না পাওয়া
পুলককান্তি কর
- তোমার লাস্ট গল্পটা যেটা পড়তে দিলে, ওটা নিয়ে একটু কথা বলার ছিল অমিয়দা।
- কোন গল্পটা পর্ণা?
- ওই যে মোহালি আর টুবাই নিয়ে গল্পটা! নাম তো এখনও দাওনি ওটার!
- কী বলবে? ভালো লাগেনি বুঝি?
- না, ভালো লেগেছে। তবে ওই যে মোহালি প্রেম করে এটা জেনেও টুবাই ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিল - ওই জায়গাটা আমার পছন্দ হয়নি।
- কী করলে ভালো হত? প্রশ্ন করল অমিয়।
- না মানে টুবাই যেমন চরিত্রের ছেলে - ও এইটা বলে কেমন ‘ফেকলু’ হয়ে গেল না! বরং নিরুচ্চার ছিল - সেটাই ভালো লাগছিল।
- জানো পর্ণা - ভালোবাসায় কোনও কোনও সময় মুখে বলারও প্রয়োজন হয়। তুমি খেয়াল করে দ্যাখো - টুবাই যদি তার হৃদয়ের কথাটা না বলে উঠতে পারতো- গল্পটা এগোতোই না। নিরুচ্চার প্রেমগাথা হয়েই থেকে যেতো আমার ওই ‘কুয়াশা ভোরাই’ গল্পটির মতো।
- তা ঠিক। তবে টুবাই আসলে খুব সূক্ষ্ম রসবোধের ছেলে তো। আমার মনে হলো ও যেন হিউমিলিয়েটেড হলো ওইখানটায়।
- ‘ভালোবাসা’ ভাবলে আর হিউমিলিয়েশান আসে কিভাবে পর্ণা? দুটো শব্দ তো বিপ্রতীপ! অন্য কোনও সাজেশান থাকলে বলতে পারো।
- কেন? এখনো ছাপতে যায়নি লেখাটা?
- যায় নি। পূজোর জন্য চেয়েছিল গল্পটা। এখন বলছে উপন্যাস চাই। তাই ভাবছি অন্য কোনও ভালো জায়গায় দিয়ে দেব লেখাটা।
- ওই গল্পটায় মোহালি কিন্তু একবারও স্বীকার করলো না যে সেও টুবাইকে ভালোবাসে। একবার অন্তত যদি কোনও ইঙ্গিত দিতে, তবে বোধহয় পাঠকের শান্তি হতো।
- তুমি কী ভাবো পর্ণা? আমি লেখক বলে সব কিছুই আমার হাতে? আমি চাইলেই সব বদলে দিতে পারি? লেখাটা আসে পর্ণা; আমি লিখিনা।
- আচ্ছা অমিয়দা, মোহালি টুবাইকে ভালোবাসতো, নাকি বাসতো না?
- তোমার কি মনে হয় একজন পাঠিকা হিসেবে?
- ভালোবাসতো বলেই তো মনে হয়। ওর ক্রিয়াকলাপও তো সেইরকমই। অ্যাটলিস্ট ভালোবাসতো ভাবতে তো ভালোলাগে। কিন্তু তুমি সরাসরি কিছু ইঙ্গিত দাও নি। তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি।
- সব পাঠক পাঠিকা কি আমায় জিজ্ঞেস করে মনষ্কামনা পূর্ণ করবে পর্ণা? যেমনটা তোমরা বুঝেছ - লেখকও তেমনটাই বুঝেছে।
- না অমিয়দা, তুমি বলো, লেখকের অভিপ্রেতটা কি?
অমিয় একথার কোনও উত্তর করল না। সামনে একটা বাছুর ছুটে গেল বলে জোরে ব্রেক করল গাড়ীটার। মেইন রোডে গরু ভেড়া উঠে গেলে গাড়ী চালানোটা বড় হাঙ্গামার। নিজেকে সামলে বলল, ‘আচ্ছা পর্ণা, হঠাৎ বাপের বাড়ী যাচ্ছো যে?’
- মা অনেকদিন থেকেই ঘ্যান ঘ্যান করছিল। গত দু-তিন ধরেই বলছিল একটু জ্বর সর্দি কাশির মতো হয়েছে। তাই ভাবলাম একবার ঘুরেই আসি।
- তা কাল যখন বিকেলে তোমার বাড়ী গেলাম - তখন বললে নাতো?
