পর্ব- ৩১
স্বপন কুমার দে
এখন সকাল দশটা। হাসপাতাল চত্বরে ভিজিটরদের ভিড়। দশটা থেকে এগারোটা-- এই এক ঘণ্টায় রোগীর বাড়ির লোকজন রোগীর সঙ্গে একটু দেখা করতে যায়, চিকিৎসার ব্যাপারে জানতে চায়। ভিড় সামলাতে নার্সরা হয়রান হয়ে যান। তবু, ঐ সময়টার জন্য অল্প সুস্থ রোগীরা উদগ্রীব হয়ে থাকে, কখন বাড়ির লোকের সঙ্গে দুটো কথা বলা যায়।
মল্লিকা জেনারেল ওয়ার্ডের সতেরো নম্বর বেডের কাছে গিয়ে দেখল, সম্পূরকের মা ও দাদা সেখানে রয়েছেন। মা ছেলের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর কথা বলে যাচ্ছেন। মল্লিকা কাছে যেতেই সম্পূরকের দাদা উদ্দালক তাকে দাঁড়াবার জায়গা করে দিতে একটু দূরে সরে দাঁড়াল।
" কেমন আছেন সম্পূরকবাবু? শরীরের ব্যথা কমেছে? ডাক্তারবাবু ভিজিট করে কী বললেন?"
" দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন করলে উত্তর দিই কেমন করে?"
মল্লিকা হেসে ফেলল সম্পূরকের কথা শুনে," ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলতে হবে না। আপনার কথা শুনেই বুঝতে পারছি ভালো আছেন। এঁরা কবে ছুটি দেবেন বলেছেন?"
" সকালে আরও দুটো টেস্ট হয়েছে। দুপুরের দিকে রিপোর্ট হাতে পেলে ডিসিশন নেবেন। আপাতত বিকেল পর্যন্ত এখানেই আছি।"
" আমার জন্য আপনাকে কীরকম ঝামেলার মধ্যে পড়তে হল বলুন দেখি। এখন মনে হচ্ছে আপনার এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী।"
" নিজেকে অকারণ অপরাধী ভাববেন না মল্লিকা দেবী। আপনি ছাড়া অন্য কেউ হলেও আমি একই কাজ করতাম।"
এবার ওদের কথার মাঝে কথা বলেন সম্পূরকের মা। মল্লিকার উদ্দেশ্যে বলেন," আমরা কখনোই তোমাকে দোষ দিই না। আমার ছেলে যেটা করেছে সেটা একদম ঠিক করেছে। তবে হ্যাঁ, এর জন্য ও কয়েক দিন অফিস যেতে পারবে না, সেটা ওর কাছে অস্বস্তির।"
" জেঠিমা, আপনারা খুব ভালো মানুষ, তাই ওভাবে বলতে পারলেন। অন্য কেউ হলে হয়তো....।" মল্লিকার কথা শেষ হলনা তার আগেই দু'জন পুলিশ অফিসার সম্পূরকের বেডের কাছে চলে এলেন। এঁদের সঙ্গে এসেছেন একজন নার্স। তিনিই চিনিয়ে দিলেন," এটাই সতেরো নম্বর বেড স্যার, আর বেডে শুয়ে আছেন সম্পূরক রায়।"
একজন অফিসার তাঁকে বললেন," থ্যাঙ্ক ইউ সিস্টার। ঠিক আছে আপনি আসুন। আমরা আমাদের কাজ করি।"
নার্স চলে গেলেন ওদের মধ্যে একজন অফিসার বেডের পাশে রাখা একটি টুলে বসে পড়লেন। শুরু করলেন," নমস্কার সম্পূরকবাবু, আমরা লোকাল থানা থেকে আসছি।"
" নমস্কার স্যার," সম্পূরক প্রত্যুত্তর দিল। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সম্পূরকের মা ,দাদা এবং মল্লিকা।
অফিসারটি বললেন, " আমরা গতকাল ঘটে যাওয়া ঘটনার ইনভেস্টিগেশনন করতে এসেছি। তার আগে জিজ্ঞেস করি, এরা কারা?"
সম্পূরক একে একে তার মা, দাদা এবং মল্লিকার পরিচয় দিল।
" ওহ্ আপনিই চন্দ্রমল্লিকা দেবী? নমস্কার! আপনি কি সম্পূরকবাবুর পূর্ব পরিচিত?
