জ্বলদর্চি

আরেক শেষের কবিতা /পুলককান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস

আরেক শেষের কবিতা 

পুলককান্তি কর 

- একটু পায়ের ধুলো দে বাবা তোর। আমি সাত জন্মে তোর মতো ঢিট্‌ পুরুষ মানুষ দেখিনি। ক্রোধে গজগজ করতে করতে আক্ষরিক ভাবেই দেবলের পা ছুঁয়ে দিল শান্তনু।
- আরে এতে তুই রেগে যাচ্ছিস কেন বল দেখি?
- রাগবো না কি করব? তোর চরণামৃতে মাদুলি ডুবিয়ে গলায় বাঁধবো? নাকি তোর বাণী শুনে তোর মহিমা কীর্ত্তন করব?
- আমি অন্যায়টা কী বলেছি শুনি!
- বলবি কেন! অন্যায় করছিস। মুনুর সাথে তুই যা করছিস ওটা অন্য কেউ হলে তোর তলপেটে বাক্স বাজিয়ে দিতাম।
এত সিরিয়াস কথাতেও হেসে ফেলল দেবল।
- এটা আবার কী প্রবাদ দিলি রে বোঁচা?
শান্তনু একটু নাদুস নুদুস বলে ওর বন্ধুরা সবাই ওকে বোঁচা বলে।
- ও যা হোক বললাম - সেটা ইস্যু নয়। আজ একটু বাদে মুনু আসবে এখানে। আজই ওকে প্রপোজ কর বা কিছু একটা কর। অনেক দিন থেকে তোদের ন্যাকামি দেখে যাচ্ছি,আর সহ্য হচ্ছে না।
- তোর এত দরদ তো তুই প্রপোজ কর না?
দেবল এখনও হাসিমুখে ব্যাপারটা ম্যানেজ করছে।
- শোন ‘দ্যাবা’ ঢ্যামনামো মারিস না। এমন কাঁচা দেব না, মাথায় বরফ দিতে হবে তখন! মুনু কি আমায় ভালোবাসে, না আমার প্রতি ইন্টারেস্ট দেখায়? দেখালে তো কবেই টেস্‌কে দিতাম।
- সেতো আমাকেও দেখায় না!
- ফের ঢ্যামনামো? এত ন্যাকাখোকা সেজো না সোনা! কার মনে কি, আমরা বুঝি না, না? আমার দিব্যি করে বলতো, মুনুকে তুই ভালোবাসিস না?
 চুপ করে রইল দেবল। শান্তনু ওর সেই হাফপ্যান্টের বন্ধু। ওকে মিথ্যে বলতে খারাপ লাগে।
- কী হল? বল আমার দিব্যি দিয়ে! আজ চুপ থাকিস না তুই। কাল মুনু আমাকে বলেছে, ওর নাকি এবার বিয়ের যে সমন্ধটা এসেছে, তাকে নাকচ করা মুশকিল। ওর বাবা প্রায় রাজী হয়ে গেছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, হল্যান্ডে চাকরী করে। ভালো স্যালারি।
-মুনু বলেছে তোকে?
-তা নয় তো কি আমি হাত গুনে জেনেছি?
শান্তনুর গলায় এখনও রাগ।
- কই আমাকে বলেনি তো!
- কী বলবে? প্রানসখা! আমাকে উদ্ধার করো? তুই পুরুষ হয়েও মুখ ফুটে কিছু বলিস নি, ও বলবে কীভাবে?
- কেন, বন্ধু হিসেবে কি আমার জানার এক্তিয়ার নেই? তোকে বলল কি করে?
- এটাই তো কথা! তুই তো তেমন বন্ধু নোস্‌। তোকে বলা যায় না নিশ্চই! ঠিক আছে, এখন তো জানলি; এবার ওকে বলে দে, ওকে আশ্বস্ত কর।
- না রে বোঁচা! ওকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
- কেন, সম্ভব নয় কেন? তুই ওকে ভালোবাসিস না?
দেবল আবারও চুপ করে রইল।
- কী হল? বল? চুপ করে আছিস কেন?
- ও তুই বুঝবি না।
- কেন? আমি হাঁদা না ভোঁদা?
- তুই বোঁচা। মজা করল দেবল।
- শ্যালা তোর কান কি চুলকাচ্ছে? উদোম দেব এমন, বাপ বাপ বলে গিয়ে দাঁত ক্যালাবি।
- তোকে তো বললামই, ওকে বিয়ে করতে পারবো না!
- ফষ্টি নষ্টি সবই করতে পারবো, বিয়ে করতে পারবো না কেন?
- বোঁচা আবেগের চোটে যা তা বলিস না। আমি ফষ্টি নষ্টি করেছি কখনও মুনুর সাথে?
- ওই হল। শব্দটা ভুল বলেছি। ঘুরেছো, গল্প করেছো, সরু সরু কাব্য করেছো – সে কি এমনি এমনি?
- সে তো প্রিয় জনের সাথে করাই যায়। তোর সাথে কি করি না, ঘুরি না?
- আমি আর মুনু কি এক হলাম? আমি ছেলে, ও মেয়ে!
- এখন ছেলেতে ছেলেতে প্রেম করা যায়! ও কথা বলিস না! 
- তোর এখনও মজা পাচ্ছে দ্যাবা? তুই বিশ্বাস কর, মনে হচ্ছে তোর পাছায় ক্যাঁৎ করে এক লাথি মারি!
