আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
উনচল্লিশতম পর্ব
মেদিনীপুর চিরকালই বিপ্লবের শহর।সেই কোন মুঘল আমল থেকেই নাকি শহরটির পত্তন,বেড়ে ওঠা।অসংখ্য গলিঘুঁজি, প্রতিটি বাড়ির সামনের রোয়াক,দেওয়ালে দেওয়ালে কুলুঙ্গি,চারিপাশের মুসলিম প্রতিবেশীদের উপস্থিতি এর সত্যতা অস্বীকার করেনা।পরে পরে স্বাধীনতা সংগ্রামে এই শহরের ভূমিকা নিয়ে তো শহরবাসী আজও গর্বিত।
শরীর ভালো থাকলে এখনও মনের পটে ভেসে আসে বিরজার স্বল্পকালীন স্বাধীন জীবনের সেসব অবাক করা কথা।
তখনকার মেদিনীপুর ছিল মূলতঃ মফস্বল। মোরাম ঢালা রাস্তার দুধারে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা বসত,কোতোয়ালী থানা।ভালো ভালো স্কুল কলেজের দৌলতে জেলার মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের ভীড় ছিল বেশ।মেসবাড়ি ছিল অনেক, ভাড়াবাড়িও পাওয়া যেত সহজে।মিউনিসিপ্যালিটি ছিল,জলকষ্ট থাকলেও ঘরে ঘরে নীচু চৌবাচ্চা বানিয়ে জলের সরবরাহের ব্যবস্থাও ছিল।তাছাড়া গলির মোড়ে মোড়ে মন্দির,মসজিদ,লাইব্রেরী,তিনটি সিনেমাহল, অদ্ভুত ঢোলা পোষাক পরা কাবুলিওয়ালার দল এবং পথচলতি অসংখ্য রিকশা।এগুলি সবই শহরের অহঙ্কার ছিল।বিরজার কলকাতা বাসের স্বল্পকালীন কিছু স্মৃতি থাকলেও একজন পরিনত নারী হিসেবে এসব উপভোগ করার আনন্দ তিনি আজীবন মনে রেখেছেন। দুপুরবেলা কাজের অবসরে বৌমার সঙ্গে লাইব্রেরীতে গিয়ে কার্ড করানো, বই পাল্টে আনা; ম্যাটিনি শোতে পাড়া প্রতিবেশী দিদিদের সঙ্গে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখা, রিকশা করে ফেরার পথে ঝালমুড়ি খাওয়া, ফুচকা খাওয়া…এসবের আকর্ষণ যেন নিস্তরঙ্গ জীবনপ্রবাহে এক অন্য নতুন গতি এনেছিল।
তাছাড়া সেখানে তো কোন দায় ঝক্কি ছিল না।আশেপাশের বেড়াতে যাওয়ার মতো জায়গায় ছুটির দিনগুলিতে যাওয়া হতো।কর্ণগড়ের সেই অদ্ভুত মন্দির,ধূ ধূ বালি ছড়ানো নদীচর, সেই অতি বিখ্যাত সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির,ফকির কুঁয়োর জলের উপকারিতা ইত্যাদি নানা জায়গায় ঘোরা এবং গল্প শোনা,বাড়ির পেছনের মুসলিম পাড়া থেকে ভেসে আসা কলতান, তীব্র আতরের খুসবু এবং দুপুরের দিকে আদা-রসুন ছড়ানো রান্নার বিজাতীয় গন্ধ আজও মেদিনীপুর উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে।আসলে, মানুষের মন বা আবেগ তো সময় বা পরিস্থিতিতে বদলায়।তবু কিছু স্মৃতি তার ছায়া ফেলে রাখে আজীবন।
মনে পড়ে,তাঁদের মেদিনীপুরের বাসাবাড়ির কাছাকাছি থাকতেন সন্ন্যাসীপ্রতিম এক বৃদ্ধ।সাদা জামাকাপড়,সাদা দাড়ি,মুখে প্রসন্ন হাসি;নাম সম্ভবতঃ বিমল দাসগুপ্ত;আরও অনেকের মতো স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁর কার্যকলাপের গল্প লোকমুখে আলোচিত হতো,বিকেলবেলা বাড়ির সামনে বসে পাড়ার কচিকাঁচাদের তিনি অগ্নিযুগের গল্প বলতেন। পাড়ার ছেলেমেয়েরা ভীড় করে শুনতো সেসব গল্প…কখনো ক্ষুদিরাম, কখনও রাজনারায়ণ বসু,কখনও বা পেডি বা ডগলাস হত্যার গল্প। মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আসার গল্পও হো’ত।
🍂
আরও পড়ুন 👇
