দূর দেশের লোকগল্প ২০৬—বতসোয়ানা (দক্ষিণ আফ্রিকা)
মাছের কেন জিভ নাই
চিন্ময় দাশ
সব জীবেরই জিভ আছে। বড় হোক, বা ছোট। সবারই জিভ আছে একটা করে। নাই কেবল মাছের। কোনও মাছেরই জিভ নাই। সে সমুদ্রের রাজা-মন্ত্রী তিমি-হাঙর হোক, বা এঁদো ডোবার চুনো-পুঁটি। কারুরই জিভ নাই, কারুরই।
কিন্তু হোল কেন এমনটা? ডাঙায়, জলে, আকাশে কতো কতো জীব। কতো রকমের চেহারা তাদের। সবই তো বিধাতার সৃষ্টি। হাত-পা চোখ-মুখ নাক-কান কতো কিছুই দিয়েছেন সকলকে। জিভও দিয়েছেন সকলকে। কেবল মাছকে দেননি।
কিন্তু এমনটা হোল কেন? বিধাতা পুরুষ অবিচার করতে পারেন, ভাবতেও পারে না কেউ। সকলের মনেই খটকা রয়ে গেছে ব্যাপারটা নিয়ে।
একদিনের ঘটনা। বনে গাছ কাটছে এক বুড়ো কাঠুরিয়া। হঠাৎ সামনে একজন লোক হাজির। বলল—কীহে, কেমন আছো? সব ঠিকঠাক চলছে তো?
এবার ঠাহর করতে পারল বুড়ো। ইনি তো স্বয়ং বিধাতা। কী সৌভাগ্য আমার। সাক্ষাৎ ঠাকুরের দেখা পেয়ে গেলাম। কুড়ুল ধরা ছিল হাতে। ফেলে দিয়ে, বলল—পেন্নাম হই, ঠাকুর। সবই ঠিক চলছে আপনার দয়ায়।
বিনয় আর গদগদ ভাব দেখে, বেশ একটু কৌতুক হোল বিধাতার। একটা গাছে ঠেস দিয়ে বসেই পড়লেন সেখানে। মনের ভাব, একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। খোঁজখবরের কাজটাও সেরে নেওয়া যাবে কিছুটা।
আসলে ব্যাপার হোল, মাঝে মাঝেই এভাবে বেরিয়ে পড়েন বিধাতা। দুনিয়ায় কে কেমন আছে, কার কোথায় কী অসুবিধা, সেসব খোঁজ নিয়ে যান। আজও সেই কাজে বেরিয়েছেন। প্রথমেই এই বুড়োর সাথে দেখা।
বুড়োর সংসারের খোঁজখবর সারা হোল এক সময়। বিধাতা বললেন—চলি হে। আরও পাঁচ গাঁয়ে যেতে হবে।
বুড়ো ভাবল, সুযোগ হাতছাড়া করতে নাই। এমন মওকা জীবনে আর পাব না।
আবার হাত জড়ো করে বলল—একটা কথা জানবার ছিল, ঠাকুর।
--কী এমন কথা? আমারই কাছে জানতে চাও?
--অনেক দিনের সাধ। মাঝেমাঝেই মাথাটা কেমন ঘুলিয়ে ওঠে। হাজার চেষ্টা করি। কিন্তু উত্তর খুঁজে পাই না।
--তাই না কি? তা, প্রশ্নটা কী, বলো শুনি।
বুড়ো তো আহ্লাদে ডগমগ। খোদ বিধাতার কাছে জেনে নেওয়া যাবে। এমন কপাল ক’জনের হয়? সে বলল—এই গোটা দুনিয়া নিজের হাতে গড়েছ তুমি। যা যা দরকার, সব দিয়েছ সবাইকে, সব।
বিধাতা বললেন—দিয়েছিই তো? বলো, কোন জিনিষটা তোমাকে দিইনি?
