কখনও যদি সাড়া দেন পিসিমা, ফিরে আসেন সম্পুর্ন ভাবে চেতনায়,এই প্রত্যাশায়…(ক্রমশঃ)
0 Comments