জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব-৩০/স্বপন কুমার দে

এক মুঠো রোদ
পর্ব-৩০


স্বপন কুমার দে

কোনও সপ্তাহে দু'দিন, কোনও সপ্তাহে তিনদিন--এভাবেই মল্লিকা কলকাতায় ডঃ বরাটের তত্ত্বাবধানে পি এইচ ডি করে চলেছে। কমপ্লিট হতে হয়তো অনেকদিন লেগে যাবে, ততদিন এভাবেই চলতে হবে। দুটো টিউশন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কলকাতায় যাতায়াতের খরচ, স্টাডি মেটেরিয়ালের খরচ, অথচ রোজগার কমে গেছে। এই অবস্থায় অভাবের মাঝখানেও সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তার পড়াশোনার ব্যাপারে। কোনো অবস্থাতেই সে মাথা নোয়াবে না।

কলকাতা থেকে ফিরতে ফিরতেই রাত হয়ে যায়। খুব সকালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে, সারাদিন সেখানে কাজ থাকে, আবার রাতের ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরা। খুব কষ্ট হয়। মল্লিকা অবশ্য হোটেলে খায় না, ভোর ভোর ভাত তরকারি রেঁধে টিফিন কৌটায় নিয়ে চলে যায়, দুপুরে খেয়ে নেয়। আবার রাতে বাড়ি ফিরে কিছু খেয়ে নেয়। এভাবেই চলছে।

সেদিন সাড়ে আটটার ট্রেনটা লেট করে রাত দশটা বাইশ নাগাদ স্টেশনে পৌঁছাল। মল্লিকা স্ট্যান্ড থেকে সাইকেলটা নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। প্রতিদিনের মত সে তার নির্দিষ্ট পথ ধরে চলেছে। এ পথে যে কোনো বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে, সেটা সে কল্পনাও করেনি। মাঝখানের কিছুটা রাস্তা অন্ধকার, ওখানে ল্যাম্পপোষ্টের আলোগুলোও জ্বলেনি। হঠাৎ দশ বারোজন লোক মল্লিকার রাস্তা আটকে দাঁড়াল। মল্লিকা ফাঁকা জায়গা দেখে পালানোর চেষ্টা করলে তারা সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ধরে নিল। সাইকেল থেকে পড়ে গেল মল্লিকা। চিৎকার করবার চেষ্টা করতেই একজন রুমাল দিয়ে মুখটা চেপে ধরল। একটা অশ্রাব্য গালিগালাজ করে বলল," তোর বড় দেমাক হয়েছে। আজ তোর সব দেমাক ভেঙে দেওয়া হবে।" আরও দু'জন জোর করে ধরে একটা মারুতিতে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। হাত, পা ছুড়তে লাগল মল্লিকা ; প্রাণপণে বাধা দিতে লাগল কিন্তু অতগুলো লোকের কাছে সে অসহায়। নিজের বিপদ বুঝতে পেরে গেছে মল্লিকা। আর বোধহয় উপায় নেই। সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দিতে লাগল। সামনে কতগুলো ভয়ংকর জন্তু তাকে ঘিরে ধরেছে। ভয়ার্ত হরিনীর মত বুকফাটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু ইতর অসভ্য লোকগুলো তার মুখটা রুমাল দিয় চেপে রেখেছে। ঠিক সেই সময়েই একটা আশার আলো দেখতে পেল মল্লিকা। একটা মোটর বাইক সেদিকেই আসছে। একজন লোক। দাঁড়িয়ে গেল, অস্বাভাবিক একটা দুর্ঘটনার আশঙ্কা করে সে চিৎকার করে প্রতিবাদ করল," কে তোমরা? ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও মেয়েটাকে। তোমরা কি মানুষ? ছাড়ো নাহলে পুলিশ ডাকবো।" তখন তিন চারজন লোক তাকে ঘিরে ধরল। চারজনে মিলে একজনকে পেটাতে শুরু করল। কিল, চড়, লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিল। এইসময়ই ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল নিমাই রিকশওয়ালা । আবছা অন্ধকারেও সে মল্লিকাকে চিনতে পারল, বুঝতে পারল বিপদ। চিৎকার করে উঠল," কে কোথায় আছো আমার মেয়েকে বাঁচাও। ওরা মেরে ফেলল আমার মেয়েকে। নিজে ছুটে গেল মল্লিকার কাছে। তাকেও পেটাতে লাগল গুন্ডারা। কিন্তু ততক্ষণে নিমাইয়ের চিৎকার শুনে লোক বেরিয়ে এসেছে, পাশাপাশি বাড়ির আলোগুলো জ্বলে উঠে। দুস্কৃতিরা কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। এমন সময় তাদের কারো একজনের ফোনে রিং হয়ে যাচ্ছিল। শোনা গেল, একজন বাকিদের বলছে," সুজনদা ফোন করছে।" ততক্ষণে পাড়ার লোক জড়ো হয়েছে। এবার গুন্ডাদের ভয় হল, ধরা পড়ার ভয়। শিকারকে বাগে পেয়েও ধরতে না পেরে তারা দুটো গাড়ি নিয়ে চম্পট দিল।