- অপরাধ?
- অপরাধ হচ্ছে, কথাটা ঘোরাচ্ছিস। তুই সোজা সাপ্টা বল না, ওকে বিয়ে করতে পারবি না কেন! তুই অন্য কাউকে ভালোবাসিস না, আমি জানি। তুই ‘গে’ না। মুনুকে যথেষ্ট ভালোবাসিস্‌। মুখে বলিস না, তবু আমি বুঝি। বিয়ে করতে সমস্যাটা কী?
- আচ্ছা, বিয়ে করাটা কি আবশ্যিক? বিয়ে না করেও তো সম্পর্ক রাখা যায়!
- কীভাবে?
- কেন? এখন যেমন আছি, সেভাবেই থাকব।
- ওঃ। মধু খাবো, দায়িত্ব নেবো না! 
- তুই বার বার অশ্লীল ইঙ্গিত করছিস কেন বোঁচা? এরকম হলে কথা বলার মানে হয় না!
একটু বিরক্তি প্রকাশ করল দেবল।
- তা নয়তো কী? একটা মেয়ের পক্ষে বিয়ে না করে এভাবে থাকা সম্ভব? ওর বাবা-মাকে কী কৈফিয়ৎ দেবে? তাও যদি তুই লিভ্‌ টুগেদার করতিস, সেও না হয় হতো!
- তাহলে বিয়ে করে নিক।
- কাকে করবে?
- কেন? ওই হল্যান্ডের ছেলেটিকে!
- বা,বা বা বা বা বাঃ। আর তুই?
- আমার আর কী?
- তোর কষ্ট হবে না?
- কষ্ট হবে কেন? কষ্ট হলে তো বিয়েই করে নিতাম।
- তুই কি তবে সত্যি ওকে ভালোবাসিস না দ্যাবা?
- বাসলেই কি বিয়ে করতে হয়?
- তুই কি মানুষ, নাকি দেবতা?
- মানুষই।
- তোর প্রিয় মেয়েটি অন্য লোকের হবে, তার সাথে শোবে, তোর ভালো লাগবে?
 একথার কোনও উত্তর দিল না দেবল। প্রসঙ্গ ধরে শান্তনু আবার বলল, ধর যদি ওর বর ভালো লোক না হয়? ওকে কষ্ট দেয়?
- খারাপটাই ভাবছিস কেন, ভালোও তো হতে পারে।
- ভালো হলে ক্ষতি নেই, খারাপটা হলে? প্রিয়জনরা তো খারাপ আশঙ্কাটাই করে। তখন সইতে পারবি তো?
- সে মানুষের যা কপালে আছে তাই হবে, তুই মিছিমিছি চিন্তা করিস না।
🍂
- কিন্তু ধর....
- মুনু আসছে এদিকে। চুপ কর এবার। পরে কথা বলব।
 বলতে বলতেই মুনু এসে ওদের কাছে বসল। ওরা একাদেমি অফ ফাইন আর্টসের বাঁদিকের গলিতেই আড্ডা দেয় রোজ। প্রত্যেকে যে যার কাজের জায়গা থেকে বেরিয়ে এখানে এসে জড়ো হয় আর আড্ডা মারে। তিনজনেই ইংলিশ এ এম.এ পাশ করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। মুনু মানে অদিতি, বেহালার দিকে এক স্কুলের টীচার। দেবল কলেজে অধ্যাপনা করে। শান্তনু একটা বেসরকারী অফিসে চাকরি করে। মুনুর সাথে ওদের আলাপ, ওরা যখন আশুতোষ কলেজে বি.এ পড়তে ঢোকে তখন থেকে। মুনু আসা মাত্রই শান্তনু বলল, ‘আমি এখন একটু বেরোচ্ছি রে, তোরা কথা বল’।
 দেবল বুঝল, শান্তনু ওদের সময় দেওয়ার জন্য বেরোতে চাইছে। তবু বলল, ‘কোথায় যাবি শুনি?’
- এই একটা ট্যুর আছে রে, টিকিট কাটতে যাব শিয়ালদায়।
- কেন, এই রবীন্দ্র সদনেই একটা কাউন্টার আছে না রেলওয়ে রিজার্ভেশনের? মুনু বলল অনিশ্চয়তা নিয়ে।
-না, না; ও এখন খোলা থাকবে কিনা ঠিক নেই। আমি শিয়ালদাতেই যাব।
- তুই এখানে ফিরবি, না আমরা চলে যাবো? দেবল প্রশ্ন করল। আসলে দেবল ও শান্তনু এখনও একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেই থাকে কেষ্টপুরে। মুনুর বাড়ী মানিকতলায়।
- সে আমি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করব।ফোন করে দেব দেরী হলে। শান্তনু বলল।
- তা চা খেয়ে যা।
- না রে, দেরী হয়ে যাবে খুব। বলেই হন্‌ হন্‌ করে হাঁটা দিল শান্তনু।
- মুনু কিছু খাবি?
- চল, খিদে পেয়েছে খুব।
- কি খাবি? টিকিয়া রোল? 
