দূরদেশের লোক গল্প ২০৪ —নরওয়ে (ইউরোপ)
তিনটি সাহসী ছাগল
চিন্ময় দাশ
বাঘ যতই ভয়ানক হোক, বয়স হয়ে গেলে, তখন কিন্তু তারই সমস্যা। ঠিকমত দৌড়ঝাঁপ করতে পারে না। তাতে শিকার করতে ঝামেলা হয়। তেমনই একটা বাঘ এসে ডেরা নিয়েছে একটা নদীর ধারে।
জুৎসই একটা খোঁদলও পেয়েছে পাহাড়ের খাঁজে। একা থাকবার পক্ষে বেশ বড়ই। পাশ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি নদী। চওড়া নয় তেমন। তবে, স্রোত বেশ খর। সেখানেই ডেরা বেঁধেছে বাঘ।
বাঘটার বয়স হয়েছে । তার চেয়ে বড় কথা, স্বভাবেও সে একটু আলসে। ভাবটা এমন—তিনি রাজামশাই! আয়েস করে শুয়ে বসে কাটাবেন। বনের প্রাণীরা নিজে থেকে এসে, হাজির হবে তার ডেরায়। শিকারের দৌড়োদৌড়ি করতে হবে না রাজামশাইকে।
কিন্তু এই হতচ্ছাড়া জঙ্গলে সে তো আর হয় না। অগত্যা মাথা খাটাতে হয়েছে রাজাকেই। কাঠকুটো দিয়ে একটা সাঁকো বানিয়েছে নদীতে। খাবার জোগাড়ের জন্য, নদীর ওপারে যেতে হবে এপারের সবাইকে। তখন তাদের ধরবে আর খাবে।
নদীর ওপারে একটা পাহাড়। সেই পাহাড়তলীতে বিশাল ছড়ানো মাঠ। সবুজ ঘাসের মেলা সেখানে। জেব্রা, হরিণ, খরগোশ, পাহাড়ি ছাগল—সকলের মেলা বসে যায় মাঠটাতে।
তিনটে ছাগল থাকে বনে। তিন ভাই তারা। বাঘের ফন্দি তারাও জানে। কিন্তু এক সময় এমন অবস্থা, যেতেই হবে নদীর ওপারে। নইলে এপারে পেট চলছে না আর।
ছোট দুজন বলল—কিন্তু, বাঘ যে ওৎ পেতে বসে আছে ওখানে। তার কী হবে?
বড় বলল—একটা ফন্দি বের করেছি আমি। সেই মতো চললে, বাঘ বাবাজি কিছুই করতে পারবে না।
নিজের ফন্দি ছোট দুজনকে ভালো করে বুঝিয়ে দিল বড়টা। বাড়ি থেকে প্রথম রওণা দিয়েছে ছোট ছাগলটা। মাচায় উঠে পার হচ্ছে। শব্দ উঠল—মচ মচ! মচ মচ!
তেমন জোরালো নয় শব্দটা। কিন্তু বাঘ কান পেতে রেখেছে যে। ঠিক শুনে নিয়েছে। হেঁকে উঠল—কে উঠেছে আমার সাঁকোয়?
ছাগল বলল—টিন-টিন-টিন। টিন-টিন-টিন। যাই তো আমি প্রতিদিন।
বাঘ বিরক্ত—গান শোনাতে হবে না। আমিটা কে? নাম বল।
ছাগল বলল—কেন? তোমার নাই কি জানা? আমি ছোট্ট ছাগল ছানা।
পাহাড়ি ছাগলের মাংস মিষ্টিই হয়। বাঘ বেশ খুশি। বলল—একটু দাঁড়া। আসছি আমি।
বাইরে এসে, এক পলক দেখে নিল বাঘ। বলল--ভালোই হয়েছে। তোকে দিয়েই সকালের জলখাবারটা সেরে নিই।
ছাগল বলল—চেহারা দেখছো না আমার? তোমার এক গ্রাসের খাবার আমি? কী এমন লাভ হবে আমাকে খেয়ে?