- তখনও ঠিক করিনি। রাতে যখন ফোন করলাম মা’কে, তখনই ঠিক করলাম। তারপরেই তোমাকে কনফার্ম করেছি।
- ভবা জানে?
- হ্যাঁ, কালকেই বলেছি ওকেও।
- ভবা কবে আসবে আবার? এমাসে আসবে?
- শেষের দিকে একটা টিকিট তো কেটে রেখেছে শুনেছিলাম। এখনও কনফার্ম নয়।
- আচ্ছা পর্ণা, তোমার কাজের মেয়েটি কি আসবে এ ক’দিন। মানে তুমি যদ্দিন না ফিরছো?
- দ্যাখো কবে আমি আসবো ঠিক নেই, তাই ওকে আর বলিনি। তোমার কাছে তো এক সেট চাবি আছে। তুমি খুলে গাছ-টাছগুলোয় জল দিয়ে দিও, সন্ধ্যায় একটু প্রদীপটাও জ্বেলে দিও।
- কদ্দিন আমায় বেঁধে রাখবে শ্রীময়ি? সকাল সন্ধ্যা এখানে ডিউটি দিলে আমার কাজকর্ম হবে কখন?
- তুমি বাড়ীতে থেকেই বা কী করবে অমিয়দা? ওখানেও রেঁধে খাও, এখানেও খাবে। তুমি তোমার লেখার সরঞ্জাম আর জামাকাপড় নিয়ে এ বাড়ীতেই থেকে যাও ক’দিন।
- হ্যাঁ – এই করি আর কি? কপট রাগের ভঙ্গি করল অমিয়। পথে যেতে যেতে একটা ডাবওয়ালা দেখে গাড়ী দাঁড় করাল সে। জিজ্ঞাসা করল- ‘ভাই ডাব কত করে?’
- পঁচিশ টাকা বড়টা, মাঝারিটা কুড়ি...
- জল হবে তো ভালো?
- হ্যাঁ। খান না। খেয়ে পয়সা দেবেন।
- দাও দেখি দুটো করে ডাব! কচি শাঁস দেখে দিও। নাও পর্ণা ডাব খাও - সস্তার ডাব!
- পঁচিশ টাকার ডাব শস্তা হয়ে গেল অমিয়দা?
- জীবনে বাজারে যাও পর্ণা? বাজারে গেলে তো শুধু কসমেটিক্স নইলে মল। আমাদের সি.আই.টি তে ডাব এক একটা এখন পঞ্চাশ টাকা। কালকেই খেলাম।
- দিয়া যখন পেটে ছিল, তখন তো রোজ ডাব খেতাম। কত করে তখন আনতে অমিয়দা?
- আট টাকা, দশ টাকা। সেও হয়ে গেল আজ আঠারো বছর!
- সত্যি দিন কেমন চলে যাচ্ছে, না? মনে হচ্ছে - এই তো সেদিন দিয়া যখন এল - কিছু খেতে পারতাম না তখন। মা কদিন এসেছিল - তা বাবার এমন তাড়া এল - সেও চলে গেল। ভাগ্যিস তুমি ছিলে তখন। রোজ এটা ওটা করে দেওয়া, ডাব কিনে আনা, ডাক্তার দেখানো - কৃতজ্ঞতায় নম্র গেল পর্ণার স্বর!
- ও কথা আর তুলছো কেন পর্ণা? আমি বেকার মানুষ! আমার কি আর সময় দেখলে চলে? আচ্ছা বলতো - তোমার বাপের বাড়ীটা কি ডায়মন্ড হারবার পেরিয়ে যেতে হয়, নাকি তার আগে? সেই তোমার বিয়ের সময় এসেছিলাম। তারপর তো বোধহয় আসিনি আর!
- এসেছিলে। আমার একবার জন্ডিস হয়েছিল বিয়ের বছর দুই পরে। তখন আমি এখানেই ছিলাম। দিয়ার বাবার সাথে তখন এসেছিলে একবার।
- ও আচ্ছা! তা ডায়মন্ড হারবার পেরিয়ে যাব কি?