যে মানুষটি মল্লিকাকে রক্ষা করতে গিয়ে বেদম মার খেয়েছে, সে তখনও মাটিতে পড়ে। পাড়ার লোকেরা এতক্ষণ সেই মানুষটিকে ধরাধরি করে পরিচর্যা করতে লাগল। খুবই আঘাত পেয়েছে সে। টর্চের আলোয় তাকে দেখে শিউরে উঠল মল্লিকা," সম্পূরকবাবু, আপনি!"
" মল্লিকা দেবী, আপনি এখানে!"
সে সব পরে হবে। আপনাকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।"
"বাম হাতটা মনে হয় ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে। খুব যন্ত্রণা।"
" হ্যাঁ, এক্স রে করতে হবে। আমি আপনাদের বাড়িতে খবর দিয়ে দিচ্ছি।"
বলতে বলতেই কোথা থেকে একটা পুলিশ গাড়ি এসে পৌঁছাল। তারাই ওদের হাসপাতালে নিয়ে গেল। মল্লিকার সাইকেলটা নিমাইকাকু রিকশোতে নিয়ে গেল। সম্পূরকের মোটর বাইকটা পাশের একটা বাড়িতে রেখে দেওয়া হল।

হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে দেখানোর পর সম্পূরককে ভর্তি করতে হল। তার আঘাত কিছুটা গুরুতর। বুকে,পাঁজরে আঘাত লেগেছে। বাম হাতটা ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে। মল্লিকার তেমন বড় কিছু হয়নি, হাতে গায়ে নখের আঁচড় ছাড়া। মল্লিকাই সম্পূরককে ফর্মে সই করে ভর্তি করল। হাসপাতালে ভর্তি করার পর পরই সম্পূরকের বাবা আর দাদা সেখানে হাজির হল। মল্লিকার কাছে ঘটনাটা তারা শুনল। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে আঘাত কতটা, জানল। এখানে ট্রিটমেন্ট করলেই হবে, না অন্য কোথাও নিয়ে যেতে হবে, জিজ্ঞেস করল। ডাক্তারবাবু বললেন," ভয়ের তেমন কিছু নেই। আঘাতের ফলে কয়েকটা জায়গায় কালসিটে পড়ে গেছে। ব্যথা সারতে সময় লাগবে। বাম হাতে সামান্য ফ্র্যাকচার হয়েছে। হাতটা প্লাসটার হবে। এখানে একদিন রেখে পেসেন্টকে আপনারা বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। স্ক্যানে কোনো মেজর ইনজুরি ধরা পড়েনি।"
মল্লিকা বলল," জেঠু, আজকের রাতটা আমি এখানেই কোনোরকমে থেকে যাবো, আপনারা নাহয় বাড়ি চলে যান।"
অমরেশবাবু বললেন," তা হয় না মল্লিকা। তুমি মেয়ে হয়ে এই পরিবেশে রাতে একা থাকবে কী করে? একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছো, আবার নতুন একটা বিপদে পড়তে চাও?"
মল্লিকা এতটুকু অপ্রস্তুত হল না, কিন্তু সম্পূরকের বাবার মুখের ওপর কথা বলতেও পারল না। শুধু মনে মনে ভাবতে লাগল, আজ সম্পূরকবাবুর এই অবস্থা শুধুমাত্র তার জন্য। তাকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনের পরোয়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গুন্ডাগুলোর মাঝে। প্রাণপণে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিল, চড়, লাথি খেয়েছে, তবু সেখান থেকে পালায় নি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে সম্পূরক যখন রাত কাটাচ্ছে তখন মল্লিকা নিশ্চিন্তে স্বার্থপরের মত সেখান থেকে চলে যাবে কী করে? তাহলে ওই গুন্ডাগুলোর সঙ্গে মল্লিকার তফাৎ কী?
" কী হলো মল্লিকা, দাঁড়িয়ে রইলে যে?" অমরেশবাবুর শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে মল্লিকার সম্বিত ফিরল," না জেঠু, মানে।"
" তুমি ভাবছো, তুমি চলে গেলে আমরা কিছু ভাববো।  ভাববো, তুমি স্বার্থপর। তাই না মল্লিকা? না, আমরা কেউই তোমার সম্পর্কে এ ধরনের কিছু ভাবছি না। আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। তুমি এখন বাড়ি যাও, কাল সকালে বরং একবার এসো। ডাক্তারবাবু তো বললেন, ভয়ের কিছু নেই। তাছাড়া তেমন হলে দালু আছে, আমি আছি। আমরা দেখবো। এখন দালু তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।"
" না জেঠু, দাদাকে যেতে হবে না। আপনারা এখানেই থাকুন। আমার জন্য নিমাইকাকু বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার সঙ্গেই চলে যাচ্ছি। তবে, দরকার পড়লে যেকোনো সময় আমাকে ফোন করবেন। নাহলে কাল সকালেই আসবো।"

