জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬৯ /বিজন সাহা

ক্রেস্তভজদ্ভিঝেনস্কি সাবর

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬৯ 

বিজন সাহা 

রমানভ 


রমানভ-বরিসোগ্লেবস্ক নামে এই শহরটি ভোলগার দুই তীরেই অবস্থিত। এটা আসলে দুটো স্বাতন্ত্র্য শহরের সমন্বয়ে তৈরি তাদের আছে নিজস্ব প্রশাসন। বর্তমানে একে তুতায়েভ নামেও ডাকা হয় আর পুরানো ইতিহাস স্মরণ করে ভোলগার বাম তীরকে বলা হয় রমানভস্কি অঞ্চল। 

রমানভ শহরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ত্রয়োদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যখন উগলিচের যুবরাজ রোমান ভ্লাদিমিরভিচকে সেইন্টহুডে অভিষিক্ত করা হয়। আর তাঁর নামানুকরনে এই শহরের নামকরণ করা হয় বলে ধারণা করা হয়। গোল্ডেন হোর্ড ও নভগোরাদের উশকুইনিদের বিভিন্ন হামলার ফলে কাঠের তৈরি এই শহর একাধিক বার ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। সে সময় শহর রক্ষার প্রধান উপায় ছিল কাঠের তৈরি উঁচু দেয়াল। ১৩৪৫ সালে ইয়ারোস্লাভলের রাজা নিষ্ঠুর চোখা ভাসিলি দেভিদোভিচের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রোমান ভাসিলিয়েভিচ নতুন করে এই শহর তৈরি করেন এবং একে রমানভ রাজ্যের কেন্দ্রে পরিণত করেন। ১৪২৫ থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত চলমান জ্ঞাতি যুদ্ধে শহর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৪৬৮ সালে রানী মারিয়া ইয়ারোস্লাভনা নতুন করে রমানভস্কি ক্রেমলিন তৈরি করেন। শহরে ১৫ মিটার উঁচু বাঁধ ও খাদ, সেতু ইত্যাদি তৈরি হয়। এসব পরতিরক্ষা ব্যবস্থা ১৬২২ সালের অগ্নিকান্ডের আগে পর্যন্ত টিকে ছিল। ১৪৭২ সালে রানী নিজের পুত্র উগলিচ রাজ আন্দ্রেই বলশইকে রমানভ রাজ্য দান করেন, কিন্তু ১৪৯১ সালে আন্দ্রেই বন্দী হলে রোমানভ পাকাপাকি ভাবে মস্কো রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৪৬৮ সালের দিকে পরিব্রাজক আফানাসি নিকিতিন রমানভ ভ্রমণ করেন। ১৫৬৩ সালে ইভান গ্রজনির ইচ্ছাক্রমে বিরাট সংখ্যক নগাই ও তাতারদের ইয়ারস্লাভলে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন থেকে রমানভ পরবর্তী ২০০ বছরের জন্য নগাই শাসক মুরজাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। অনেকের মতে রুশ ভূমিতে তাতারদের স্থানান্তরিত করা ছিল এক ধরণের ঐতিহাসিক কৌতুক যার ফলে শুধু রমানভ নয় সমগ্র ইয়ারোস্লাভলে তাতারদের রাজ্যত্ব শুরু হয়। সে সময় রাষ্ট্র তাতারদের খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার পলিসি গ্রহণ করে। ১৭৬০ সালের ১৩ ডিসেম্বরের নির্দেশ অনুযায়ী রমানভের তাতাররা রাশিয়ান অর্থোডক্স ধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাদের কাস্ত্রমা এলাকায় নির্বাসন দেয়া হয়। তাতার মুরজাদের শাসনকালে রমানভে ইসলাম বিকশিত হয়। শহরের আশেপাশে মসজিদ তৈরি হতে থাকে। তবে যারা নিজ বিশ্বাসে অটল ছিল সেসব তাতারদের কাস্ত্রমা এলাকায় নির্বাসন দেওয়ার পরে রমানভের মসজিদগুলো সরিয়ে নেয়া হয়। তাতারদের বসবাসের ফলে রমানভ এলাকায় মেষপালন শুরু হয়। সপ্তদশ শতকের শুরুতে অরাজকতার সময়ে লুটপাট করে রমানভ শহর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এর পরে শুরু হয় নবজাগরণ। শহরে জাহাজ নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব জাহাজের নাম ছিল রমানভকি। এরা ছিল দ্রুতগামী। ১৭০৮ সালে রমানভ ইঙ্গেরমানল্যান্ড প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়, ১৭১৯ সালে সাঙ্কত পিতেরবুরগের পেশেখনস্কি প্রভিন্সে, ১৭২৭ সাল থেকে মস্কো প্রদেশের ইয়ারোস্লাভ প্রভিন্সের অন্তর্ভুক্ত হয় আর ১৭৭৭ সালে কাউন্টি শহরের মর্যাদা যায়। এ থেকে আমরা দেখি রমানভ দীর্ঘ সময় বিভিন্ন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতকে এখানে বেশ কিছু খ্যাতনামা গির্জা তৈরি করা হয়। গির্জার বাইরেও বনিকেরা পাথরের স্থাপনা তৈরি করে। সেই সময়ের বেশ কিছু স্থাপনা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে ১৯১২ সালে তৈরি ২৫ মিটার উঁচু ফায়ার টাওয়ার উল্লেখযোগ্য। 