- না রে। চল বরং হাঁটতে হাঁটতে শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালের দিকে যাই, ওখানে ভালো মোমো পাওয়া যায়।
 দুজনে আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করল শম্ভুনাথের দিকে। এখন রবীন্দ্রসদনের সামনের রাস্তার উপর ওভার ব্রীজ হয়ে কেমন যেন হয়ে গেছে পরিবেশটা। আগের মতো আর ভালো লাগে না আকাশটা। ক’বছর আগেও কেমন ঘন নীল হয়ে থাকতো আকাশ। মুনু ওই আকাশ দেখতে ভালবাসতো খুব। এখন ফেব্রুয়ারির শেষ। বেশ সুন্দর ফাল্গুনের হাওয়া বইছে চারপাশে। আজ অনেক দিন পরে সেই নীল আকাশটা চোখে পড়ল দুজনের। মুনু একটু আনমনা গলায় বলল, ‘বল দেখি, নীল আকাশ দেখলে তোর কী মনে পড়ে’? 
 দেবল মনে মনে বলল ‘তোকে’, কিন্তু মুখে বলল, নীল আকাশ মানে তো কৃষ্ণ। কৃষ্ণের কথা মনে পড়ে। ‘নীলি নীলি অম্বর পর” - গানটাও মনে পড়ে।
- জানিস, আমার নীল আকাশ দেখলে একটা মহাশূন্যতার ফিলিংস হয়। বিরাট এক শূন্যতা - বিরাট এক মায়া  যেন! আর আজকে দেখ, একফালি চাঁদ – নিজেকে জাহির করবে বলেই যেন অন্ধকার কে আঁচড়ে দিয়েছে।
- ‘ধরা যেথা অম্বরে মেশে/আমি আধো জাগ্রত চন্দ্র
 আঁধারের বক্ষের পরে/আধেক আলো রেখা রন্ধ্র।‘ দেবল আবৃতি করে উঠল।
- ‘শেষের কবিতা’ না?
- হ্যাঁ। নিবারণ চক্রবর্তী। ওখানে রবিঠাকুর কেমন সুন্দর কতকগুলো কথা এই পরিপ্রেক্ষিতে অমিতের জবানীতে বলেছিলেন, মুনু তোর মনে আছে?
- না রে!
- উনি বলেছেন, এই যে চাঁদের আধখানা জাগা, ওই অল্প একটুখানি আলো - আঁধারটাকে সামান্য খানিকটা আঁচড়ে দিয়েছে। এই হল ওর খেদ। একটা স্বল্পতার জাল চাঁদটাকে জড়িয়ে ফেলছে - সে যেন ওটাকে ছিঁড়ে ফেলবে বলে মরিয়া। ঘুমোতে ঘুমোতে যেন গুমরে উঠছে সে।
- কী অপূর্ব! দ্যাখ, আজকের চাঁদটাও যেন তেমনি। সত্যি এজন্যই রবিঠাকুর! পুরো উপন্যাসটায় নিবারণ চক্রবর্তীকে দিয়ে নিজেকে যেভাবে সমালোচনা করেছেন উনি - তা শুধু তাঁকেই মানায়। বিনম্র লাগলো মুনুর গলা। 
- মুনু তুই কি জানিস, এই শর্মাও রবিঠাকুরের উপর খোদকারি করার সাহস দেখিয়েছিল একসময় এই নিবারণ চক্কোত্তির আস্কারায়?
- জানিনা ত। শুনি শুনি।
- নে তার আগে মোমো টা খা। ফাইন আর্টসে গিয়ে বলব।
 একটু পরেই মোমো টোমো খেয়ে ওরা এসে বসল একটা গাছের তলায়, বাঁধানো বেদীতে। মুনু বলল, নে, এবার বল।
- এই যেমন ধর শেষের কবিতাতে একটি সুন্দর কবিতা ছিল
     ‘চুমিয়া যেয়ো তুমি          আমার বনভূমি
              দখিন সাগরের সমীরণ
     যে শুভখণে মম           আসিবে প্রিয়তম-
              ডাকিবে নাম ধ’রে অকারণ।‘  
- হ্যাঁ রে, দারুণ কবিতা! তুই কী খোদকারি করেছিস, শুনি! 
- শোন; ‘চুমিয়া যেয়ো তুমি         আমার বনভূমি
               ওগো দক্ষিণ সমীরণ!
      মিলন রাতে মম          আসিবে প্রিয়তম
               ডাকিবে নাম ধরে অকারণ।‘ - কী রে কেমন লাগল? দারুণ উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ল দেবলের গলায়।
- ‘দখিন সাগরের সমীরণ’ বদলে ‘ওগো দক্ষিণ সমীরণ’ করেছিস তো? শুনতে তোরটাই ভালো লাগছে। তবে  দ্যাখ - যে সমীরণ  দখিন সাগর থেকে আসছে তার ব্যাপকতাকেও তো বুঝতে হবে! আমার ছোট্ট বনভূমি তে দখিন সাগরের হাওয়া এসে চুম্বন করবে – যখন কিনা প্রিয়তম আসবে, সেটাও ভাবা দরকার। 
- মুনু তোর ব্যাখ্যাটা ভালো। আর রবিঠাকুরের লেখা - তাঁকে অতিক্রম করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে এই ব্যাপকতা কি খুব দরকারি? বরং দক্ষিণ সমীরণকে ওগো বলে যে আকুতি জানানো হচ্ছে - সেটা শ্রুতিমধুর বেশী।  
- ‘যে শুভখনে মম’ জায়গাটা কী দোষ করল? ওটা বদলালি কেন?
