ক্ষণিক আলোকে
পুলককান্তি কর
দূর থেকে তোড়িকে লাগেজগুলো নিয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি একটু আড়ালে সরে গেল ইন্দ্রনীল। তোড়ি কি ওকে দেখতে পেল? আর পেলেই বা কী? সঙ্গে তো বরও রয়েছে। ওরা সেলিব্রিটি কাপ্ল; ব্যাপারটাই আলাদা। এই লাউঞ্জের মধ্যে অনেকেই তারিয়ে তারিয়ে দেখছে ওদের। দেখুক গে। ও একটা উল্টো দিকে মুখ করা সোফায় বসে মোবাইলটা খুট খুট করতে লাগলো কিছুক্ষণ। ওকে আরও ঘন্টা দেড়েক বসতে হবে এখানে। মুন্নাদা’র ফ্লাইট আসবে প্রায় ছ’টা নাগাদ। ও এলে তবেই বেরোনো। একা একা বসে থাকা যেমন বোরিং, তেমনি এমব্যারাসিং। হঠাৎ আড় চোখে তাকাতেই চোখে পড়ল তোড়িকে সবার সামনেই জড়িয়ে ধরে কপালের উপর একটা কিস্ দিল ওর বর ‘ঋতু-টু’। ও আসলে মিউজিক কম্পোজার। নাম ঋতুপর্ণ। ইন্ডাস্ট্রিতে এই জন্য ওকে সবাই ঋতু-টু বলে ডাকে। অপভ্রংশ হতে হতে এখন ওর নাম ঋটু। দৃশ্যটা দেখেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল ইন্দ্র’র। না হয় বাবা তুই আইন মাফিক বর, তাই বলে লোকজন মানামানি নেই? এই এত লোকের সামনে এইভাবে আবেগ প্রকাশ করার কোনও মানে হয়? কী দেখাতে চাস্ - সুখী দম্পতি? যতসব বিলিতি অনুকরণ! খানিকটা চুপচাপ বসার পর ভাবলো একটু ইউটিউবে গান শোনা যাক। ওর প্রিয় গানগুলো সব ইউটিউবের অফলাইনে ডাউনলোড করা থাকে। হেড ফোনটা লাগিয়ে চুপ করে চোখ বন্ধ করে সে গানেই মন দিল। বেশ খানিকক্ষণ বাদে ওর হাতের চেটোতে একটা নরম স্পর্শ অনুভব করে চোখ মেলে দেখল - পাশেই তোড়ি। বলল - ‘কী ব্যাপার, এখানে?’
- আকাশ থেকে পোড়ো না ইন্দ্র। আমি দেখেছি তুমি আমাকে দেখেছ। আমাকে দেখেই তো লুকিয়ে পড়লে!
- লুকিয়ে পড়ব কেন? আমি চোর না ডাকাত?
- চোর ডাকাত হলেই শুধু লুকোতে হয় বুঝি? মানুষ অনেক সিচুয়েশন ফেস করতে চায় না বলেও তো আড়াল খোঁজে!
- এইটা ঠিক শব্দ বলতে পারো। ‘লুকোনো’ বলো না। আর তাছাড়া তোমাকে ফেস করতে কি আমি ভয় পাই?
- এত তেরিয়া হয়ে কথা বলছো কেন ইন্দ্র? মেজাজ ঠিক নেই? আমি শুধু বলতে চাইছিলাম ঋতু’র সাথে আমাকে তোমার দেখতে ভালো নাও লাগতে পারে, তাই! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
- তা তোমার বরকে ফেলে এদিকে চলে এলে যে? বর কিছু মনে করবে না?
- না, না। ও বেরিয়ে গেল। ওর একটা রেকর্ডিং আছে আজ। চারটে থেকে স্টুডিও বুক করা আছে।
- তুমি সাথে গেলে না?
- না না, আমার রেকর্ডিং নেই। আমি লাগেজ নিয়ে বাড়ী ফিরব। তোমাকে দেখতে পেয়ে এদিকে চলে এলাম।
- তোমার লাগেজ কোথায়?
- এইতো! বলেই পাশের ট্রলিটা ইঙ্গিত করে দেখালো সে।
- তুমি যাবে কিসে? তোমার ড্রাইভার তো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে বোধ হয়!
