আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
ছত্রিশতম পর্ব
বেশ মনে আছে,দিনটি ছিল বিজয়া দশমী। তখনকার মেদিনীপুর শহরে গুটিকয়েক বারোয়ারী পুজো হলেও বাড়ির পুজোর রমরমা ছিল বেশ। ওনারা থাকতেন কোতোয়ালী থানার কাছাকাছি,বলতে গেলে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। কাছেই স্কুল,কলেজ, ব্যাঙ্ক, বাজার। বাড়ির সামনের রাস্তা ঘিরে চলছিলো অলিগঞ্জ অ্যাথলেটিক ক্লাবের পুজোর প্রস্তুতি। বিরজা বারোয়ারী পূজার ব্যাপারটি তেমন না জানলেও বৌমা জানত সেসব। সেও যে ছিল বাঁকুড়া শহরের মেয়ে।
এক সন্ধ্যায় পাড়ার ছেলেরা চাঁদা চাইতে এলে, শাশুড়ি-বৌমায় কথাবার্তা হয় ও ব্যাপারে।বৌমার কাছেই শেখা যে পাড়ার সবাই মিলে একসঙ্গে টাকা জোগাড় করে পূজা-অর্চনা, খাওয়া-দাওয়ার পূজাই বারোয়ারী। তবে তাঁরা তো গ্রামের মানুষ।পাড়ার বারোয়ারী পূজায় অংশগ্রহণ করলেও একটু দূরেই এক বাড়িতে পূজা হয়, সেখানেই পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। যথারীতি সেখানেও সপরিবার নিমন্ত্রণ ছিল।
বৌমার ভাইটিও তখন কয়েকদিন তাঁদের সঙ্গে ছিল। যদিও ছেলেমানুষ, ভীষণ গম্ভীর স্বভাব তার।সারাদিন বইমুখে জানলা দরজা বন্ধ করে বসে থাকতোপ্রয়োজন ছাড়া কারো সঙ্গেই তেমন মিশতো না।এমনকি নিজের জামাইবাবুর সঙ্গেও ঐ টুকটাক কথাবার্তা বলতো।
তাঁদের ছিল দুইটি বড়ো ঘর, একখানি বারান্দা,উঠোন, রান্নাঘর এবং একটি অব্যবহৃত ভাঁড়ার ঘর।সে সেখানেই থাকতো নিজের মতো।
তবে বিরজার সঙ্গে প্রথম দিন থেকেই এক অসমবয়সী বন্ধুত্বের সম্পর্ক তার তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
পৌঁছনোর দিনে ঐ তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বিরজা সামান্য খিচুড়ি আর ভাজাভুজিই করতে পেরেছিলেন। কইমাছের বিশেষ একটি পদ খাওয়াবার ইচ্ছে থাকলেও হয়নি।তবে সেই খাবারটুকুই যে কি পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছিল সে,মনে আছে। এবং খাওয়া শেষে যখন জানা গিয়েছিল, খাবার শেষ;কি লজ্জা!কি লজ্জা ছেলের। অনেক করে বোঝাতে হয়েছিল, ছেলেদের খাইয়েই মায়েদের তৃপ্তি, নিজেদের জন্য কিচ্ছুটি পড়ে না থাকলেও…
পরে পরে জলখাবারে মুড়ির সঙ্গে একখানি বেশী নারকেল নাড়ু দেওয়ার ছলে,বা ভাতের পাশে পেটিমাছটি যুগিয়ে দিতে দিতে সেই অন্তরঙ্গতা আরও বেড়েছিল।
আসলে,বিরজা নিজে হয়তো সন্তানের জননী ছিলেন না, কিন্তু ভাইপো-ভাইঝিদের কাছে তো তিনিই ছিলেন ছায়া। অপরদিকে ছেলেটিও ছোট থেকেই হোষ্টেলে মানুষ,মাতৃহারাও। ফলে, এইসব সাধারণ মাতৃযত্নের আস্বাদন তার জীবনে নতুন। প্রথম প্রথম এসবে সে খানিক বিব্রতবোধ করলেও পরে পরে বেশ উপভোগ করতো,টের পেতেন তিনি। বাড়ি থেকে বেরোতোই না,ফলে ভাইপো কোর্টে বেরিয়ে গেলে, কোনদিন পেয়ারা পেড়ে দিতে, কোনদিন জবা ডাল কেটে দিতে হলে তাকেই ডাকতেন,আসতো, টুকটাক কথাও বলতো। শেষের দিকে তো স্নানের আগে কয়লাও ভেঙে দিত রোজ,বিরজার অস্বস্তি উপেক্ষা করেই।
এমনই একদিন শিউলী ঝোপ সাফ করতে গিয়ে শুঁয়োপোকা লেগে ছেলের হাতে কি জ্বলুনি! জোর করে চূন দিয়ে ডলে ছেঁড়া চঠ দিয়ে মুছিয়ে দিতে তবে খানিক স্বস্তি পেল সে,কি যে কৃতজ্ঞতা তখন তার মুখে!