- দ্যাখ – বাপারটা তো মিলনেরই রাত। অমিতের নাম করে রবিঠাকুর যখন তাঁর নিজের বিরুদ্ধেই স্পর্ধা জাগাচ্ছেন, বোকা বোকা সেন্টিমেন্ট থেকে বেরিয়ে স্মার্ট কাব্যের কথা বলেছেন, সেখানে ‘শুভখণ’ কথাটা একটু ‘ভিক্টোরিয় পবিত্রতা’ নয় কি? ওই একটা গান আছে না- ‘যে ছিল আমার স্বপন চারিনী’, তাতেও এরকম এক লাইন আছে – ‘শুভখণে কাছে আসিলে, লজ্জা আমার ঢাকিলে গো’ – এখানেও দ্যাখ, তুমি এসে আমার লজ্জা ঢাকলে যখন – সেটাও হয়ে গেল শুভখণ? এজন্যই বদলে দিয়েছি আমি।   
- কিন্তু এখানে তো কবি স্বপন চারিনীর অ্যাসপেক্টে যাকে কাছে পাওয়া গেছে – তার কথা বলেছেন, তার আসাটাই যে অপরের বুঝতে না পারার লজ্জা থেকে মুক্তি দিয়েছে – অতএব ওটা বিশেষ শুভখণ  – এই এ্যাঙ্গেলটা ধরতে চেয়েছেন মনে হচ্ছে।
- সে হয়তো হচ্ছে, কিন্তু নিবারণ চক্রবর্তী নির্ঘাত এই শব্দটা লিখতো না। মিলন রাতই লিখতো বা এইজাতীয় কিছু লিখতো।
- আগের ‘শুভখণ’ টাতো নিবারণ চক্রবর্তীই লিখেছে। মুনু ফোড়ন কাটল।
- হ্যাঁ তা লিখেছে; তবে লেখা উচিৎ হয়নি।
- আর কিছু?
- তারপর ধর- ‘ছাদের উপরে বহিয়ো নীরবে
          ওগো দক্ষিণ হওয়া
          প্রেয়সীর সাথে যে নিমেষে হবে  
          চারি চক্ষুতে চাওয়া।‘
- এ বাবা, এতেও কারিকুরি করেছিস নাকি? যাঃ! এতে কিছু করিস না – এটা আমার প্রিয় কবিতা। প্রায় আর্তনাদ করে উঠল মুনু।
- এতে সব ঠিক আছে, কিন্তু ধর আমি যদি বলি, ‘আমি তোর প্রেমিক’-কেমন লাগবে শুনতে! বা ধর - যদি বলি, ‘আমার প্রেমিকা বড় লাজুক’। এই শব্দগুলো এখন বোকা বোকা লাগে না? প্রেয়সী শব্দের জায়গায় ভাব তো- ‘প্রেমিকার সাথে যে নিমেষে হবে চারি চক্ষুতে চাওয়া’ কেমন লাগে? আর তাছাড়া অনুনয় করা হচ্ছে দখিন হাওয়াকে যে তুমি ওই মুহূর্তে বও; তাকে কি আমরা বলব, আমার প্রেয়সীর সাথে যখন দৃষ্টি বিনিময় হবে, তখন তুমি শব্দ করো না; হয় নাম নিয়ে বলব বা মনে মনে অন্য কিছু বলব। 
- তা তুই এখানে কি করেছিস?
- ‘গোধূলির রঙে যে নিমেষে হবে চারি চক্ষুতে চাওয়া’। চারি চক্ষুতে বললেই বাকি দুটো চোখ যে প্রেয়সীর - সেটা এমনিই বোঝানো যাবে।
- দেব, তোর এইরকম একটা কবিতা ছিল না?
- হ্যাঁ। ‘সন্ধে হাওয়ায় মৌসুমী মন চুরি 
     বুকের মধ্যে কুয়াশা শিশির ঝড়
     আজকে আমার বকুল ভাবার দিন
     দোহাই বাতাস, আজ তুই চুপ কর!’
-শেষ হয়ে গেল নাকি?
- না রে! আর মনে নেই। আরও দুটো স্তবক আছে। একই মুডের এমনই একটা কবিতা কিন্তু শেষের কবিতাতেই আছে।
- কোনটা?
- ওই যে,  ‘দোহাই তোদের। একটুকু  চুপ কর।
        ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।‘ 
জানিস তো, এতেও খোদকারি করেছি আমি। 
- কীরকম?  
- দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর।
 ভালোবাসিবারে তোরা দে মোরে অবসর।
- পরের লাইনে একমাত্রা বাড়ল তো!
- না। দ্যাখ ‘একটুকু’ উচ্চারণে চারমাত্রা লাগে না। তিনমাত্রা লাগবে। ওকে মেকাপ দিতে ‘দোহাই তোদের’ – এরপর লম্বা বিরতি। পরের লাইন ওতেই মেকাপ হবে। আমি যে পড়লাম, খারাপ লাগল?
- না। তোরটা বেটারই লাগল। কিন্তু কী ব্যাপার বলতো? তুই নতুন করে শেষের কবিতা লিখবি নাকি?
- ইচ্ছে তো হয়; সাহস হয় না।
- সাহস হয় না কেন? তুই তো গোঁয়ার গোবিন্দ! তোকে তো ডরপোক্‌ মনে হয় না।
-না রে! তোকে ঠিক বোঝাতে পারবো না। কোথায় যেন স্বয়ং রবিঠাকুর এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন আড়াল হয়ে। 
 খানিক্ষণ চুপ করে রইল দুজনে। মুনু কিছুটা স্বগোতোক্তির মতো আওড়ালো, - ‘ভালোবাসিবারে তোরা দে মোরে অবসর’। – আচ্ছা এই ভালোবাসাটা নিভৃত না কি সক্রিয়? কী মনে হয় তোর?
