পর্ব- ২৯
স্বপন কুমার দে
'সুখবরটা' বস্তিতে চাউর হতে বেশি সময় লাগল না। বম্ব ফাটার আওয়াজ আর লোকের হট্টরোলে বাড়িতে বাড়িতে কথাটা পৌঁছে গেল, মল্লিকাও শুনল।
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লেগে গেল। আসল কথা আর গুজব মিলেমিশে এমন একটা চেহারা নিয়েছে যে, তখন সুজনকে দেবদূত মনে হল। প্রত্যেকের পাকা বাড়ি, সঙ্গে দু'লাখ টাকা-- আবেগে ভাসছে গোটা পাড়া। দু'চারজনের কথা মিলিয়ে মিলিয়ে মল্লিকা প্রকৃত সত্যটা অনুভব করল। বস্তি উচ্ছেদ, পুনর্বাসনের নামে মিথ্যা প্রতারণা, শহর থেকে খেদিয়ে দেওয়া। শরীরের শিরা উপশিরায় এতক্ষণে আগুন ধরে গেল। কূট কৌশলী সুজনের শয়তানি বুদ্ধিতে যে ফাঁদ পাতা হয়েছে, তাতে মাথা গলাচ্ছে বস্তিবাসী। মল্লিকা ভাবল, শয়তানের মুখোশ খুলে দিতে হবে, বস্তিবাসীদের বাঁচাতে হবে। তবে এখনই কিছু করা চলবে না। এখন নেশামত্ত লোকগুলোর কাছে সুজন ভগবান। এখন বলতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। সকাল হোক, তাদের বোঝাতে হবে, ঠাণ্ডা মাথায় লাভ ক্ষতির হিসাব তুলে ধরতে হবে। নিজেদের ভালোমন্দ, নিজেদের অধিকার ওদের জানাতে হবে। এভাবে বিকিয়ে যাওয়া চলবে না। ভেবে ভেবে রাতে ভালো ঘুমই হলনা তার।
পরদিন সকাল হল নির্দিষ্ট সময়েই কিন্তু আনন্দ উৎসবে যোগদানকারী পুরুষদের এখনও ঘুম ভাঙেনি। মল্লিকার সকালবেলার ঘরের কাজ সারা হয়ে গেছে। সে শুধু অপেক্ষায় আছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। রাস্তার ট্যাপ কলে জল এসেছে, এখনই ভিড় জমবে। দেখতে দেখতে ভিড় হচ্ছে। মল্লিকা শুরু করল," ও কাকিমা, শুনছি নাকি আমাদের সবার পাকা বাড়ি হবে। আর কোনও চিন্তা নেই।"
কাকিমা ব্যস্ততার মাঝেও উত্তর দেন," হ্যাঁ গো বাছা, তোমার কাকু তো তাই বলল।"
" এখানটা তাহলে আমাদের ছাড়তে হবে ?"
" তা আর কী করা যায়? তাছাড়া তো উপায় নেই।"
" যেখানটায় যাচ্ছো, সেই জায়গাটা কি তোমরা কেউ দেখেছো?"
