শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬৮ / সালেহা খাতুন
২০০১ সাল বাবা এবং আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাবা ঐ বছর এপ্রিলে রিটায়ার করলেন আর আমি জুলাইয়ে মেদিনীপুর কলেজে জয়েন করলাম। প্রথম সন্তানরূপে সংসারের হাল আমার ধরার কথা। কিন্তু তখন আমার আলাদা সংসার হয়ে গেছে। পুত্র-কন্যার ভেদাভেদ করছি না। এখনকার দিনে পুরোপুরি কৃষিজীবী না হলে পুত্রসন্তানও আলাদা গৃহ তথা আলাদা সংসার নির্মাণ করে। বিবাহের পর শুধু কন্যাকেই পিতৃগৃহ ছাড়তে হয় তা নয় পুত্রকেও এখন পিতৃগৃহ ছাড়তে হয়। এ প্রসঙ্গে একটি মজার কথা মনে পড়লো। সালাউদ্দিন শ্যামনগরে থাকাকালীন একদিন বলেছিলেন, “ তোমাকে আস্তে আস্তে আমি সাহাপুর থেকে তুলে নেবো”। কিন্তু কে যে কাকে তুলে নিল! দুজনেই জেলান্তরিত হয়েছি।
পড়াশোনা পড়ানো সবই চলছে। যে যাঁর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। বাবা তাঁর কনিষ্ঠ কন্যার বিবাহ দিলেন অক্টোবরের সাত তারিখ। বড়োমেয়ের কথা ভেবে পুজোর ছুটিতেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। আমাকে নিয়ে বাবার গর্বের শেষ নেই। বিবাহ অনুষ্ঠানে কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। গর্ব ভরে বাবা বলছিলেন, “আমার বড়ো মেয়ে কলেজে অধ্যাপনা করে,অধ্যাপক”। বাবাকে আমি কী দিয়েছি? কিছুই না। বিশেষ করে অর্থ তো নয়ই। স্যার বলেছিলেন, “তুমি ভাবছো, চাকরি পেলে সব সমস্যার সমাধান হবে, মোটেই না। দেখবে তখন কত পাওনাদার হাজির হবে”। স্যারের কথা সত্যি হয়েছিল। বিবাহসূত্রে যাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, সেখান থেকে এসেছিল নানান দাবি, কেউ কেউ বলেছিলেন অর্থের বিনিময়েই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবেন, কেউ বা বলেছিলেন প্রপার্টির অংশ পেতে গেলে মান্থলি রেমুনারেশান দিতে হবে। প্রথম মাসে এগারো দিনের মাইনে চার হাজার তিনশো বত্রিশ টাকা পেয়েছিলাম, কিন্তু বৃহত্তর সংসার দাবি করেছিল চার লাখ টাকা। নিরুপমার মতোই নীরবে উচ্চারণ করছিলাম আমি কি কেবল একটা টাকার থলি?
স্যার গর্ব করে বলেন, “আমার ছাত্রীরা শুধু চাকরি করেনা সংসারও চালায়”। এবার ঘোরতর সংসারী হয়ে উঠলাম। জীবনে কিছুটা স্থিরতা এলো। চুপিচুপি একেবারেই জানান না দিয়ে গর্ভে প্রাণের স্পন্দন শোনা গেল। তাও প্রায় তিন-চারমাস পর জানতে পেরেছি সে কথা। উলুবেড়িয়া হাসপাতালের কোয়ার্টারে থাকতেন ডাক্তার বি কে সিং। প্রচণ্ড শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কোথাও কোনো ডাক্তার না পেয়ে আউটডোর থেকে ডাক্তারের কোয়ার্টারে গিয়ে পৌঁছে গেলে তিনি দেখে দেন। আর কী অদ্ভুত যোগাযোগ ডাক্তার পড়াশোনা করেছেন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে। স্কুলটি আমার মেদিনীপুর কলেজের একেবারে লাগোয়া। নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানিয়ে দিলেন আগামীর আগমনের কথা। মনের গভীরে লালিত হতে থাকলো সে।
মেদিনীপুরে চিকিৎসা শুরু হলো ডাক্তার কাঞ্চন ধাড়ার অধীনে। একা একা মেদিনীপুরে থাকি কিন্তু ভাগ্য করে সব কলিগদের পেয়েছি। এক্ষেত্রে মুশকিল আসান হলেন পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. অন্নপূর্ণা নন্দ। যাঁর পৈতৃক ভিটা মুগবেড়িয়ায়। বেড়ে ওঠা পড়াশোনা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণাই তিনি। আমরা দুজনে একই মাসে কলেজে জয়েন করি। ওঠাবসা চলাফেরা একই সঙ্গে করি। কলেজে একদিন হঠাৎ পেটে ব্যথা শুরু হলো। আমাকে নিয়ে চলে গেলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারকে ফোন করে স্পন্দন হাসপাতালে এনে USG করিয়ে আমাকে পৌঁছে দিলেন মির্জাবাজার বাঁদি পাড়ার চকের সেই বাড়িতে। নিজের রবীন্দ্রনগরের বাসা থেকে টাকা নিয়ে নিজেই সব ব্যবস্থা করেন।
ড. ধাড়া ও তাঁর পেশেন্টদ্বয়
দুজনে একই ডাক্তারের অধীনে ছিলাম। সন্তানের জন্ম দিতে অন্নপূর্ণা চলে যান বেনারসে মা বাবার কাছে আর আমিও চলে যাই সাহাপুরে আমার মা বাবার কাছে। অন্নপূর্ণাকে একমাসের স্পেশাল লিভ নিতে হয়েছিল। কেননা তখন নিয়ম ছিল চাকরিতে জয়েন করার নমাস পূর্ণ হলে তবেই মেটারনিটি লিভ পাওয়া যাবে। আমার ক্ষেত্রে সমস্যা হয় নি। নমাস পুর্ণ হয়েছিল। আমাদের আগে এক কলিগকে একারণে উইদাউট পে করা হয়েছিল। অবশ্য তিনি পরে মেদিনীপুর কলেজ ছেড়ে আমেরিকা চলে যান।
আমরা ইয়াং অধ্যাপক, তাই সিনিয়র অধ্যাপকরা আমাদের ইনভিজিলেশন ডিউটি দিতেন কঠিন কঠিন রুমে, যেমন ব্যালকনি-গ্যালারি ইত্যাদিতে। সেখানে সিঁড়ি ভাঙতেই হবে। ধাপে ধাপে টেবিল চেয়ার বসানো। ফিজিওলজির অধ্যাপক সুজাতাদি প্রতিবাদ করেছিলেন, স্যারদের বলেছিলেন ; "সি ইজ গোয়িং টু বি এ মাদার"। অনেকেই সহানুভূতিশীল ছিলেন। আবার অনেক মেল কলিগ মজা করেই হোক বা রসিকতা করেই হোক বলতে ছাড়তেন না যে, তাঁরাও এমন মেটারনিটি লিভ পেলে মন্দ হতো না!