- বলা মুশকিল মুনু। নিভৃত ভালোবাসায় অবসরটা বেশী জরুরী। সারাদিন কাজের ফাঁকে, সংসারের প্রতি সব আনুগত্য দেখিয়ে অবসর মিললে তবে না নিভৃত ভালোবাসার মানুষকে ভাবা যায়! সক্রিয় ভালোবাসায় উভয় পক্ষের তালমিল থাকলেই হ’ল। মনে হয়, সেখানে অবসর খোঁজার দরকার কম পড়ে। সেখানে অবসর খোঁজা বরং পরস্পর থেকে আড়াল তোলার জন্যই।
- রবিঠাকুরেরই একটা গান আছে না – এই নিভৃত ভালোবাসার প্রসঙ্গে -  
          ‘আমি নিশিদিন তোমারে ভালোবাসি 
                তুমি অবসর মতো বাসিও’  – দ্যাখ এই শেষের কবিতায় অমিতও এই আকাঙ্ক্ষায়  লাবণ্যকে বিয়ে না করে কেটিকে আংটি পরাল। ডায়লগও দিল কবিতার মোড়কে – 
         কোনওদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে/  বসন্ত বাতাসে/  অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস / ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ, /  সেওক্ষণে খুঁজে দ্যাখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে/             তোমার প্রাণের প্রান্তে, বিস্মৃতি প্রদনে/  হয়তো দিবে সে জ্যোতি,/ হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নের ঘুরতি।/ তবু সে তো স্বপ্ন নয়, /সবচেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়- / সে আমার প্রেম, /তারে আমিই রাখিয়া এলেম / অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে।
- বাঃ! তোর মুখস্থ আছে পুরোটা? দেবল কিছুটা বিষ্ময় প্রকাশ করল।
- এককালে প্রায় পুরো বইটাই তো মুখস্থ ছিল। যাই হোক, তোর কি মনে হয় কেটির সাথে দাম্পত্যের মাঝে কোনও একদিন বসন্ত বাতাসে লাবণ্যের উদ্দেশ্যে যদি দীর্ঘশ্বাস ধেয়ে যায় – তবে তার মধ্যে অমিতের খারাপ লাগাটা থাকবে না?
- সে কৈফিয়ৎ কিন্তু রবিঠাকুর দিয়েই রেখেছেন – তুই যে গানটা বললি ওখানেই। ওই যে বলেছেন-
                 ‘ তুমি চিরদিন মধুপবনে / চিরবিকশিত বন ভবনে
                  যেয়ো মনোমত পথ ধরিয়া
                  তুমি নিজ সুখস্রোতে ভাসিয়ো।‘ তারপরে বলেছেন-
                  ‘যদি তার মাঝে পড়ি আসিয়া
                      তবে আমিও চলিব ভাসিয়া
                  যদি দূরে পড়ি তাহে ক্ষতি কী
                       মোর স্মৃতি মন হতে নাশিও।‘
 যে এমন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তার ওই খারাপ লাগাটুকু সহ্য করার ক্ষমতাও থাকা উচিৎ। তবে অবসর মত প্রিয় মানুষটি যদি ভালোবাসে, তবে মনে স্বস্তি পাওয়া যায় বৈকি - সেই হয়তো ‘দেবে জ্যোতি, হয়তো ধরিবে কভূ নামহারা স্বপ্নের মূরতি’।
মুনু একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আচ্ছা অবসরটুকু যদি না পাওয়া যায় - তবে?’
- হ্যাঁ সে সম্ভাবনাও প্রবল। সেটা উভয়পক্ষকেই মেনে নিতে হবে।
- সবাই তো একরকম ভাবে না দেব!
- সেটাই তো সৃষ্টির সৌন্দর্য রে! এক একজন এক একরকম বলেই কোনও কিছু বাঁধা গতে লাগে না। একজনের হিসেব অন্যজনের উপর ফলে না। যারা স্রোতে ভেসে যায় তারা ‘আম আদমী’।
- দেব, শান্তনুকে ফোন কর না, রাত সাড়ে আটটা বাজতে চলল। মা চিন্তা করবে।
- চল উঠি। বোঁচা মেসেজ করেছে দেখছি। ও আসবে না, সোজা চলে যাবে।
- কিসে যাবি? ক্যাব বুক করব?
- কর। মুনু কাল কখন আসবি? শনিবার তো!
- কাল আসবো না রে! বাড়ীতে একটা প্রোগ্রাম আছে কাল। মা বেরোতে বারণ করেছে।
 রবীন্দ্রসদন থেকে কাঁকুড়গাছি আসতে যতক্ষণ লাগলো দুজনের কোনও কথা হল না। হঠাৎ একটা গুমোট হাওয়া যেন ঘুরতে লাগলো দুজনের চারপাশে। দিন কী ফুরিয়ে যাচ্ছে? বাড়ীর সামনে এসে মুনু নেমে গেল প্রায় নিঃশব্দে। দেবল কাঁচটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের প্রোগ্রাম কাল?’ 
