পর্ব ১৯
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া
মুখবন্ধ বনাম আমার কৈফিয়ৎ
এসো সুসংবাদ এসো...
কোভিডের প্যানডেমিক পেরিয়েও ভীষণ অসুখে পড়েছে এই গ্ৰহ।যুদ্ধের পুরনো ব্যামো যেমন বেড়ে চলেছে তেমনি একলা সবকিছু এক জীবনে ভোগ করে নেবার উদগ্ৰ লোভে কিছু মানুষ অপরকে দমন পীড়নে উন্মাদের মতো শুষে নিচ্ছে মানুষের শ্রম আর সময়।ছড়িয়ে দিচ্ছে সন্দেহ আর অবিশ্বাস।আশা এটুকুই মানুষ জেগে উঠছে।গণদেবতার ঘুম ভাঙছে।
দুই বাংলাই উত্তাল এখন। ছাত্র আন্দোলন দিয়ে শুরু করে গণ অভ্যুত্থানের ফলে ওপার বাংলার সার্বিক পরিবর্তনে পরিস্থিতি বেশ কিছুটা বেসামাল, ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণেও নেই সবকিছু এবং তারাও ভুলের উর্ধ্বে নয়।ভাঙচুর ও নতুন কিছু তৈরির সময় সবটুকু ভালো কখনো হয় না এবং এই আন্দোলন এমন কিছু সুসংবদ্ধ প্যারী কমিউনও নয়। আর সবখানেই সবরকম মৌলবাদীরা তো সুযোগের অপেক্ষাতেই থাকে।তবু সোশ্যাল মিডিয়ার সব কিছু এত হইহই এবং আবেগপ্রবণ ভাষায় বলা বা লেখা হয় যে সেসবে হকচকিয়ে যায় মন। তবুও মনে হয় বাংলাদেশ কী থেকে কী হচ্ছে বলতে হলে আর কিছুটা সময় আমাদের দিতেই হবে।
আর এপার বাংলায় যা ঘটছে এওতো আমরা দেখিনি কোনোদিন। তারায় তারায় অসংখ্য মোম জ্বেলে কারা যেন হেঁটেই চলেছে। কারা এসেছে তবে সাড়া জাগাতে সব অসাড় ভাঙাচোরা মনে? সমস্ত মেঠো পথ থেকে একদিন ওরা রাজপথ হয়ে যাবে এই খবর শুনবে বলে ঠায় বসে থাকে মন। বসে থাকে আর ছটফট করে।যেন মরিচ বাটা ডলে দিয়েছে কপালে কেউ। আগুন ধরে গেছে কপালের গায়।
একচল্লিশ দিন হয়ে গেল লেখালেখিতে মন দেওয়া সম্ভবই হচ্ছে না। মন কেবলই পড়ে থাকে দুঃসংবাদ শিরোনামে।এত অন্যায় এত বড় অপরাধ তবু কোনো তার সুরাহা হবে না মন তা মানতে চায় না। একটা করে দিন যায় আর ভাবি এত মানুষের প্রতিরোধ ও চাওয়া নিশ্চয়ই বিফলে যাবে না। উদ্যত মুঠি হাত দেখে মনে পড়ে যায় স্কুল বেলায় পড়া কিশোর কবিকে। "কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে ভেঙেছে খিল/মিছিলে আমরা নিমগ্ন তাই, দোলে মিছিল।"
দু:খ-সুখের ধারায় ধারায় কারা আনে প্রাণ? কারা তা হারায় আর নাইট ডিউটি দিতে চোখ লেগে এলে ঘুমের ভেতর অচেনা এক তরুণী চিকিৎসকের মা লাগাতার কাকে যেন ডেকেই যান।বলেন ভোর হলেই মেয়ের নাকি তার বাড়ি ফেরার কথা।
তিলোত্তমার প্রতি এত বড় অন্যায় এত নৃশংস হত্যার পর সমস্ত কিছু বেমালুম লোপাট করে দেবার মতো অপরাধের ঘটনায় শান্ত,দৃঢ় অথচ সুসংবদ্ধ এক ছাত্র আন্দোলনের সাথে সর্বস্তরের মানুষের মিলে মিশে যে ঢেউ উঠলো তার সামনে ধুয়ে মুছে গেল সব রঙের পতাকা।তুমি কোন দলে বলো তুমি কোন ছাতার তলায় প্রশ্ন ওঠার আগেই জনমানস ন্যায় আর অন্যায় এই দুটি মাত্র তফাতের মাঝখানের খোলা চাতালে রোদ বৃষ্টি ঝড়ে খোলা ছাত্রদের ঘিরে সিনা টান করে দাঁড়ালো।
