সৌমেন রায়
চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি।
‘মার্কসবাদ’ (২)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আচ্ছা কিশোর বয়সের একটি ছেলে বা মেয়ের পক্ষে এইভাবে পড়া সম্ভব? ভেবে দেখুন সে সকালে এক বা দুটো টিউশন করে স্কুল আসছে। তারপর আবার স্কুল থেকে গিয়ে টিউশন পড়ছে।কোন ফাঁকা সময় নেই, খেলা নেই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা নেই। অভিভাবক ছেলে মেয়ের সময়ের হিসাব পাই পাই বুঝে নিচ্ছেন। তাহলে সে তার স্বাভাবিক দুষ্টুমি করবে কখন? কঠোর নিয়মের নিগড়ে বাঁধা জীবনে স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব? কৈশোরের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলি কি অবদমিত হয়ে যাচ্ছে না? হয়ত সেই কারণে তারা টার্গেট করে স্কুলকে। ওখানে শাস্তি নেই। মারামারি তো বটেই এমনকি বকাবকিও বন্ধ। যদি কোমল মনে আঘাত লাগে! মাস্টার তো সবসময় নিজেই ভয়ে থাকে। সে আবার বকবে কি! অনেক উদাহরণ আছে ,সামান্য কিছু বললে স্কুলে এসে হম্বি তম্বি। বেশি হলে শিক্ষককে রাম প্যাদানি। আর শিক্ষক যদি রাজার কাপড়ের খবর রাখে তাহলে শ্লীলতাহানি কেস। সবই হচ্ছে স্টুডেন্টের সামনে। মানুষ খারাপ জিনিস রপ্ত করে দ্রুত। এই স্টুডেন্টরা অভিভাবক হয়ে সমাজকে যে এর দশগুণ ফিরিয়ে দেবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কথায় আছে বাপের চেয়ে বেটা এককাঠি সরেস হয়। শিক্ষক ভাবে কে ঝামেলায় যাবে বাবা। পরের ছেলে পরমানন্দ। শাস্তির পক্ষে বলছি না। বলছি না শাস্তি দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন দৈহিক শাস্তি কি করে মনের মধ্যে প্রবেশ করে তা তার বোধের অগম্য। চাকরির তিন চতুর্থাংশ কেটে গেছে এমন অনেক শিক্ষককে কখনও বেত ধরতে হয়নি। শাস্তি অন্যভাবেও দেওয়া যায়। যে শিক্ষক ভালোবাসে তার সামান্য গলার টোনের পরিবর্তন, মুখের ভাবের পরিবর্তন ছাত্র-ছাত্রীরা ধরতে পারে। বুঝতে পারে ভুল করছে। কিন্তু তার জন্য হৃদয়ে স্থান করে নিতে হয়। সেজন্য কিঞ্চিত শ্রম লাগে। তার চেয়ে বড় ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটা শ্রদ্ধার, ভালবাসার সম্পর্ক থাকা দরকার। অর্থাৎ শিক্ষার পরিবেশ থাকা দরকার। সেটি তো সোনার পাথর বাটি। তবে আবার এও দেখা গেছে কখনও কখনও ‘ লাথো কা ভূত বাতো সে নেহি মানতা।‘ একটা স্বপ্নের কথা বলি আপনাদের। স্বপ্নে একদিন দেখি এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সেমিনারে ব্যাখ্যা করছেন কিভাবে শাস্তি শিশু মনকে বিভ্রান্ত করে দেয়, কষ্ট দেয়, তার কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। হঠাৎ দেখি বেয়ারা গিয়ে তার মাথায় চাটি মারল ।