- হ্যাঁ। ওখান থেকে আরও চার কিলোমিটার।
- পর্ণা - নৌকো চড়ে কুঁকড়াহাটি যাবে? শুনেছি ডায়মন্ড হারবার থেকে নৌকো চলে - ওদিকে কুঁকড়াহাটি পর্যন্ত। অনেকক্ষণ নৌকোর মধ্যে - বেশ মজা হবে।
- এখন আর তত মজা নেই অমিয়দা! এখন এই রুটে সরকারি লঞ্চ চলে।
- যাঃ শালা! নগরায়ন হতে হতে সব রোমান্টিক ব্যাপারগুলো টেঁসে গেল। এই জন্যই এখনকার ছেলেমেয়েরা আর আমাদের কালের মতো হাত ছোঁয়াছুয়ি মার্কা রোমান্টিসিজম ভাবতে পারে না। এই দেখলাম সেদিন অটোতে একটা মেয়ের চুল উড়ে এসে একটা ছেলের মুখে লাগছিল বলে ছেলেটি ইংরেজিতে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিল। আমরা তো মনে মনে ভাবতাম - আহা এ রেশমী জুলফে, এ সরবতী আঁখে...
- এত রোমান্টিক হয়ে তুমি কী করলে অমিয়দা। না ছুঁতে পারলে কারো হাত - না চুল! খালি লিখে গেলে, লিখেই গেলে...
- ছাড়ো এসব। এবার ভবা এলে কি তোমরা দিয়ার কাছে যাবে? নাকি এবারও ওর সময় হবে না?
- কী করে বলব অমিয়দা? জানোই তো ওকে। এখন তো এখানেও আসার সিওরিটি নেই! দিয়ার কাছে গেলে আগে থেকে টিকিট করাতে হবে তো! এখন তো আর হুট করে টিকিট পাওয়া যায় না। তিনমাস আগে টিকিট করতে হয়।
- সে সুযোগ ভবার জীবনে কখনও আসবে না পর্ণা! তেমন হলে তোমরা তৎকালে কেটে বেরিয়ে যাও। মেয়েটারও তো মনে হতে পারে - বাবা দেখা করতে আসে না। ভবাকে জিজ্ঞেস ক’রো, নইলে ওই সময়টায় আমিই না হয় দিয়ার কাছ থেকে ঘুরে আসবো।
- দেখি কথা বলে ওর সাথে। ও যদি না আসে - তাহলে তোমার সাথে না হয় আমিও যাব অমিয়দা। কত মাস মেয়েটাকে দেখি না।
- আর তো একবছর পর্ণা। গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলে যে মেয়েটা আবার কোথায় যাবে মাস্টার্সের জন্য কে জানে! এমন একটা সাবজেক্ট – বেশী জায়গায় তো কোর্সটাই নেই। জি.আর.ই, টি.আর.ই লাগাতে পারলে তো কথাই নেই। একেবারে বিদেশ। দুবছরে তিনবছরে একবার দেখা। এখন থেকেই মন শক্ত করো পর্ণা। ধরে নাও মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
- আমার মন শক্ত অমিয়দা। তুমিই যা দিয়া দিয়া কর সারাদিন – তুমিই বরং মন শক্ত কর। ও বাইরে চলে গেলে তোমার কী হবে আমি সেই চিন্তা করি।
- তুমি আর চিন্তা করো না পর্ণা। জানো না লেখকের মন শক্ত হয়? এত বিচ্ছেদ ছাড়াছাড়ি করে দিতে ওদের হাত কাঁপে না। আমার কিছু হবে না। তোমারই কষ্ট হবে। অবশ্য দিয়ার বিয়ে হতে আরও ছ’বছর মিনিমাম। ততদিনে ভবা’র রিটায়ারমেন্ট হয়ে যাবে। ও তখন নিশ্চই তোমাকে সময় দেবে।
- তুমি সেই আনন্দে থাকো অমিয়দা। ও বাড়ী থাকার লোক? দেখবে অন্য কোনও চাকরীতে জয়েন করেছে।
- ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আবার অন্য কী চাকরী করবে?
- আজকাল তো জানো না, সব রিটায়ারমেন্টের পরে বিভিন্ন কোম্পানির কন্সালট্যান্ট হয়ে যায় নইলে ফিনান্স ম্যানেজমেন্টের ব্যবসা করে।
- তোমাদের আর টাকার দরকার আছে কি পর্ণা?
- টাকার দরকার তো প্রয়োজনীয়তার জন্য নয়। দিয়ার বাবার কাছে ওটা একটা তাগিদ বেঁচে থাকার! নইলে এখন তো ভি.আর.এসও নিতে পারে। গত সতেরো বছর ধরে তো বাংলার বাইরে বাইরে পোস্টিং। যদি বা বাংলায় দেয়, বাড়ী থেকে এতদূরে যে এর থেকে বাইরে হলেই ছিল ভালো।
- তুমি কখনও এ ব্যাপারে কিছু বলো না?
