পর্ব ১৭। বুড়ো হাড়ে ভেল্কিবাজি
বাসুদেব গুপ্ত
দাদুর ডেন এখান থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটারের মধ্যে। একটা ছোট দ্বীপ গজিয়ে উঠেছিল সুনামির পরে, সেখানেই উঁচু ইস্পাতের জালের বাউন্ডারীর মধ্যে আন্ডারগ্রাঊন্ডে থাকেন দাদু। খালি চোখে কিছুই দেখা যায় না শুধু কয়েকটি রকেট লঞ্চারের মত স্ট্রাকচার। আর কয়েকটি ক্যামেরা। বাউন্ডারীটাই একটা বিরাট এন্টেনার কাজ করে। তার মধ্যে দিয়ে ডাটা স্পীড ৬জি ২.৫ টেরাবিট/সেকেন্ড। সেই এন্টেনা দিয়ে অনির্বাণের মেসেজ পৌঁছল খ্যাপা বিশুর কাছে। মেসেজ ফিল্টার লাল আলো আর বিপ বিপ করে উঠতেই বোঝা গেল, একটা কিছু বিপদ হয়েছে, অনির্বাণ এখানে আসছে কিন্তু সতর্কবার্তার মানে হচ্ছে সঙ্গে আসছে কোন বড় এনিমি। এখনো সময় আছে ২০ ঘণ্টা মত। বিশু কাজে লেগে গেল।
ফাই ফরমাশ খাটার জন্য অনেক এ আই বিশুর কাজ করে। প্রথমেই মেসেজের লোকেশান সূত্রধর নামের এআইকে দেওয়া হল খোঁজ লাগাতে। জানা গেল এটা ১০ কিমির মধ্যে, এর লোকেশান স্ক্র্যাম্বলার দিয়ে ঘেঁটে দেওয়া হয়েছে। সেটাকে হ্যাক করতে সূত্রধরের লাগলো দশ মিনিট। এটা কম খাটনিতেই হয়ে গেল। এবারে স্কাইগারড এআইকে দেওয়া হল ঐ লোকেশানে গত দু তিন দিনের ট্রাফিক দেখে সন্দেহজনক কিছু থাকলে বার করতে। সময় লাগছে বলে বিশু এক কাপ কফিতে দু ড্রপ ভ্যানিলা দিয়ে আরাম করে বসলেন একটা লেজিবয়তে। এই রেসিপিটি নীপার পছন্দ ছিল। সে আজ ৩০ বছর আগেকার কথা। নীপার ছবি সাজানো চারদিকে। কোনটা আদিবাসীদের সঙ্গে নাচছে, কোথাও দুরগাপুজোর সিঁদুর খেলায় মুখ লালে লাল, কোথাও বাগানের একরাশ গাঁদা ফুলের সামনে একটা হলুদ শাড়ী পরে জল দিচ্ছে ঝাঁঝরি থেকে, চারপাশে আলোটাই কেমন হলুদ হয়ে গেছে। আর সবচেয়ে বড় ছবিটা একটা ফাঁকা মাঠের, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে নীপা হাত নাড়ছে, যেন কোথাও চলে যাচ্ছে, আর ফিরবে না। এই ছবিটা তোলার দু মাস পরেই সে অবশ্য না ফেরার দেশে চলে যায়। বিশু একটু মুচকি হাসে, কবেকার কথা। তারপর কাজ কাজ কাজ, ইলেক্ট্রনিক্স কম্পিউটার, এ আই, সারভিলান্স, ইন্ট্রিউডার ডিটেকশান, কাজের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে এখানে এসে থিতু। এখন কাজ আর কাজ নয়, কাজ শুধু খেলা। রোবট শিশুদের পার্ক বানাবার প্ল্যানটা এগোয় আবার থেমে যায়। কে জানে নীপা থাকলে কি বলত।
🍂
টিং করে একটা শব্দ হয়, স্কাইগারড পরদায় ভিডিও বানিয়ে দিয়েছে, সেটা দেখাতে থাকল। চারটে ড্রোনের একটা ফর্মেশান লুপ স্টেশন থেকে উড়ে সোজা চলে গেছে ঐ লোকেশনে, তার মধ্যে একটা ড্রোন বেশি ক্যাপাসিটি, তাতে মানুষ নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
বিশুর এমনিতে কোন আবেগের বালাই নেই, তবে এবারে একটু চিন্তা হল। অনিকে কেউ বন্দী করে এনেছে, আমার কাছে এন্ট্রি পাওয়ার জন্য। ও বুদ্ধিমান ছেলে, আর আমার কাছে এন্ট্রি পাওয়া পর্যন্ত ওর কিছু হবে না এটা নিশ্চিত। কিন্তু তার পর? আমার আর ওর দুজনেরই লাইফ রিস্ক। কিন্তু ওরা কে? কি চায়?
