জ্বলদর্চি

বকুল/ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৩১
বকুল

ভাস্করব্রত পতি

'হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।
শত বরনের ভাব উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ,
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে॥
ওগো, নির্জনে বকুলশাখায় দোলায় কে আজি দুলিছে, দোদুল দুলিছে॥
ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল, আঁচল আকাশে হতেছে আকুল,
উড়িয়া অলক ঢাকিছে পলক -- কবরী খসিয়া খুলিছে।
ঝরে ঘনধারা নবপল্লবে, কাঁপিছে কানন ঝিল্লির রবে--
তীর ছাপি নদী কলকল্লোলে এল পল্লির কাছে রে' --
 --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বর্ষা এসে গিয়েছে। আর তাই বকুল ফুল ফোটারও সময় হয়েছে। এখন বকুল গাছের তলায় অবধারিত অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে থাকতে দেখা যাবে ছোট ছোট বকুল ফুল। আর ফুলের সাঁজি হাতে নিয়ে সেইসব ফুল কুড়োনোর মজাই আলাদা। 
বকুল ফুল

এটি একটি দ্বিবীজপত্রী ঘন সবুজ বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। যা সারা ভারতের সর্বত্র পাওয়া যায়। এছাড়াও আন্দামান, শ্রীলঙ্কা, বার্মা, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ ইত্যাদি স্থানে জন্মায়। ফ্রান্স, অষ্ট্রেলিয়া, ভানুয়াটু, মালয়েশিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বকুলের চাষ হয়। 

উচ্চতায় ৪০ - ৫০ হাত। বিভিন্ন মন্দির, শিক্ষালয়, পার্ক, বড় বাগান কিংবা পথচলা রাস্তার ধারে লাগানো হয়। পাতাগুলো মসৃন এবং ঢেউখেলানো। টকটকে সবুজ। এখন ডেকোরেটিং শিল্পে বকুল পাতা ব্যবহৃত হয়। ফুলগুলো খুব ছোট ছোট, সাদা এবং সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি প্রেম পর্যায়ের গানে বকুলগন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় --
'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
সুরের বাঁধনে,
তুমি জানো না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে,
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
সুরের বাঁধনে। 
সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুলগন্ধ 
সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ,
তুমি জানো না, ঢেকে রেখেছি তোমার নাম
রঙ্গীন ছায়ার আচ্ছাদনে,
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
সুরের বাঁধনে। 
তোমার অরূপ মূর্তিখানি
ফাল্গুনের আলোতে বসাই আনি,
অরূপ মূর্তিখানি
বাঁশরি বাজাই ললিত-বসন্তে, সুদূর দিগন্তে
বাঁশরি বাজাই ললিত-বসন্তে, সুদূর দিগন্তে,
সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী 
সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী 
গানের তানের সে উন্মাদনে,
তুমি জানো না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে,
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণসুরের বাঁধনে'।

বকুল ফুল আয়তনে ১ সে. মি. মাপের, গোলাকার এবং বেশ কারুকার্যময় ছোট ছোট তারার মতো। এই ফুল রাত্রে ফোটে এবং সারাদিন ধরে গাছের তলায় টুপটুপ করে পড়তেই থাকে। যেন 'বকুল বিছানো পথ'! আজ বকুল গাছ ক্রমশঃ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। দেখা পাওয়াই দুষ্কর। ফলে বকুল ফুল বিছানো পথ খুঁজে পাওয়ার রাস্তাও নেই বললেই চলে। বহু আগে অজয় ভট্টাচার্যের লেখা একটি গান গেয়েছিলেন শচীন দেব বর্মন। সে গানের মজ্জায় রয়েছে 'বকুল বিছানো পথ' এর চিত্র ---
'তুমি যে গিয়াছ.. 
বকুল বিছানো পথে.. 
নিয়ে গেছো হায় একটি কুসুম.. 
আমার কবরী হতে.. 
নিয়ে গেছ হিয়া কি নামে ডাকিয়া.. 
নয়নে নয়ন দিয়া...  
আমি যেন হায় ফেলে যাওয়া মালা.. 
কূলহারা নদীস্রোতে... 
তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে..
খেলাঘরে কবে ধূলির খেলায়.. 
দুটি হিয়া ছিল বাঁধা... 
আমার বীনাটি তোমার বাঁশিটি.. 
এক সুরে ছিল সাধা.. 
সে খেলা ফুরালো সে সুর মিলালো.. 
নিভিল কনক আলো.. 
দিয়ে গেছ মোরে শত পরাজয়.. 
ফিরে এসো জয়রথে... 
তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে..
নিয়ে গেছো হায় একটি কুসুম.. 
আমার কবরী হতে.. 
তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে..'

ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সুতো দিয়ে বকুল ফুলের মালা গেঁথে নিজেদের মতো করে একসময় খেলতো। বকুল ফুল শুকিয়ে গেলেও পচে যায়না, এর মধ্যে থাকে উদ্বায়ী তেল। শুকনো ফুলের মধ্যেও অনেক দিন ধরে গন্ধ থাকে। বকুল ফুল থেকে আতর তৈরি হয়। গ্রীষ্মকালের শেষে ফুল হয়। শরৎকাল পর্যন্ত গাছে ফুল ফুটতে দেখা যায়। লোকগানের সুরেও অনুরণিত হয় বকুল ফুলের নির্যাস --
'বকুল ফুল বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি।
শালুক ফুলের লাজ নাই রাইতে শালুক ফুটে।
যার সনে যার ভালোবাসা, সেইতো মজা লুটে।
আমার জামাই ধান বায় হরিণডাঙার মাঠে।
সোনা দেহে ঘাম ঝরে দেইখা পরাণ ফাটে।
শাওন ভাদর মাসে জামাই আদর করে।
ইচ্ছে জামাই করবো আদর দানাতো নাই ঘরে'। 

