বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৩৬
পাট
ভাস্করব্রত পতি
'ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা
জমিজমা ঘরবাড়ি।
পাটের আড়ৎ ধানের গোলা
কারখানা আর রেলগাড়ী।
তার বেলা'?
-- খুকু ও খোকা, অন্নদাশঙ্কর রায়
সংস্কৃত শব্দ 'পট্ট' থেকে 'পাট' শব্দের উদ্ভব হয়েছে। যা শুধু পাট নয়, রেশম সহ অন্যান্য তন্তুকেও বোঝায়। মহাভারতে পট্টবস্ত্রের কথা পাওয়া যায়। 'আইন ই আকবরী'র ইংরেজি অনুবাদে (Jarret, 1590) পাটের তৈরি বস্ত্রের উল্লেখ মেলে। পাট ওড়িশায় 'জোত' বা 'ঝুটা' এবং বিহারে 'পাটুয়া' হিসেবে পরিচিত। এই ঝুটা থেকেই ইংরেজিতে এসেছে 'Jute'। কি ভাবে 'জুট' (Jute) শব্দটি এসেছে সে প্রসঙ্গে বি সি কুণ্ডু(১৯৫৯) লিখেছেন, "Roxburgh, the Superintendent of Botanic Garden, Sibpur, Howrah first used the word 'jute' in a letter dated 1795 addressed to the Court of Directors of the East India Company. It is probably the anglicised form of the word 'jhout' or 'jhot' used by the Oriya (people of Odisha) gardeners employed in the Botanic Garden. The first commercial mention of the word 'jute' is in the customs returns of the exports for 1828, when 364 cwt. of raw jute was sent to Europe. Towards the end of 18 th century, Roxburgh was engaged in search of a suitable substitute in India for the European hemp for the manufacture of cordage for the company's ships and as a cheap material for sacking. In 1793, he exported to England for the first time 100 tonnes of raw jute under the name of pat (Wallace, 1909). But in the begining of 19 th century, the word pat was completely superseded by jute in all commercial correspondence" (Watt, 1908)।
পাট ক্ষেত
বর্ষাকালে চাষ করা অন্যতম একটি উদ্ভিদ হল পাট। ঘন বর্ষা বা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত কখনও পাট চাষের অন্তরায় হয়না। এটি একসময় পশ্চিমবঙ্গের বুকে প্রচুর চাষ করা হলেও ইদানিং পাটের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা কমে যাওয়ায় চাষের পরিমাণ কমে গিয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু চাষী আজও চাষ করেন পাট। আসলে পাটের বিকল্প বাজারে এসে গিয়েছে। তাই পাটের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। একসময় অত্যন্ত ঐতিহ্যশালী এই পাট চাষ এবং পাটকে কেন্দ্র করে হুগলি নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য পাটকল। আজ সেসব ইতিহাস। 'সোনালী আঁশ' পাটের সোনালী দিনের সেই ঐতিহ্য আজ বিলীয়মান।
পাটের বিজ্ঞানসম্মত নাম Corchorus capsularis Linn। এটি Tiliaceae পরিবারের অন্তর্গত। পাটকে সংস্কৃতে বলে কলাসকা। বাংলায় বলে তিত্পাতা, নালতে এবং হিন্দীতে নারচা। তিক্তরসসম্পন্ন পাটের অপর নাম নাড়িক এবং নলিত। তারই লৌকিক নাম নালতে। একে ঘি নালিতা পাট বা নার্চাও (Corchorus capsularis) বলে। আমরা যাকে সাদা বা তিতা পাট বলি, বাংলাদেশে তা পাট ও কোষ্টা নামে পরিচিত। বগীপাট, গুটিপাট ও পশ্চিম আফ্রিকীয় সোরেলও বলা হয়। ললিত পাট, ভুঞ্জিপাট, বন পাট ইত্যাদি মিঠা পাট নামে পরিচিত (Corchorus olitorius, বা Jew's Mallow)। মুম্বাইতে 'হিরণখোরী' ও 'ভূপালি' নামে পরিচিত বন পাট বা বিল নালিতা (Corchorus fascicularis)। চট্টগ্রামে পাটকে 'নারিস' শাকও বলে। ভারতের উত্তর পশ্চিম রাজ্যগুলিতে বলে 'হরণা', ওড়িশায় 'কাউরিয়া', 'নালিতা' বা 'নস্করকানি কোষ্টা'।