মনে পড়লে এখনও বুকখানি ভরে যায় তাঁর!আসলে মানুষ তো স্নেহের কাঙাল,চিরদিন।যার কাছে যতটুকু স্নেহ সে অর্জন করে জীবনভ’র,সেটুকুই তার অমৃতসঞ্চয় বলে সে মানে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
ইতিমধ্যে পূজা এসে যায়। বৌমার বাবা এবং বাড়ি থেকে দাদা-বৌদিদিও সেবছর পূজায় মেদিনীপুরে আসার ইচ্ছেপ্রকাশ করেন। আসলে, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতে কোন বাবামাই বা না চায়!তায় আবার নতুন অতিথির আগমন প্রত্যাশা…
কিন্তু সমস্যা হলো অন্য। সবাই আসার খবর পেয়ে ছেলেটি চলে যেতে চাইছিল,তার নাকি ওতো লোকজন পছন্দ নয়। বোনের কান্না,জামাইবাবুর বারণ,কিছুই শুনছিল না।শেষে তিনিই জোর করে তাকে আটকালেন।তবে শর্ত ছিল পুজোর পরেপরেই সে ফিরে যাবে তার জায়গায়।
ইতিমধ্যে পুজো চলে এলো,বাড়িভর্তি মানুষজন।নানাবিধ খাবারের আয়োজন।সকাল সন্ধ্যায় পুজোমন্ডপে যাওয়া,নতুন কাপড় পরা … গ্রামের মানুষ তাঁরা,এসব তো জানা ছিল না।বেশ একটু উৎসব উৎসব ভাব, ভালো লাগছিল। সপ্তমীর দিনে রুইমাছের কালিয়া,অষ্টমীতে লুচি-মুগমোহন,নবমীতে খাসির মাংস ইত্যাদি ইত্যাদি রকমারি স্বাদ বদলও চলছিল।দশমীর সকালটি ছিল একটু যেন অন্যরকম।মনটা কেমন যেন কু ডাকছিল বিরজার।কি যেন মনে হতে দশমীর সকালে হঠাৎ মুড়ি দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-'হ্যাঁগো ছেলে!এতদিনেও তো মুখ ফুটে কিচ্ছু খেতে চাইলে না!তোমার কি খেতে ভালো লাগে গো?'
ডাগর সুন্দর চোখ দুটি হাতে ধরা বই থেকে তুলে উত্তর দিয়েছিল,
-'না চাইতেও তো সবসময় এতো ভালো খাবার খাওয়াচ্ছেন পিসিমা,আর কি চাইব বলুন তো?'
-'পায়েস খাবে?ভালোবাসো?'
-'খুব।খাওয়াবেন?'