- ড্রাইভার ঋতু’কে নিয়ে গেছে। আমি ক্যাব বা প্রিপেড করে চলে যাবো। তুমি অযথা চিন্তা করো না। আমার কোনও তাড়া নেই। তা তুমি এখানে বসে আছো কেন?
- এইতো মুন্নাদা মুম্বাই থেকে ফিরবে চারটের ফ্লাইটে। এখানে ঢুকবে প্রায় ছ’টা। ওর সাথে একটা অ্যাপয়েনমেন্ট আছে।
- তা এয়ারপোর্টেই কেন?
- আসলে আমিও ফিরলাম ব্যাঙ্গালোর থেকে। ওখানে আমার প্রোগ্রাম ছিল তো! আবার যে যার কাজে বেরিয়ে যাবো, তাই এখানেই অ্যাপয়েনমেন্ট ঠিক হয়েছে।
- তুমি কি এখন মুন্নাদার সাথেই বাজাচ্ছ?
- না, না। ফ্রী ল্যান্সার। ব্যাঙ্গালোরে বাপনের সাথে কাজ করলাম। সামনে কতগুলো প্রোগ্রাম মুন্নাদা’র সাথে করবো ঠিক আছে।
- কী প্রোগ্রাম? লাইভ না রেকর্ডিং?
- লাইভ। আমেরিকা ট্যুরে যাচ্ছে মুন্নাদা। প্রায় আট-নটা স্টেজ শো আছে ওখানে। তা তোমরা কোত্থেকে?
- ভেলোরে গেছিলাম?
- কেন গো? কার কী হল?
- আমার সেই একটা ওভারিয়ান সিস্ট ছিল না? ওটা এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। প্রায় দিনই ব্লিডিং, পেটে ব্যথা। প্রোগ্রাম ফোগ্রাম সব তো লাটে উঠেছে!
- সে কী? ডাক্তার কী বলল?
- বললো শিগ্গির অপারেশন করা দরকার। তখন বায়োপসি করে দেখতে হবে খারাপ কিছু কিনা! যা ব্লিডিং হয়, আমার তো মনে হয় ক্যান্সার হয়ে গ্যাছে।
- তুমি তো আবার বেশী বেশী বোঝ! অকারণ চিন্তা করো’না তোড়ি, ভেলোর খুব ভালো জায়গা। তাড়াতাড়ি বরং অপারেশনটা করিয়ে নাও।
- কীভাবে করবো এখন? সামনে পুজো। প্রায় দু-মাস পুরো বুকিং। ঋতুরও রেকর্ডিং এর চাপ।
- এখন আর লোকে পুজোর গান শোনে নাকি? হাল্কা আওয়াজ দিল ইন্দ্র।
🍂
আরও পড়ুন 👇
- লোকে না শুনুক। গায়ক গায়িকারা তো পূজোয় একটা সিডি না রিলিজ করতে পারলে শান্তি পায় না! অতএব এখন অসম্ভব।
- রোগকে গাড়ানো কী তাই বলে উচিৎ হবে তোড়ি? আগে শরীর, তবে অন্যকিছু। খুবই উদ্বিগ্ন শোনালো ইন্দ্রের গলা। বলল - ‘তাছাড়া এত এত প্রোগ্রাম নিয়েছ, তুমি এই শরীর নিয়ে টানতে পারবে তো?
- সেই তো ভাবছি ইন্দ্র। বেশীরভাগই তো মাচা’র প্রোগ্রাম, নেচে কুদে গাইতে হয়।
- তুমি ঋটুকে বলো, সব ক্যান্সেল করে এখনই অপারেশনটা করাক।
- না ইন্দ্র। সম্ভব নয়। ওর এখন অনেক প্রেসার।
- ঠিক আছে, ও ওর কাজ করুক। তুমি তোমার প্রোগ্রামগুলো ছেড়ে দাও। ডেট নিয়ে নাও ডাক্তারবাবুর কাছে। তুমি চাইলে আমি নিয়ে যেতে পারি। অবশ্য যদি তাতে কোনও অসুবিধা না হয়।
- থ্যাঙ্ক ইউ ইন্দ্র, ফর ইয়োর কনসার্ণ। কিন্তু তোমার নিজেরও ওসময় প্রোগ্রাম আছে বললে না?