ছোট থেকেই ব্যতিক্রমী এবং অনেক বইপত্র পড়ার সুবাদে বিরজার খুব ইচ্ছে করতো সরাসরি সেসব গল্প শুনতে,কিন্তু ঐ যে,গ্রামের মেয়ে,তায় সমর্থ বয়সের রীতিমতো সুন্দরী ব্রাহ্মণ বাড়ির বিধবা।শহুরে আদবকায়দায় অভ্যস্তও ছিলেন না তেমন।কে কি ভাববে,এই জাতীয় কেমন যেন এক দ্বিধা তাঁকে ঘিরে রাখতো সর্বক্ষণ।তাই সামনে না গেলেও জানালার আড়াল থেকে শুনতেন সেইসব আত্মপ্রজ্বলন কথা…গোপনে নিভৃতে জ্বলে উঠতো দীপ,মনে মনে ভাবতেন,যদি আর কয়েকটা বছর আগে জন্মাতেন,তাঁর নিরর্থক জীবনের আর্থিক সম্পদগুলি হয়তো দান করে দিতেন এমনই কোন আদর্শবান কর্মকান্ডে।কেউ জানতেও পারতো না,তবু দিতে তো পারতেন।
তাছাড়াও,মনে পড়ে,রাস্তার মোড় পেরিয়ে একটু এগোলেই আরেক বিপ্লবী শহীদ প্রদ্যোত ভট্টাচার্যের একহারা দোতলা বাড়িটির কথা,তার উল্টোদিকেই ছিল দূর্গামন্দির।বিভিন্ন ব্রতপালনে মন্দিরে গেলেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন,ভাবতেন কোন অমৃত প্রেরণায় ছোট্ট ছোট্ট কিশোর প্রাণগুলি উৎসর্গ করেছিল তাদের জীবন দেশমাতৃকার পায়।
শুধুই কি আবেগ!নাকি যুগের দাবী!তা নাহলে বৌমার ভাইটি,অতো ভালো ছাত্র হয়েও কিভাবে সবকিছু ছেড়ে ভেসে গেল সময়ের স্রোতে,এতদিন পরেও যার কথা মনে পড়লে টনটনিয়ে ওঠে তাঁর অনাস্বাদিত মাতৃসত্তা! সত্যিই, বিপ্লব কি এবং কেন তা না বুঝলেও তিনি এটুকু অন্তত বোঝেন যারা সত্যিকারের সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখে, লৌকিক চাওয়া পাওয়ার তুচ্ছ গন্ডী তাদের বেঁধে রাখতে পারেনা কখনও।
বাঁধা পড়ে থাকেন তাঁরা, যাঁরা নৈমিত্তিক যাপনে অভ্যস্ত, সামাজিক নিগড়ে স্বচ্ছন্দ জীবন ছাড়া যাঁরা পা ফেলতে ভয় পান।
তবে তার মানে এইও নয় যে সাধারণ মানুষের জীবন একেবারে মামুলি ডালভাত সদৃশ।সে জীবনেও বৈচিত্র্য থাকে, ছিলও বৈকি।তা নাহলে, ব্রাহ্মণ বাড়ির বিধবা হয়েও মুসলমান বাড়িতে যাতায়াত করেছেন, তাদের দেওয়া খাবার খেয়েছেন,অন্তরঙ্গতা… সেটাও কি একেবারে ফেলনা নাকি!
এখনও বেশ মনে করতে পারেন,মেয়েগুলির নাম…শবনম,রাবেয়া,জলি। অধিকাংশ ছিল মুসলিম বাড়ির মেয়ে,পড়তো বাড়ির সামনের মেয়ে-ইস্কুলে।আর বিরজার বাসাবাড়ির লাগোয়াই থাকতেন ঐ ইস্কুলের বাংলা দিদিমনি,অরুণাদি। তাঁর দেশবাড়ী ছিল বিরজার শ্বশুরবাড়ির দেশে। সেই সুত্রে যাতায়াত ও ঘনিষ্ঠতাও ছিল। দিদি ছিলেন নিঃসন্তান, কিন্তু ছাত্রীরা প্রায়ই আসতো বাড়িতে, কতটা পড়তে,আর কতোটা তাঁর বাড়ির কাশীর পেয়ারা খেতে তা বোঝা ছিল ভার।
হ্যাঁ, খুব সুন্দর এক ঝাঁকালো পেয়ারা গাছ ছিল দিদির,আঙুরফলের মতো গোছা গোছা ফলতো বছরভ’র; বাইরেটা সবুজ,ভেতরে লাল,স্বাদে সফেদার মতো।তার টানেই টিয়ার ঝাঁক আর তাদের মতোই সাদা-সবুজ টিউনিক পরা মেয়েদের দল হাজিরা দিতো সবসময়,দু একটি ডাল পাঁচিল পেরিয়ে বিরজার উঠোনেও বেয়ে আসতো … এভাবেই আলাপ।ওরা সব কলকল করে কথা বলতো,সেলাই করতে ভালোবাসতো, ওদের সেলাই শিখিয়ে দিতেন তিনি, ওরা তাঁকে দিদিমনি বলেই ডাকতো। তিনি তাদের কাছে শিখেছিলেন লাচ্ছা সিমুই,সজনেফুল ডিমের ডানলার রান্না।ওদের মধ্যেই শবনমের বিয়ের দিন গিয়েছিলেন অরুণা দিদির সঙ্গে ওর বাড়ি।দিনের বেলা বিয়ে,বিয়ে করেই শ্বশুরবাড়ি যাওয়া, যাওয়ার আগে জড়িয়ে ধরে কান্না…একেবারে নিজের মেয়ের মতো।কে বলে, সম্পর্কে জাতপাতের ছায়া থাকে! ভালোবাসা যে অজাতশত্রু। স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষের ক্ষুদ্রতায় তাকে বৃথাই খন্ডিত করতে চাইলেও সে অজেয়ই থেকে যায়,জীবনভর বারবার তার প্রমাণ পেয়েছেন তিনি।(ক্রমশঃ)
0 Comments