- না অমিয়দা। তুমি তো জানো আমার যখন বিয়ে হয়, তখন আমার বয়স মাত্র একুশ। ওর বয়েস তখন বত্রিশ। তখনই ও একটা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে বর্ধমানের এক মফস্বল অফিসে চাকরি করত। শাশুড়ীকে দেখাশোনার জন্যই সম্ভবত গ্রাম থেকে সুশীলা মেয়ে খুঁজে বিয়ে করেছিল। সে বউ এর দায়িত্বই সামলেছে সারাজীবন – তার বরের সঙ্গিনী হতে পারেনি কোনওদিন।
অমিয় কোনও উত্তর করল না। ওর অজানা নয় দিনগুলো। ভবতোষের বাবা ওর খুব অল্প বয়সেই মারা যান। ওর মা, বাবার পেনশনের টাকায় অনেক কষ্টে ওকে মানুষ করেন। সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রমে আর চিন্তায় ভবার মা’র স্বাস্থ্য ভেঙ্গেই গিয়েছিল। ভবা যখন চাকরী পায়, তখন ওর মা একেবারেই শয্যাশায়ী। অনেকটা মায়ের সুশ্রুষা ও দেখাশোনার জন্যই ভবার বিয়ে দেওয়া। এই ষড়যন্ত্রের অন্যতম কান্ডারী সে নিজেই। ভবতোষ যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ে, অমিয় তখন থেকেই ওর বন্ধু। গ্রাজুয়েশনের সময় ভবতোষ গেল কমার্স লাইন এ, অমিয় বাংলায়। তবে বন্ধুত্বটা থেকে গেছে এখনও। প্রথম প্রথম শ্রীপর্ণা এত শত পেরে উঠতো না। তবে গ্রামের মেয়ে তো! শারীরিক সামর্থ্য এবং সংসার গড়ার একটা চেষ্টা অন্তত এদের থাকে। অমিয় তখন একে অনেকটাই সাহচর্য দিয়েছে। অমিয়ের তখন এত নাম যশ হয়নি। পারিবারিক কারণেই হোক বা যে কোনও কারণে অমিয় বরাবরই জমদারি মেজাজের লোক। কোনওদিন চাকরীর চেষ্টাও করেনি, ব্যবসা বাণিজ্য করার কথাও ভাবেনি। বেলেঘাটা সি.আই.টি মোড়ের কাছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিরাট বাড়ী। অল্প স্বল্প জমিজায়গাও আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ও একমাত্র ছেলে। বাবা মা মারা যাওয়ার পর দু-একটা জায়গা বিক্রি করে ঝামেলার পরিসরও কমিয়ে ফেলেছে সে। এখন অমিয় একেবারেই ঝাড়া হাত-পা।
- তুমি দুপুরে খাবে কিনা বলেছো মা কে? এখন তো প্রায় একটা বাজে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
- হ্যাঁ। তুমিও যে খাবে ওখানে, সে কথা বলে দিয়েছি। তা আর কতদূর অমিয়দা? রাস্তাঘাট সব বদলে গেছে। কোথায় এলাম বুঝতেও পারছি না।
- জি.পি.এস দেখাচ্ছে এখনও আধঘন্টার মতো পথ। পর্ণা, আমি আর ওখানে খাবো না আজ। ফিরতে অনেক দেরী হয়ে যাবে।
- না খেলে খাবে কোথায়? দুপুরে তো খেতে হবে কোথাও! তুমি খেয়ে দেয়েই বেরিয়ে পড়ো, আমি আটকাবো না।
- আজ কি আর তোমাদের বাড়ী যেতে হবে? নাকি কালকেই যাবো?
- সে তোমার যা খুশী। আমি গাছে ফাছে জল দিয়েই এসেছি। সেরকম হলে একেবারে কালকেই যেয়ো।
- সেই ভালো। কাল একদম সকাল সকালই চলে যাবো ভাবছি। তোমাদের ওখানের হোম ডেলিভারি’র ফোন নাম্বারটা দাও তো! কাল আর রান্নাবাড়ীর ঝামেলা করবো না। উপন্যাসটা শেষ করতে হবে আর দিন দশেকের মধ্যে। খুব তাড়া লাগাচ্ছে ওরা।
- ঠিক আছে। এখুনিই তোমার ফোনে এস.এম.এস করে দিচ্ছি। মনে করে খুলে দেখো। আচ্ছা - তোমাকে করতে হবে না - আমিই ফোন করে দেব কাল হাবুকে - ও একটা-দেড়টা নাগাদ এসে মিল দিয়ে যাবে। কী খাবে কাল? চিকেন বলে দেবো?
