স্পাসো-প্রিওব্রাঝেনস্কি সাবর
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭২
বিজন সাহা
রীবিনস্ক আজকে
গত সপ্তাহে আমরা রীবিনস্কের অতীত ইতিহাস নিয়ে বলেছি। আজ দেখব সোভিয়েত আমল আর বর্তমান দিনের রীবিনস্ক। ১৯১৮ সালের ২ মার্চ রীবিনস্কে সোভিয়েত রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু সেই বছরের ৮ জুলাই সেখানে ঘটে সোভিয়েত বিরোধী গণ অভ্যুত্থান। তবে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কর্তৃপক্ষ সেই বিদ্রোহ দমন করে। ১৯২০ এর দশকে এই শহর ছিল রীবিনস্ক প্রদেশের কেন্দ্র স্থল। তবে ১৯৩৬ সাল থেকে একে ইয়ারোস্লাভলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শহরের নতুন পর্যায় শুরু হয় দেশের শিল্পায়নের সাথে। রাশান রেনো পরিণত হয় বিশাল মোটর তৈরির কারখানায়, তৈরি হতে থাকে বিমানের মোটর। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রীবিনস্ক এভিয়েশন ইনস্টিটিউট। সোভিয়েত আমলে এসব কারখানা ঘিরে গড়ে উঠত শহর, কিন্তু রীবিনস্কের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। এর মূল কারণ ছিল বিমানের বাইরেও এখানে ছাপাখানার মেশিন তৈরির কারখানা, জাহাজ নির্মাণ কারখানা, রেল তৈরির কারখানা ইত্যাদি কাজ করত। এছাড়া এখানকার নদী বন্দর আগের মতই শহরের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে।
১৯৩৬ সালে বলশায়া ভোলগা প্রজেক্টের অধীনে শুরু হয় রীবিনস্ক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির কাজ। দ্রুত গড়ে ওঠা কল কারখানায় যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়াও এর লক্ষ্য ছিল ভোলগা থেকে বাল্টিক ও মস্কো নদীর গভীরতা রক্ষা করা। এই নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিল ভোলগাস্ত্রোই নামে এক কোম্পানি আর এখানে কাজ করার জন্য ভোলগার গুলাগে অবস্থানকারী বন্দীদের ব্যবহার করা হয়। পিতৃভূমির যুদ্ধ শুরু হবার আগেই হাইড্রোলিক ইউনিট নির্মাণ কাজ শেষ হয় আর ১৯৪১ সালে শুরু হয় রিজারভয়ার পূর্ণ করার কাজ যা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে। নির্মাণ কাজ শেষ হবার আগেই ১৯৪১ সালে ১৮ নভেম্বর এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। ১৯৪২ সাল থেকে রীবিনস্ক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র মস্কোয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে শুরু করে। এখান থেকেই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেমন ক্রেমলিন, আর্মি হেড কোয়ার্টার, রেডিও স্টেশন, রেল স্টেশনগুলো বিদ্যুৎ পেতে শুরু করে। তাই বিদ্যুৎ পরিবাহী লাইনের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ তারের মাধ্যমেও মস্কোর সাথে রীবিনস্ক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক সংরক্ষিত লাইন পাতা হয়। আর এই লাইনের কারণেই যুদ্ধের সময়ও মস্কোর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ এক মুহূর্তের জন্যও বিঘ্নিত হয়নি। রীবিনস্ক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গুরুত্ব বুঝে জার্মান বাহিনী বার বার এখানে বিমান আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তৈরি হয় রীবিনস্ক বিমান ব্রিগেড। ১৯৪১ সালে রীবিনস্ক বাঁধের উপর ২৪ ঘন্টা দুটো ইয়াক-১ বিমান পাহারা দিত। এ রকম প্রতিরক্ষার কারণে দেড় বছরে রীবিনস্কের আকাশে জার্মান বাহিনী ৫০ টি যুদ্ধ বিমান হারায়। যুদ্ধের সময় শহরবাসীরা মূলত বিমান বাহিনী ও ট্যাঙ্ক বহরে লড়াই করে। অনেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বীরের উপাধি পায়।