 মুনু না শোনার ভান করে বলল, ‘চলি রে! গুড নাইট। সাবধানে যাস’। বলেই পেছন ফিরে চলে গেল দ্রুত। দেবলের মনে হল এটাই কি – ‘প্রানের পরে চলে যাওয়া!’
                              (২) 
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ হতে প্রায় এগারোটা বাজল। দেবলরা যেখানে ভাড়া থাকে, তাদের রুমটা একেবারে তিনতলায়। সামনে খোলা ছাদ। শান্তনু দুটো চেয়ার পেতে সিগারেটটা ধরিয়ে এসে বসল ওখানে। দেবল ইচ্ছে করেই দেরী করছে, শান্তনু গেলেই ধরবে ওকে নির্ঘাত। মুনু নিয়ে ওর সাথে কথা বলতে ওর একেবারেই ইচ্ছে করছে না আজ। তবু উপায় নেই। ধীর পায়ে সে বসল শান্তনুর পাশে। বলল ‘কী রে টিকিট পেলি?’
- হ্যাঁ। আর এ.সি, তবে সময় আছে, হয়ে যাবে মনে হয়।
- কোথায় যাবি?
- শিলিগুড়িতে। ওখানে কী সব ক্যাম্পেনিং আছে। তোর কী খবর আজকে?
- কী আবার খবর হবে? 
- বললি মুনুকে?
- না।
- বললি না? কী করলি সারা সন্ধ্যা?
- কাব্যচর্চা।
- কী কাব্য?
- ওই রবিঠাকুর।
- আরে আমিও তো লিটারেচারের লোক নাকি? না হয় মার্চেন্ট অফিসে কাজ করি, তা বলে রবিঠাকুরের কোন লেখা, সেটা বুঝবো না?
- শেষের কবিতা।
- ওঃ। ট্রাশ লেখা একটা।
- দ্যাখ বোঁচা – ফালতু কথা বলিস না। তোর সাথে আমি শেষের কবিতা আলোচনা করতে চাইনা।
- সে আর করবি কেন? আলোচনা তো মুনুর সাথেই করে ফেলেছিস! তবে ফালতুটা কি বললাম শুনি? আমি তোদের মতো সাহিত্যে রোমান্টিসিজম খুঁজিনা, আমি প্রাক্‌টিক্যাল রোমান্টিসিজমে বিশ্বাস করি।
- শেষের কবিতায় নন্‌ প্রাক্‌টিক্যাল কি আছে শুনি?
- পুরোটাই। প্রেম করতাম কেটিকে। শিলং এ এসে প্রেমে পড়লাম লাবণ্যের। ফাটাফাটি প্রেম- কবিতা মবিতা করে ইউফোবিয়ার চুড়ান্ত। ব্যস আবার কেটির নাকিকান্না। শোভনসুন্দরের আগমন..... 
- শোভনসুন্দর নয়, শোভনলাল। ফোঁস করে উঠল দেবল।
- ওই হল। তাও তো ওকে সুন্দর বানালাম। শোভনের পর লাল আদৌ যায় কী? সে যাই হোক, কেটির কান্না দেখে অমিতের উপলব্ধি হল ও ডেইলি ব্যবহারের উপযুক্ত - আর লাবণ্য হল পুষ্করিণী, যেখান থেকে ও রোজ ডুববে আর জল তুলবে। বলি এটা সম্ভব? 
- অসম্ভবের কী আছে?
- অমিত কেটিকে বিয়ে করবে আর মনে মনে রোজ ঘড়া ভরবে লাবণ্যের রসে, এটা কেটির প্রতি প্রবঞ্চনা নয়? লাবণ্যেরই বা কোন সম্মান আছে এতে? 
- বোঁচা এটা ভালোবাসার ব্যাপার, দেহ দখলের নয়!
- ওখানেই তো আপত্তি। আমরা বাবা সাধারণ জিনিস বুঝি, যাকে ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করব।যাকে ভালোবাসি না তাকে বিয়ে করব কেন? আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিসকে কি আমাদের প্রিয় হতে নেই?
- সাধারণ মানুষের সাথে অসাধারণদের তো এখানেই তফাৎ। তারা ভালো জিনিসকে তুলে রাখে, যাতে তার আলোয় অনেকদিন প্রিয়তা পেতে পারে।
- তুই কি নিজেকে অসাধারণ ভাবিস দ্যাবা?
- এখানে আমার কথা আসছে কোত্থেকে? আমি সাধারণই; তবে তোর মতে বিশ্বাসী নয়? 
- আর শোভনসুন্দর? ও দুটো সরু সরু কথা বলল, আর লাবণ্যের মতো মেয়ে তাকে বিয়ে করে নিল? সে অমিতের পাছায় মুড়ো ঝাঁটার প্যাঁটা লাগাতে পারলো না? উল্টে তাকে কেটিকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার, আনন্দ দিতে চেষ্টা করার বুদ্ধি দিল? নুড়ো জ্বেলে দে শালাদের প্রেমকে। আমার তো মনে হয় বাপু - এ শুধু কাব্যিক প্রেম। সত্যি সত্যি হলে না, সমাজ পরকীয়ায় ভরে যাবে! প্রতিটি পরস্ত্রীকে আমি যদি ‘লাবণ্যময়’ দেখি, দোষ কি তাতে হবে না? 
- বোঁচা আমাকে যা বলছিস বল, লোকের সামনে এসব বলিস না। একটা কালজয়ী সাহিত্য সম্পর্কে তোর যা ব্যাখ্যা, লোকে বিশ্বাসই করবে না তুই লিটারেচারের ছাত্র! 