- সে তো ফাইনাল হবে আজকে, মুন্নাদা এলে। আর হলেই বা কি, না বলতে কতক্ষণ!
- বুঝতেই তো পারছো, ঋতুকে ছাড়া যাওয়াটা ঠিক দেখাবে না।
- তাহলে বুবুকে বলি। ও আর ওর হাজব্যান্ড নিয়ে যাক তোমাকে?
- না ইন্দ্র। এক্স হাজব্যান্ডের বোন আর ভগ্নিপতি তাদের এক্স বউদিকে অপারেশন করাতে ভেলোর নিয়ে যাচ্ছে - মিডিয়া ছেড়ে দেবে ভাবছো? অন্য গল্প খুঁজবে এর ভেতর।
- এটাতো গোপন বিষয় তোড়ি? এর মধ্যে মিডিয়া নাক গলাবে কেন, তোমারই বা এন্টারটেইন করবে কেন?
- এখন তোড়ি চক্রবর্তী কি সাধারণ কেউ ইন্দ্র?
হঠাৎ করে কথাটা গিয়ে বিধঁলো ইন্দ্রের মনে। তোড়ি কি তার সাথে দাম্পত্যের সময়টাকে বলতে চাইছে? তোড়ি তখন ছোট খাটো প্রোগ্রাম করে বেড়ায় কলেজের সোস্যালে বা পূজোর প্যান্ডেলে। ওরা একটা অর্কেস্ট্রা গ্রুপ বানিয়ে ছিল। মূলত ইন্দ্রই ছিল ওর মালিক প্লাস অর্গানাইজার। অনেক ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতো সে। যেমন স্ট্রিং ইন্সট্রুমেন্ট, তেমনি বাজনা। ড্রাম, তবলা, খোল সমান তালে বাজাতে পারতো। এখন ইন্ডাস্ট্রিতে যদিও তার ড্রামার হিসাবে পরিচিতি, কিন্তু অনায়াসে অন্য কিছুতে তার নাম হতেই পারতো। তখন এক একটা প্রোগ্রাম করে সাত-আট হাজার টাকা ম্যাক্সিমাম পাওয়া যেত। ইন্দ্র যখন তোড়িকে বিয়ে করে, তখন ইন্দ্রের বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। বিভিন্ন শিল্পির গান সে হিন্দিই হোক বা বাংলা – গাইতো তোড়ি। ওর নাম ছিল তখন ‘মিস ব্যারি’। হঠাৎ এমন নাম যে কেন হয়েছিল মনে নেই তার। তখন তোড়ি ছিল ‘ভাদুড়ি’। বিয়ের পর ইন্দ্রই প্রথম ‘তোড়ি চক্রবর্তী’ নামে একটি সি.ডি. বার করাল ওর রবীন্দ্রসঙ্গীতের। যন্ত্রানুষঙ্গ পরিচালনা করল সে নিজেই। তখন থেকে আস্তে আস্তে একটা জমি তৈরী হল তোড়ির। এখন তোড়ি চক্রবর্তী নামটাই একটা ব্র্যান্ড। ঋতুর সাথে বিয়ের পরেও তোড়ি ‘চক্রবর্তী’-ই লেখে। পদবী বদল করেনি এখনও। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে অন্য ধারার গান গাইলেও তোড়ি মূলতঃ রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পি। ইন্দ্র বলল - ‘তোড়ি চক্রবর্তী তো কখনও সাধারণ ছিল না তোড়ি! আজ সাধারন মানুষ সেটা বুঝতে পেরেছে এই যা!’
তোড়ি কিছু না বলে ওর বাঁ হাতটা দিয়ে ইন্দ্রের হাঁটুর উপর একটু চাপ দিল।
ইন্দ্র বলল,‘অসাধারণ হলেই সব কিছু মিডিয়ার হাতে তুলে দিতে হয় না তোড়ি? তোমার মনে রাখা উচিৎ মিডিয়া তোমার জন্য, তুমি মিডিয়ার জন্য নও।’
- তোমার কি মনে হয়, খবর আমরাই লিক করি, মিডিয়া আমাদের করে না?