" হ্যাঁ,ওনার ফ্যামিলিতে আমি একটি মেয়েকে পড়াতে যাই। সেই সূত্রেই বাড়ির সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয়।"
" ওহ্! তাহলে গতরাতে আপনারা দুজনে একসাথে স্টেশন থেকে বেরিয়েছিলেন?"
" না, তা কেন হবে? আমি ফিরছিলাম সাইকেলে। আমি আক্রান্ত হওয়ার সময় সম্পূরকবাবু ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার চিৎকার শুনে উনি আমাকে বাঁচাতে যান।" মল্লিকা উত্তর দেয়।
" গত রাতে ঠিক কী ঘটেছিল, আপনি আমাকে বলুন তো।"
এতক্ষণ মল্লিকার চোখে মুখে যে স্বাভাবিকতা ছিল তা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে লাগল। সে বলতে শুরু করল। মনে পড়ে গেল, কতগুলো নোংরা কুৎসিত হাত তাকে স্পর্শ করছে, তার উদ্দেশ্যে বর্ষিত হচ্ছে নোংরা নোংরা শব্দ। নরপশুদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য তার প্রাণপণ চেষ্টা, গোঙানি। ঠিক তখনই দেবদূতের মত আবির্ভাব একজন মানুষের, সাহায্যের চেষ্টা, মার খেয়েও পালিয়ে না যাওয়া এবং নিমাইকাকুর সকাতর চিৎকার। সবকিছুই একে একে বলে গেল মল্লিকা। অফিসারেরা সব শুনছিলেন এবং নোট করে নিচ্ছিলেন।
" আচ্ছা সম্পূরকবাবু, এত রাতে আপনি ঐ রাস্তা দিয়ে কেন আসছিলেন? আপনি কি আগে থেকেই জানতেন, এরকম কিছু ঘটতে পারে?"
" স্যার, আমি গিয়েছিলাম আমার বাবার বন্ধুর বাড়ি। কাকু আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। রাত হয়ে গিয়েছিল বলে ওনাকে আমি বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম। পৌঁছে দিয়েই বাড়ি ফিরছিলাম। আপনি আমার বাবার বন্ধু জগন্নাথ বোসকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন।"
" আমার শেষ প্রশ্ন মল্লিকাদেবীকে। আপনি কি এ ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেন?"
" হ্যাঁ স্যার, করি।"
" কাকে?"
" প্রোমোটার সুজন হালদারকে।"
" সুজন হালদার মানে নেতা অবিনাশ হালদারের ছেলে? আপনি কী করে বুঝলেন যে, এই কাজ তারই? আপনি কি তাকে দেখেছেন?"
" না দেখিনি, তবে ওই লোকগুলো আমাকে টানতে টানতে বলছিল, কেন আমি বস্তি উচ্ছেদে বাধা দিচ্ছি। এইজন্য তারা আমাকে শাস্তি দিতে চায়। স্যার, প্রোমোটার সুজন হালদার চায় জোড়াদিঘি বস্তিটা দখল করে ফ্ল্যাট করতে। অন্যান্য লোকেদের বুঝিয়েছিল কিন্তু আমি তার প্রতিবাদ করি। সেই থেকেই আমার ওপর ওদের রাগ। তাছাড়া আরও কারণ আছে। আমি নিশ্চিত, ওর পোষা গুন্ডারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে।"
" ঠিক আছে, আমরা আপনাদের অভিযোগ শুনলাম। আমাদের যা ব্যবস্থা নেওয়ার, আমরা নেবো। এখন চলি।"
পুলিশ চলে গেলেও মল্লিকা এবং সম্পূরকদের মুখ চোখে অস্বস্তির ছায়া রয়ে গেল।
সম্পূরকের মা বললেন," কী দরকার ছিল বলো তো, তোমার এত কথা বলার? তুমি যাদের নামে অভিযোগ করলে তাদের কিচ্ছু হবে না, অথচ তুমি নিজেই আরও বিপদে জড়ালে। দেখো, তোমার আরও বড় ক্ষতি না হয়ে যায়।"
" এছাড়া আমার আর কোনও উপায় নেই জেঠিমা। সাপের বিষ দাঁত ভাঙতে না পারলে আমাকে একদিন ছোবল খেতেই হবে। তাই ছোবল মারার আগে দাঁত ভাঙতে চাই। সম্পূরকের মা হাঁ করে চেয়ে রইলেন মল্লিকার দিকে।
* * * * *
কিছুটা তোলপাড় হল এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মল্লিকার কথায় পুলিশ প্রাথমিক কাজ শুরু করল। পুলিশ জানল অবিনাশ হালদারের ছেলে অপরাধী, এবং সে কথা পুলিশ অবিনাশবাবুকে সবার আগে জানাল। তিনি নেমে পড়লেন মাঠে। চাপা দিতে প্রভাব ও অর্থ দুটোরই ব্যবহার করতে লাগলেন।