- সে যা হয় কিছু একটা বলে দিও। পেট ভরানোটাই তো বিষয়।
- তুমি এক কাজ করো অমিয়দা! দিয়া যে টেবিলটায় পড়তো - ওটা আমি কালকেই সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছি। ওই যে অয়েল ডিফিউজারটা আছে না, ওতে ওই ল্যাভেন্ডারের তেলটা দিয়ে লিখতে বসো। ওই গন্ধে মনটা ভালো হয়ে যাবে। লেখাটাও খুলবে।
- মন ভালো থাকলে তো চলবে না পর্ণা। বিষাদের জায়গা ছুঁয়েছি এখন।
- তা ল্যাভেন্ডার বিষাদেও ভালো কাজ দেয়! মজা করল পর্ণা! আর তা নইলে নিম তেল দিয়ে দিও।
- সে না হয় দেব, কিন্তু তোমার গ্যাসের বুকিংটা কালকেই করানোর ছিল না? করিয়েছো?
- হ্যাঁ। ফোন করে দিয়েছি।
- আর একটা চেক যেটা ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার ছিল?
- সে তো ভুলে মেরে দিয়েছি অমিয়দা। কী হবে?
- ও আমি দিয়ে দেব কাল।
- ও থাক না অমিয়দা। তোমার লেখার তাড়া আছে বললে।
- আমি কি টানা লিখি নাকি পর্ণা? মাঝে মাঝে বিশ্রামও তো নিই। তখনই দিয়ে আসবো।
- আরে এত সিরিয়াসলিই বা নিচ্ছ কেন তুমি? আমি ফিরে এসেই না হয় জমা দেব। আর্জেন্ট তো কিছু নেই!
- কতদিন চেকটা পড়ে আছে বলো তো? এই তুমি দিচ্ছি দেবে করলে, নইলে কবে আমি জমা করে দিতাম! ভবা যদি অনলাইন চেক করে তবে তোমায় বকবে।
- ও আর এমন কী? ঠিক আছে তুমি যেটা ভালো বোঝ করো। এই যে সামনের রাস্তাটা ওখান থেকে ডান দিকে টার্ন নিও।
- ওই দিকেই তো নদীটা পড়বে, না?
-হ্যাঁ। আমাদের বাড়ির পাশেই তো! হেঁটে পাঁচ – সাত মিনিট।
- লোভ দেখিও না পর্ণা। আজ তাহলে থেকে যেতে ইচ্ছে হবে।
- হলে হবে। তুমি তোমার মর্জির মালিক। কাউকে তো কৈফিয়ৎ দেবার নেই। থেকে যাও; বিকেলে যাব নদীর পাড়ে।
- না পর্ণা। আজ থাক। লেখাটা সত্যিই জরুরী। যেদিন তোমার ফেরার ইচ্ছে হবে - তার আগের দিন না হয় চলে আসবো এখানে। সন্ধের নদী দেখতে খুব ভালো লাগে। সেদিনও দেখবো, পরের দিন যদি তোমার ঘুম ভাঙে সকালে, তবে ভোরেও দেখবো নদীটা তোমাকে প্রেক্ষাপটে রেখে। বলো, এবার কোনদিকে যাবে?
- ওই তো বঁদিকে ঘুরেই ডানদিকের বাড়ীটা। মনে পড়ছে?
- হ্যাঁ – অনেকটা একই রকম আছে সামনেটা। তুমি নামো, আমি জিনিসপত্র নিয়ে নামছি।
ঘন্টা দুই তিনেকের মধ্যেই বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিল অমিয়। ওর একা একা ড্রাইভ করতে ভালো লাগে না। বেশীর ভাগ দিনই এমন সময় সি.ডি. টা চালিয়ে প্রিয় গানগুলো শোনে। আজ আর সেসব ইচ্ছে হ’ল না তার। এই ফাঁকে উপন্যাসের আগামী অংশটুকুর কিছুটা চলন মনে মনে আভাস পেতে চাইল সে। কিন্তু কোথাও যেন মন লাগলো না ঠিকমতো। ডায়মন্ড হারবারে পৌঁছে নদীর ঠিক পাড়টায় গাড়ীটাকে দাঁড় করালো সে। মস্ত বড় মোহনা। জলের এত বিস্তার যে মনটারও তল পাওয়া যায় না এখানে। হঠাৎ দেখলো পর্ণার ফোন। ‘কী হলো?’