- করলে করুক। যারা এসব পেজ থ্রি কভার করে সবাইকে তুমি চেনো, একদিন ডেকে কড়কে দেবে।
- তাহলে তো হয়ে গেল ইন্দ্র, দুদিনেই বেলুন ফটাস্।
- ছিঃ তোড়ি। তোমার কনফিডেন্স এখন এই জায়গায়? তুমি যে জায়গায় পৌঁছে গেছো, তোমার এখনও মিডিয়ার সাপোর্টের প্রয়োজন?
- সাপোর্ট না করুক, পেছনে লাগলে মুশকিল।
- পেছনে লাগবে কেন? তুমি অপারেশনের খবর ছাপতে বারণ করেছো বলে? দ্যাখো তোড়ি, সবসময় মিডিয়া পেজ-থ্রি’র পেছনে ছুটো না, এতে নিজের পূর্ণতা আসে না। যা হোক, কিছু মনে ক’রো না – এসব বললাম বলে।
- আরে না না, আমি জানি আমার জীবনে তোমার থেকে বড় ওয়েল উইশার এবং সত্যিকারের সমালোচক নেই।
- এখন কী গান করছো লেটেস্ট?
- ওই তো দুটো ফিল্মের গান করলাম - একটা ঋতুর’ই সুর করা, একটা রণজয়ের। রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও অ্যালবাম বেরোবে একটা এইবার পুজোয়।
- কী কী গান আছে অ্যালবামে?
- এবার বাচ্চাদের নাচের গানই করেছি। এর নাকি বাজার ভালো?
- তোমার গলায় রবীন্দ্রনাথের বিষাদের গান গুলোই খুলতো। সে সব গাও না?
- হ্যাঁ গাই তো! রেকর্ডও আছে। ইউটিউবেও আপলোড করেছি। তুমি শোননি?
- তেমন শোনা হয় না। বোঝোই তো ব্যস্ততা!
- আমার এখনকার একটা গানও শোননি তুমি?
- না, না তা শুনবো না কেন? রাস্তা ঘাটে তো আজকাল তোমার গানই বাজে। ওই যেটুকু কানে আসে।
- তাতে কী মনে হয় ইন্দ্র? গান কি খারাপ হয়েছে আগের থেকে?
- ওভাবে শুনে কি সমালোচনা করা যায় তোড়ি? সমালোচনা করতে হলে মন দিয়ে শুনতে হয়। স্থির হয়ে উপলব্ধি করতে হয়।
-এখন তুমি কী শুনছিলে ইয়ার ফোনে?
- ওই তো ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’! ঋতু গুহের গলায়।
- ওটা আমার গলায় একবার শোন ইন্দ্র। ভালো লাগবে।
- তোমার রেকর্ড, যেটা বাজারে চলে তাতে তো তুমি ‘আখর’ বিহীন গেয়েছো; তুমি হয়তো ভুলে গ্যাছো – আমি ওটা ‘আখরযুক্ত’ ভার্সানেই বেশী ভালোবাসি।
- আছে তো। তুমি ইউটিউবে সার্চ করো। দেখবে ওখানে আখরযুক্তই গাওয়া আছে। যেমনটা তুমি শুনতে ভালোবাসো, তেমনটাই গেয়েছি।
- আচ্ছা, শুনবো’খন।
- আচ্ছা ইন্দ্র, তুমি কি আবার বিয়ে করেছো?
- এই তোমাদের এক সমস্যা তোড়ি। তোমাদের সব খবর আমরা পেপার খুললেই পাই। কিন্তু আমরা সামান্য ইনস্ট্রুমেন্ট প্লেয়ার, আমাদের কথা তো পাবে না পেপারে! মজা করলো ইন্দ্র।
- বলো না!
- তোমার কি মনে হয় তোড়ি?
- করেছো। একজন গ্রামের সুন্দর সুশীলা গৃহবধূ যে ফাংশান করে রাত-দুপুরে বাড়ী ফিরে হুজ্জুতি করবে না, বরং খাবার সাজিয়ে বসে থাকবে, যত্ন করে রান্না করবে, বিছানা করবে।
- বাঃ! দারুন বর্ণনা করলে তো!
- না, মানে এসবই তুমি পছন্দ করো কিনা?
