আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত লাইন দুটি মনে পড়ে যাচ্ছে,
*মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই*।
সত্যিই এত সুন্দর জীবনে, কে মরতে চাই? তবুও শত শত প্রান আত্মাহত্যা করছে, নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, কেন? কিসের জন্য? আসুন আমরা সবিস্তারে আলোচনা করে জেনে নিই...
আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে, একজন নর কিংবা নারী কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া বা বলতে পারি,স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ। ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ আত্মহত্যা করেন, তখন জনগণ এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করে। ডাক্তার বা চিকিৎসকগণ আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধরূপে ঘোষণা করা হয়েছে।অনেক ধর্মেই আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যিনি নিজেই নিজের জীবন প্রাণ বিনাশ করেন, তিনি - আত্মঘাতক, আত্মাঘাতি রূপে সমাজে পরিচিত হন।
বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস (WSPD), আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ১০ই সেপ্টেম্বর পালন করা হয়। এই দিবসটির আয়োজন করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (IASP
নিজেকে নির্মমভাবে হত্যার অপর নাম আত্মহত্যা। এই নির্মমতার প্রভাব অবর্ণনীয়। প্রতিটি মানুষই জীবনের কোনো, না কোনো সময়ে আফসোস করে আমাদের জীবন কেন এত ক্ষণস্থায়ী? এত সুন্দর পৃথিবী, এত সুন্দর জীবন আর জীবনের সাথে সম্পর্কের এত মধুর বন্ধন ছেড়ে কে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চায়? এ প্রশ্নের উত্তর, ‘না’কেউই চায় না।
প্রিয়জনকে ছেড়ে, পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় না কেউই। পৃথিবীতে এমন একজনও সুস্থ মানুষ পাওয়া যাবে না, যে কি না মৃত্যুর কথা মনে করলে আঁতকে ওঠে না। তবু কিসের আশায় মানুষ নিজের জীবনকে নিজেই হত্যা করছে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেই সামনে চলে আসে আত্মহত্যার করুণ রূপ!
আত্মহত্যা যে কত নির্মম, আত্মহত্যা যে কত নিষ্ঠুর-তা কেবল প্রিয়জন হারা মানুষগুলো বুঝতে পারে। মৃত্যুর ওপারের জীবন কেমন আমাদের জানার সুযোগ নেই। তাই হয়তো বেঁচে থাকা, এপারের জীবনে মানুষ এমন কিছু ঘটনার সম্মুখীন হয়, যে ঘটনায় তার জীবন হয়ে ওঠে অতি তুচ্ছ, যা হননে একজন মানুষ জীবনের মহত্ত্ব একটি মুহূর্তের জন্য ভুলে যায়। এই নিষ্ঠুর ঘটনা হতে পারে একটি ঘটনা অথবা কয়েকটি ঘটনার সমন্বয় যা রূপ নেয় ভয়ংকর বিষণ্নতায় মোড়া এক অলীক পরিণতির।
কী কী কারণে মানুষ বহু সাধ ও সাধনার এই জীবনকে এক নিমেষে হত্যা করে? আত্মহত্যাকে একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়? গবেষণা বলছে, আর্থিক সংকট, বেকারত্ব, লেখাপড়ায় বাধা, পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রেমে ব্যর্থতা, অনুভূতির টানাপোড়েন, পছন্দের বাইরে বিয়ে দেওয়া বা করা, সামাজিক সম্মানহানিসহ নানাবিধ সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ দায়ী একজনের আত্মহত্যার পেছনে।
কারণগুলো বিশ্লেষণ করে যদি আমরা একটি বিশেষ সূচকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তা হবে ‘আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা’র অভাব। কারণ, একজন মানুষ যদি রাষ্ট্রের ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’র মধ্যে থাকে তাহলে তার আর্থিক অসচ্ছলতা বা বেকারত্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার দরকার পড়ে না। সাধারণত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ বা মেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া এসবের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী আর্থিক অসচ্ছলতা। এছাড়া, আত্মহত্যার জন্য দায়ী উল্লেখ্য কারণগুলো কখনোই একজন মানুষের বিষণ্নতার কারণ হতে পারে না, যদি সে ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’র মধ্যে থাকে।
🍂
বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রায় অর্ধশতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার উপর এক সমীক্ষায় পেয়েছে, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১জনেরও বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৬৫জন পুরুষ এবং ৩৬জন নারী শিক্ষার্থী।
উন্নত বিশ্ব তথা যেসব দেশে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে কম, তাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেসব দেশের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা কত বেশি মজবুত। ওইসব রাষ্ট্র, নাগরিকদের জন্য আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা দিতে বদ্ধপরিকর। পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে যে,শারীরিক অসুখের মতো মনেরও অসুখ হতে পারে। এই অসুখের নাম বিষণ্নতা।
প্রতি বছর, ১০ই সেপ্টেম্বর, বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করতে একত্রিত হয় লক্ষ,লক্ষ ব্যক্তি, যা পরিবারকে প্রভাবিত করে। এমন একটি বৈশ্বিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই দিনটি উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব বহন করে।আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
একটা মানুষের আত্মঘাতী হওয়ার পেছনে, সম্ভাব্য কারণগুলো সম্পর্কে জেনে নিই..
