বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৩৯
শোলা
ভাস্করব্রত পতি
একদিন এক চাষী জলাভূমিতে শোলাগাছ কাটছিলেন। সেসময় এক বিদেশী উদ্ভিদবিজ্ঞানী তাঁকে গাছটির নাম জানতে চায়। কিন্তু চাষী গাছটির নাম জানতোনা। উত্তরে বললেন, 'ইসকা নাম নেহি জানতা'। ঐ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ভাবলেন এটাই বোধহয় গাছটির আসল নাম। তিনি তখন শোলাগাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম ল্যাটিন ভাষায় পরিবর্তন করে রাখলেন 'অ্যাস্কাইনোমিনি' (ইসকা নাম নেহি)! পরবর্তীতে Fabaceae পরিবারের এই শোলার বিজ্ঞানসম্মত নাম হয়ে উঠলো Aeschynomene aspera। এছাড়াও শোলাগাছের আরও যেসব প্রজাতির সন্ধান মেলে, সেগুলি হল --
Aeschynomene lagenaria Lour.
Aeschynomene indica
Aeschynomene surattensis Wight & Arn.
Aeschynomene trachyloba Miq.
Hedysarum lagenarium (Lour.) Roxb
প্রাকৃত শব্দ 'সলাহর' থেকে এসেছে 'শোলা' বা 'সোলা' শব্দটি। পালি ভাষায় 'সল্লহুক' (সংলঘুক)। মানিক গাঙ্গুলী তাঁর ধর্মমঙ্গল কাব্যে লিখেছেন, 'সোলার দুপাটী দন্ত গঠে'। ময়নামতীর গানে রয়েছে 'সোলা হইতে পাতল বুড়া হৈল ততৈক্ষন'। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে পাই, 'পলায় বাঙ্গাল ভাই পেলাইয়া সোলা'। শিবায়নে পাই 'সোলা শ্যামা'।
শোলাকে হিন্দিতে লাউগাউনি, কন্নড়ে তানাকালি, ওড়িয়াতে শোল, তামিলে আথুনেট্টি, আথুনেড্ডি, তেলুগুতে নিরুজিলুগা, নিট্টিজুলুগা, বেণ্ডু চেট্টু, মালয়লামে নিরকাডাসাম, পঙ্গুচেডি, ইংরেজিতে Spong Wood বলে। ভারত ছাড়াও শোলাগাছ জন্মাতে দেখা যায় নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, লাওস, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে। ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে শোলাগাছ জন্মায় তামিলনাড়ু, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম, কেরালা ইত্যাদি রাজ্যের জলাভূমি অঞ্চলে।
শোলা হল কাণ্ডসর্বস্ব একপ্রকার জলজ গাছ। বাইরের অংশ সবুজ রঙের, কিন্তু ভেতরটা সাদা। তবে শুকিয়ে গেলে মেটে রঙের হয়ে যায়। খুব হালকা, থার্মোকলের মতো। ম। মোটামুটি শোলাগাছ ৫ - ৬ ফুট লম্বা হয় এবং কাণ্ডের ব্যাস হয় ২ - ৩ ইঞ্চি। গা অমসৃণ। সাধারণত তিন ধরনের শোলাগাছ দেখা যায় -- কাঠশোলা, ভেতোশোলা এবং পিনশোলা। এদের মধ্যে কাঠশোলা বেশ শক্ত, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হোমিওপ্যাথি ঔষধের শিশির কর্ক বানানো হয় এটি দিয়ে। পিনশোলা তেমন কোনো কাজে লাগেনা। তবে ভেতোশোলা বা ভাটশোলা বা ফুলশোলা বেশ নরম এবং হালকা হয়। তাই কাজে লাগে মালাকারদের। সুকুমার রায় তাঁর 'পালোয়ান' কবিতাতেও শোলার নরম গঠন সম্পর্কে উল্লেখ করে লিখেছেন --
