জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদপর্ব- ৩২/স্বপন কুমার দে

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ৩২


স্বপন কুমার দে

জীবন স্বাভাবিকভাবে বয়ে চলার মধ্যে একটা ছন্দ আছে। তার মধ্যেও হয়তো ক্লান্তি আছে, দুঃখ আছে, যন্ত্রণা আছে, তবুও বিরতিহীন বয়ে চলাই জীবনের ধর্ম। সেই গতি হঠাৎ যদি থেমে যায় তখন মনের মধ্যে একটা অসাড়তা জন্মে। বড় একা লাগে। বহুজনের মধ্যে থাকলেও কর্মহীন একাকীত্ববোধ গ্রাস করে। কবে আবার স্বাভাবিক হবে, কবে আবার অতি পরিচিত জীবনের গতিতে সামিল হবে--এই বোধ তাকে অহরহ পীড়া দেয়। সম্পূরক স্বাভাবিক নিয়মে সপ্তাহান্তে ছুটি কাটাতে বাড়ি এসেছিল। পথে একজন বিপন্ন মহিলাকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে মার খেয়ে জখম হয়, তারপর হসপিটাল, হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ, প্লাস্টার, ওষুধ, বিশ্রাম- সবে মিলিয়ে দশ বারো দিন বাড়িতে বসে বসে নিজের মনেই বিরক্তি জাগে। কখনও কখনও মনে হয়, এইসব ঝামেলার মধ্যে না পড়লেই ভালো হত, আবার যখনই সেদিনের অন্ধকারে আলো-আঁধারি ছায়ায় আর্ত মহিলার চিৎকার,-- ভয়ে, কান্নায়, অসহায় একটি মেয়ের কাতর আবেদন 'বাঁচাও, বাঁচাও' আর্তনাদ কানে বেজে ওঠে, তখন মনে হয়," যা করেছি, ভালো করেছি। সেদিন যদি ওই মেয়েটার পাশে না দাঁড়াতাম তাহলে হয়তো ঝামেলা এড়ানো যেত, কিন্তু নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দিতাম কী করে?" পরে যখন জানতে পেরেছিল ঐ মহিলাই মন্টির প্রিয় ম্যাডাম মল্লিকা তখন আরও বেশি ভালো লেগেছিল। মন্টি এজন্য কাকুকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছে। ভালো কাজের যে এতটা আনন্দ থাকে তা যদি মানুষ অনুভব করতো, তাহলে খারাপ কাজ করার আগে অনেকবার ভাবতো।

প্রতিদানে মল্লিকাও কৃতজ্ঞতা জানাতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি। বারে বারে হাসপাতালে গেছে, বাড়িতে আসার পর নিয়মিত খোঁজ নিয়েছে এবং মন্টিকে পড়াতে এসে অন্তত একবার 'সম্পূরকবাবুর' সঙ্গে দেখা করেছে। সম্পূরক বুঝেছে মল্লিকা একজন বস্তির সাধারণ মেয়ে হলেও তার মধ্যে ভদ্রতা, বিনয়ের সাথে সাথে আপোষহীন  অদম্য জেদ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস আছে। শিক্ষা ও সাহসের এমন মিশ্রণ তাকে ব্যাতিক্রমী চরিত্র করে তুলেছে। সহসা মল্লিকার অন্তরের এই ঐশ্বর্যকে,এই সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করল সম্পূরক। এই সৌন্দর্য বাইরে থেকে দেখা যায় না শুধুমাত্র অনুভব করতে হয়।

কেবল তাই নয়, কখনো কখনো হালকা রসিকতা মল্লিকার উচ্চ রুচির রসবোধকেও প্রদর্শন করে। যেমন সেদিন বলল," আমার মনে হয় সম্পূরকবাবু, সব কিছুই ওপরওয়ালার সাজানো প্লট। মায়ের কাছ থেকে বেশিদিন আদর যত্ন পাওয়ার জন্যই তিনি এ ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। কৃতজ্ঞতাটা বরং আমারই পাওয়া উচিত, আমি আপনাকে সুযোগ করে দিয়েছি।"
হাসির রেখা ফুটে উঠল সম্পূরকের চোখে মুখে, ঠোঁটের রেখায়," বাহ্, আপনি তো খুব সুন্দর কথা বলতে পারেন ম্যাডাম।"
" এতবড় উপকারের বিনিময়ে আর কীই বা করতে পারি? আপনার ঋণ কোনওদিন শোধ করতে পারবো না। আপনার মত এতবড় মন সবার নেই, আমার কথা ছেড়েই দিন। আপনার মহত্বের কাছে আমি তুচ্ছ।"
" নিজেকে এতটা ছোট ভাবার কোনো কারণ নেই ম্যাডাম। আমি জানি আপনি কী। আপনার সামনে বাধার পাহাড়। সেগুলো টপকাতে আপনি বদ্ধ পরিকর। তাই আপনার মত মানুষকে সাহায্য করতে পেরে আমারও ভালো লাগছে।"
" সত্যি আর নিতে পারছি না। আমার এত প্রশংসা করলে অহংকারের বোঝাটা বেড়ে যাবে।"
" ও ম্যাডাম, আমাকে একটু ভদ্রতা দেখানোর সুযোগ দিন। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, যদি কোনো অসুবিধা না থাকে, তাহলে সামনের চেয়ারটায় বসুন। আমি বৌদিকে চা আনতে বলছি।" বলেই মল্লিকার দিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসল।
মল্লিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল," আমি আসছি সম্পূরকবাবু। দেখি, মন্টির অংকগুলো হল নাকি। আপনি বসুন।" বলেই যেমনভাবে এসেছিল তেমনভাবেই দ্রুত বেরিয়ে মন্টির ঘরে ঢুকল।