হাসপাতালের বেডে শুয়ে সম্পূরকের মনে হল, একবার মল্লিকার সঙ্গে দেখা হলে ভালো হত। কেন যে সে কথা মনে হল, তার কোনো ব্যাখ্যা সে দিতে পারল না। বাবা আর দাদা দেখা করতে এল, কতক্ষণ কথা হল। সম্পূরক ওদের বোঝাল রাতে তার কাছে থাকার দরকার নেই। মা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে। কাল বরং মাকে একবার নিয়ে এলে ভালো হয়।
🍂
ওরা চলে যাচ্ছিল, সম্পূরক ডাকল," বাবা!"
বাবা ঘুরে দাঁড়ালেন," কিছু বলবি?" বলে কাছে এলেন।
সম্পূরক একটু থেমে বলল," আমি কি কিছু ভুল করেছি? তোমাদের বিপদের মাঝখানে ফেললাম।"
" না, কোনো ভুল করিসনি। একশোবার ঠিক করেছিস, হাজারবার ঠিক করেছিস। যদি না করতিস, একটা মেয়েকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে ভীরুর মত নিজের গা বাঁচাতিস  তাহলে বুঝতাম, আমি তোকে মানুষ করতে পারিনি।"
সম্পূরকের মুখে একটু আলোর টুকরো মুহূর্তে তার মুখমন্ডলকে আলোকিত করে তুলল।

" বাবা, মল্লিকা মানে মন্টির ম্যাডাম কি চলে গেছেন?"
" হ্যাঁ, আমিই তাকে বাড়ি চলে যেতে বললাম। ও ওর এক কাকুর সঙ্গে বাড়ি চলে গেল।তুই কি ওকে কিছু বলতিস?"
" না, মানে কাল পুলিশ আসবে জবানবন্দি নিতে। আমি তো সবটা জানিনা, তাই ওঁর দরকার।"
" মল্লিকা থাকবে। পুলিশ ওকে থাকতে বলেছে।"
" ওহ্! মেয়েটার ওপর দিয়ে কী ঝড়টাই বয়ে গেল। আমরা ঠিক সময়ে না এলে ওঁর জীবনে কতবড় বিপদ যে ঘটে যেত...!"
" এ সব বিষয় পরে আলোচনা করা যাবে। তুই এখন একটু ঘুমিয়ে পড়্। আজকে তোর কাছে কি কাউকে থাকতে হবে? অবশ্য এখানে কাউকে থাকতে দেবে না। তুই চাইলে দালু নাহয় বারান্দায় রাতটা কাটিয়ে দেবে।"
" তার প্রয়োজন নেই বাবা। আমার সেরকম কোনো অসুবিধা নেই। তোমরা বাড়ি যাও।"

হাসপাতাল থেকে ফিরে বাড়িতে বাথরুমে ঢুকল মল্লিকা। সারা গায়ে জল ঢেলেও তার মনের যন্ত্রণা জুড়ালো না। মানুষ যে এতটা নীচে নামতে পারে তা তার ধারনার বাইরে ছিল। লোকগুলোর মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোচ্ছিল। দুটো গাড়িকে অন্ধকারে রেখে তারা অপেক্ষা করছিল মল্লিকার; অর্থাৎ তারা আগে থেকেই মল্লিকার গতিবিধি নজরে রেখেছিল। তাদের ধমকানি, শাসানির মধ্যে মল্লিকা বুঝতে পারছিল যে বস্তির জমি দখলই এ ঘটনার কারণ। প্রথমটায় ধন্দে থাকলেও ওদের একজনের মুখে ' সুজনদা' শব্দটা শুনেই সে পুরোটা পরিষ্কার বুঝতে পারল। সে জানে সুজন তার পেছনে পড়ে আছে, এটাও বুঝতে পারে জমি দখল এখন তার প্রধান লক্ষ্য। মল্লিকা প্রতিবাদ করেছিল বলে তার ওপর রাগ থাকতে পারে কিন্তু তাই বলে গুন্ডা লাগিয়ে কিডন্যাপিংয়ের মত জঘন্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এতবড় শয়তান সুজন। চিরদিনের মত মল্লিকার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে চায় ! সমাজ আজ কোন্ পথে? মেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়? কে দেবে তার জবাব? নারীমাংসলোভী কুকুরের দল ওৎ পেতে রয়েছে এখানে ওখানে। কোনো শাস্তি নেই। এদের অর্থ, প্রতিপত্তির জোরে সহজেই পার পেয়ে যায়। কেউ না কেউ ছাতা মেলে আছে এদেরকে আড়াল করবার জন্য। এদের জন্যই ঘটতে থাকে একের পর এক পৈশাচিক অপরাধ। প্রতিবাদ নেই। শুধুমাত্র মোমবাতি মিছিল, দুটো কবিতা লেখা ছাড়া সভ্য সমাজের আর কীই বা করার আছে? লজ্জা হয়না এভাবে বেঁচে থাকতে? আর কতবার আমরা মরবো?

মল্লিকা বুঝে গেছে, এবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে প্রতিবাদ করতে হবে। পাল্টা দিতে হবে। নইলে বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই।  

Post a Comment

0 Comments