বুড়ো বলে উঠল—আমার নিজের কথা বলছি না আমি। অভাবী মানুষ। খাটাখাটুনি করি। সংসার চলে যায় আমার। আমি বলছি মাছের কথা।
বিধাতা নিজেই একটু ঘাবড়ে গেছেন এমন কথা শুনে। মাছের কথা বলছে একটা অভাবী কাঠুরিয়া? ধন্দে পড়ে গেলেন খানিক। বললেন—বলো শুনি। কী হয়েছে মাছের?
বুড়ো বলল—মাছেদের জিভ নাই কেন, ঠাকুর? দিতে ভুলে গিয়েছিলে নিশ্চয়।
বুড়োর কথা শুনে, হাসবেন, না রাগ করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না বিধাতা। গম্ভীর মুখে বললেন—ভুল আমার হয় না। যাকে যা দেওয়ার সব দিয়েছি। যার যা পাওয়ার, সবাই পেয়েছে।
বিধাতার কথা শুনে, বুড়ো গেল রেগে—ঠিক বলছ না তুমি। হয় দাওনি। না হলে, বলতেই হচ্ছে আমাকে, সকলের খবরই রাখো না তুমি। দুনিয়া শুদ্ধ সবাই দেখছে মাছের জিভ নাই। আর, তুমি নিজে সেটা দেখতে পাও না? নিশ্চয় ভুলে গিয়েছিলে। এটা কেমন বিচার?
স্বয়ং বিধাতাকে রাগ দেখিয়ে অভিযোগ করছে একজন বুড়ো কাঠুরিয়া। ভারি মজা হোল বিধাতার। যাবেন বলে, উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বসে পড়লেন আবার। বললেন—তাহলে, বলি শোন ব্যাপারটা।
অনেক কালের পুরাণো ঘটনা। এত কাল আগের, জানলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। আর সব জীবের মতো, মাছেরাও তখন ডাঙাতেই থাকত, জলে নয়। তা হলে বুঝতে পারলে তো, কতো দিন আগের ঘটনা।
মাছেরা কখনও ডাঙায় থাকত, এটা শুনেই ভড়কে গেছে বুড়ো। সে কোন রকমে বলল—যত কাল আগেরই হোক, ঘটনাটা বলো তুমি। শুনে রাখি।
বিধাতা বলতে শুরু করলেন।
মাছেরাও প্রথমে জঙ্গলে থাকত। আর সব জীবেদের সাথে। সব সময় বকবক করা মাছেদের স্বভাব হয়ে গিয়েছিল। সব সময় বকবক করলে যা হয়, সকলের নিন্দা-মন্দ করে বেড়াত মাছ।
শুধু কি নিন্দা? অন্যের কুৎসা করা, অন্যের নামে মিথ্যে করে বানিয়ে বানিয়ে নানান কথা বলা – কোন কিছুই বাদ দিত না মাছ। আর একটা কাজ ছিল মাছের। সেটা হোল, এর কাছে তার নিন্দা করা। খানিক বাদে, তার কাছে গিয়েই এর নিন্দা করা।
মাছের এই স্বভাবে নাজেহাল হয়ে পড়েছিল বনের সবাই। শেষমেষ সবাই চেষ্টা করত মাছকে এড়িয়ে চলবার। কিন্তু সে কি আর সম্ভব হয় সব সময়? একই জঙ্গলে থাকতে হয় যে।
এদিকে হয়েছে কী, সকলকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে পেরেছে, এটাতেই মাছের আনন্দ। ফূর্তি ধরে না মাছের মনে। এমনি ভাবে নিজের সীমা ছাড়িয়ে যেতে লাগল মাছের।
একদিনের ঘটনা। সেদিন কাঠবেড়ালির সাথে কথা বলছে মাছ। হাজারো কথার পরে, সিংহের কথা উঠেছে আলোচনায়।
মাছ বলল—কেন যে সবাই ওই ধেড়েটাকে রাজা বলে মানে, আমার তো মাথায় ঢোকে না।
কাঠবেড়ালি জিভ কেটে বলল—এ কী বলছো তুমি? চুপ, চুপ। এভাবে কেউ বল কখনও? রাজা বলে কথা। কানে গেলে, রেহাই পাবো না দুজনে।
--বলব না কেন? রাজা হবার মত চেহারা না কি ওর। গায়ে গতরে বড় হলেই হোল? তাহলে তো, ঐ মাথামোটা হাতিকে রাজা করলেই হোত। কত বড় চেহারা তার।
কাঠবেড়ালি বলল—কিন্তু সিংহকে পছন্দ নয় কেন তোমার? মাছ বলল—হবে কী করে পছন্দ? শনের নুড়ির মত এক মাথা চুল। রাজ্যের উকুনের বাসা মাথাটাতে। আর, কী বোঁটকা গন্ধ, মা গো!