রাতে পড়তে বসে মল্লিকা দেখল তাদের জোড়াদিঘি বস্তিটা অদ্ভূতভাবে শান্ত। মাতালের চিৎকার নেই, ক্লাবের ছেলেদের হল্লা নেই। কেবল থেকে থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ চিৎকার। মনে ভাবে, আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে তাকে। স্যারের নির্দেশ মত অনেক অনেক রেফারেন্স বই পড়তে হয়। যে বিষয়ের উপর সে থিসিস করছে তার ওপর কাজ করতে গিয়ে দেখেছে, দেশি বিদেশি অনেক বই পড়তে হচ্ছে। দু-তিনটে লাইব্রেরির মেম্বারশিপ নিয়েছে। পড়ার জন্য উপযুক্ত সময় এই রাত্রিবেলা। তবে বেশি রাত জাগা তার কোনোদিনই হয় না।কোনওদিন সকাল সকাল ট্রেন ধরে কলকাতা যেতে হয়, কোনওদিন আবার টিউশন থাকে। তার ওপর সংসারের যাবতীয় কাজ।
🍂
এমনইভাবে প্রতিটি দিন প্রতিটি রাত মল্লিকার জীবনে ঘুমহীন স্বপ্ন মাখা আবেশ, শপথকে কাছে টানে, আগলে রাখে। দূর দিগন্তের অভিযাত্রী সে, এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। শোক, দুঃখ, আবেগের পিছুটান পিছনে ফেলে আরও আরও বহুদূর...বহুদূর। পথ চলার ক্লান্তি নেই, থমকে দাঁড়ানোর আলস্য নেই, অন্ধকারে পিছলে পড়ার ভয় নেই। ট্রেনে, বাসে,ট্রামে কত ধরনের লোকের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। সমাজটা লড়াইয়ের একটা ময়দান। এখানে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে দেবে না। নিজের অধিকার নিজেকে লড়াই করে ছিনিয়ে নিতে হয়। তাই মল্লিকাকে তো ভয় পেলে চলবে না। তার একার লড়াই তাকে একাই লড়তে হবে। কখনও হয়তো কেউ একটু আধটু সাহায্য করতে পারে, তবে রথের রশিটাকে তাকে একাই টানতে হবে।

                             *****

এখানেও রাত্রি নামে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে সম্পূরক দেখতে পায় শুক্লা একাদশীর চাঁদ। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে চারদিক। কাছে দূরে বাড়ির ছাদে, গাছের ছায়ায়, ফাঁকা মাঠে চাঁদের আলো পড়ে মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই রাত, সুন্দরী চাঁদ মায়াবী জ্যোৎস্নায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চায় সম্পূরক। প্রকৃতির এমন বাঙ্ময় রূপ সে আগে দেখেনি। সায়েন্সের ছাত্র সে, তাই চাঁদ, চাঁদের আলোকে মহাজাগতিক সৃষ্টি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে রাজি নয়। ভাবুক কবিরা যত ইচ্ছা কবিতা লিখুন চাঁদকে নিয়ে, প্রেমিক প্রেমিকা যত খুশি ভেসে যাক চাঁদের ভেলায়, সে এ পথের পথিক নয়। কিন্তু আজ তার মনে হল প্রকৃতিও মুখর। সেও যেন কথা কয় ফাঁকা মাঠে, গাছের ছায়ায়, চাঁদের আলোয়, পাখির গানে নদীর কলকল্লোলে। তাকে বুঝে নিতে হয়, অনুভব করবার মত মন চাই।

সম্পূরক দেখল, ওই চাঁদ, ওই মাঠ, রাতচরা পাখি, তার রাত্রি জাগরণের সঙ্গী। নিস্তব্ধ রাত্রি যেন কানে কানে তার সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত। দিনের আলোয় মানুষের ব্যস্ততায় তার দেখা পাওয়া যায় না। সে যেন চুপি চুপি কথা বলে।

রূপসার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর কত রাত সে ভালো ঘুমোতে পারেনি। নিদ্রাহীন রাতে ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের কঙ্কালটা বয়ে বেড়িয়েছে। বড় বেশি অন্ধকার লেগেছে রাতগুলো। বাইরের অন্ধকার মনের ভেতরে জমাট বেঁধেছে। মেনে নিতে পারেনি রূপসার সঙ্গে অন্য কারও সম্পর্ক। শব্দহীন, অশ্রুহীন কান্না বুকের ভেতর থেকে নিংড়ে নিংড়ে বেরিয়েছে তার স্মৃতি ভুলে থাকার জন্যই স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছে। দিনের বেলায় হাজারো কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে চেয়েছে। মায়ের চোখে ধরা পড়েছে, ছেলের বেদনার মূহূর্তগুলো। সম্পূরকও ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে, এভাবে বাঁচা যায় না। নিজেকে শক্ত হতে হবে, সংযত হতে হবে। তার নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মা বাবার জীবন। তাই সব সম্পর্ক ঝেড়ে ফেলে স্বাভাবিক হয়েছে সে।

আজকের রাত্রি যেন সব অন্ধকার মুছে দিয়ে আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে পৃথিবী। খুশিতে ভরে যাচ্ছে দেহ মন। মুহূর্তের ভালোলাগা পথের সঞ্চয় হয়ে প্রাপ্তির ঘরে আনন্দ ভরে দিচ্ছে। চোখের উদাস দৃষ্টি শূন্যের পথে কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আনন্দের মাঝে একরাশ শূন্যতা গ্রাস করছে সম্পূরককে। বড় ফাঁকা, বড় একা লাগে। এ কি দুর্বলতা, না অভাব? অনেক রাত পর্যন্ত তার চোখে ঘুম এল না।
 

Post a Comment

0 Comments