অস্তাপ বেন্দার ও তার সাগরেদউল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৪৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রীবিনস্কের নামকরণ করা হয় শেরবাকভ। শেরবাকভ ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তবে ১৯৫৭ সালে তার ঐতিহাসিক নাম ফিরিয়ে দেয়া হয়। এরপর ১৯৮৪ সালের ১৫ মার্চ শহর নতুন নাম পায় – আন্দ্রোপভ। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আন্দ্রোপভ এক সময় এখানে লেখাপড়া করতেন। তবে ১৯৮৯ সালের ৪ মার্চ সে আবার পুরানো নাম ফিরে পায়। যুদ্ধের পর এখানে ইনস্ট্রুমেন্ট তৈরির কারখানা, ইলেকট্রোটেকনিক্যাল, ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল, অপ্টিকো-মেকানিক্যাল কারখানা গড়ে ওঠে। রীবিনস্ক তখন ছিল আধা বন্ধ শহর, মানে বিদেশীদের এই শহরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হত না। ১৯৬০ এর দশকে এখানে বহুতল বিশিষ্ট বাড়িঘর গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৬৩ সালে ভোলগার উপর তৈরি হয় অটমোবাইল ব্রীজ। ১৯৮০ দশকে এখানে আড়াই লাখ লোক বসবাস করত। পেরেস্ত্রোইকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন রীবিনস্কের জীবনেও পরিবর্তন ডেকে আনে। ২০০৭ সালে স্পাসো-প্রিওব্রাঝেনস্কি সাবর খুলে দেয়া হয়। ২০১০ সাল থেকে শুরু হয়েছে বিভিন্ন রিকনস্ট্রাকশনের কাজ। নিকোলস্কায়া টাওয়ার, রেল স্টেশন, রেড স্কয়ার থেকে শুরু করে অনেক কিছুই নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে।
২০২৪ সালের ২৮ এপ্রিল আমরা রীবিনস্ক যাই। আমাদের প্রথম স্টেশন ছিল ভোলগা তীরে যুদ্ধের মেমোরিয়াল। রাশিয়ায় মনে হয় এমন কোন জনপদ নেই যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবানল এসে পৌঁছেনি। এমন কোন জনপদ নেই যেখানে সেই যুদ্ধের বীরদের উদ্দেশ্যে মেমোরিয়াল নেই। রীবিনস্কের মেমোরিয়ালের কেন্দ্রীয় সৌধ সুউচ্চ স্তম্ভ যেখানে বিমানের প্রপেলার হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন সৈনিক। আছে অনির্বাণ শিখা, যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত সমরাস্ত্র স্টেনগান, কামান, আছে যুদ্ধের শিশুদের মূর্তি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। লোকজন আসছে সেখানে, কেউ বা ফুল দিচ্ছে মনুমেন্টের পাদদেশে। সেখান থেকে দূরে দেখা যাচ্ছে ভোলগার উপরে সেতু আর স্পাসো- প্রিওব্রাঝেনস্কি সাবর। সেখানে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে বাসে করে আমরা যাব একটি পার্কে। সেটা রেল স্টেশন থেকে একটু দূরে। রেল স্টেশন আমরা দেখব বাস থেকে। সেখানে রয়েছে শিল্পীদের বাড়ি। এক সময় অনেক শিল্পী মিলে কাঠের এই সুন্দর বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। সেখান থেকে একটি ক্যাথলিক গির্জার পাশ দিয়ে আমরা যাব পার্কে। ছোট্ট সুন্দর পার্ক। বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি সেখানে। আছে জীবন্ত রাজহাঁস। আমাদের দেখে এমন ভাব নিল যে বলার মত নয়। সেখানে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে আমরা গেলাম স্কমরোখভ পাহাড়ে। আসলে এটা পাহাড় নয়, একটু উঁচু টলার মত যেখানে উঁচু দালান তৈরি সম্ভব নয়। তাই সেখানে তু-১০৪এ লাইনার স্থাপন করা হয়। শহরের মাঝখানে এত বড় এক লাইনার সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এক সময় এর ভেতরে সিনেমা হল তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে এক অগ্নিকান্ডে ভেতরের সব কিছু পুড়ে যায়। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিস থেকে উপযুক্ত অনুমতি না পাওয়ায় সিনেমা হল তৈরির পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়। এখানে দেখলাম ছোট ছোট মাইক্রোরাইয়ন বা পাড়ার ভেতরে ছোট ছোট পার্ক যেখানে বাচ্চাদের নিয়ে মায়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল রেড স্কয়ার। রীবিনস্ক আঞ্চলিক মিউজিয়াম এরই এক কোণে অবস্থিত। একটু দূরে স্পাসো-প্রিওব্রাঝেনস্কি সাবর। আশে পাশে অনেক খাবার দোকান। এরকম একটা ক্যাফেতে আমরা খেয়ে গেলাম গির্জায়। সেখান থেকে ভোলগার উপরে সেতুতে। এখন সেখানে নির্মাণ কাজ চলছে যদিও সেখান দিয়ে ঠিকই গাড়িঘোড়া চলছে সীমিত পরিমাণে। আমরা অনেকদুর পর্যন্ত হেঁটে গেলাম ব্রীজের উপর দিয়ে। ব্রীজের যেখানে শুরু সেখানে ভোলগার সমান্তরালে যে রাস্তা সেটাই মনে হয় এখানকার প্রধান সড়ক – অন্তত পর্যটকদের জন্য। অনেক পুরানো বাড়িঘর। পুরানো মানে বিপ্লবের আগে তৈরি অবস্থাপন্ন মানুষদের বাড়িঘর। সেখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা এলাম রেড স্কয়ারে যেখানে দাঁড়িয়ে লেনিন সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। নীচে এক লোক গিটার বাইয়ে গান গাইছিলেন। উশাকভ সরণীতে রয়েছে অ্যাডমিরাল উশাকভের আবক্ষ মূর্তি। সেসব ঘুরে আমরা এলাম ভোলগা তীরে। সেখানে রয়েছে গুণটানা মানুষের ভাস্কর্য। একটু দূরে রয়েছে এখানকার অন্যতম প্রধান ভাস্কর্য – সিনেমার নায়ক অস্তাপ বেন্দার ও তার সাগরেদের মূর্তি। কত লোক যে তাদের সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। গুলিয়াও সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি। এখানে যে জিনিসটি বেশি করে চোখে পড়ল তা দোকানপাট বা রাস্তাঘাটের নাম। সব নামের শেষে একটি বিশেষ চিহ্ন – যা বিপ্লব পূর্ববর্তী রাশিয়ায় বিশেষ ভাবে ব্যবহার করা হত। এখনও সেটা ব্যবহার করা হয়, তবে আগের মত শব্দের শেষে নয়। যার ফলে পুরানো দিনের ঘরবাড়ির মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল যেন শতাধিক বছর পেছনে চলে গেছি। এরপর আমরা গেলাম রীবিনস্ক আঞ্চলিক মিউজিয়ামে। সেখানে ঐতিহাসিক জিনিসপত্রের বাইরেও ছিল আর্ট গ্যালারী। শিশকিন, লেভিতান ও অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি ছিল সেখানে। তারপর গেলাম পিয়ানো মিউজিয়ামে। বিভিন্ন আঁকার ও টাইপের কত যে পিয়ানো। এক মহিলা সেসব পিয়ানো বাজিয়ে শোনালেন। কত ভিন্ন রকমের শব্দ যে সেসব থেকে বেরোয়! সেখান থেকে আমরা যখন বেরুলাম ঘরে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। প্রায় তিরিশ কিলোমিটার লম্বা এই শহর ভোলগার তীর বরাবর বিসৃত। পর্যটকদের যেহেতু মূলত শহরের দর্শনীয় স্থানেই নিয়ে যায় তাই অনুমান করি সেটা এই ক্রেস্তভ রাস্তা ঘিরেই।
রীবিনস্কের ভিডিও
ছবিতে রীবিনস্ক
http://bijansaha.ru/album.php?tag=292
0 Comments