কাজানস্কো-প্রিওব্রাঝেনস্কায়া গির্জা

রমানভ শহরের দেখার মত অনেক গির্জা আছে। ১৬৫৮ সালে ইয়ারোস্লাভলের শিল্পীরা তৈরি করে  ক্রেস্তভজদ্ভিঝেনস্কি সাবর আর এর দেয়ালে ছবি আঁকে ইয়ারোস্লাভল ও কস্ত্রমার শিল্পীরা।  সপ্তদশ শতকের কাঠের গির্জার স্থানে ১৭০৩ – ১৭০৪ সালে এখানে তৈরি স্পাসস্কায়া গির্জা। ১৯৩৬ সালে স্তালিনের আমলে এই গির্জা ভেঙ্গে ফেলা হয়। সপ্তদশ শতকের কাঠের গির্জার জায়গায় অষ্টদশ শতকে তৈরি হয় পাথরের ভস্ক্রেসেনস্কাইয়া গির্জা। এই গির্জাও সোভিয়েত আমলে ভেঙ্গে এর  ইট বিভন্ন নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়। অষ্টদশ শতকের শুরুতে পাথর দিয়ে তৈরি করা হয় পাক্রভস্কায়া গির্জা। ১৭৪৬ – ১৭৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্পাসো – আরখানগেলস্কি গির্জা আর ১৭৫৮ সালে তৈরি হয় কাজানস্কো-প্রিওব্রাঝেনস্কায়া পাথরের গির্জা। ১৭৮৩ সালের তৈরি ত্রইস্কায়া গির্জা ১৯৩৬ সালে বন্ধ করে গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯০-২০০০ সালে সেই গির্জা পুনর্নির্মাণ করা হয়। ১৭৯৫ সালের তৈরি হয় ভজনিসেনস্কায়া বা লিওন্তেভস্কায়া গির্জা। ১৯১৪ সালে তৈরি হয় তিখন গির্জা যা ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত শাসনের রোষে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়।           

🍂

      ২০২৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আমরা এক দিনের সফরে সেখানে যাই। এটা ছিল স্থানীয় ট্র্যাভেল এজেন্সির আয়োজিত এক্সারশন। খুব ভোরে দুবনা থেকে রওনা হয়ে ইয়ারোস্লাভল ও রীবিনস্কের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত এই শহরে আমরা পৌঁছই দুপুর সাড়ে এগারোটায়। পথে রেল ক্রসিং-এ আমাদের গাড়ি থামে। হঠাৎ দেখি কয়লায় চলা ট্রেন। সেই ইঞ্জিন। ক্যামেরা বের করতে করতেই হুইসেল দিয়ে চলে গেল। পরে শুনেছি ইয়ারোস্লাভল রীবিনস্ক লাইনে এ রকম দু একটা ট্রেন চলে। আমরা যাই দুবনা থেকে বরিসোগ্লেবস্ক শহরে। সেখান থেকে ফেরি পার হয়ে পৌঁছই রমানভ শহরে। ভোলগা এখানে ৪০০ মিটার মত প্রশস্থ। ফেরি বাদেও আছে স্পীড বোট। নদীর রমানভ পার মানে বাম তীর বেশ উঁচু, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। গাছের পাতা ইতিমধ্যে লাল হলুদ সহ বিভিন্ন রং ধারণ করছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই মনোরম। বাস এপারে রেখে আমরা ফেরিতে চলে গেলাম রমানভ পাড়ে। আগেই বলে দিয়েছিল যে আমাদের প্রচুর হাঁটতে হবে আর অনেক ওঠানামা করতে হবে বাঁধ আর খাদে। তাই আমরা যেন আরামদায়ক জুতা পরে আসি।  