- আমি কোনওদিন কি তোমায় বলেছি যে গান ছেড়ে দাও, সংসার কর?
- তা বলোনি। তবে আমি বুঝতে পারতাম। এটা তো ঠিক, আমি কেরিয়ার সচেতন! এটা তুমি পছন্দ করতে না।
- আমি নিজে কি কেরিয়ারিস্টিক তোড়ি?
- একেবারেই নয়। না হলে তোমার যোগ্যতার লোককে এভাবে থাকতে হয় না!
- এভাবে মানে?
- আই মিন্ তোমারও অনেকখানি খ্যাতি পাওয়ার যোগ্যতা ছিল ইন্দ্র।
- আমি তো সেই নিয়ে কখনও আফসোস করিনি। আমি আজ যেমন আছি, তাতেই খুশি।
- এটা তুমি পারো ইন্দ্র, কিন্তু সকলে তো তোমার মতো নয়!
- আমার তো তাতেও আপত্তি নেই তোড়ি। প্রত্যেকের জীবন তার তার নিজের। প্রত্যেকের অধিকার আছে সে কীভাবে সামনের জীবন কাটাবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
- তা তুমি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছ ইন্দ্র? আমি কি ঠিক বলেছি?
- কোন কথাটা?
- এই যে তোমার বিয়ে নিয়ে?
- না। বিয়ে করিনি।
- কেন?
- ফালতু আর ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ তোড়ি? জানোই তো আমাদের জীবন। রাতের পর রাত বাড়ী ফিরতে ভোর হয়ে যায়! বাইরে ট্যুর থাকলে কথাই নেই। এভাবে দাম্পত্য চলে? যাকে বিয়ে করব, তারই বা কী দোষ বলো? অকারণ শাস্তি দেওয়া।
- এভাবে ভাবলে তো কোন সঙ্গীত শিল্পিরই বিয়ে হবে না!
- সবাই হয়তো ভাবে না। আমি ভাবি!
- তাহলে আমাকে বিয়ে করেছিলে কেন?
- তখন বুঝিনি তোড়ি। যৌবনের উন্মাদনা, তোমার রূপ, সবথেকে বড় কথা - তোমার গলার প্রতি প্রেমই তখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যৌবনে ভালো কিছুকে অধিকার করতে পারাটা একটা অ্যাচিভমেন্ট মনে হয়। তুমি যখন গাইতে আর লোকে সেই গানে আপ্লুত হয়ে যেত, আমি ভাবতাম – এই গলা আমার – এই দেহটা আমার – এই মানুষটা আমার। যখন তোমার আমার প্রতি মনোভাবটা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না, তখন ভাবতাম যে করে হোক তোমাকে জিততেই হবে। পাগলের মতো উজাড় করে দিতাম নিজেকে ড্রামে, নইলে তবলায়। একদিন তুমি আমার হলে – আমি কিন্তু সব পেয়ে গেছি বলে নিজেকে উজাড় করতে ছাড়িনি, বরং আরো বেশী মগ্ন হয়ে গেছি ধ্বনির তরঙ্গে।
- এখন তাহলে অনেক পরিণত হয়ে গেছ বলতে চাও?
- হয়তো হইনি ততটা – যতটা হতে চাই। তবে আগের থেকে চিন্তাটা অনেক বদলে গেছে স্বীকার করি।
- তুমি কি পুরোনো কথা একবারও মনে করো না ইন্দ্র?
- না। বেশ দৃঢ় শোনালো ইন্দ্রের গলা।
- খারাপ স্মৃতি না হয় নাই মনে রাখলে, ভালো স্মৃতিও কি আসে না?
- ভালো স্মৃতি এলে সাথে সাথে খারাপটাও তো আসবে? তখন তাকে ফেরাবে কী করে? এর থেকে দ্বাররুদ্ধ করে দাও সবকটাকেই।
- বাঃ! কিন্তু ইন্দ্র, আমার কিন্তু পুরোনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে। সেই একবার ঝাড়গ্রামে প্রোগ্রাম করতে গিয়ে কী মুশকিল পড়েছিলাম ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। তখন বিয়ে হয়েছিল না আমাদের। কি ‘নাইট’ ছিল যেন সেটার?