সকলে তেড়ে গেল বেয়ারার দিকে। তিনি থামালেন। বললেন না ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার বক্তব্য শুরু হল। বেয়ারা আবার চাঁটি মারল। তিনি আবার বোঝালেন যে তোমার হয়ত তবলা বাজাতে ভালো লাগে। তা আমি তোমায় তবলা কিনে দেব। আপাতত টেবিল বাজাও। আমায় বক্তব্যটা শেষ করতে দাও। তিনি বক্তব্য শুরু করতে আবার চাটি। হঠাৎ রেগে তিনি ঠাটিয়ে এক চড় মারলেন বেয়ারের গালে। পুরো হল চুপ। কি যন্ত্রণায় পড়ে যে তিনি এ কাজ করলেন সে কি আর কেউ বুঝবে? কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশিবিষে দংশেনি যারে। যাকগে মরুকগে, স্বপ্ন তো স্বপ্নই হয়, তাই না? শাস্তি না থাক কিন্তু মাঝে মাঝে ফোঁস করার অধিকারটুকু থাকা দরকার। কিন্তু সেটুকু হরণ করা হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা জানে শিক্ষকের কিছু করার ক্ষমতা নেই। কি করে জানছে? নিশ্চয়ই পরিবার বা সমাজ তাকে জানাচ্ছে! আচ্ছা খারাপ কাজের জন্য, ভুলের জন্যও তিরস্কার করা যাবেনা? তিরস্কারহীন কৈশোর, যৌবন ভবিষ্যতে বাস্তব সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে তো? প্রথম বয়সে তিরস্কারহীনতার ফলে পরিণত বয়সে হতাশা গ্রাস করবে না তো? অপ্রাপ্তির দুঃখ, ভুলের জন্য তিরস্কার কোমল মনে আঘাত করে না মনের জমিটি শক্ত করে ভেবে দেখা দরকার। একবার এক শিক্ষক বলছিলেন ধরুন বাসে উঠে কেউ সিট পেল না। কোমল মনে আঘাত পেয়ে কিছু করে বসবে না তো? তাহলে কি ব্যবস্থা নেবেন? অবশ্য উল্টো দিকটাও অস্বীকার করা যায় না। হাতে ক্ষমতা থাকলে তার অপব্যবহার কখনো কখনো হয়। শাস্তি অনেক সময়ই নির্মমভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। কেউ কেউ অ্যান্টিবায়োটিক ওভারডোস দিচ্ছে। তাই বলে বাজার থেকে এন্টিবায়োটিক তুলে দেবেন? যাদের মাত্রা জ্ঞান নেই তাদের শাস্তি দিন। আবার স্টুডেন্টদেরও সমস্যা বিস্তর। সে নিয়ে পৃথক কোন পর্বে আলোচনা হবে।
গাড়ি একটু বেলাইনে চলে গিয়েছিল। কথা হচ্ছিল টিউশন নিয়ে। সেই সম্পর্কে একটা ঘটনা বলি। কয়েক বছর আগে মাধ্যমিক ভূগোল পরীক্ষার পরদিন এক বন্ধু ফোন করে বলল তোর কথা মতো ছেলেকে টিউশন দিলাম না। ওর মা পরীক্ষা হলের বাইরে বসে দেখেছে স্যারদের কি সুন্দর নোটস। ম্যাপ আঁকবে ;নদী নীল রং, পাহাড় খয়েরী। আমার ছেলে তো কিছুই পারবে না। বলেই ঝপাং করে ফোনটা কেটে দিল। বোধহয় বন্ধু বিচ্ছেদ হয়ে গেল। বন্ধুর ছেলেটিকে সামনে থেকে দেখে মনে হয়েছিল তার টিউশন দরকার নেই। সাজেশন দিয়েছিলাম কোন টিউশন দিসনা, নিজেকে পড়তে দে। পুরোটা মঞ্জুর না করলেও কয়েকটা বিষয়ের টিউশন সে দেয়নি। রেজাল্টের দিন আবার ফোন। ধরবো কি ধরবো না ভাবছি। সেই তো গালাগালি খেতে হবে। যতই হোক বস্ত্রহীন বয়সের বন্ধু তো, ধরলাম ফোনটা। ও প্রান্ত থেকে বন্ধু বলল ভাই ছেলে ভূগোলে নিরানব্বই পেয়েছে। তুই কিছু মনে করিস না। গিন্নির চাপে তোকে কত গালাগাল দিয়েছি মনে মনে। এমন ছেলের অভিভাবকও ভরসা রাখতে পারছে না তো সাধারণ স্টুডেন্টের অভিভাবক কি করবে? অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে বাংলা দিদিমনি ছেলেকে বাংলা পড়তে পাঠাচ্ছেন, অংকের