মল্লিকা দুপুরে রান্না করে ভাত খাওয়ার উদ্যোগ করছে। এমন সময় বাইরে হাঁক ডাক শুনতে পেল। এরকম তো প্রায়ই হয়, তাই মল্লিকা ওসব গ্রাহ্য করল না। খাওয়ার আসন পাতল, থালা ধুয়ে এবার খেতে বসবে তখন চিৎকারটা আরও জোরালো হল এবং ' মল্লিকা' শব্দটি বেশ জোরে জোরে শোনা গেল। এবার আর মন না দিয়ে পারল না।
দরজা খুলে দেখতে পেল অনেকগুলো অপরিচিত মুখ। কতকগুলো বাইক সার দিয়ে দাঁড় করানো। তাদের মুখ দিয়ে অশ্লীল শব্দের ফুলঝুরি। এরপর তার নজর পড়ল সুজনের ওপর। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পাড়ার লোকেদের শাসাচ্ছে," মেরে ঠ্যাং ভেঙে দেবো। ঘর থেকে বেরোতে দেবো না। ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেবো। সুজন হালদারের আসল রূপ এখনো দেখেনি। এক্ষুনি দেখাবো। ওই তোরা করছিস কী? মেয়েটাকে টেনে বার কর্।"
তার সঙ্গে আসা যুবকের দল উৎসাহিত হয়ে চিৎকার করতে থাকে," বেরিয়ে আয় মল্লিকা। বেরিয়ে আয় শা...।"
" মুখ সামলে কথা বলো। ভদ্রতা জানো না? রাতের অন্ধকারে যা করতে পারো, দিনের আলোতেও তাই করবে নাকি? দেশে মানুষ নেই?"
" অ্যাই, অ্যাই, বেশি বুলি আওড়াবি না। এক্ষুনি সাইজ করে দেবো," হুঙ্কার দেয় সুজন।
পাশ থেকে একজন মাঝবয়সি লোক বাজখাই গলায় বলে," সুজন, এই সেই?"
সুজন ইশারায় 'হ্যাঁ' করতেই গর্জে ওঠে সেই মধ্যবয়সি," তোর এতবড় সাহস, সুজনের নামে পুলিশে অভিযোগ করিস! চল্ তোর কোনো ক্ষমা নেই। এক্ষুনি থানায় চল্।বড়বাবুর সামনে কেস উইথ ড্র করবি চল্।"
" না করবো না। কী করবে তোমরা?" মল্লিকা তার সিদ্ধান্ত বদলায় না।
" বুকে পা তুলে দেবো। সামান্য একটা বস্তির মেয়ে। এতবড় বুকের পাটা!"
আবার অন্যজন বলে," ওইসব বলে কিছু হবে না। চল্ ওকে তুলে নিয়ে চল্। দেখি ওর কোন্ বাপ আটকায়।"
লজ্জায়, অপমানে মল্লিকা ওদের মুখের দিকে চাইতে পারছিল না। মদের উগ্র গন্ধে তার বমি পাচ্ছিল। লোকগুলো এক নাগাড়ে তাকে অপমান করে চলেছে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। পাড়ার লোক জড়ো হয়েছে বটে, কিন্তু তারা দুর্বল। তাছাড়া সুজন এ পাড়ার ছেলেদের খাইয়ে ক্লাবের সরঞ্জাম কিনে দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে রেখেছে। সুজন ভেবেছে এ পাড়ায় সে যা খুশি করতে পারে কেউ বাধা দেবে না।
🍂
আরও পড়ুন 👇
সুজন বেপরোয়া হয়ে যায়," রাতে বেরাতে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরবে। তাতে কে তাদের হেনস্থা করেছে তার ঠিক নেই অথচ দোষ হল সুজনের। চেনে না আমাকে। সোজা করে দেবো। আরে, পয়সা ছুড়লে তোর মত কত মেয়ে আমার কাছে ঘুর্ ঘুর্ করবে। সতীপনা দেখাচ্ছে।" সুজনের গলা ক্রমশ চড়তে থাকে। সাঙ্গোপাঙ্গরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এক সময় তারা মল্লিকার হাত ধরতে যায়। এবার মল্লিকা চিৎকার করে ওঠে," এ পাড়ায় কি কেউ বেঁচে নেই? পাড়ারই একটা মেয়েকে কতকগুলো বাজে লোক হেনস্থা করছে, গায়ে হাত দিতে যাচ্ছে আর সবাই চুপ করে মজা দেখছে। এটা যদি তোমাদের মেয়ের বেলায় হয়, তাহলেও কি তোমরা চুপ করে থাকবে?"ঘুম ভাঙে বস্তিবাসীর। প্রথম প্রতিবাদটা এল বৃদ্ধ সতীশকাকার কাছ থেকে," সুজনবাবু, এটা আপনারা ভালো করছেন না। একটা মেয়েকে আপনারা এইভাবে অপমান করতে পারেন না।"
একজন হেঁড়ে গলায় সতীশকে ধমকায়," অ্যাই বুড়ো, মরবার পালক গজিয়েছে, তাই না? দেখবি ঘাড়টা ধরে নর্দমায় ঢুকিয়ে দেবো?"