১.বিষণ্ণতা:
গভীরতার মধ্যে একটি অবিরাম দুঃখ,বিষণ্ণতার কারণে ব্যক্তিরা একেবারে সক্রিয়তা থেকে দূরে সরে যেতে পারে এবং তাদের আচরণে একটি বড় পরিবর্তন দেখা দেয়।
২.অস্থিরতা এবং উত্তেজনা:
অস্থির ভাবনা এবং উত্তেজনা থেকে ভয়, অশান্তি নির্দেশ করতে পারে। উদগ্রীব এবং অস্বস্তির অনুভূতি উপেক্ষা করা উচিত নয়, কখনোই।
৩.সামাজিক বিবর্তনতা:
যারা মনের চিন্তার সাথে লড়াই করে, তারা বন্ধু, পরিবার এবং সামাজিক যোগাযোগ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয়।তারা কথোপকথন এবং মিডিয়া গুলি এড়াতে থাকে,যা তারা আগে ভীষণভাবে সক্রিয় থাকতো।
৪. নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়া:
অপ্রতিরোধ্য অনুভূতি মোকাবিলা করার জন্য অ্যালকোহল কিংবা বিভিন্ন ধরনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়া।
৫.ঘুমের সমস্যা:
ঘুমের মারাত্মক ব্যাঘাত, অনিদ্রা বা অত্যাধিক ঘুম, অন্তর্নিহিত কষ্টের ইঙ্গিত হতে পারে।
৬. নিজের ক্ষতি করা:
নিজেকর ক্ষতি করা যেমন, পুড়িয়ে ফেলার মতো মারাত্মক ক্ষতিকারক কাজ করে ফেলা।
৭. আত্মপ্রার্থনা বা আবেগ সম্পর্কে বলা:
আত্মহত্যার চিন্তাভাবনাকে মৌখিকভাবে প্রকাশ করা, সহজে প্রকাশ করা বা অনুরোধ ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত। আত্ম-ক্ষতির যে কোনো উল্লেখ,অবিলম্বে বাড়ির লোকেদের বোঝা উচিত।
আত্মহত্যার চিন্তাভাবনার বিপরীতে আমরা কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি..
১.ভালোতা বাড়ান:
আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা আছে কারো মধ্যে, জানতে পারলে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে এবং নিজের,নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
২.খোলা কপোকথন:
স্বাস্থ্য ও মনসম্পর্কে খোলামেলা কথোপকথন হওয়া উচিত এবং মানুষদের বোঝাতে হবে যে তারা যখন উদ্বেগ করছে,তখন তাদের বিভিন্ন সাহায্য নেওয়া উচিত।
৩. কেউ আত্মহত্যার মুখোমুখি হলে এবং পাশের জন বুঝতে পারলে, তার বন্ধুবান্ধব, পরিবার এবং পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে ও তাদের কষ্টের কারণ জানতে হবে প্রয়োজনে কোন কলের মাধ্যমে বাড়িতে জানাতে হবে।
৪.সমর্থন প্রচার করুন:
হেল্পলাইন, হস্তক্ষেপ অভিযান এবং বিপদ স্বাস্থ্য সংস্থাতে তথ্য ছড়িয়ে দিতে হবে।
৫.বিচারহীনভাবে শোনা প্রয়োজন:
যদি কেউ আপনার সাথে তাদের অনুভূতি শেয়ার করে, বিচার না করে শোনা উচিত।সহানুভূতির সঙ্গে তাদের সাহায্যের চেষ্টা করতে হবে।
৬. কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করা: আত্মহত্যার পড়তে পারে এই সন্দেহ থাকলে, তাকে যথাসম্ভব কথাবার্তা বলে পুলিশে খবর দেয়া উচিত।
৭. কাউন্সেলিং করানো: সর্বোপরি কেউ অবসাদগ্রস্থ হয়ে থাকলে বা বহুদিন ধরে বিষণ্ণতায় ভুগলে তাকে কাউন্সেলিং করানো উচিত।
৮ সচেতনতা: বাড়ির এবং চতুর্দিকের মানুষের মধ্যে যদি অসামঞ্জস্য ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়,তাহলে তাকে বোঝানো উচিত এবং পাড়ায় পাড়ায় সচেতনতা প্রচারের জন্য ক্যাম্পেনিং করা উচিত।
বিশ্ব আত্মঘাতী প্রতিরোধ দিবসে একটি অনুস্মারক হিসাবে একজন ব্যক্তিকে সতর্ক করে, আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করতে পারি। আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা যাদের আছে,তাদের বোঝানো উচিত জীবন কত সুন্দর।আমরা এভাবে একটি জীবন বাঁচাতে পারি।
১০ই সেপ্টেম্বর, এই দিনটিকে বিশ্বে অনুপ্রাণিত করে, যেখানে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সহানুভূতিশীল এবং চারপাশের কথোপকথন উন্মুক্ত,সহায়ক ও কলঙ্কমুক্ত। আমাদের স্কুল পাঠ্যসিলেবাসেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি চ্যাপ্টার থাকা উচিত। এর মাধ্যমে আমরা একটি সহানুভূতিশীল সমাজ গঠন করতে পারি।
0 Comments