শিক্ষক ছেলেকে অঙ্ক শিখতে পাঠাচ্ছেন টিউশনে। কেন পড়তে পাঠাচ্ছেন? কারণ তাদের কাছে নাকি পড়তে বসে না। সব অভিভাবকেরই প্রায় একই অভিযোগ পড়তে না পাঠালে পড়বে না। ফাঁকি দেবে । মানে অভিভাবকের চাহিদা মত পড়বে না। আসলে সবাই তো চায় তার ছেলেটি স্যার সি ভি রমন বা স্যার আশুতোষ এর মত হোক। নিজের ছেলের সীমাবদ্ধতা কেউ বুঝতে চান না। সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার চেষ্টা করা উচিত। সেজন্য স্টুডেন্টকে উদ্বুদ্ধ করা উচিত। কিন্তু অভিভাবক চাইছেন নিজেই সাঁতরে নদী পের করে দিতে। ফলে তার মনের দিকটি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অত্যাচার চলে যতদিন না সে মুখ ফুটে প্রতিবাদ করতে পারে। যখন মুখ ফোটে সে এমন ফোটে যে অভিভাবকের বোলতি বন্ধ। উপরোক্ত বাংলা দিদিমণিকে জিজ্ঞাসা করলাম চাঁদের পাহাড়, ঘনাদা, টেনিদা, ফেলুদা এসব পড়িয়েছেন? বলল কিছু পড়েনা , শুধু মোবাইলে গেম খেলে। প্রায় পুরো প্রজন্মটাই সাহিত্য পাঠ দূরের কথা বিখ্যাত সব বইগুলোর নামই শোনেনি। দু চারটা ব্যতিক্রম অবিশ্যি আছে। সবাই মিলে ঘষে ঘষে তাদের পারফেক্ট বানাচ্ছেন। যাতে বইয়ের একটি শব্দও ছাড়া না হয়ে যায়। এমন ছাঁচে ঢালা প্রজন্মের ছেলেরা সামান্য ব্যর্থ হলেই হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে। এমন উদাহরণ অনেক আছে।
নোট সর্বস্ব রেডি ফুড খেয়ে খেয়ে মাথার অবস্থা খারাপ। মুক্তচিন্তার বিকাশ, বোধশক্তির বিকাশ ,সমস্যা সমাধানের দক্ষতার বিকাশ এসবের কোন গল্পই নেই। গল্প শুধু মার্কসের। মার্কসই মূল লক্ষ্য নয় এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। অভিভাবক কিই বা করবেন? ভালো স্কুলে ভর্তি হতে, জয়েন্টে চান্স পেতে তো পরীক্ষায় নম্বরই পেতে হয়। হাতে-কলমে শিখছে কিনা, বোধ শক্তি আছে কিনা এসবের পরীক্ষা কি হয়? দুধ ফুটে ফুটে সর জমেছে এমন প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ কিছু কোর্সে ভর্তি হতে না পারলে জীবিকা অর্জন এখন অনিশ্চিত। অন্তত অভিভাবকরা মনে করেন যে সে সব স্থানে না ঢুকতে পারলে সন্তান ‘রসে বসে ‘ থাকতে পাবে না। এখন তো শুধু ‘দুধে ভাতে’ থাকলে চলে না। আর সেসব স্থানে ঢোকার প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নের কাঠিন্য মানের বাধা টপকাতে হয়। সে বাধা কি যে বাধা বোঝে কি আনজনে ! বাধ্য হয়ে ছোট থেকেই মার্কসের সাধনা করা ছাড়া উপায়ও থাকেনা। তাহলে অনর্থক সে ‘বাজে কাজে ‘ সময় ব্যয় করবে কেন? স্কুলে আসবে কেন? তাকে তো বাধ্য হয়ে ‘মার্কসবাদী’ হতে হয়। ছেলেটাকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে হবে তো! এ মার্কস অবশ্য সে মার্কস নয়। তবে এখানেও শ্রেণী শত্রু আছে। বন্ধুরাই এখানে তৈরি করা শ্রেণী শত্রু। অজান্তেই ঈর্ষার বীজ বপন হচ্ছে কোমল মাটিতে। মার্কসবাদীরা ছুটছে আর ছুটছে। ওই বিদ্যা ফুটে টিউশনে, যাই তাই আহরণে দাঁড়াবার সময় তো নাই!