- কদ্দুর পৌঁছালে?
- এই তো ডায়মন্ড হারবার।
- নিশ্চই দাঁড়িয়ে গেছো নদী দেখে?
- হ্যাঁ।
- জানি তো। এই জন্য ফোন করে তাড়া লাগালাম। প্রায় পাঁচটা বাজে। অন্ধকারে তোমার চালাতে কষ্ট হবে। স্টার্ট দাও।
- এই যাচ্ছি। পাঁচ মিনিট পরে।
- না, তুমি এখুনি যাও। স্টার্ট দাও, তবে ফোন ছাড়বো।
- আচ্ছা মেয়ে বাবা তুমি।
- জানোই তো! মিছিমিছি সময় নষ্ট করছো কেন? যাও।
অমিয় স্টার্ট দিল গাড়ীটার। সূর্যাস্তের মেঘ দেখা যাচ্ছে আকাশে। কতরকম রঙের ছটা! ঈশ্বর নিজে তুলি নিয়ে আঁকতে বসেন এই সময়টায়। রাস্তার দিকে মন দিল অমিয়। আজ আর বাড়ী যাবার ইচ্ছে নেই। মুচিপাড়ায় ভবাদের বাড়ীতেই থাকবে সে। রাতের খাবারটুকু কিনে নিলে হবে।
২
খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লো অমিয়। প্রাতঃকৃত্য সেরে একটু চা খেল বেশ আরাম করে। এবার স্নান করে লিখতে বসবে সে। ল্যাভেন্ডারের তেলটা খুঁজতে কিছুটা সময় গেল তার। সাধারণত যে র্যাকে এগুলো রাখে পর্ণা - সেখানে খুঁজতে গিয়েই দেরী হল। পর্ণা আগেভাগেই ওটা দিয়ার পড়ার টেবিলে রেখে গেছে। একটু ব্রেকফাস্ট বানিয়ে নিল সে ব্রেড সেঁকে। মুডটাকে একটু বানিয়ে নিল, নিলয় নামের চরিত্রতে ঢুকতে হবে এবার। একটা ডোরবেল বাজলো। পেপার কি বন্ধ করে যায়নি পর্ণা? থাক গে। পেপার দেখতে বসলেই সকালটা যাবে মিছিমিছি। গ্যাঁট হয়ে বসে রইল সে। আবার ডোরবেল বাজতেই উঠে গিয়ে দরজা খুললো সে – ‘একি পর্ণা তুমি?’
- চলে এলাম। দরজা খুলছিলে না কেন? লেখায় তন্ময় ছিলে নাকি?
- না,না। ভাবলাম পেপার ওয়ালা বুঝি! তা তুমি চলে এলে যে?
- এমনিই।
- এমনি মোটেই না। তুমি ফোন করোনি কেন? নিয়ে আসতাম তাহলে! কী হলো? চুপ করে রইলে যে!
- কী বলব? ইচ্ছে হল, চলে এলাম।
- সে না হয় এলে, কিন্তু এলে কীভাবে?
- কেন আমজনতার বাহন!
- বাসে এসেছ? তাহলে তো খুব ভোরে বেরিয়েছ বোধহয়!
- হ্যাঁ। পাঁচটার বাস ধরেছি। ধর্মতলায় এসে একটা ট্যাক্সি নিলাম।
- ফোন করলে না কেন পর্ণা? আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম।
- তাহলে তো অনেক দেরী হয়ে যেত!
- কীসে দেরী হত পর্ণা। খুলে বলই না ছাই! বুঝতে পারছিনা তো কিছুই।
- তুমি যদি সকালে আমাকে আনতে বেরোতে - আসতে তো আমার বিকেলই হতো – সে কথাই বলছি।
- কেন, ধর্মতলা থেকে অন্তত এখানে তো নিয়ে আসতে পারতাম! অভিমান ঝরে পড়লো অমিয়’র গলায়।
- তুমি বললে তোমার লেখার তাড়া। তাই!