বাঘ হেসে উঠল—ছোট বলে ছেড়ে দেব না কি?
--বড় পেলে, ছোটকে ছাড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। একটু সবুর করো। খানিক বাদেই আমার মেজো ভাই আসছে। সে কিন্তু আমার চেয়ে মোটা। তাতে কিন্তু লাভই হবে তোমার।
🍂
আরও পড়ুন 👇
--বাহ, সে তো বেশ ভালো কথা। এখন তোকে খাই। একটু বাদে তোর ভাইকে খাবো।।
-- কী বোকা, কী বোকা! ছাগল বলল—আমাকে খেলে, সে কি আর এ পথ দিয়ে আসবে না কি?
বাঘ মুরুব্বির মতো মাথা নেড়ে বলল—তা আবশ্য ঠিকই বলেছিস। যা তাহলে। কিন্তু তোর সে ভাই যদি না আসে?
--তাতেই বা তোমার ক্ষতি কী? বিকেল বেলা আমাকে তো এ পথেই ফিরতে হবে। তখন আমাকেই খেয়ে নিয়ো তুমি।
বাঘ বলল—ঠিক ঠিক। তাহলে, চলে যা তুই। তোর ভাই আসুক। ততক্ষণ আর একটু গড়িয়ে নিই।
মেজো আর বড় তো আড়ালে লুকিয়ে পুরোটা দেখছে, আর শুনছেও। ছোটর কথাবার্তায় দুজনেই বেশ খুশি। যেমনটা বলে দেওয়া হয়েছিল, ঠিকঠাক বলতে পেরেছে। এবার মেজো ছাগলটা এগিয়ে গেল।
বাঘ গিয়েছিল একটু গড়িয়ে নেবে বলে। খানিক বাদেই মাচার শব্দ কানে গেল তার। বাঘ হেঁকে উঠল—কে উঠেছে আমার সাঁকোয়?
ছাগল বলল— টিন-টিন-টিন। টিন-টিন-টিন। যাই তো আমি প্রতিদিন।
বাঘ বিরক্ত—গান শোনাতে হবে না। আমিটা কে? নাম বল।
ছাগল বলল— রাজা, তোমার নাই কি জানা? আমি মেজো ছাগল ছানা।
শুনে বাঘ বেশ খুশি। সত্যিই তাহলে এসেছে মেজোটা। বলল—একটু দাঁড়া। আসছি আমি।
বাইরে এসে, একেও এক পলক দেখে নিল বাঘ। বলল—ঠিক। একটু বাড়তি মাংস আছে তোর। তোকে দিয়েই সকালের জলখাবারটা সেরে নিই।
ছাগল বলল—চেহারা দেখছো না আমার? তোমার এক গ্রাস খাবারও হবো না। কী এমন লাভ হবে আমাকে খেয়ে?
বাঘ হেসে উঠল—তাই বলে ছেড়ে দেব না কি?
--বড় পেলে, ছোটকে ছাড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। একটু সবুর করো। খানিক বাদেই আমার বড় ভাই আসছে। ইয়া তাগড়াই শরীর তার। তাতে কিন্তু লাভই হবে তোমার। চিবিয়ে সুখ পাবে।
--বাহ, তাই না কি? সে তো বেশ ভালো কথা। এখন তোকে খাই। একটু বাদে তোর বড় ভাইকে খাবো।।
-- কী বোকা, কী বোকা! ছাগল বলল— বড় তো এই এল বলে। আমাকে খেয়েছ দেখলে, সে কি আর দাঁড়াবে এখানে? লম্বা ছুটে পগার পার হয়ে যাবে।
বাঘ মুরুব্বির মতো মাথা নেড়ে বলল—তা আবশ্য ঠিকই বলেছিস। যা তাহলে। কিন্তু তোর বড়ভাই যদি না আসে?