কারা এগিয়ে দিচ্ছে ত্রিপল,কারা বিছিয়ে দিল ভালবাসা,মাথায় করে বস্তায় বয়ে আনলো নিজের খেতের শশা,কারা আনল জল বা খাবার কে এঁকে আনল ছবি, কার প্ল্যাকার্ডে লেখা রইল জল নয়, রক্ত ছিল চোখে আর মায়েদের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো মমতা ও অহংকার যখন শিরদাঁড়া সোজা রেখে গোলাপ হাতে ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত হয়ে সব ছেলেমেয়েরা।
আষ্টেপৃষ্ঠে ডিউটির ফাঁকে মন পড়ে থাকে অভূতপূর্ব এই সময়ের মধ্যে এই যাপনের মধ্যে।ভেবেইছিলাম লেখাটা আবার করে শুরু করাই যাবে না।আজ সেপ্টেম্বর সতেরোই। কিছুটা হলেও শান্ত হলো পরিস্থিতি ও মন। এটুকু অন্তত ভাবনার সময় এল যে এখন থেকে জেগে থাকবে সবাই যতদিন না তারা শেষটুকু দেখতে পাচ্ছে।
অস্থির ডানা নিয়ে চোখ আবার উঁকি দিয়ে দেখে ওপার বাংলার উদলা করা জানলা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় করে দাঁড়ানো দুই বাংলাই বন্যার শিকার আবার। বৃষ্টি, নদীদের বেড়ে যাওয়া জল আবার ভূগোল জানে না।তাই সাধারণ মানুষের অবস্থা সংকটে আবার।
গণ অভ্যুত্থানের পর সেখানে অস্থিরতাও চরম। আগুন জ্বলে উঠলে সে ভালো মন্দ নির্বিচারে সবকিছুই বেশ খানিক পুড়িয়ে তবে শান্ত হয়।যে কোনো গণ অভ্যুত্থানের গলানো লাভা অনেক বৃষ্টিযুগ পার হয়ে তবে ফের সুফলা মাটির সন্ধান দেয়। আবার ভরে ওঠে ভালবাসার খেতি বাড়ি।
ভাবি অনাসৃষ্টিতে কী তুখোড়ই না ছিল এই
বৃটিশ শাসকরা! পৃথিবীর যেখানেই উপনিবেশ গড়েছে ধুরন্ধর তস্করের মতো গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে ছেড়েছে।বহু বছর পেরিয়ে আজও তাদের সেই devide & rule থেকে আমরা বেরোতেই পারলাম না। খুড়োর কলের মতো আমাদের নাকের সামনে পঞ্জিকা মাফিক সেই সেই এক অতি বৃহৎ লাল মুলো ঝুলিয়ে রাখা আছে। আমরা দু বাংলায় তাকেই চরম মোক্ষ জেনে একে অন্যকে সাত জম্মের শত্তুর নিজেদের শানাচ্ছি।
এখন আমাদের বুকের মধ্যে খুব লম্বা এক কাঁটাতারের বেড়া যার এধারে ধান্দাবাজরা যত আমাদের লড়িয়ে দেয় ওধারেও সেই একই ধুরন্ধর লড়াই উল্টোমুখো চলতে থাকে। লড়তে লড়তে ভুলেই গেছি কবে ইংরেজ আমলের আগেও একখানা বঙ্গভূমি ছিল।সেখানে এইসব আপদবালাই ছিল না।যুদ্ধ ধর্ম বা ধর্মযুদ্ধের এত প্রচার যার কতখানি ঘটেছে বা ঘটছে তার সত্যি মিথ্যে যাচাই করবে কেবল সময় কেননা যার কিনা টি আর পি,ফুটেজ কিচ্ছুর দরকার নেই।
এমনকি কাঁটাতার নিজেও জানে এপারে ওপারে আমরা দৌড়ে গেছি কতবার স্বজনদের একবারটি ছুঁয়ে আসবো বলে... কতবার গান আর কবিতা হাতে একুশের ভোরে গিয়ে দেখেছি ভাষার রূপসী মুখ।দুয়োরে খিল পড়লে টান দিয়ে খুলে ফেলেছি বুকের কপাট।
🍂
আরও পড়ুন 👇