- লেখার তাড়া আছে বলেই কি ওরা আমার গলায় পাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে পর্ণা? যা হোক, হঠাৎ চলে এলে কেন সেটা বলো!
চুপ করে রইল পর্ণা।
- কী হল বলো? তাড়া লাগালো অমিয়।
- কাল একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম।
- কেমন দুঃস্বপ্ন শুনি।
- বলা যাবে না।
- বলা যাবে না অথচ চাক্ষুষ এসে দেখা যাবে! রাগের গলায় বলল অমিয়।
- প্লিজ অমিয়দা, বলতে পারবো না। জোর করো না।
- আরে বলে ফ্যালো পর্ণা। দেখবে, বললে ভালো লাগবে।
- আসলে তুমি জড়িয়ে এতে। তাই...
- ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করব না। তাছাড়া এটা স্বপ্ন – এই জ্ঞানটুকু আমার আছে।
একটু চুপ থেকে পর্ণা বলল, ‘কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম দিয়ার বাবা আমাকে ডিভোর্সের নোটিশ দিয়েছে।
- তো! এটা আমাকে না বলার কি আছে?
- ডিভোর্সের কারণ নাকি তুমি?
- আমি?
- এমন স্বপ্ন কেন দেখলাম অমিয়দা। লোকে বলে সাবকনসাসে এসব ভাবলে নাকি স্বপ্নে আসে। আমি তো কখনো এমন কিছু ভাবিনা।
- আসলে কাল অনেকগুলো গল্পের ভালো মন্দ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তো, তারপরই ভবার বিয়ে করা ইত্যাদি নিয়েও কথা হ’ল। সেসবই বোধহয় স্বপ্নে এসেছে। এসব নিয়ে তুমি ভেবো না।
- কিন্তু ও তোমাকে দায়ী করছে - এটাই আমার খারাপ লাগছে। আমি ভাবছি, সত্যি সত্যি ও এমনটা ভাবে না তো?
- ভবা কি এনিয়ে তোমাকে কোনওদিন কিছু বলেছে? অন্তত আকারে ইঙ্গিতে? একটু ভালো করে ভেবে দেখ তো পর্ণা!
- না অমিয়দা। তাছাড়া ও কোন মুখে বলবে একথা! ও নিজে জানে না সংসারের প্রতি ওর কন্ট্রিবিউশান? অসুস্থ মা আর নবোঢ়া বউ দুজনকে তোমার ঘাড়ে ফেলে ও চাকরী সামলেছে। মা যখন মৃত্যু শয্যায় – ও নেই। ডাক্তার হাসপাতাল সব তুমি করেছ। একদিন পর দয়া করে এসে সে শুধু মুখাগ্নি করে পুত্রের দায় সামলেছে। দিয়া যখন হ’ল – কে ছিল নার্সিংহোমে? ওর তো তখন জলপাইগুড়ি পোস্টিং। মেয়ের মুখ দেখল যখন, তখন আমার নার্সিংহোম থেকে ছুটি হয়ে গ্যাছে। ষষ্ঠী পূজোর দিন ও এল। অথচ ও দাম্পত্যের সব দাবী দাওয়া আদায় করেছে ষোল আনাই। সে বলবে কোন মুখে?
- দ্যাখো পর্ণা, মানুষ তার নিজের দোষ বিশেষ দেখে না। যে কোনও কিছুতে অন্য কারোকে অভিযুক্ত করতে পারলেই সে খুশী হয়। আমার তোমাদের ব্যাপারে ইনভলভমেন্টে ভবা যদি অখুশী হয় – সেটা অযৌক্তিক নয়।
- আছা অমিয়দা দিয়ার বাবার সাথে তোমার তো মোটামুটি নিয়মিত কথা হয়। কী কথা বলে ও?
- এই আমি এখানকার সব ইনফর্মেশন দিই। তোমাদের কথা হয়, দিয়ার কথাও হয়। ও আমাদের অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের খোঁজখবর নেয়। ইয়ারকি ফাজলামি হয় - সেই ব্যাচেলার আমলের মতো।
- ও তোমাকে কখনও এরকম ইঙ্গিত করেছে অমিয়দা?