ক্লাবের ছেলে ভোলা বলে," আমাদের পাড়ায় এসে আমাদের রোয়াবি দেখাবে না। আমরাও তোমাদের নর্দমায় ঢুকিয়ে দেবো।"
ঠিক তখনই একটা লাঠির জোরালো ঘা খেয়ে বসে পড়ে ভোলা। তার মাথা দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। এবার রাগে ফেটে পড়ে গোটা পাড়ার লোক, মেয়েরা চিৎকার করতে থাকে," যার ঘরে যা যা অস্ত্র আছে-- দা, কাটারি, কোদাল, বেলচা, খুন্তি শাবল, লাঠি নিয়ে সবাই বেরিয়ে এসো। আজ আমাদের মা বোনেদের ইজ্জত রক্ষার লড়াই। ওরা আমাদের রক্ত ঝরিয়েছে। আমরা এর বদলা চাই। একজনও যেন না ফিরে যেতে পারে।"
ছেলে, বুড়ো, পুরুষ মহিলা এবার অস্ত্র হাতে সবাই বেরিয়ে আসে। ক্লাবের ছেলেরাও এককাট্টা হয়। তারাই মল্লিকাকে ঘরে যেতে বলে। মল্লিকা তাদের সঙ্গ ছাড়ে না। বলে," আমাকে অস্ত্র দাও, আমিও তোমাদের সঙ্গে লড়ব।"
সুজন বলতে থাকে," বেইমান, নিমকহারাম। আমার টাকায় চব্য চোষ্য খেলি আবার আমার বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়াচ্ছিস। এইজন্য তোদের বলে, বেইমানের বাচ্চা।"
" খবরদার সুজন, বাপ তুলে কথা বলবে না। তুমি কেন আমাদের সঙ্গে মিশতে, বুঝি না ভেবেছো। শয়তান কোথাকার। মল্লিকা আমাদের পাড়ার মেয়ে, আমাদের ঘরের মেয়ে। তার গায়ে হাত তুলতে গেলে মেরে হাত ভেঙে দেবো।"
সুজনের পক্ষের লোকেরা হুঙ্কার ছাড়ে," দেখবি, কে কার হাত গুঁড়িয়ে দেয়? একটা বোমা মারলে সব কটা পরিষ্কার হয়ে যাবি। দেখাবো দেখবি।"
পাড়ার দুজন মহিলা ছুটে আসে। একেবারে দুটোর গলায় বঁটি চেপে ধরে বলে," বেশি কথা বললে চালিয়ে দেবো। গলা দু'ফাঁক করে দেবো। তাদের সঙ্গে আরও মহিলা যোগ দেয়, যোগ দেয় মল্লিকা। এবার সুজনেরা ভয় পায়। অন্যভাবে শাসাতে থাকে," সব অনুদান, সাহায্য বন্ধ করে দেবো। না খেতে পেয়ে মরবে। আমার বাবার কতটা ক্ষমতা তোমরা জানো না।"
" আমাদের কতটা ক্ষমতা, সেটা তুমিও জানো না। আমরা যদি তোমাদের পাশে না থাকি তাহলে তোমার বাবার পদটাও থাকবে না।"
" তোমরা তাহলে বস্তি খালি করবে না?"
সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে," না "।
শেষ পর্যন্ত পিছু হটে সুজন। তার লোকেদের ডেকে নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
0 Comments