অতোটুকু পুঁচকে জীব কাঠবেড়ালি। রাজার নামে নিন্দা শুনে, বুক ধুকপুক করছে তার। ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হবার জোগাড়। এমন আলোচনায় থাকলে, বিপদ হতে পারে পরে।
সুড়ুৎ করে সরে পড়ল কাঠবেড়ালি। তার পর দৌড় লাগিয়েছে লেজ নাচিয়ে। সোজা এসে হাজির হয়েছে সিংহের ডেরায়।
সিংহ তখন গা এলিয়ে নাক ডাকাচ্ছে আয়েস করে। কাঠবেড়ালি আলতো করে দু’বার লেজ বুলিয়ে দিয়েছে রাজার চোখে-মুখে। অমনি তিড়িং করে উঠে বসেছে রাজা। সামনে কাঠবেড়ালিকে দেখে, বলে উঠল— এখন ঠিক দুপ্পুর বেলা। তুই এখানে ঢুকেছিস কেন?
কাঠবেড়ালি সামনের দুটি পা জড়ো করতে ওস্তাদ। সেইভাবে রাজাকে একটা সেলাম ঠুকে দিল লম্বা করে। বলল—একটা জরুরী নিবেদন ছিল, হুজুর। তাই অসময়ে এসেছি।
🍂
আরও পড়ুন 👇
রাজা বলল— তাড়াতাড়ি বলে ফেল, কী নিবেদন তোর?
মাছ যা বলেছে সিংহ সম্পর্কে, সব বলে গেল কাঠবেড়ালি। মাছের এই স্বভাব সম্পর্কে সিংহ শুনেছে অনেকের কাছে। কিন্তু বনের রাজাকে নিয়ে এমন মন্তব্য? ভাবতেই পারছে না। এত ঔদ্ধত্ব একটা মাছের?
রাগে গরগর করছে রাজামশাই। কাঠবেড়ালি সাহস করে বলল—এর একটা বিহিত করা দরকার, হুজুর। কান ঝালাপালা হয়ে গেল সকলের। এক্ষুনি কিছু একটা করুন।
রাজা বলল—শোন, তুই গিয়ে সবাইকে ডেকে বলে আয়। বিকেলে আমার এখানে বৈঠক। বনের সবাই যেন হাজির থাকে। বলে দিবি, যে হাজির না হবে, শাস্তি পেতে হবে তাকেও।
বিকেল বেলা। বনের যত জীব, সবাই এসে হাজির হয়েছে সিংহের ডেরায়। রাগে ফুঁসছে সিংহ। গরম নিঃশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। হুঙ্কার দিয়ে উঠল—মাছটা কোথায়? সামনে আয় হতভাগা।
মাছের তো একেবারে মরণদশা। জমায়েতের একজনও তার পক্ষে নাই। কেউই ভালো চায় না তার। ভাবতেও পারছে না, কী দুঃখ আছে আজ কপালে!