তিতা বা সাদা পাটের জন্মভূমি ইন্দো বার্মা অঞ্চল এবং ভারত। কেউ কেউ বলেন, ভারতই হল পাটের আদি জন্মভূমি। তবে মিঠা বা তোসা পাটের আদি জন্মস্থান হল আফ্রিকা এবং ঘি নালিতা পাটের আদি জন্মস্থান চিন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গে দুই প্রজাতির পাট চাষের এলাকা সম্পর্কে নিত্যগোপাল মুখার্জী (১৯০১) উল্লেখ করেছেন- "The round fruited variety (the Corchorus capsularis) is more commouly grown, except in the districts round about Calcutta and in Midnapur where the long fruited variety (the Corchorus olitorius) prevails"। পশ্চিমবঙ্গে মোট ৫৬৭.২ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। মোট উৎপাদন হয় ৮৮০.৮৩ হাজার বেল (১ বেল = ১৮০ কেজি)। আর সবচেয়ে বেশি ১৫৪.৮ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় মুর্শিদাবাদে। এছাড়াও নদীয়ায় ১১৬.৭ হাজার হেক্টর, কোচবিহারে ৭২.৭ হাজার হেক্টর, উত্তর ২৪ পরগনায় ৫০.৭ হাজার হেক্টর, উত্তর দিনাজপুরে ৫০.৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়।
পৃথিবীতে ৩৬ রকমের পাট চাষ হয়। ভারতের বুকে ৮ রকমের পাট চাষের খোঁজ মেলে। মিঠা পাট, তিতা পাট ছাড়াও বাফুলি, বাফুল্লি, বাফালি, বাবুনা, মুধিরি, কুরাণ্ডু (Corchorus antichorus) পাটের চাষ হয়। উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ অঞ্চলের তরণীকান্ত বিশ্বাসের লেখা খন গানে পাই পাটের কথা --
'পাটবাড়ি চষিয়া, জমি কাদা করিয়া
গাড়নি দিলে ভালো তুলাই হয় গো'।
পশ্চিমবঙ্গের বুকে চাষ হওয়া তোষা পাটের প্রজাতিগুলি হল - জে আর ও ৫২৪ (নবীন), জে আর ও ৭৮৩৫ (বাসুদেব), জে আর ও ৮৭৮ (চৈতালী), জে আর ও ৬৬ (সূবর্ণজয়ন্তী তোষা), জে আর ও ৮৪৩২ (শক্তি তোষা), এন জে ৭০১০ (রাণী), কে আর ও ৪ (গৌরাঙ্গ), জে আর ও ২০৪ (সুরেন), এস ১৯ (সুবলা), সি ও ৫৮ (সৌরভ), জে আর ও জি ১ (রিথিকা), জে আর ও এম ১ (প্রদীপ), জে আর ও ১২৮ (সূর্য), জে আর ও ২০০৩ এইচ (ইরা), সি ও ৫৮ (সৌরভ), জে বিও ১ (সুধাংশু), জে আর ও ২৪০৭ (সমাপ্তি), জে আর ও ৬৩২ (বৈশাখী তোষা) এবং সাদা পাটের প্রজাতি হল জে আর সি ৩২১ (সোনালী), জে আর সি ৬৯৮ (শ্রাবন্তী), হাইব্রিড সি (পদ্মা) ও জে আর সি ২১২ (সবুজ সোনা), ইউ পি সি ৯৪ (রেশমা), জে আর সি ৭৪৪৭ (শ্যামলী), জে আর সি ৪৪৪৪ (বলদেব), জে সি সি ৫ (অর্পিতা), জে আর সি এম ২ (পার্থ), বি সি সি ২ (বিধান পাট ৫), জে আর সি ৯০৫৭ (ঈশানী), আর আর পি এস ২৭ সি ৩ (মোনালিসা) ইত্যাদি। পাটের কয়েকটি বিলুপ্ত প্রজাতির নাম হল দিয়াড়া বা দাওড়া, জঙ্গীপুরী, নারায়নগঞ্জী, বক্রাবাদী, দেশওয়াল, ভাটিয়াল, সিরাজগঞ্জী, উত্তরিয়া বা উত্তুরে, করিমগঞ্জী ইত্যাদি।
বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাট উৎপাদন হয় ভারতে। আর ভারতের বুকে পাট চাষের এলাকা ও উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ প্রথমের সারিতে। গত কয়েক বছরের গড় হিসেবে দেশের ৭৫% পাট চাষের এলাকা ও মোট ফলনের ৭৮% পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে।
২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী ঐ বছর ভারত ১৮,০৭,২৬৪ টন, বাংলাদেশ ৮,০৪,৫২০ টন, চীন ৩৬ টন, উজবেকিস্তান ১৯ টন, নেপাল ১০ টন পাট উৎপাদন করেছে। সারা বিশ্বে উৎপাদিত হয়েছে ২৬৮৮৯১২ টন পাট। আমাদের দেশের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির মধ্যেই পাটের চাষ সীমাবদ্ধ। আসলে এতদঞ্চলে মেলে এঁটেল দোআঁশ, বেলে দোআঁশ মাটি। যা কিনা পাট চাষের পক্ষে খুব উপযোগী। ভারতে বর্তমানে রয়েছে ৯৩ টি পাট শিল্প। এর মধ্যে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে আছে ৭০ টি। পাটের চাষ পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আসাম, বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ের মতো সাতটি রাজ্যের ৮৩ টি জেলায় পাট উৎপাদিত হয়।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় পূর্ববঙ্গ পৃথক হয়ে নতুন দেশ পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ। সেসময় পাট চাষ ও শিল্পের মধ্যে অমিল সম্পর্কে অমিয় কুমার ব্যানার্জী (১৯৭২) 'ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স: হুগলী' (West Bengal District Gazetteers: Hooghly) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, "With the partition of country in 1947, the main jute belt of undivided Bengal went to East Pakistan. This imbalance has since been largely overcome by expanding the cultivation of jute in the West Bengal districts (as also elsewhere in the country) and the Hooghly District plays an important role in this bid to self sufficiency which is instrumental in earning substantial foreign exchange for India"।
রাজ নিঘণ্টু ও ভাবপ্রকাশ গ্রন্থে পাটের উল্লেখ আছে --
'দ্বিবিধং পট্টশাকংতু তিন্তুকং মধুরং তথা।
কৃমি কুষ্ঠহরং তিক্তং রক্তপিত্ত জ্বরে হিতম্।
মধুরং পিচ্ছিলং শীতং বিষ্টম্ভি কফবাতকৃৎ।
নাড়িকং নলিতং চাপি তিক্তকস্যাপি নামতঃ'।।
অর্থাৎ পট্টশাক বা পাটপাতা দুই প্রকারের। একটির স্বাদ মধুর, একটির তেতো। মধুর রসসম্পন্ন পাট পিচ্ছিল, এবং শীতবীর্য, তবে পেটে একটু বায়ু করে এবং কফ ও বায়ুরোগের হিতকর নয়। কিন্তু তিক্তস্বাদের পাট রক্তপিত্ত রোগ দূর ক'রতে সহায়ক, অগ্ন্যুন্দীপক, আমাশয়, জ্বর প্রভৃতি পিত্তবিকারজাত রোগেও হিতকর। আর পাটশাকের তরকারি তো দারুণ সুস্বাদু এবং শরীরের পক্ষে উপকারী। প্রাচীন ভাঁড়যাত্রার পালাগানে পাই 'পাটশাক তোলা'। পাটশাকের রান্না নিয়ে প্রবাদে রয়েছে --
'কি শাক রেঁধেছিস্ খেঁদী, পাটশাকের ঝোল।
খেদা নাকের ঘড়ঘড়ানি পাড়ায় গণ্ডগোল'॥