-মনে নেই। বোধ হয় বোম্বের কোনও আর্টিস্টের নামে নাইট ছিল।
-হ্যাঁ হ্যাঁ! শরীর খারাপ না কী একটা কারণে উনি সেদিন আসেননি। আমার প্রোগ্রাম চলছে। তখন রাত প্রায় দুটো। হঠাৎ করে যেন গুঞ্জন উঠল, উনি আসেননি। তারপর ক্রমাগত ঢিল এসে পড়তে লাগলো স্টেজে। আগুন ফাগুন লাগিয়ে একাকার কাণ্ড! তুমি তো প্রায় কোলে করে আমকে নিয়ে লুকিয়ে পড়লে কোথায়, তারপর ছুটতে ছুটতে কোনও এক বাগানে – মনে হচ্ছিল এই বুঝি কেউ মারতে এলো।
-কী বোকা ছিলাম আমরা! লোকের ক্রোধ তো আমাদের উপর ছিল না। মিছিমিছি পালাতে গেলাম। আসলে প্যানিক হয়ে গেছিল। ওই একটা ঢিল তোমার মাথায় এসে লাগতেই তুমি ‘মা-গো’ বলে বসে গেলে – আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। এখন আর এসব নাইট ফাইট হয় গ্রামে?
-হয় না নিশ্চই। হ’লে তো আমিও ডাক পেতাম।
-তুমি ডাক পাও না যখন, নিশ্চিত হয় না। মজা করল ইন্দ্র।
একটু চুপ থেকে তোড়ি বলল , ‘আমি ঋতুর সাথে কেমন আছি, কই জিজ্ঞাসা করলে না তো ইন্দ্র!’
- এসব জিজ্ঞাসা করার কী দরকার? ভালোই আছো নিশ্চই।
- দেখেই বুঝে গেলে?
- না, মিডিয়াতে তোমাদের খারাপ থাকার কথা লেখেনি এখনও। বরং মাঝে মাঝেই ছবি দেয় – কোথাও দুজনে জাজ্ হয়ে যাচ্ছো, কোনও হোটেলে পার্টিতে যাচ্ছো। কোনও পরকীয়ার কথাও তো কারও নামে চোখে পড়েনি মনে হচ্ছে।
- সবসময় মিডিয়া মিডিয়া করে আওয়াজ মারছ, আমি কি বুঝছি না ইন্দ্র? আওয়াজ দাও – ওটাকে আমি অস্বীকার করতে পারিনা।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তোড়ি আবার বলল, ‘আমি তোমায় খুব মনে করি ইন্দ্র, বিশেষ করে ঋতু যখন আমায় আদর করে’।
- থাক না তোড়ি। আমি তো এসব শুনতে চাইনা।
- কেন চাও না? তুমি নাকি অনেক পরিণত হয়েছো! আমাকে মনেও করো না – তাহলে নুনের ছিটে লাগছে কেন? খুব নির্দয় ভাবে বলল তোড়ি।
- শুনতে চাই না, এটা আমার এক্তিয়ার বহির্ভুত বলে। তোমার দাম্পত্যের তৃপ্তি বা অতৃপ্তি তোমার কাছেই থাক না তোড়ি। তুমি জানো না, আমি অন্যের ব্যক্তিগত সম্পর্কে নাক গলাই না?
- আমি কি অন্য কেউ ইন্দ্র?
- আমাকে যখন ছেড়েই চলে গেছো, তখন আর এই নিয়ে অভিমান করা তোমার সাজে না তোড়ি। তুমি ঋতুকে যদি আদৌ ভালোবেসে বিয়ে করে থাকো, তোমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তে অন্য কোনও পুরুষকে মনে করা বা তার সাথে মনে মনে তুলনা করাটা আদৌ যুক্তিসঙ্গত এবং রুচিকর নয় – বোধকরি সে বোধ উন্নতির সিঁড়ি চড়তে চড়তে তোমার খোওয়া যায়নি!
- সে তুমি যতই ছোটো করো ইন্দ্র, তোমার কাছে লজ্জা কি? ছোট তো তোমার কাছে হয়েই আছি। অতএব তোমাকে কোনও কিছু বলতে আমার দ্বিধা নেই।
- কেন বলতে চাও তোড়ি? যখন দেখছো আমার এবিষয়ে কোনও ইন্টারেষ্ট নেই?