--তাতেও তোমার ক্ষতি নাই। বিকেল বেলা আমি তো এ পথেই ফিরব। তখন আমাকেই খেয়ে নিয়ো।
বাঘ বলল— বাহ, ভালো কথা বলেছিস। চলে যা তাহলে। বড়ভাইটা আসুক। ততক্ষণ আর একটু গড়িয়ে নিই।
বড় তো আড়াল থেকে দেখছিল। এবার সে এসে সাঁকোয় চড়েছে। তার চেহারা একটু ভারিই। মচ-মচ শব্দ কানে গিয়েছে বাঘের। নিশ্চয় বড় ছাগলটা এসেছে। গমগমে গলাইয় হাঁকড়ে উঠল-- কে উঠেছে আমার সাঁকোয়?
ছাগল বলল— টিন-টিন-টিন। টিন-টিন-টিন। যাই তো আমি প্রতিদিন।
বাঘ বিরক্ত—গান শোনাতে হবে না। আমিটা কে? নাম বল।
ছাগল বলল—কেন? রাজা তোমার নাই কি জানা? আমি তো বড় ছাগল ছানা।
শুনেই এক লাফে বাঘ বাইরে। এসেই এক ঝলক দেখে নিল বড়কে। চেহারাটা ভালোই আছে এর। বলল--ভালোই হয়েছে। তোকে দিয়েই সকালের জলখাবারটা সেরে নিই।
ছাগল বলল— সে না হয় খেয়ো। কিন্তু এখন ছেড়ে দাও। বিকেলে খেও বরং।
হাসি পেয়ে গেল বাঘের। বলল—কী যে বলিস। ছেড়ে দেব তোকে?
--ছেড়ে দিতে তো বলিনি আমি। ছাগল বলল-- ওপারে যাচ্ছি। খেয়ে দেয়ে নাদুস-নুদুসটি হয়ে আসি। তখন খেও আমাকে। দেখবে, তখন কিন্তু পেট ভরে যাবে তোমার। ঘুমও ভালো হবে সারা রাত।
কথাটা বেশ মনে ধরল বাঘের। মন্দ বলেনি। বলল—ঠিক আছে, যা এখন। তবে দেখিস, দেরি করিস না যেন। সূজ্জি ডুবে গেলে, খাবার অভ্যেস নেই আমার।
--নাগো, না। তার অনেক আগেই ফিরব। চিন্তা কোর না। বলে, ছাগল চলে গেল সাঁকো পার হয়ে।
ভাই দুটো অপেক্ষায় ছিল ওপারে। বড় ফিরতে, তাদের ভারি খুশি। বলল—এখন তো ছাড় পাওয়া গেল। কিন্তু ফেরার বেলা? তখন কী হবে?
--তখন আর বোকা বানাব না, বুঝলি। একেবারে অক্কা পাইয়ে ছাড়ব বাছাধনকে। বড় বলল-- এখন চল, পেট ভরে খাওয়া যাক। গায়ে একটু গতরও হোক। তার পর দেখাচ্ছি মজা ব্যাটাকে।
পেট ভরে খেয়েছে তিনজনে। ফেরার পথে, আবারও ছোটই প্রথমে সাঁকোয় চড়েছে। বাঘ বসে আছে হা-পিত্যেস করে। সে বলল—কে রে তুই? আমার সাঁকোয় চড়েছিস?
উত্তর এলো-- টিন-টিন-টিন। টিন-টিন-টিন। এ পথেই আমি ফিরি প্রতিদিন।
--তাতে কী হয়েছে? নামটা বল।
উত্তর এলো--রাজা, তোমার নাই কি মনে? আমি ছিলাম প্রথম জনে।
বাঘ বলল—খুব মনে আছে। আয়, এখন তোকেই খাই। খিদেয় আমার পেট চুঁই-চুঁই।
ছাগল বলল—আমার বাকি দু’ভাই তো এসে পড়ল বলে। তারা অনেক নাদুস-নুদুস। আমাকে খাচ্ছো দেখলে, তারা আর এ পথ মাড়াবে না কিন্তু।
--তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু তারা যদি এ পথে না-ই আসে, তখন? বাঘকে থামিয়ে দিয়ে ছোট বলল—তাহলে, আমি এখানেই জমা রইলাম। তখন আমাকেই খেয়ো।
বাঘ ভারি খুশি। বলল-- বলিহারি বুদ্ধি তো তোর। স্বভাবটিও বেশ ভালো। ঠিক আছে, বোস এখানে।
ওপারে আড়ালে থেকে সব দেখছিল বাকি দুজন। ছোট রেহাই পেয়েছে দেখে, মেজোটা সাঁকোয় চড়েছে। বাঘ বলল-- কে রে তুই? আমার সাঁকোয় চড়েছিস?