আষাঢ় শ্রাবণ মাসে বর্ষার মরশুমে যেসব ছোটখাটো খালবিল, ডোবা, পানা জলমগ্ন থাকে সেখানে কাঁচা পাটের বাণ্ডিল ডুবিয়ে রেখে পচানো হয়। যাতে ঐ পাট পুরোপুরি জলের মধ্যে ডুবে থাকতে পারে, এজন্য পাটের বাণ্ডিলের উপরে ভারী কিছু চাপা দেওয়া হয়। সাধারণত কাদামাটির চাঙড় চাপা দেওয়া হয়। তবে এরফলে কিন্তু পাটের তন্তুর রঙ কালচে ধূষর হয়ে গিয়ে গুনগত মান কমিয়ে দেয়। জলের মধ্যে কয়েক দিন থাকলে কাঁচা পাট পচে যায়। পাট পচানোর এই পদ্ধতিকে বলে 'রিবন রেটিং'। এসময় পাটকে পচাতে সাহায্য করে এক বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া। কোথাও কোথাও পাট পচানোর জন্য 'ক্রাইজাক সোনা' নামে এক প্রকার জীবাণু পাউডার ব্যবহার করা হয়। এতে থাকা ব্যাকটেরিয়া ব্যাসিলাস পুমিলাস আই এম এ ইউ ৮০২২১, ব্যাসিলাস পুমিলাস এস ওয়াই বি সি ডাবলু এবং ব্যাসিলাস পুমিলাস জি ভি সি ১১ পাট পচানোর কাজকে দ্রুততর করে। পাট যেখানে পচানো হয়, সেখানে অদ্ভুত একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। এরফলে অবশ্য ওখানকার জল নষ্ট হয়ে যায়। তা ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়। কালো বর্ণের সেই জল অবশ্য বিষাক্ত। তাই যেসব পুকুরের জল দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয়, সেখানে পাট পচানো হয় না। পাটের ভেজা আঁশ রোদে শুকানো হয়। পাটকাঠিকেও রোদে মিলে শুকনো করে নিরাপদ স্থানে রাখা হয় ব্যবহারের জন্য। শরতের আকাশ উঁকি মারছে শুকোতে দেওয়া পাট তন্তুর সারিতে
পাটের আঁশ সাধারণত ১ - ৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এক একটি পাটের আঁশের কোষ ২ - ৬ মিলিমিটার লম্বা এবং ১৭ - ২০ মাইক্রণের হয়। পাটের মধ্যে থাকে Capsularin, Galacturonic Acid, Glycuronic Acid, Pectic Acid, Corchorin এবং Corchoritin। পাট থেকে চটের বস্তা সহ গেরস্থালির নানা সামগ্রী তৈরি হচ্ছে। পাট দিয়ে কার্পেট, পর্দা, কম্বল, বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, জুতা, ফুলদানি, শৌখিন সামগ্রী তৈরি হয়। পাটের শাড়ি একসময় বহুল প্রচলিত ছিল। মুকুন্দরামের 'চণ্ডী'তে আছে: 'পাট শাড়ী নিয়া মোরে দিল খুঞা...'। কৃষ্ণদাস কবিরাজের 'চৈতন্যচরিতামৃত'তে আছে -- 'চিত্রবর্ণ পট্টশাড়ী ভূণী পোতা পট্টপাড়ি.....'। প্রবাদে আছে -- 'গরু বিকায় ঠাটে / কাপড় বিকায় পাটে'।
পাটের আঁশ থেকে তৈরি হয় সূতলি দড়ি। যা দৈনন্দিন জীবনে খুবই কাজে লাগে। এই পাটের দড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের 'মনসার ভাসান', 'শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল', 'গোরক্ষবিজয়', 'চৈতন্যমঙ্গল', বিজয়গুপ্তের 'মনসামঙ্গল', দ্বিজ বংশীদাসের 'বিষহরি ও পদ্মাবতীর পাঁচালী'তে।
এছাড়াও পাট থেকে পাওয়া যায় পাট কাঠি। যা জ্বালানি হিসেবে খুব জনপ্রিয়। তাছাড়া এগুলো পান বরোজের বেড়া, আতশবাজি হিসেবে হাউইয়ের কাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একসময় চাষীরা শশা জমিতে পাটকাঠি পুঁতে রাখতো বড় বড় শশার পাশে। ফলে ভোররাতে শশা তোলার সময় সাদা পাটকাঠি দেখে সহজেই শশা খুঁজে পাওয়া যেতো। মড়া পোড়ানোর সময় 'ঝুলকাঠের বোঝা'র অন্যতম উপাদান হল পাটকাঠি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নৌকাযাত্রা' কবিতায় মেলে পাট পরিবহনের চিত্র --
'মধু মাঝির ঐ যে নৌকাখানা
বাঁধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে।
কারো কোনো কাজে লাগছে না তো
বোঝাই করা আছে কেবল পাটে'।।
0 Comments