মার্কসের বিনিময়ে হারাচ্ছে কি? স্কুলে একটি বাচ্চা শুধু মাত্র বিষয়ের পাঠ নিতে আসে না। সহপাঠীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে সে সহমর্মিতা, সহযোগিতার পাঠ নেয় । সমাজে বেঁচে থাকার পাঠ নেয়। তার প্রতিবেশীদের চিনতে শেখে। পরস্পরের সঙ্গে মিশতে শেখে। একে অন্যের সুখ, দুঃখ স্পর্শ করে। যা তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য অপরিহার্য। স্কুল একটি ছোট সমাজ। সেখানেই শিশু সামাজিক হয়ে ওঠে। ভবিষ্যতের সুনাগরিকদের মনভূমিটি তৈরি করে দেওয়ার স্থান হল স্কুল। মার্কসের বিনিময়ে এখন তা হারাতে বসছে। সমাজ এই ‘সামান্য ক্ষতি’ টুকু মেনেও নিয়েছে।
এখন আবার সে জগতেও পরিবর্তনের হাওয়া । বাজারে এসে গেছে বাইজুস, টিউটোপিয়ার মত অনলাইন অ্যাপ। এইচ এম দের ধরে ঢুকতে চাইছে স্কুলগুলিতে। এখানে পড়াশোনা অ্যানিমেশন করে দেখানো হয়। না বুঝলে একই ক্লাস বারবার করা যায়। ঘরে বসে অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছে পাঠ নেওয়া যায়। যে কোন প্রশ্ন করা যায়। হরেক সুবিধা। শুধু যে পড়ছে আর যে পড়াচ্ছে তাদের চোখে চোখ মেলে না। টিউশন হয়তো আবার একটা বাঁকের মুখে। পরিবর্তন কোন পথে তা এখনই জানা সম্ভব নয়। ক্রমশ জানা যাবে নিশ্চয়ই।
7 Comments
আরও এক মাঙ্গলিক কিস্তির লেখা নিয়ে সৌমেন পাঠকদের কাছে হাজির। দুটি পর্বে ভাগ করে আলোচনা করেছেন লেখক যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে গণ্য হতে পারে। শাস্তি মানে সবসময় করপোরাল পানিশমেন্ট হতে হবে এমনটা বোধহয় নয়। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের বুঝতে পারাটা খুব খুব জরুরি। যিনি যত তাড়াতাড়ি এটা করতে পারেন তিনি তত দ্রুত ছাত্রদের মনের কাছাকাছি পৌঁছে যাবেন। এটাও শিক্ষকদের তরফে দীর্ঘ অনুশীলন দাবি করে। শাসনের সঙ্গে সোহাগ মেশাতে হবে পরিমিত অনুপাতে। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তবে স্থায়ী ফল দায়ী।
ReplyDeleteমতামত দেখে বোঝা যায় পাঠের গভীরতা।🙏🙏
Deleteআলোচনায় নয়া মার্কসবাদের দর্শন নিয়ে আলোচনা উঠে এসেছে সৌমেনের লেখায়। একালের মানুষ হলে এই লেখা পড়ে মার্কস সাহেব নির্ঘাত ভিরমি খেতেন। ছেলেপুলে মানুষ ( ? ) করার এমন আত্মনাশী প্রক্রিয়া কষ্ট দেয়। অভিভাবকদের এহেন আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছেলেমেয়েরা প্রথম সুযোগেই বাবা মায়ের নাগালের বাইরে চলে যাবার উপায় খোঁজে। চলেও যায় কোনোরকম পিছুটান না রেখেই। বাবা মার শেষ
ReplyDeleteদিন কাটে বৃদ্ধাশ্রমে। এমন ভবিষ্যৎ মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত তো ?
পড়ছেন,ভাবছেন এটাই ভালো লাগছে।
Deleteসৌমেনের লেখায় এই সময়ের অভিভাবকদের মনোভঙ্গির যে চিত্রায়ন তা আগামীদিনে ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভাগ্যিস বস্ত্রহীন বয়সের বন্ধু পুত্র ঐ নম্বর পেয়েছিল না হলে এই বয়সে হয়তো নতুন করে বস্ত্রহীন অবস্থায় ফিরে যেতে হতো।
ReplyDeleteSoumen Roy
Deleteশেষ বাক্যের জন্য 😂😂
Delete