যত রকমের অভিযোগ আছে এক এক করে বলে গেল রাজা। শেষে বলল—বনের রাজা আমি। শাস্তি আমি দিতেই পারি। তোমাদের ডেকেছি, কারণ তোমাদেরও সবাইকে জ্বালিয়ে মেরেছে ব্যাটা। তোমরাও বলো, কী শাস্তি দেওয়া উচিত।
চেহারায় বড় হলে কী হবে, হাতি ভারি শান্তশিষ্ট জীব। কোন রকম ঝুটঝামেলা বা হুজ্জুতির ধারকাছ দিয়ে যেতে চায় না। হাতি বলল— একটাই কাজ। বন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক। বাকিরা সবাই শান্তিতে থাকতে পারব তাতে। সহজেই মিটে যায় সব।
হই-হই করে উঠল অন্যেরা—ওটি হবে না। অনেক জ্বালিয়েছে আমাদের। শাস্তি ওকে পেতেই হবে। কড়া শাস্তি চাই মাছের।
বনবেড়াল ছিল ভীড়ের ভেতর। সে দেখল ভালো মওকা পাওয়া গেছে। এগিয়ে এসে বলল—আমাকে হুকুম দিন, রাজামশাই। কচ করে ওর মুণ্ডুটা কেটে নিচ্ছে এক্ষুনি। যত বদবুদ্ধি সব তো ওর মুণ্ডুটাতেই। সেটা চিবিয়ে খেয়ে ফেললেই, সব ল্যাঠা চুকে যায়।
শেয়ালও ছিল জমায়েতে। সে এগিয়ে এলো—আমার একটা নিবেদন ছিল। রাজা বলল—নিবেদন কী হে? তুমি হলে পণ্ডিত। পরামর্শ দাও বরং।
প্রশংসা শুনলে কে না খুশি হয়? তাও আবার স্বয়ং বনের রাজার মুখ থেকে। গদগদ গলায় শেয়াল বলল—সারা জীবন জ্বালিয়ে মেরেছে সবাইকে। এক লহমায় জীবন চলে গেলে, শাস্তিট আর কোথায় হোল? মেরে ফেলাটা ঠিক হবে না।
রাজা খেঁকিয়ে উঠল—কী বলতে চাইছ, খুলে বলো তো, বাপু। সবাই তোমার মত বুদ্ধিমান নয়। বেশি পণ্ডিতি দেখিয়ো না।
শেয়াল বলল—তাহলে, পরিষ্কার করেই বলি। মাছের কোন দোষ নাই। দোষ যা কিছু, তা হচ্ছে ওর জিভের।
সবাই হাঁ। কারও মাথায় কিছু ঢুকছে না। রাজা বলল—হেঁয়ালি রেখে, যা বলবার সোজা করে বলো। জিভের দোষ, এ আবার কেমন কথা?
জিভেরই তো দোষ, রাজামশাই! শেয়াল বলল— আসলে হয়েছে কী, মাছের জিভটা ভারি বেয়াড়া। সব সময় সুড়সুড় করে। তাতেই তো কথা বলে যেতে হয় মাছকে। যত দোষ ওর জিভের।
এবার রাজা তোতলাতে লেগেছে—হ্যাঁ হে, কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু কোন শাস্তি পাবে না মাছ?
--কে বলল পাবে না? চরম শাস্তি পেতে হবে ওকে। এমন শাস্তি হবে, চিরকাল ভুগতে হবে হতভাগাকে। বেড়ালকে বলুন, মাছের জিভটা কেটে নিক।
বলবার অপেক্ষা রইল না। এক লাফে এগিয়ে এল বনবেড়াল। কুচ করে মাছের জিভটা কেটে, পেটে পুরে দিল। কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই।
রাজা বলল—খুব ভালো কাজ হয়েছে। তবে, হাতির কথাটাও কিন্তু ফেলে দেবার নয়, বুঝলে। আমার এই বনে মাছের থাকবার কোনও দরকারই নাই। আমরা শান্তিতেই থাকতে চাই সকলে।
সবাই সায় দিল সে কথায়। বনের গায়েই তো আতলান্তিক সাগর। সাগরে নিয়ে গিয়ে, ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হোল মাছকে।
বলা শেষ হোল বিধাতার। কাঠুরিয়াও সব শুনে, ভার খুশি। বিধাতা দাঁড়িয়ে উঠে বললেন—এবার বুঝলে তো, কাউকে কিছু দিতে ভুল হয় না বিধাতার। সবাইকেই সব কিছু দিয়ে, তবেই দুনিয়ায় পাঠিয়েছি আমি।
বুড়োর মুখে কথা নাই। এদিক ওদিক মাথা নাড়ল কেবল।
0 Comments