'খেলার ছলে ষষ্ঠিচরণ হাতি লোফেন যখন তখন,
দেহের ওজন উনিশটি মন, শক্ত যেন লোহার গঠন
একদিন এক গুন্ডা তাকে বাঁশ বাগিয়ে মারল বেগে
ভাঙল সে বাঁশ শোলার মত মট্ ক'রে তার কনুই লেগে'।
সাধারণত শোলা সংগ্রাহকরা 'ভেতো শোলা' সংগ্রহ করেন। কেননা এই শোলা গুনমানে সবচেয়ে সেরা। যাবতীয় উপকরণ তৈরি হয় এই শোলা থেকেই। যাঁরা শোলা সংগ্রহের কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে পদে পদে বিপদের ঝুঁকি রয়েছে। বিষধর সাপ, পোকামাকড়, জোঁক এবং জলজ চুলকানির আক্রমণ বাঁচিয়ে শারদোৎসবে সবসময় সদাসতর্ক হয়ে শোলা সংগ্রহ করেন তাঁরা। মৃত্যুভয় ঠেকিয়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে জলে নেমে শোলা সংগ্রহের কাজ। হাজার সমস্যা থাকলেও শোলা সংগ্রহের পেশা ছাড়তে চাননা এক শ্রেণীর মানুষ। কেননা, এতে কোনো ইনভেস্টই নেই। শোলা চাষ করতেও হয়না তাঁদের। কেবল প্রকৃতির বুক থেকে গায়ে গতরে খেটে সংগ্রহ করে আনতে হয় শোলা। তা থেকেই মোটামুটি ভালোই আয় হয় তাঁদের। গ্রামের পুকুর, খালবিল, নদীতে নামতে হয় সংগ্রহের জন্য। বর্ষার শেষদিকেই বেশি মেলে। পুকুরের মালিককে দিতে হয় গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। একটা পুকুর থেকে মেরে কেটে হয়তো দু'বান্ডিল শোলা মেলে।
এরাজ্যের বহু জেলায় শোলা পাওয়া গেলেও দুই মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এলাকাগুলি থেকে মেলে বেশি পরিমাণে শোলা। কেলেঘাই, ক্ষীরাই, কাঁসাই, সুবর্ণরেখা, শিলাবতী ইত্যাদি নদী তীরবর্তীতে থাকা বিভিন্ন জলাভূমি এলাকা শোলা উৎপাদনের মোক্ষম স্থান। মোটামুটি ক্ষীরাই, গড়বেতা, ভোগপুর, পটাশপুর, দাসপুর, গোবর্ধনপুর, ভগবানপুর, জকপুর, মোহনপুর, মাদপুর, নিমতলা, পিংলা, চন্দ্রকোনা, ঘাটাল, পাঁশকুড়া, রাণিচক, বালিচক, শ্যামচক, সবং, নারায়ণগড়, দাঁতন, এগরা, কাঁথি, খেজুরি, ময়না, তেমাথানি ইত্যাদি এলাকায় ব্যাপক পরিমাণে পাওয়া যায় শোলা। শুধু দুই মেদিনীপুর নয়, ওড়িশার ভদ্রক, ছত্রপুর, বহরমপুর, বারিপদা, বালেশ্বর, জলেশ্বর, ভুবনেশ্বর এলাকাতেও বিপুল পরিমাণে শোলা উৎপাদিত হয়। সেখান থেকেও সংগ্রহ করে আনা হয় শোলা।