রমানভ আঞ্চলিক মিউজিয়ামে

সব দেখে মনে হল শহরের এই দিকটি অনেক বেশি শান্ত। অন্তত যেটুকু আমরা দেখেছি তা তাতে সেটাই মনে হয়েছে। বেশ কিছু সমান্তরাল রাস্তা। আর রাস্তার সাথে লম্বাকারে অবস্থান করছে অনেক খাদ ও বাঁধ, মনে হয় খাদ খুঁড়ে সেই মাটি দিয়েই পাশে উঁচু বাঁধ তৈরি হয়েছে। এসবই প্রাচীন কালের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এলাম ছোট্ট এক সেতুর কাছে। সেখান থেকে একটু দূরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মৃতিসৌধ। এর পাশেই ক্রেস্তভজদ্ভিঝেনস্কি সাবর। বাইরে থেকে বেশ সুন্দর। স্তালিনের আমলে ভেতরের সব কিছু তচনচ করে দেয়া হয়েছিল। এখন দেখে মনে হল কিছু কিছু কাজ চলছে, এর মধ্যেই চলছে প্রার্থনা। ভোলগা থেকে মিটার পঞ্চাশ ভেতরে অবস্থিত শ্বেত শুভ্র এই গির্জা। এরপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা গেলাম লেনিন স্কয়ারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক আগেই বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে, কিন্তু অন্তত স্কয়ার, স্ট্যাচু এসবের মধ্যে হলেও লেনিন ঝিল, লেনিন ঝিভ, লেনিন বুদেত ঝিত – মানে লেনিন ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। স্কয়ার সংলগ্ন পার্কে বসে আছেন মার্ক্স। সেখান থেকে আমরা গেলাম নদীর ধারে অবস্থিত কাজানস্কো-প্রিওব্রাঝেনস্কায়া গির্জায়। বাইরে থেকে সুন্দর দেখালেও ভেতরটা ফাঁকা, মনে হয় সোভিয়েত আমলে এটাও রক্ষা পায়নি। এখন চলছে পুনর্নির্মাণের কাজ। চারিদিকে তার চিহ্ন। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আরেকটি গির্জা যেখানে গেলে নাকি বুদ্ধি বাড়ে। এর স্থাপত্য অতি সাধারণ। সেখান থেকে ফেরার পথে দেখি আরও দুটো পুরানো গির্জা – এখনও কোন মতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সবার অজান্তে ওখানে গেলাম ছবি তুলতে। এদিকে লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে। রমানভ ছোট শহর। হুট করে ৫০ – ৬০ জন মানুষের একসাথে খাওয়ার ব্যবস্থা করা কষ্ট, তাই আগে থেকেই এসব অর্ডার করতে হয়, এজন্য থাকে নির্দিষ্ট সময়। তাই সবাই তাড়াহুড়ো করছে। গুলিয়া আমার অপেক্ষায়। তবে এই কোম্পানির সাথে আমি এর আগেও অনেকবার গিয়েছি। ওরা জানা আমার ছবি তোলার শখের কথা, তাই খুব একটা ঝামেলা করে না। তাছাড়া ৫০ এর বেশি এই গ্রুপে আমি শুধু একটা বিদেশী নই, একমাত্র পুরুষ। এসব এক্সারশনে সাধারণত যায় বয়স্ক মহিলারা, অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে আর আমার মত দুই এক জন। লাঞ্চের পর ছিল মিউজিয়াম। এখানে যেকোনো এক্সারশনে গেলে স্থানীয় আঞ্চলিক জাদুঘর দেখা একটা মাস্ট আইটেম। সেখানে ছিল আর্ট গ্যালারী, বিভিন্ন সময়ের স্থানীয় লোকজনদের ব্যবহৃত পোশাক ও গৃহস্থালির জিনিসপত্র। তবে শহরের এদিক সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরানো দালানকোঠা। গির্জাগুলোও অনাদরে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ এসব পুনর্নির্মাণ করলে এই রমানভ হবে মিউজিয়াম শহর যেমনটা সুজদাল। হয়তোবা এক সময় এসব হবে। কারণ ইউরোপ আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সুযোগ কমে যাওয়ায় রাশিয়ায় আভ্যন্তরীণ পর্যটন গতি পাচ্ছে। সেদিক থেকে আমার রমানভ ভ্রমণ ছিল আনন্দ বেদনায় ভরা। জানি না প্রাচীন বাড়িঘর আমাকে কেন এত টানে! এবার ফেরার পালা। আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম নদীর ধারে। পথে পড়ল এডমিরাল উশাকভের স্ট্যাচু। রাশিয়ার নৌ বাহিনীর বীরদের মধ্যে অন্যতম। তিনি এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এখান থেকে আমরা যাব বরিসোগ্লেবস্ক তীরে। সেই গল্প পরের পর্বে।   

তুতায়েভের ভিডিও 

https://youtu.be/oRLhfEiTlRU 

ছবিতে তুতায়েভ 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=274


Post a Comment

0 Comments