- লিটারেচারের ছাত্র হলেই কি ফ্যান্টাসীতে বিশ্বাস করতে হবে? আমি তোদের মতো করে সাহিত্য বুঝি না, আমি প্রাক্‌টিক্যাল বিষয়কে গুরুত্ব দিই।                                                                  
- আচ্ছা বোঁচা, পৃথিবীর কতগুলো প্রেম শেষমেষ বিয়ে পর্যন্ত যেতে পারে?
- বেশীর ভাগই পারে না।
- তবে এটা ভাবছিস না কেন ‘শেষের কবিতা’ সেই সব ‘না ফোটা’ কুশীলবদের জন্য? এর উপাখ্যান তাদেরই বেদনাকে নিয়ে, তাদের না পাওয়াকে রিলিফ দেওয়ার জন্যই!
 চুপ করে রইল শান্তনু। কিছুক্ষণ পরে বলল, ‘তবে শোন, মুনু কিন্তু ‘শেষের কবিতা’ নিয়ে তোকে যে মহান কাব্যিক ডায়লগই দিয়ে থাকুক, সে কিন্তু মোটেই লাবণ্য নয়!’
- তুই কি করে বুঝলি ও লাবণ্যের মতো ভাবে না।
- অন্য বিষয়ে ভাবে কিনা জানিনা, তবে এই ব্যাপারে ভাবছে না –  নিশ্চিত বলতে পারি। কাল ওকে পাত্রের বাড়ী থেকে দেখতে আসছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কালই ফাইন্যাল হয়ে যাবে।
- তুই কী করে জানলি?
- এইতো তুই বাড়ীতে নামিয়ে দিয়ে আসার পর ও ফোন করেছিল। তখনই বলল। সব থেকে বড় ব্যাপার, ও ওর মা-বাবাকে কি বলবে বলতো? এতদিন তোর সাথে ঘুরেও কোনও আশ্বাস যদি তাঁদের না দিতে পারে, ওনারাই বা কদ্দিন ওয়েট করবেন? 
- ওয়েট করবেন কেন? তেমন হলে কালকের সম্বন্ধই ফাইন্যাল করে ফেলুন না?
- তুই কি পাষাণ নাকি অমানুষ দ্যাবা? তোর মনে কষ্ট হচ্ছে না, ও কষ্ট পাচ্ছে ভেবে? 
- বোঁচা, দ্যাখ মুনুকে আমি পছন্দই করি। আমার জীবনে মা বাদে সেই অর্থে নারী যদি কেউ থাকে, তবে সেটা মুনু। ও কষ্ট পাক আমি নিশ্চিত চাই না। আবার এটাও ঠিক, বিয়ে করে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাক, সেটাও আমি চাইনা।
- সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কথা আসছে কেন?
- তুই আমার কথা জানিস না? আমার বাবা-মার তো শুনেছি আবাল্য প্রেম ছিল। বিয়ের পর ছ-সাত বছরও টেকেনি। আমাকে নিয়ে ‘মা’ কিভাবে মানুষ করেছে তা তো তোর অজানা নয়। আমাদের বন্ধু দীপ আর মৈত্রেয়ীর কতদিনের প্রেম! টিকল?
- ওদের টিকল না বলে তোরও টিকবে না ভাবছিস কেন? আমার বাবা-মা, মুনুর বাবা-মা সবাই কি ডিভোর্সের জন্য হাঁকু-পাঁকু করছে?
- তা নয় রে বোঁচা, আমার মনে হয় কোনও কিছু পেয়ে গেলে তার অনাদর শুরু হয়। মুনুকে আমি পেয়ে  হারাতে চাইনা।
- তা তুই কি কোনও কেটি মেটি জুটিয়েছিস নাকি? বেশ রাগ রাগ স্বরে বলল শান্তনু।
- হলে তুই জানতিস না কি? তবে ভেবেছি বিয়ে আমি করব না।
- তোর মা শুনবে? বাধ্য করে যদি?
- তখন দেখা যাবে।
- তা সেই মেয়েটিকে বিয়ে করলে কি তোর অশান্তি হবে না?
- হবে হয়তো। তবে তার জন্য মুনুকে তো দায়ি করতে হবে না, এটাই শান্তি। উল্টে মনে হবে ‘মুনু থাকলে নিশ্চয়ই এভাবে রিঅ্যাক্ট করতো না’। এই রিলিফটা মনকে খুশি করবে। আমার বিশ্বাস মুনুও এভাবে রিলিফ পেতে পারে ভবিষ্যতে।
- তুই মেয়েদের হাতি চিনিস। ওরা হচ্ছে তরল, যখন যে পাত্রে থাকে তখন তার। যাকে বিয়ে করবে, দেখবি অহরহ তার চিন্তাতেই দিন কাটিয়ে দেবে।
- বোঁচা, তাহলে বৃথা আর হেদিয়ে মরছিস কেন? তেমন হলে তো কোনও সমস্যাই নেই; ল্যাঠা চুকে গেল। দু-চারদিনের খারাপ লাগা শুধু! নতুন স্বামীর মন পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
- সে না হয় হবে। আমি তো তোর কথাও ভাবছি দ্যাবা। আমি জানি তুই প্রচন্ড ভালোবাসিস ওকে। ফালতু কিছু সম্ভাবনার দুঃস্বপ্নে সম্পর্কটাকে ভেঙ্গে দিবি? মুনু অন্য কারও – তোকে কষ্ট দেবে না?