মূলতঃ ভাদ্র থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত চলে শোলা সংগ্রহের কাজ। অন্যান্য সময়ে এঁরা অন্যান্য পেশায় যুক্ত থাকেন। তবে এখন আর আগের মতো শোলা মেলেনা বলে আক্ষেপ শোলা সংগ্রহকারীদের। আসলে জলাভূমিগুলি পরিষ্কার করে কোথাও মাছচাষ হচ্ছে, কোথাও পদ্মচাষ হচ্ছে। তাছাড়া এত বেশি কীটনাশক ও নানা ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে যে, শোলা গাছ আগের মতো জন্মাচ্ছেনা।
কোলাঘাটের ভোগপুর ও নন্দাইগাজন গ্রামের প্রায় ২০ টি মুসলিম পরিবার শোলা সংগ্রহের পেশায় যুক্ত। আগে এই সংখ্যাটা ছিল আরও বেশি। এখানকার মুসলিম মানুষজন ভিন্ন ধর্মের হয়েও অনেকটাই যুক্ত হিন্দুদের এই শারদোৎসবের সাথে। তাঁরা কাঁচা শোলা কেটে বাড়িতে এনে শুকনো করতে দেয় ভালো করে। এক বাণ্ডিল শোলাকে বলে 'পুরিয়া’। প্রতি পুরিয়া বিকোয় ২০০ - ২৫০ টাকায়। স্থানীয় মালাকাররা তাঁদের কাছ থেকে সেই শুকনো শোলার পুরিয়া কেনেন। সরু শোলার বান্ডিলে লাভ হয় ৮০ টাকা। আর মোটা শোলার বান্ডিলে লাভ হয় ১৫০ টাকা। মোটামুটি ৩৬ ইঞ্চি বেড়ের এক বান্ডিল শোলা বেচে এই সময়ে এক একজন ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করেন। উৎপাদন কম, কিন্তু সংগ্রাহক বাড়ছে। ফলে আয়ও কমছে এঁদের। রোদে এই শোলা শুকিয়ে বিক্রি করেন তাঁরা। মালাকাররা কেনেন সেসব।
যাঁরা শোলার কাজ করেন, তাঁদের বলা হয় 'মালাকার'। এঁদের পেশা নিয়ে পুরাণে একটি কাহিনীর খোঁজ পাওয়া যায়। পুরাণ মতে, শিব এবং পার্বতী যখন মাথায় সাদা মুকুট পরার ইচ্ছে প্রকাশ করেন, তখন তাঁদের ইচ্ছাপূরণের জন্য জলাশয়ে জন্ম নিয়েছিল শোলা নামের হালকা এক ধরনের উদ্ভিদ। কাহিনী অনুসারে, দেবাদিদেব মহাদেব যখন হিমালয়কন্যা পার্বতীকে বিয়ে করতে এলেন, তখন তিনি মাথায় সাদা মুকুট পরার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। এই মুকুট বানানোর ভার পড়ল বিশ্বকর্মার ওপর। কিন্তু তিনি তো কেবল কাঠের এবং পাথরের কাজই করেন। এসব দিয়ে তৈরি মুকুট তো মাথায় পরা যায়না। কি হবে তাহলে? সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন স্বয়ং মহাদেব। তাঁর ইচ্ছেয় মর্তের জলাশয়ে জন্ম নিল একধরনের হালকা গাছ। যা আসলে শোলাগাছ। আর বিশ্বকর্মার বদলে সেই জলাশয়ে আবির্ভাব হল এক সুদর্শন যুবক। যে কিনা জলাশয়ের শোলা কেটে তৈরি করল শিবের বিয়ের মুকুট বা টোপর। ঐ যুবক হল মালাকার সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। যাঁরা এখনও শোলা কেটে টোপর সহ নানাবিধ সামগ্রী তৈরি করে চলেছেন বছরভর। এই শোলার মুকুট নিয়ে হুগলি জেলার একটি ধাঁধা বেশ জনপ্রিয় -- "জলে জন্ম লগনে কর্ম কারিগরে করে / ঠাকুর নয়, ঠুকুর নয়, মাথার ওপর চড়ে"!