" কেন, দেখার আর কী আছে বাপু? সুজনবাবু কি আমাদের খারাপ জায়গায় বাড়ি করবে নাকি?" পাশ থেকে নেপুর বউ নথ দুলিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল।
মল্লিকা নেপুর বউয়ের দিকে চেয়ে একটু হাসল," না বৌদি, আসলে আমি বলতে চাইছি, যে আমাদের যে কারও একবার দেখার দরকার আছে। ধরো, এই যে আমাদের এখানে জল, বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে বা একটু পা বাড়ালেই বাজার, স্কুল, হসপিটালের সুবিধা পাচ্ছি, তা সেখান থেকেও এগুলো পাবো তো? তাছাড়াও সেখানকার রাস্তাঘাট কেমন, জায়গাটা কতদূরে, সেটাও তো জানা দরকার।"
🍂
আরও পড়ুন 👇
নেপুর বউ একথায় মনে হয় সন্তুষ্ট হল না। সে ফিসফিস করে পাশের বউ মানুষটিকে কী যেন একটা কথা বলল। দোলা পিসি বলল," মল্লিকা যেটা বলছে, সেটা কিন্তু একেবারেই ফেলে দেওয়ার নয়। বাড়ির ছেলেদের এটা বলা দরকার।"মল্লিকা এবার থামল না," শুধু তাই নয়, আমাদের এই বস্তির দাম কয়েক কোটি টাকা। বস্তির মানুষগুলোকে এখান থেকে তুলে দিয়ে সুজনবাবুর মত প্রোমোটারেরা এখানে তৈরি করবে মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিংস। তা থেকে মুনাফা তুলবে কোটি কোটি টাকা। আর আমাদের নামমাত্র কিছু টাকা দিয়ে নতুন বাড়ির লোভ দেখিয়ে অতি সস্তায় বস্তিটা হাতিয়ে নিতে চাইছে। আমরা এখান থেকে সরে গেলেই তার আসল রূপটা দেখতে পাবে। তখন আর কপাল চাপড়ালেও কিচ্ছু করার থাকবে না।"
পাশাপাশি যারা ছিল, তারা ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে মল্লিকার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
" কাকিমা, জেঠিমা বা বৌদি, আপনাদের বলছি, আপনারা বাড়িতে গিয়ে বাড়ির পুরুষ মানুষদের বলুন। তাদের কাছে জানতে চান, এই বস্তিতে থেকে যার যে কাজ সহজে করতে পারছেন, ওখান থেকেও তা সহজে পারবেন কি? যারা টোটো, অটো চালান,, যারা পরের বাড়িতে বা দোকানে কাজ করেন, যারা চা অথবা পান দোকান করেন, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠান, তাদের সেই সুবিধা গুলো থাকবে কি? রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে এতগুলো লোক খাবে কী?"
মল্লিকার কথা এতক্ষণে তারা বুঝতে পেরেছে। জল বালতি নিয়ে যে যার ঘরে যায়।
মল্লিকার কথাগুলো এ কান ও কান হতে হতে ঘরে ঘরে পুরুষদের কানে পৌঁছাল। রাতের আনন্দ দিনের আলোয় কেমন যেন বিস্বাদ হয়ে গেল।
" মেয়েটা আমাদের একটু ভালো থাকতে দেবে না দেখছি। বড্ড বাড় বেড়েছে। এক্ষুনি ওকে শায়েস্তা করা দরকার, নয়তো একবার সুজনদার কানে কথাটা গেলে সব বানচাল হয়ে যাবে।"
ছেলে, ছোকরা, বুড়োরা একত্রিত হয়। সবাই রাগে ফুঁসছে। একটা বিহিত দরকার।
" কী ভেবেছে কী? একটু লেখাপড়া শিখেছে বলে আমাদের মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? জ্ঞান দিতে হলে অন্য কোথাও দিক।"
পাড়ার লোকের হাঁকাহাঁকিতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মল্লিকা। কোনোরকম ভূমিকা না করেই মাঝবয়সি দামোদর কুলা মল্লিকার কাছে জানতে চাইল," বলি, ব্যাপারখানা কী? সকাল সকাল পাড়ার মেয়েদের মাথায় কী বিষ ঢুকিয়েছো যে তারা আমাদের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করেছে। তুই কি কারও ভালো দেখতে পারিস না? নিজের তো সাতকূলে কেউ নেই, কোন্ দিন কোন্ নৌকায় ভেসে যাবি তার ঠিক নেই, আমাদের তো বউ ছেলেমেয়ে আছে। আমাদের যদি কেউ ভালোবেসে কিছু দিতে চায়, তাতে তোর আপত্তি কিসের? তুই সুজনকে দেখতে পারিস না, সেটা তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার, তার সঙ্গে আমাদের জড়াচ্ছিস কেন?"
মল্লিকা চুপ করে রইল। এইসব অসভ্য অমার্জিত কথার উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না।
ক্লাবের ছেলে শিন্টা বল," সুজনদা ভালো বলে তোকে এতদিন কিছু বলেনি এইবার কিছু হলে আমাদের কিছু বলতে পারবি না, এই বলে রাখলাম।"
আর থাকতে পারল না মল্লিকা," তার মানে তোমরা জানো, আমার কিছু হতে পারে? আমি তোমার পাড়ার মেয়ে না? এই পাড়ার মেয়েকে বাইরের কেউ অপমান করলে তোমাদের গায়ে লাগবে না? তোমরা কী ধরনের মানুষ?"