- না। কখনোই নয়। ভবা তেমন ছেলে নয় পর্ণা। নিছক একটা স্বপ্ন দেখেছ – তাকে এত সিরিয়াসলি নিও না।
একটুক্ষণ চুপ করে রইলো দুজনেই। তারপর হঠাৎ পর্ণা বললো, ‘একটা কথার সত্যি উত্তর দেবে অমিয়দা?’
- তোমাকে কোন কথাটা আমি মিথ্যে বলি?
- না তা নয়। আসলে এতবছর বাদে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাইছি; একটু কুণ্ঠা ও হচ্ছে...
- কুণ্ঠার কিছু নেই পর্ণা। বলো, কী জানতে চাইছো?
- তুমি বিয়ে করোনি কেন অমিয়দা?
- করার আর সময় পেলাম কই?
- কেন? সময়ের অভাব কখন ছিল?
- না মানে যখন বিয়ের বয়স ছিল তখন বাবা-মা মারা গেলেন, জোর করার কেউ ছিল না।
- এটা পুরো ঠিক কথা নয় অমিয়দা। তখন তুমি আমার সংসার নিয়েই ব্যস্ত ছিলে। শাশুড়ীকে দেখা, আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে সংসারের উপযুক্ত করা - এর মধ্যে শাশুড়ী মারা গেলেন, দিয়া হলো - ওর বেড়ে ওঠা, সব কিছুতেই তুমি এত মগ্ন হয়ে গেলে যে – তোমার আর বিয়ে করা হল না।
- বিয়ে করলে এক্সট্রা কী হতো?
- তোমার নিজের সংসার হ’তো। তুমি মানসিক ভাবে তো খুবই সংসারী!
- নিজের সংসার মানে কী পর্ণা? এটা কি আমার সংসার নয়? তুমি কি আমাকে পর ভাবো, নাকি দিয়া ভাবে?
- দিয়া তো তোমাকে নিজের বাবার চেয়েও বেশী পছন্দ করে অমিয়দা। ওর বাবা শুধু ওর বায়োলজিক্যালি বাবা। কিন্তু বাবার কোন কাজই ও করেনি। ওর ছোটবেলায় ন্যাপি বদলানো, পটি কাচানো, স্কুলে ভর্তি করা, অসুখ হলে সেবা করা – কোনটা করোনি তুমি? ও তোমাকে খুবই ভালোবাসে।
- তাহলে আমার সংসার না হওয়ার দুঃখ করছ কেন?
- তুমি লেখক, তুমি বোঝনা কি বলতে চাইছি আমি?
- সে বুঝেছি। কিন্তু সব বোঝা বুঝতে নেই পর্ণা। আর বুঝলেও বোঝাতে নেই।
- কিন্তু কালকেই তুমি বলেছো কিছু কিছু কথা মুখে প্রকাশ করা দরকার।
- তা ঠিক। তবে অনেক সোচ্চার কথা আবার সংযমের বাঁধন ঢিলে করে দেয় পর্ণা।
- কিন্তু তুমি তো বঞ্চিত হলে অমিয়দা!
- বঞ্চনা কিসের? আমি যদি বিয়ে করতাম তবে তোমাকে কি এভাবে পেতাম, না কি দিয়াকে?
- আমাকে আর কি পেয়েছ অমিয়দা? আমি তো তোমায় কিচ্ছুটি দিতে পারিনি।
- রক্ত করবী মনে আছে তোমার? ওখানেও নন্দিনী বিশু পাগলকে একই কথা বলেছিল। উত্তরে বিশু পাগল কী বলেছিল তোমার মনে পড়ছে?
- না।
- বলেছিল, তোমার সেই না দেওয়াকে আমি কপালে টিপ্ পরে চলে যাবো। জয় গোস্বামী খুব সুন্দর করে লিখেছেন এটা – ‘সমস্ত না পাওয়া আমি নিলাম দুহাতে/দ্যাখো - আর জায়গা নেই হাতে।‘ যাকে তুমি না পাওয়া বলছ, তাতেই আমি পূর্ণ হয়ে গেছি পর্ণা। আর নতুন কিছু নেওয়ার জায়গা নেই এখানে। তুমি আছো বলেই তো লেখা আছে আমার! দাওনি বলছ কেন? নাও বসো এখানে। তোমার তো ব্রেকফাস্ট হয়নি নিশ্চই। আমি কতগুলো স্যান্ডউইচ বানিয়ে আনছি। ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল অমিয়। পর্ণা ওইদিকে চেয়ে বসে রইল! বসেই রইল।
-
0 Comments