'দেখি…'
মুখ টিপে হেসে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বিরজা।ততক্ষণে দুই বেহাইমশাই একসঙ্গে বাজার থেকে ফিরেছেন বড় বড় কইমাছ নিয়ে।নতুন শীত পড়ার আগে,ঐসময় বেশ সুন্দর পাকা কই পাওয়া যায়,যেমন তার স্বাদ,তেমনই আকৃতি।এদিকে বৌমায়ের আবদারে একঝুড়ি কু্ঁদরীও তোলা হয়েছে পোস্ত হবে বলে।
অগত্যা শিলপাটায় বেশ খানিকটা পোস্ত বেটে কুঁদরীর পোস্ত,পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে মুসুরীর ডাল,সামনের পাতে সামান্য ভাজাভুজি আর কই মনোহরা রান্না হবে,এমনটাই বৌদিদি বলেছিলেন।
এমনিতে বিরজার হাতের রান্না চলনসই, কিন্তু কিছু কিছু পদে তার হাতে নাকি সৈরিন্ধ্রী এসে বসেন,এমনটাই বলে অনেকে। শ্বশুরবাড়ির কাকিমার কাছে শেখা এই পদটিও তার হাতে খোলে ভালো। সেদিনও তেমনি অন্যান্য রান্নার শেষে কড়াইতে অল্প তেল ঢেলে বিরজা কই মনোহরা রাঁধতে বসলেন।খুব হালকা করে কই মাছগুলো এপিঠ ওপিঠ ভেজে,ঐ তেলেই জিরে ফোড়ন ফেলে মিহি করে বেটে রাখা পেঁয়াজ আদা আর কাজুবাদামের মন্ড এবং অল্প চিনি,হলুদ দিয়ে ভালো করে কষিয়ে মাছগুলি একে একে সাজিয়ে দিয়েছিলেন।জল মরে এলে অন্য কড়াইতে পাঁচফোড়নে তেঁতুল গোলা জল এবং চিনি ঘন করে ফুটিয়ে তাতে আগের কড়াইয়ের মাছগুলি সাবধানে তুলে একে একে উল্টোপীঠটিও রান্না করা হো’ল। তারপরে রান্নাঘরের বদ্ধ বাতাস ঘিরে গভীর সুগন্ধ উঠলে,কড়াই নামিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখেন, সবাই খাওয়ার জন্য উদগ্রীব।বৌদিদি আসন পেতে জল গড়িয়ে তৈরি।বিরজাও তাড়াতাড়ি উনুন নিকিয়ে আর চারটি কুচো কয়লা তাতে ফেলে ভাত বাড়তে বসলেন।সোনারঙা কাঁসার থালায় পরপর ভাত, উচ্ছেভাজা,ফুল ফুল পটলভাজা,গয়নাবড়ি ভাজা,কুঁদরীপোস্ত, নুন-লেবু-লঙ্কা সাজিয়ে সবার সামনে ধরলেন। বৌমা ডালের বাটিগুলি এগিয়ে দিলেন,সখ করে কেনা বাহারি কাঁচের প্লেটে সাবধানে একে একে কই মনোহরা সাজিয়ে পরিবেশন করলেন।
দাদা তো আগেই খেয়েছেন,তাঁর মুখ দেখে মনে হলো রান্না উৎরেছে। বেহাই মশাইয়ের প্রতিক্রিয়া বোঝা গেলনা কিছু,ঘাড় নীচু করে হুসহাস খেয়েই যাচ্ছিলেন।বিরজা তারপরে তাকিয়েছিলেন ছেলেটির মুখের দিকে…কি যেন নাম ছিল তার,আজ আর মনে পড়েনা ঠিক।তবে রোদঢালা আশ্বিনের সেই দ্বিপ্রহরে সেই একটি তরুণ মুখের আলোক প্রফুল্ল রসনাতৃপ্তি তাঁর জীবনভ’র প্রিয় প্রাপ্তি বলেই মানেন আজও।দিন গড়িয়ে যায়,সময় প্রবাহও; কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি মনোগহনে স্ফুটনসুখী প্রসূনের মতোই সুগন্ধি ছড়ায়, একথা অস্বীকার করা যে অসাধ্যই…(ক্রমশঃ)
0 Comments