🍂
আরও পড়ুন 👇
গর্ভে সন্তান লালন করছেন এমন মা’র বাহ্যিক চেহারায় পরিবর্তন আসবেই। আমার অনার্সের শিক্ষার্থীরা সেদিকে নজর দিত না কিন্তু পাস কোর্সের ক্লাসে অনেক সময় ক্লাসে ঢুকলেই অল্প বয়সী অল্পমতি ছেলে মেয়েরা হেসে ফেলতো। পড়ানোয় কোনো ঘাটতি থাকতো না। মির্জাবাজার থেকে হেঁটেই কলেজে আসতাম। প্রায় আধঘন্টা হাঁটতে হতো। সেসময় হাঁটাই নিরাপদ মনে হতো। মে মাসের শেষের দিকে ডেট দিয়েছিলেন ডাক্তার। ফলে এপ্রিলের বাইশ তারিখ পর্যন্ত কলেজে আসি। বটতলার কাছে একদিন অঙ্কের অধ্যাপক ড. মণিমোহন মণ্ডল প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে দিয়ে আমাকে হেঁটে আসতে দেখে শঙ্কিত হয়ে বলেন, “কাল থেকেই ছুটি নিয়ে নাও। এই গরমে পড়ে গিয়ে হার্টফেল করবে না হলে”। মেদিনীপুরে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের অন্যতম একজন হলেন মণিবাবু। আদতে তিনি আমার জেলারই মানুষ।
সহকর্মীদের মধ্যে আলফাজদা, মাধবীদি হবু মাকে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন। যাকে সাধভক্ষণ বলা যেতেই পারে। বাড়িতে গেলে বড়ো মা, সেজো মা, চাচীমা, ছোটো মা সাধ খাওয়ান। শাড়িও উপহার দেন। মা বাবা আগেই অবশ্য ফুলেশ্বরে কানোরিয়া জুটমিলে গিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। গোলাপি রঙের একটা শাড়ি দিয়েছিলেন। বড়ো ননদাই পাঠিয়েছিলেন একখান বিদেশি রিস্ট ওয়াচ। আজো ব্যবহার করি। অনেক পরে, প্রায় কুড়ি বছর পরে ঘড়িখানা তাঁকে দেখিয়ে বলেছিলাম,চিনতে পারছেন? যথারীতি ঘড়িখানা চিনতে পারেন নি। তবে খুশি হয়ে বলেছিলেন, “ভাবী অনেককেই তো অনেক উপহার দিয়েছি কিন্তু শুধু আপনিই যত্ন করে রেখেছেন”।
দু’হাজার দুই সালের পনেরো মে বাবা মা উপহাররূপে পেলেন তাঁদের আদরের নাতনিকে। বাবা মার বিবাহের তারিখ ছিল চোদ্দো মে উনিশশো বাহাত্তর। পনেরো মে তাঁদের বৌভাতের তারিখ। তদানীন্তন ওয়েস্টব্যাঙ্ক হসপিটালে ড. কাকলি কুমার সিজার করলেন। তিনি বোঝালেন চাকরিজীবী মহিলাদের পক্ষে সিজার কেন বেশি সুবিধার। আমি ডাক্তার দেখাতে পেলে কোথাও আমার পেশার কথা বলি না। কিন্তু আমার মেডিকেল ফাইলে তিনি ড.কাঞ্চন ধাড়ার সার্টিফিকেট দেখে সব বুঝে নেন। তিনি আমাকে মনে রেখেছেন কারণ তাঁর কেরিয়ারে প্রথম সিজার আমারই। আমাদের তিন ভাইবোনেরই সন্তানের জন্ম কাকলি কুমারের হাতে। শাশুড়িমাকেও দেখিয়েছিলাম ভিন্ন একটি কারণে। কাকলি কুমারের সঙ্গে ভাইয়ের সন্তান জন্মানোর সময় কথা হয়। তিনি বলেন, তাঁর পেশেন্টদের মধ্যে তখনও পর্যন্ত আমিই ছিলাম হাইলি কোয়ালিফায়েড পেশেন্ট।
0 Comments