এরপর ফল হয়, কাঁচা ফল সবুজ হলেও পাকা ফল লাল হয়। পাখিদের খুব প্রিয়। গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা পাকা বকুল ফল খেত একসময়। সুমিষ্ট স্বাদের। কিন্তু এখন খায়না। অনেকেই জানেইনা বকুল ফুল বা ফল সম্পর্কে। অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে এগুলোর। 

'মদনং কাম মাকুতিং বাচং সত্যং আশীয়।
মৈত্রঃ শরসি পয়সো রেতঃ আভৃতং যশঃ শ্রীশ্রয়তাম্'।
(অথর্ববেদ, বৈদ্যককল্প ৫১২।৩।৪১ সূক্ত)
অর্থাৎ, তুমি মদনজাত অর্থাৎ বকুলজাত, তুমি মনের অভিলাষ, সত্য বাক্য এবং বল আমাকে দাও। তোমার শূন্য মদ্য দুখের সার, অন্নের সার, যশ, শোভা, কীর্তি' ও মৈত্র আমাতে থাকুক। বেদে উল্লিখিত এই বকুল ফলের মদ খুবই প্রিয়। বহুকাল আগেই সংস্কৃত সাহিত্যে এই বকুল গাছের ফুল ও ফলের স্থান বেশ উপরের দিকেই ছিল। 

বকুল সাধারণত পরিচিত ভ্রমরানন্দ, মদ্যামোদ, করক, সীধুগন্ধ, সদাপুষ্প, স্থির কুসুম, সুরভি, শারদিক, ধন্বী, মধুপুষ্প, মুখদোহন, চিরপুষ্প নামে। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Mimusops elengi Linn, এটি Sapotaceae পরিবারের অন্তর্গত। হিন্দিতে মূলসরি, মৌলসিরি, মাউলসারাউ, মোলসিরি, তেন্ডু, মোরসালি, মাউলসারি, মোলসারি, মাউলসের, মাউলসিরি, বলসারি, সংস্কৃতে সীধুগন্ধ, আনাঙ্গাকা, ছিড়াপুস্প, দোহালা, গুধাপুস্পকা, মধুপুস্প, বকুলা, কেশারাপা, কিরাপুস্প, কারুকা, বকুল, কেশারা, মধুপাঞ্জারা, মাকুলা, মধুগন্ধা, কন্ঠা, বকুলাহ ওড়িয়াতে বেলেসরী, বউল কড়ি, বর শোলী, সাঁওতালিতে পিতাজ্, গুজরাটিতে বোলঝিরি, তামিলে মাকিলাম্পু, কেসারাম, ভাগুলাম, কোসারাম, মাকিলাম ভিটটু, ইলাঞ্জি, ইলাঞ্চি, মাকিলাম মারাম, মগাদাম, ভাকুলাম্পু, কেছারাম, মাকুলাম্পু, আলাগু, ম্যাগিলাম, ম্যাগিল, ভাকুলাম, ম্যাগিঝ, মাহিলা, মাকিঝাম্পু, মাগাদাম, মোগিদাম, ম্যাগিঝাম, ম্যাগিশ, মারাঠীতে ওভানি বকুঠধ, মনিপুরীতে বোকুল লৈ, তেলুগুতে পাবড়া, পোগড়চেট্ট, দ্রাবিড়ীয়তে ঘোলসরি, ইংরেজিতে Ipointed Leaved Mimusops, Spanish cherry, Bullet wood বলে। এছাড়াও থাই ভাষায় কাইও, কুন, মায়ানমারে কায়া, ইন্দোনেশিয়তে তাঞ্জাং, কারিকিশ, মালয়েশিয়াতে এলেঙ্গি, ইলেঙ্গি, এলেঞ্জি, ইলাঙ্গি, এলানি, ইলান্নি, ইরান্নি, এরিনি, মেংকুলা, বিতিছ, বাকুলাম, মাকুরা, মাকিরা, মাকুরাম, মুকুরা বলে বকুলকে। 
বকুল ফুলের বকুল গাছ

বকুল গাছের বা মূলের ছাল, কাঁচা এবং পাকা ফল, ফুল এবং বীজ নানা ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। দাঁতের নানা রোগ, বাতশ্লেষ্মা, শ্বেতী রোগ, শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য, পুরাতন আমাশয় ইত্যাদি রোগের উপশমকারী হিসেবে বকুলের নানা অংশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একটি গজলের মধ্যে মেলে বকুলের উপস্থিতি --
'বকুল চাঁপার বনে কে মোর চাঁদের স্বপন জাগালে —অনুরাগের সোনার রঙে হৃদয় গগন রাঙালে॥
ঘুমিয়ে ছিলাম কুমুদ কুঁড়ি বিজন ঝিলের নীল জলে
পূর্ণ শশী তুমি আসি' আমার সে ঘুম ভাঙালে॥
হে মায়াবী তোমার ছোঁয়ায় সুন্দর আজ আমার তনু তোমার মায়া রচিল মোর বাদল মেঘে ইন্দ্র ধনু।            তোমার টানে হে দরদি      দোল খেয়ে যায় কাঁদন নদীকূল হারা মোর ভালোবাসা আজকে কূলে লাগালে'॥

Post a Comment

0 Comments