গত সপ্তায় রাজু মণ্ডল ভর্তি হলো মরোমরো অবস্থায়। বর্ডারে আঁধার কার্ড জমা করে বায়োমেট্রিক্সে বুড়ো আঙুলের ছাপ দিয়ে সে গেছিলো ওপারে তার নিজস্ব সাড়ে তিন বিঘের জমিতে নিড়েন দিতে।সাপে কাটলেও সে এক কিলোমিটার হেঁটে যথারীতি আঁধার কার্ড ফেরত নিয়ে আবার আঙুলের ছাপ দিয়ে এপারে এসে আরো দুই কিলোমিটার হেঁটে তারপর বাসে চেপে জেলা হাসপাতালে ভর্তি হলো যখন খুবই খারাপ অবস্থা তার।একে গোখরো ধরনের কোনো নিউরোটক্সিক সাপ তার ওপর অতটা হাঁটা এবং গাড়িতে আসতেও তার মোট ঘন্টা তিনেক পেরিয়ে গেছে।আ্যন্টিভেনাম ইত্যাদি পাওয়ার দুদিন পর সে সুস্থ হয়ে উঠে বসলে প্রথমে কয়েক ঢোক জল খেতে বললাম তাকে। দুপুরে লাল চা আর বিস্কিট খেয়ে একমুখ হাসল সে। আপনি তো উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েওছেন,ওপারে যে রোজ চাষবাস করতে গ্ৰামের অনেক মিলে যান এবং এখনো যাচ্ছেন অসুবিধে হচ্ছে না? এই সাপের কামড় টামড় ছাড়া তো অসুবিধে কিছু বুঝি না।
বালুরঘাটে বাড়ি এবং বাংলাদেশে ফোটোগ্রাফি নিয়ে পড়ছেন এক ছাত্রর সঙ্গে আলাপ হলো সেদিন। কয়েক দিন বাড়ি কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছেন ঢাকায়।এই যে এত সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা হচ্ছে এগুলি কি সত্যি? কিছুটা সত্যি তবে অনেকখানিই প্রোপাগান্ডা কেননা এসব বেশি করে প্রচার হলে দুদেশের মৌলবাদীদেরই সুবিধে হবে।
আমার এক সংবেদনশীল বন্ধু লিখছেন পানি ,গোসল ইত্যাদি শব্দ দেখলেই তিনি snooze করে দিচ্ছেন। শিউরে উঠলাম পড়ে। কতখানি biased হয়ে যাচ্ছি আমরা। তবে তো যারা এটা চাইছিল জিতে যাচ্ছে তারাই। বাংলাদেশ কী হচ্ছে কী হবে সেটার জন্য সময়ের পরে ছেড়ে দিতেই হবে। আপাতত আমাদের ধৈর্য ধরে নিজেদেরকেই
পাহারায় রাখা দরকার যাতে পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে পড়ি।
আপৎকালীন জরুরি অবস্থার মধ্যে এই লেখা পড়ার মতো ধৈর্য কারো হবে কিনা জানি না তবু বিশ্বাস আর উপলব্ধির শান্ত অনুভব, চেতনার গভীরতম আলো-অন্ধকার লেখার এইই সময় মনে হলো।
ঝিনির এই পর্বগুলি এখনই বলা খুব জরুরি যাতে দেশ কাল ধর্ম নয় কেবল মানুষ হ্যাঁ মানুষের ওপর ভালবাসার অগাধ,ঝিনির এতকালের বিশ্বাস সে হারিয়ে না ফেলে।
বলো কে নেবে মনখারাপের এই অন্ধকার আজ?
সবাইতো আলো চায়।শুধু আত্মহত্যা বরাবর নীল এই রাত্রি জানে আমাদের আয়ুর একদিকে পূর্ণ গ্ৰহণ।অন্যদিকে চাঁদ কালিপড়া লন্ঠন জ্বেলে
লেখার খাতায় রোজ একা জেগে থাকে।নীল জোছনায় ভাঙা শাঁখার রক্তে ভরে থাকে দুপারের আলরাস্তা।মনখারাপের মতো অসময় সে কেন নেবে?সন্ধের আকাশ দেখে চিনে নাও হাওয়া তবে
দেখে নাও রূপসা না তিস্তা কোন নদী কাছাকাছি এল।
কোন ব্রিজ দাঁড়িয়েছে সময়ের দুধারে একাই
মাঝখানে ভুলে যাওয়া এক গাছের ছায়ায় সন্ধে নেমেছে সবে। দেড়শো বছর আগে মরা ঠাকুর্দার হাতে পোঁতা তেঁতুল গাছ।এত জেদ তার।কাটা পড়েছে কবেই তবু ছায়া মেলে ধরে।
দেড়শো বছর আগেকার সেই গান...তার ঝুপসি আলো দ্যাখো একই সেই আকাশে বাজ বিজুরি ফের এসে আলো চমকালো।চলো দেখি সেই ছায়াখানার তলায়।চোখের পাতা ঘেঁসে আজ সবাই মিলে দাঁড়াই এসো।
0 Comments