শিন্টার কথার মৃদু প্রতিবাদ শোনা যায় কিন্তু মূল প্রসঙ্গ থেকে কেউ নড়তে চায় না। সুজনের কথা মত সবাইকে এই বস্তি ছাড়তে হবে, এমনকি মল্লিকাকেও। মল্লিকা গর্জে ওঠে," তোমরা কে কী করবে জানি না, সেটা তোমাদের ব্যাপার কিন্তু আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না।"
" কী বেয়াড়া মেয়ে দেখেছো? সাতকূলে কেউ নেই, তার আবার এত মেজাজ!"
দু'একজন বৃদ্ধ সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা এতক্ষণ বলতে চেয়েছিল কিন্তু চিৎকারে তাদের গলার আওয়াজ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। এবার বৃদ্ধ জ্যোতি সামুই একটা কথাই বলল," আমিও এখানেই থাকবো, বস্তি ছাড়বো না। তোমরা কেউই এখন ওই মেয়েটার কথা বুঝতে পারছো না, পরে বুঝবে।"
উত্তরে শোনা গেল, "আমাদের হাতে কেউ কখনও দু'লাখ টাকা দিয়েছে? সুজনদা দেবে বলেছে। ঐ টাকা দিয়ে আমরা ছোট ছোট ব্যবসায় কাজে লাগাতে পারি, মেয়ের বিয়ে দিতে পারি, ছেলের জন্য ব্যাংকে জমাতে পারি।" অমূল্য টোটো চালায়, তার মাথায় এই ভাবনাগুলো জেগেছে।"
মল্লিকা বলে," ওই টাকাগুলো তো পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। বিনা পরিশ্রমের টাকা কি কখনও রাখা যায়? যেমন জলের তোড়ে আসে তেমনই জলের তোড়ে সব চলে যায়। কেউ বাইক কিনবে, কেউ চিটফান্ডে রাখবে, কেউ অপ্রয়োজনীয় বিনোদনে সব উড়িয়ে দেবে। এইরকম টাকা কেউ রাখতে পারেনি, আর পারবেও না।"
এ কথার সমর্থনও পাওয়া যায়," ঠিক কথা, আমার স্বামী গতবছর লটারিতে এক লাখ টাকা পেয়েছিল। দেখা গেল, পরের দিন থেকে তার লটারির টিকিট কেনা বেড়ে গেল। তিন চার মাসেই সব শেষ। রাখার মধ্যে একটা রঙিন টিভি কিনেছিল।" পাড়ারই এক মহিলার গলায় হতাশা ঝরে পড়ল।
মল্লিকা বলল," আপনারা ভাবুন। আমার কথা মানতে হবে না, আপনারাই ভাবুন।"
তখনকার মত ভিড় কেটে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দশ বারোটা বাইক আর জনা কুড়ি সঙ্গী নিয়ে পাড়ায় প্রবেশ ঘটল সুজনের। এবার আর ক্লাবে নয়, জটলাটা হল মল্লিকার বাড়ির সামনে। পাড়ার লোকেদের ডেকে সব কিছু বোঝাতে লাগল এবং কে পাড়ার ক্ষতি চায়, কেন চায়, তাও জোরে জোরে বলতে লাগল। শেষকালে সবাইকে জানিয়ে দিল," কাল উকিলবাবু কাগজপত্র নিয়ে আসবেন, তোমরা সবাই সই করে দেবে। পরশু থেকে তোমাদের বাড়ির কাজ শুরু হয়ে যাবে। যে সই করবে না, তার ব্যাপারটা আমরা বুঝে নেব।"
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলল," কাল হবে না, আরও দু'দিন সময় দাও,ভেবে দেখি।"
" ভেবে দেখি মানে? কাল সব কথা হয়ে গেল, আজকে কোন উটকো মহিলার কথা শুনে, ভেবে দেখি। কোনো কথা শুনবো না, কালই এ জমি আমার চাই।" সুজনের চোখ, মুখ এবং কথা বলার ধরণ বদলে গেছে। পাড়ার লোকেরা সুজনকে এরকমভাবে কখনও দেখেনি। কিন্তু ক্রমশ ওরা একটা বিষয়ে গোঁ ধরল, কাল সই হবে না।
0 Comments