নির্মল বর্মন
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বলিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক ও নট নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার সারস্বত সমাজে আলোচিত একটি নাম। ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯২০ কলকাতার কালীঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। আশুতোষ কলেজে পড়াশোনা করেন। উমা বন্দোপাধ্যায় কে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ করেন। ১৯৯৯ এ ২৬ শে মে কলকাতার চেতলার 'তীরভূমি'তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।তাঁর ''জনপদবধূ'' উপন্যাসের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন ও থাকবেন। কথাসাহিত্যিক শচীন্দ্রনাথ সচেতন ভাবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গল্প ,নাটক ও প্রবন্ধ রচনা করতেন ও প্রকাশ করতেন। নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগে কয়েক বছর উপর অধিকর্তা পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকরঞ্জন শাখার নাট্য পরিচালক হিসেবে দীর্ঘদিন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে যুক্ত ছিলেন।এমন কি জাহাজে চাকরিরত অবস্থায় বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতার প্রেক্ষিত পরিকল্পনামাফিক সম্মুখীন হয়েছিলেন । এবং তাই দিয়েই লিখে ফেললেন ''সিন্ধুর টিপ'', ''বন্দরে বন্দরে'', ''সমুদ্রতীরবাসীর পত্র'' এবং "ডোডো পাখির নিজের দেশ'' ইত্যাদি। ১৯৮৮ সালে ''বন্দরে বন্দরে'' উপন্যাসের জন্য পশ্চিম বঙ্গ সরকারের "বঙ্কিম" পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
কথাসাহিত্যিক শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত অন্যান্য গ্রন্থ সম্ভার :- ''শ্বেতকপোত'', ''প্রজন্মের ইতিহাস'', ''সমুদ্রের গামা 'নীলসিন্ধু'', ''অভিমানী আন্দামান'', ''তীরভূমি'', ''নতুন নাম নতুন ঘর'', ''শান্তির স্বাক্ষর'', ''স্মৃতি দিয়ে ঘেরা'', ''ছায়া সঙ্গিনী'', ''পত্রলেখার উপাখ্যান'', ''একটি রঙ করা মুখ'', ''এক আশ্চর্য মেয়ে'', ''পথ'', ''কানাগলির এক রাত্রি'' ইত্যাদি। সবথেকে আড়োলন সৃষ্টিকারি দেবদাসীদের কাহিনি অবলম্বনে রচিত সফলযোগ্য উপন্যাস ''জনপদবধূ'' (১৯৫৮)!
বস্তুতঃ অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের দেবস্থলগুলির দেবদাসীদের নিয়ে এই উপন্যাসের মূল থিম রচিত। আসলে স্বাধীনতা উত্তরকালে দেহব্যবসায়িনীদের নিয়ে বেশ কয়েকটি কথাসাহিত্য রচিত হলেও ঔপন্যাসিক "জনপদবধূ" উপন্যাসে ধর্মের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত দেবদাসীদের যে গণিকাবৃত্তির ককটেল তাকেই রূপদান করেছেন। উপন্যাসের মূল ভাবনা বিষয়বৈচিত্র্য ও প্রেম সম্পর্কের আধ্যাত্মিক মূল্যায়নে সাহিত্যিক সুকৌশলে অভিনবত্বের সঞ্চারণ ঘটিয়েছেন। প্রখ্যাত সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :-
"উপন্যাসে প্রতিবেশ রচনায় ও পাত্র-পাত্রীর আচরণের মধ্য দিয়া অন্ধ্রপ্রদেশের দেবমন্দিরের বাতাবরণ, উহার কঠোর আচার-নিয়ন্ত্রিত পূজাপদ্ধতির রূপ, সুকুমার শিল্পকলার মাধ্যমে অনাবিল ভক্তি-উৎসার এবং জীবনচর্যার অধ্যাত্ম চেতনার সহজ প্রতিষ্ঠা-এই সমন্তের পরিচয় চমৎকারভাবে ফুটিয়াছে।"
"জনপদবধূ" উপন্যাসের তরুণ তুর্কি নায়ক মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার ও নায়িকা দেবদাসী ভামতী'র মধ্যে আধুনিক ভাবনা ও প্রেমসমস্যার কোনোরূপ পরিচয় আমরা পাই না। বরং তাতে আছে আধ্যাত্মিক প্রেম সম্পর্কের ক্ষেত্র। তাছাড়া 'প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই আধ্যাত্মিক প্রেমের একটি দিব্য উপাদান' এখানে উপস্থাপিত। নায়িকা 'ভামতী'র 'স্বর্গীয় ভালবাসার জন্য সে তার নায়কের কাছ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন দণ্ড' গ্রহণ করতে কুন্ঠাবোধ করেনি।
চেষ্টী বাবুর চরিত্রটিও জীবন্ত ও বাস্তবানুগ। সে মূলতঃ দোপল্লীর সংগঠকও ব্যবস্থাপক বটে। প্রাচীন নিয়মকানুনকে কোনরকম জিইয়ে রেখে দেহব্যবসাকে ধর্ম-নীতিগত রূপ দিতে বদ্ধপরিকর। আবার চেষ্টীবাবু সরোজা নাম্নী দেবদাসীর প্রতি গভীর আকৃষ্ট ।
সাহিত্যিক 'দেহব্যবসার দিকটিকে আধ্যাত্মিক রূপকের মাধ্যমে পরিবেশন করে প্রেমের দেহাতীত দিকটিকে উপস্থাপিত' করেছেন।১৯৭৩ সালে ২৩শে সেপ্টেম্বরে এই উপন্যাসের নাট্যরূপ স্টার থিয়েটার এ মঞ্চস্থসফল হয়েছিল।
নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এর১৯৫৮ র জুলাই মাসে ''এ জন্মের ইতিহাস'' নামক উপন্যাসের নাট্যরূপ ''জন্মদিন'' বিশ্বরূপায় মঞ্চস্থ সফল হয়েছিল। কথাসাহিত্যিকের ''নিজেরে হারায়ে খুঁজি' (১ম পর্ব) গ্রন্থটিও (অহীন্দ্র চৌধুরীর দীর্ঘ নাট্যজীবনের অভিজ্ঞতা ফলতঃ অহীন্দ্র চৌধুরী'র জবানিতে "দেশ" পত্রিকায় তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন - "১৪/১১/১৯৫৯-২৫/০২/১৯৬৯) বাংলা নাটকের একটি বিশেষ সময়কালের সুখপাঠ্য ইতিহাস রূপে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে"।
কথাসাহিত্যিক শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটদের জন্য অজস্র লিখেছেন। যেমন "মার্কো", "মেমোরিয়ালের পরী", "বিভূতিভূষণের মৃত্যু", চন্দ্রলোক থেকে আসছি", "ক্রৌঞ্চদ্বীপের ফকির" ইত্যাদি।
১৯৩৭ সালে সতেরোর শচীন্দ্রনাথ লিখে ফেললেন "বুভুক্ষা"! গল্পটি 'মানসী' পত্রিকা আয়োজিত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দখল করে। বিচারক ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। গোরক্ষা গল্পটি পড়ে শরৎচন্দ্র মুগ্ধ হয়ে নিজের পকেট থেকে কলম বের করে শচীন্দ্রনাথকে উপহার দেন। এবং কয়েকটি কথা বলেন:-
"তোমার জীবনে সুখ আসবে , দুঃখ আসবে, কিন্তু
এই কলমটি তুমি ছেড়ো না ,মনে রেখো
এই কলমের জন্যই তুমি জন্মেছ"।
0 Comments