উত্তর এলো-- টিন-টিন-টিন। টিন-টিন-টিন। এ পথেই আমি ফিরি প্রতিদিন।
--তাতে কী হয়েছে? নামটা বল।
উত্তর এলো--রাজা, তোমার নাই কি মনে? আমি ছিলাম দ্বিতীয় জনে।
সাঁকো পার হয়ে নেমেছে, বাঘ মেজোকে বলল—আর দেরি সয় না। আয়, এখন তোকেই খাই। খিদেয় আমার পেট চুঁই-চুঁই।
মেজো ভয় পেলো না। বলল—চেয়ে দ্যাখো, আমাদের বড়ভাই সাঁকোয় চড়ছে ওপারে। খেলে, তাকেই খাও। একেবারে নাদুস-নুদুসটি হয়েছে খেয়ে খেয়ে। আনন্দ পাবে খেয়ে।
--আর, যদি না আসে? বাঘকে থামিয়ে, মেজো বলল—তাহলে, আমিও জমা রইলাম তোমার এখানে। আমাকেও খেয়ো।
ততক্ষণে বড় উঠে পড়েছে সাঁকোয়। বাঘ বলল—কে রে তুই? আমার সাঁকোয় চড়েছিস। বড় জবাব দিল টিন-টিন-টিন। টিন-টিন-টিন। এ পথেই আমি ফিরি প্রতিদিন।
--তাতে কী হয়েছে? নামটা বল।
উত্তর এলো--রাজা, তোমার নাই কি মনে? আমি ছিলাম শেষের জনে।
বড়র নাম শুনে, বাঘের তো আনন্দ ধরে না মনে। লম্বা জিভ বাঘের। সেটা বার করে, গোঁফ চাটতে লেগেছে। বলল—তাড়াতাড়ি আয়, হতভাগা। সেই সকাল থেকে চোখ আর কান খুলে, বসে আছি তোর জন্য।
ছাগলটা ঘাবড়াল না। ভড়কাল না। গলা তুলে বলল—আমিও তৈরি হয়েই এসেছি তোমার জন্য। তোমার ঐ চোখ দুটো উপড়ে, কানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেব আমি। আজই ভবলীলা শেষ করে দেব তোমার।
বাঘের মাথায় ঢুকল না কথাগুলো। কী বলছে ছাগলটা? বনের রাজাকে এমন কথা বলে, সারা বনে কেউ কোনদিন ছিল না কি? আর, আজ একটা ছাগল কি না …
বাঘ অবাক হয়ে ভাবতে লেগেছে, ততক্ষণে ছাগল দিয়েছে এক লাফ। পাহাড়ি ছাগল সে। মাথায় দুখানা লম্বা শিং তাদের। যেমন প্যাঁচানো, তেমনি শক্ত। এক গুঁতোয় শিং দুটো গেঁথে দিয়েছে বাঘের চোখ দুটোতে। আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলে বাঘের চোখ। এক হ্যাঁচকায় ছিটকে বেরিয়ে গেল সেগুলো।
সাথে সাথে বাকি দুটো ছাগলও মোকাবিলায় নেমে পড়েছে। তিন ছাগলের শিংয়ের খোঁচায় খোঁচায়, বাঘের পেট ফুটিফাটা। নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এক্টু বাদেই বাঘ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেল। হায়রে, পেটের খিদে পেটেই রয়ে গেল বেচারার।
0 Comments