এই ‘মালাকার’ সম্প্রদায়ের আদি বাসস্থান হিসেবে উত্তরপ্রদেশের মথুরাকে চিহ্নিত করা হয়। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে তাঁরা মথুরা থেকে বাংলায় এসেছে বলে অভিমত। বাংলাদেশে মালাকার সম্প্রদায় শোলা কাটার যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দুর্গাপূজার দশমীর দিন, তা পরিচিত ‘শোলা সাইত’ নামে। মনসামঙ্গলের বেহুলা লখিন্দরের লৌহবাসরের প্রতীক ‘মনসামেড়’ বা ‘করন্ডি’ (চিত্রিত শোলার এক অপূর্ব নিদর্শন) দেখে বলা যায় যে প্রাচীনকালের মনসাপুজার সাথে শোলার চিত্রের বেশ নিবিড় সম্পর্ক ছিল। হিন্দু দের নানা উৎসবে শোলার তৈরি সামগ্রী বিপুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। হিন্দু সংস্কৃতির সাথে শোলার সম্পর্ক বেশ আত্মিক এবং গাঢ়তর বলা যায়।
শোলা কেটে নানা সূক্ষ্ম এবং সৌখিন শিল্পকর্ম তৈরি করেন মালাকার শিল্পীরা। অনেকটা ঠিক হাতির দাঁতের শিল্পকলার মতো। সেজন্য একে বলে ‘হারবাল আইভরি’ বা ভেষজ হস্তিদন্ত। নরম স্পঞ্জের মতো এই শোলা পরিচিত ‘ইন্ডিয়ান কর্ক’ নামেও। শোনা যায়, মুর্শিদাবাদে হাতির দাঁতের কারুকার্য করা শিল্পীরা হাতির দাঁত নিষিদ্ধ হয়ে গেলে হাতির দাঁতের পরিবর্তে শোলা দিয়ে নানা শিল্পকাজ শুরু করেছিলেন। কম্বোডিয়ার এটি জরায়ুর রক্তপাতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এখানে দুর্ভিক্ষের সময় শোলাগাছের পাতা ও ফুল স্যালাড হিসেবে খাওয়া হত।
তবে ইদানিং শোলার অভাবে তথাকথিত শোলাশিল্পীদের রুজিরুটিতে টান পড়েছে। তমলুকের কাখর্দা, কেশাপাট, কাঁকটিয়া, মোহাড়, কেশপুর, রুইনান, মহিষদা, দশগ্রাম, হ্যামিল্টন ব্রিজ, দেহাটি, লাঙলকাটা, বিষ্ণুপুর, অর্জুননগর, নোনামাধবচক, দুবরাজপুর, শিমুলিয়ার শিল্পীরা বাধ্য হচ্ছেন গতানুগতিক পদ্ধতি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। আসলে বাজারে শোলার জোগান কমে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আগের মতো মেলেই না শোলা। তাই দেবদেবীর গহনা তৈরিতে শোলার ব্যবহার ছেড়ে শিল্পীরা ঝুঁকছেন অন্য জিনিসে। একদিকে শোলার অপ্রতুলতা, অন্যদিকে দাম বেশি। সর্বোপরি, শোলার চেয়েও ডাকের সাজ, চুমকি, জরি, রাংতা, ভেলভেট, গোখুরা, আর্ট পেপার, রোলেক্স দিয়ে তৈরি চাঁদমালা সহ দেবদেবীর অলঙ্কার বেশি উজ্জ্বল এবং রংবাহারি। ফলে তথাকথিত শোলা দিয়ে ঐতিহ্যবাহী সামগ্রীর চাহিদা এখন ম্রিয়মান। ম্যাড়মেড়ে হয়ে পড়েছে এই জীবিকার সাথে যুক্ত শিল্পীদের জীবন। শিল্পীরাও বাধ্য হচ্ছেন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সাবেকীয়ানা ভুলে যেতে।
শোলার জিনিসের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই সস্তার জিনিসের প্রতি চাহিদা বেশি বেড়েছে। ক্রেতাদের চাহিদার পরিবর্তনের জন্য এই পরিবর্তন। সারাদিন কাজ করে একজন চাঁদমালা শিল্পী আয় করেন মাত্র ১০০ - ১৫০ টাকা! ফলে বেশিরভাগ শিল্পী এখন এটা আর পেশা হিসেবে নিচ্ছেনা। এখন বিভিন্ন দেবী প্রতিমাতে সাবেকি শোলার সাজের পরিবর্তে রাংতা, জরি, কাগজ, চুমকির সাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। দেখতেও চিকন লাগছে।
রকমারি চাঁদমালা সহ টোপর, ফুলঘর, ঝাড়া মালা, দেবদেবীর গয়না তৈরিতে এখন অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে। আগে যেমন পুরোটাই শোলা দিয়ে বানানো হত, এখন এতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। জরি, চুমকির মেলামেশায় চাঁদমালা সহ সব সামগ্রী হয়ে উঠেছে আরও ঝকমকে। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে শোলা নিয়ে মালাকারদের চিরায়ত আভিজাত্য।
0 Comments