 দেবল চুপ করে রইল। দেখল শান্তনু চুপ করে বসে আছে। বলল,  ‘বোঁচা বোস একটু, আসছি’।
- কোথায় যাবি? টয়লেট?
- না রে, মোবাইলটা নিয়ে আসি।
- এত ভোরে মোবাইল নিয়ে কি করবি?
 দেবল উত্তর দিল না। আস্তে করে ঘরে গিয়ে রিং করল। মুনুর রিং টোনটা ভারি সুন্দর, ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে’।
- কী হলো দেব, এত ভোরে? শরীর টরীর খারাপ নাকি? প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলল মুনু।
- না রে শরীর ঠিক আছে। 
- ঘুমোসনি রাতে?
- এই তো বোঁচার সাথে গল্প করছিলাম। তোর গলা শুনে মনে হচ্ছে তুই ও ঘুমোস নি।
- না না, ভোরে ঘুমটা ভেঙে গেছে।
- একটু ছাদে যা না। দেখ শুকতারাটাকে।
- আচ্ছা ধরে রাখ ফোনটা। যাচ্ছি।
 কিছুক্ষণ পরে মুনু বলল, খুব উজ্জ্বল লাগছে রে আজ তারাটা। সেই মহালয়ার দিন দেখেছিলাম। আজ পাঁচমাস হয়ে গেল।
- দ্যাখ মুনু, কালকের সেই আধো জাগ্রত চন্দ্র কখন বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ওর অভিসারের সাথী এখনও পথ চলা ছাড়েনি। এখুনি সারা আকাশ জুড়ে দিনমণির পরিক্রমা শুরু হবে, তবু শুকতারা কিন্তু তাতেও হাল ছেড়ে দেয়নি।
- হুম।
- আমার শুকতারা কি হল্যান্ডের সূর্যের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেবে, নাকি.....?
- তোর কি মনে হয়?
- সূর্য্যের অনেক পরাক্রম... বৈভব...বিদেশী হাওয়া!
- শুকতারা তো স্নিগ্ধতাই ভালোবাসে, দেব!
- কিন্তু চাঁদের তো ক্রমশ ভেঙে যাওয়া আছে, ক্ষয় আছে, নানান ধরণের মুড আছে?
- আবার গড়ে ওঠাও তো আছে।
- তাহলে আজকের প্রোগ্রামটা বাতিল করে দে।
- তা কী করে হয় দেব? বাপি আসতে বলে  দিয়েছে তো!
- ওরা যদি সব ফাইন্যাল করে দিতে চায় আজ?
- দেবে! তাই তো চেয়েছিলি এতকাল!
- এই যে স্নিগ্ধ  স্নিগ্ধ করলি?
- আমিও তুল্যমূল্য যাচাই করে দেখি, কোনটা চলনসই! মুখ টিপে হাসল মুনু।
- ইয়ারকি মারিস না এই সকাল সকাল। কোনও পুরুষ ওই দৃষ্টি নিয়ে তোকে দেখবে, আমার সহ্য হবে না।
- এই তো পুরোপুরি ছেড়ে দিচ্ছিলি। আজ মোটামুটি একটা সম্ভাবনার পথ খুলতেই তোর অধিকার বোধ চাগাড় দিয়ে দিল? কপট ধমকের মধ্যে কোথাও একটা প্রশ্রয়ের আভাস যেন খেলল মুনুর গলায়। 
- সে যা বলিস মুনু। আজ সন্ধ্যায় আসবি তো তাহলে?
- না রে। আজ হবে না। মা কে ম্যানেজ করা মুশকিল হয়ে যাবে। কাল পাক্কা আসব। যা, বরং ফ্রেশ হয়ে নে। আমার না হয় ছুটি আজ! তুই তো কলেজ যাবি? না কি গুল্লি?
- গুল্লি দেব ভাবছি। আজ সারাদিন এই মুহুর্তটাকে সেলিব্রেট করব।
- না রে দেব, কলেজ যা। একা থাকলে ভালো লাগবে না তোর, তাছাড়া শান্তনুও তো অফিস যাবে নিশ্চই?
- জানি না।
- ঠিক আছে এখন নীচে যাই। এখনই সূর্য্য উঠবে মনে হচ্ছে।
- জানিস মুনু। মনে হচ্ছে, নিবারণ চক্রবর্তী যেন এখনই আমার জন্য একটা কবিতা লিখে দিল।
- কি কবিতা?
- সুন্দরী তুমি শুকতারা
      শৈলশিখর প্রান্তে
 শর্বরী যবে হবে সারা
     দেখা দিও দিক্‌ভ্রান্তে। 
- এটা নিবারণ চক্রবর্তীর আস্ত, না কি দেবলকুমার সম্পাদিত?
- সম্পাদিত। রবিঠাকুরের কলমে ওটা ছিল ‘সুদূর শৈল শিখরান্তে’... আর ‘দর্শন দিও দিক্‌ভ্রান্তে’!
- সত্যি তোর স্বভাব যাবে না। 
- গেলে বুঝি ভালো হত?
 হঠাৎ একটা মন ভালো করা বাতাস এসে ছুঁয়ে দিল দুজনকে। আকাশ রাঙা হয়ে উঠল দূরের নারকেল গাছটার ঠিক মাথায়।

Post a Comment

0 Comments