- না থাকুক! তবু তোমাকে বলব।
- প্লিজ তোড়ি...
- আরে আমি তোমার জায়গায় থাকলে তো খুশীই হতাম ইন্দ্র, নখ বাজাতাম। মনে মনে বলতাম, দ্যাখ শালা কেমন লাগে! আমাকে ছেড়ে গেছিলি না? মজাটা টের পা...
- তুমি তো জানো, আমি তেমন নই। তোমার কষ্ট হলে আমার খারাপ লাগবে!
- এই যে বললে, আমার কোনও কিছুতে তোমার কিছু আসে যায় না?
- এ মা! এমন কথা কোথায় বললাম? আমি তো বললাম – পুরোনো বিষয় মনে করতে চাই না।
- তার মানে তো তাই হ’লো!
- কী আবোল তাবোল বলছ তোড়ি? মাথা কি খারাপ হয়ে গ্যাছে?
একটু চুপ করে থাকল তোড়ি। একটু বাদে ঘাড়ের কাছের চুলটা সরিয়ে বললো – ‘দ্যাখো এদিকে’!
- কী হয়েছে? কালশিটে কেন? পড়ে টড়ে গ্যাছো নাকি?
- না। ঋতু’র চিহ্ন। আরও অনেক আছে। এখানে দেখানো যাবে না।
- সে কী? ও মারধোর করে নাকি?
- না। সেসব নয়।
- তবে?
- ও ভীষণই পারভার্ট ইন্দ্র! তুমি আগে বলতে সৃষ্টিশীল মানুষেরা নাকি পারভার্টেড হয়! কই, তুমিও তো সৃষ্টিশীল! তুমি তো এমন ছিলে না? আমার মনে আছে ফুলশয্যার দিন থেকে প্রায় দশদিন পর্যন্ত তুমি আমাকে ছুঁয়েও দ্যাখো নি। আমিই বরং মনে মনে ভাবছিলাম, তোমার কোনও সমস্যা আছে কিনা! পরে তুমি বলেছিলে – সুগন্ধ পেতে হলে ফুলকে মেলতে দিতে হয়, পাপড়ি ছিঁড়ে দিলে হয় না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোড়ি।
কী ই বা বলবে ইন্দ্র। চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। মনে মনে ভাবলো – ডিভোর্স তো করে নিতেই পারে। না কি সাম্রাজ্য পতনের ভয়? কে জানে! মনটা বিষন্ন হয়ে গেল তার। বলল - ‘কফি খাবে?’
- খেলেই হয়।
- বসো, নিয়ে আসছি তাহলে।
ইন্দ্র ধীরে ধীরে উঠে গেল। ওর মোবাইলটা ওর সোফার পাশেই পড়ে আছে। তোড়ির মহিলা কৌতুহল জেগে উঠল। আগে ওর ছবিটা ইন্দ্রের স্ক্রীন সেভার ছিল, দেখি তো আছে কিনা? ইন্দ্রের মোবাইলে কখনও পাসওয়ার্ড থাকে না – ও ভুলে যায় বলে। এমনি সোয়াইপ করতেই খুলে গেল মোবাইলটা। না, স্ক্রীনে ‘ও’ নেই। শুধুমাত্র সবুজ সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে বিভিন্ন আইকনগুলো চোখ মেলে আছে। অন্যমনষ্কভাবে ইউটিউবে হাত গেল তার। অফলাইনটা এখনও খোলা আছে। চোখ কপালে উঠে গেল তোড়ির। কোথায় ঋতু গুহ? এ তো সব তারই গাওয়া গান! অধিকাংশই রবীন্দ্রসঙ্গীত, কিছু ফিল্মের গানও আছে। ইন্দ্রের প্রিয় যে গানগুলো অন্য শিল্পিদের গলায় আগে শুনতে ভালোবাসতো একটাও নেই লিস্টে! ও যখন এল, ইন্দ্র তার গাওয়া ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ গানটাই শুনছিল। মাঝপথেই আটকে আছে গানটি। প্লে দিতেই বেজে উঠল যেন সে নিজেই – ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে। ওহে হারাই হারাই সদা ভয় হয় হারাইয়া ফেলি চকিতে...
0 Comments