কি চায় ভাবতেই মাথায় একটা ঝিলিক খেলে গেল, কি চায় কি চায়? কী চায়। এক্সের Key । গোপীনাথ, গড, লাখমান, দু দিন আগেই অনির্বাণ সব জানিয়েছিল ও কতদূর এগিয়েছে, কি পেয়েছে, কিন্তু কি করে গডের কাছে পৌঁছবে বুঝতে পারছে না, সাহায্য চাই। এখন মনে হচ্ছে গড বা তার সাঙ্গোপাঙ্গোরাই পৌঁছে গেছে ওর কাছে।
একটা প্ল্যান করতে হবে। আর এরকম গোলমেলে ব্যাপারে বিশু সম্পূর্ণ নিজের মাথার ওপর আস্থা রেখে চলেন। এআই এখনো এতদূর এগোয় নি। কোন দিন পারবেও না হয়ত।
ঠিক আটটা পঞ্চাশে চারটে ড্রোন ছাড়ল। একটাতে অনির্বাণ হাত চেয়ারের সঙ্গে স্টীলের ক্লিপ দিয়ে আটকানো, কিছুতেই বেরোবে না, চেষ্টা করে দেখেছে। গোপীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। বাকী তিনটে ড্রোনের একটায় লাখমান, আর দুটোয় দুজন স্নাইপার। ড্রোনের কারিকুরি আকাশেই। মাটিতে নামলে এ দুজন কাজ দেবে।
চারটে ড্রোনই ল্যান্ড করল বিনা বাধায়। ঝপাঝপ করে নেমে এল যত্ন করে বোনা সবুজ ঘাসের গালিচায়। লাখমান হাঁটিয়ে নিয়ে চলল অনির্বাণকে এন্ট্রান্সের দিকে। পিঠে ছোঁয়ানো রইল লেসার রড। নীল ঝকঝকে আকাশ, আর চারদিকের ভেড়ির ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে হাওয়া। হাওয়ায় একটু মাছ মাছ গন্ধ। অনির্বাণ একবার মনে মনে ভেবে নিল ভেরাকে, আর দেখা হবে কিনা কে জানে। কিন্তু আশঙ্কা থেকেই গেল, দাদু মেসেজ পেয়ে বুঝেছে তো? নাকি রেটিনা স্ক্যান অন করে দিয়েছে, আমি দাঁড়ালেই দরজা খুলে যাবে? বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের শব্দ আসতে আসতে বাড়ছে। যত কাছে এগোচ্ছে, লেজার রডের চাপটাও যেন বাড়ছে। হয়ত দরজা খুলবে আর তখনি সব শেষ। ও মাই গড। ভেবে কেন জানি না এই সন্ত্রাসের মধ্যেও ওর হাসি পেয়ে গেল।
এক পা এক পা করে এগোচ্ছে আর ভয় বেড়ে চলেছে এক একটা করে পর্দা। ভয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে অনির্বাণ। জো ডর গয়া ও মর গয়া, দাদু বলত। এখন তার মানে বুঝতে পারছে। একটু একটু করে ঘাম বাড়ছে, হাত বেয়ে ঠান্ডা জলের মত নামছে, হাওয়ায় একটু একটু শীত করছে।
-রেটিনা স্ক্যানারের সামনে দাঁড়াও।
যেই গেট খুলবে তুক্ষুনি ওর আর এক হাতে লুকিয়ে রাখা স্মোক বম্বটা ছুড়ে দেবে লাখমান, সেরকম প্ল্যান। অনির্বাণ কিছুই জানে না। ও গিয়ে দাঁড়ালো রেটিনা স্ক্যানারের সামনে, একটু উপর দিকে সেটা আটকানো, শুধু একটা গোল ফুটো আর তার পাশে একটা স্ক্রীন, যেটা পাস বা ফেল জানিয়ে দেবে।
অনির্বাণ চোখ ওঠালো স্ক্যানিঙ্গের জন্য। কিন্তু ফুটোটা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা নীল গ্যাস। মুহূর্তের মধ্যে ও আর লাখম্যান জ্ঞান হারালো। ওদিকে পিছনে দুটি ড্রোনের সিগনাল জ্যাম হয়ে গেল হঠাত। দুটোই একশ ফুট ওপর থেকে দুমড়ে মুচড়ে নীচে পড়ল, স্নাইপার দুজনের ব্যারেলগুলো বেঁকে চুরে বেরিয়ে রইল ড্রোন গুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকে।
এবারে তক্তা পালট গিয়া। ১৫ মিনিটের মধ্যেই জ্ঞান ফিরল দুজনের। লাখমানকে বাঁধা হয়েছে একটা চেয়ারে। এর জন্য বিশুকে অবশ্য সাহায্য নিতে হয়েছে ওর পারসোনাল এসিস্টান্ট রোবট বিচ্ছুর। সে কাজ শেষ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
অনির্বাণ বোঝে এটা ওর নতুন পাওয়া জীবন। ও দৌড়ে গিয়ে দাদুর পায়ে প্রণাম করে। এটা আগে করত না, সোজা ঝাঁপিয়ে পড়ত পিঠে। এখন সিরিয়াস একটা ঘটনা ঘটছে তাই ছেলেমানুষিটা ঠিক ভালো লাগবে না বলেই ওর মনে হল। দাদু ওর হাত ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রেখে হাসল, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, যা বোস ঐ চেয়ারে। সব বলছি।
-প্রথমে বলি গ্যাসটার কথা। এই গ্যাসটাও আমার নিজের আবিষ্কার, এ আই ব্যবহার করে এর কেমিকাল কম্পোজিশান আর ম্যানুফ্যাকচারিংএর পদ্ধতি দুটোই বেরিয়েছে। ক্লোরোফরমের সঙ্গে দু একটা অন্য এলিমেন্ট লাগানো হয়েছে, সিক্রেট ফরমুলা। এই সব বুড়ো বয়সে বসে বসে খেলাচ্ছেলে নানারকম গবেষণার ফল। এর কাজ যেমন কুইক, এর থেকে জ্ঞান ফিরে আসেও তেমনি কুইক। ভয় নেই, এতে কারো কোন ক্ষতি হবে না ।
0 Comments