কবীর- সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ, রূপমদা। সারাক্ষণই নিজেকে নানারকম কাজের মধ্যে তুমি রাখো বলেই জানি। এই মুহূর্তে কী কী কাজ চলছে?
রূপম- সবে পরপর দুটো একক করলাম। তারপরে এই মুহূর্তে আমি আমার তৃতীয় উপন্যাসের বই-এর কাজ শেষ করছি। এই প্রথমবার আমার উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে, নাম ‘শব্দ ব্রহ্ম দ্রুম’। এ ছাড়া ফিল্মের কাজ তো চলছেই; একটা ফিল্মে আমি সঙ্গীত পরিচালনা পুরোটাই করছি, অন্যটার জন্য একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। এছাড়াও আছে ওয়েব সিরিজ়-এর সঙ্গীত। প্লেব্যাক রেকর্ড করা অন্য সঙ্গীত পরিচালকদের জন্য, তাও চলছে প্রায় রোজই।
কবীর- আর ফসিল্স? কনসার্ট এবং তোমাদের নতুন অ্যালবাম?
রূপম- ফসিল্সের কনসার্টে এই মুহূর্তে কিছুদিনের বিরতি— আবার শুরু হবে কিছুদিন পর। আর নতুন অ্যালবামের রেকর্ডিং-এ আমার কাজ সবে শুরু হয়েছে। তবে ঐ গানগুলো নিয়ে এখন বলব না। আগে রেকর্ডিং শেষ হোক।
কবীর- বেশ, এখন লেখার পরিসরে রয়েছ বললে। তোমার তো একটা বই প্রকাশিত হয়েছে, ‘তীরে এসো, সাহসিনী’ নামে।
রূপম- হ্যাঁ, কাব্যগ্রন্থ, সেটা বেরিয়েছে আনন্দ পাবলিশার্সের সিগনেট প্রেস থেকে। আমার জীবনের প্রথম কবিতার বই বলতে যা বোঝায়, মানে প্রকৃত বা প্রচলিত যে অর্থেই বলিস কবিতার বই, তাই। ওটাও মাথায় আছে, কারণ কবিতা লেখা আমার থামেনি। এর পাশাপাশি উপন্যাসের কাজ তো বললামই। যে অবস্থায় সেটা ধারাবাহিক রূপে বেরিয়েছিলো, আমি কিন্তু সেই অবস্থায় রাখিনি। পরিমার্জন এবং পরিবর্তন, দুটোই প্রচুর করছি। কাজেই লেখার পরিসরে অনেকটা কাজ আমাকে করতে হয়েছে।
কবীর- লেখার প্রসঙ্গেই থাকি। তুমি কবিতা লিখছ, উপন্যাস লিখছ, এদিকে আমরা অনেকেই তোমাকে প্রথম চিনেছি সংরাইটার হিসেবে। তুমি গান-লিখিয়ে, কবিতা লিখতে এসে তোমার approach কতটা পাল্টাতে হয়েছে? এমন কোনো চ্যালেঞ্জ বা চাপ কবিতা লিখতে গিয়ে বোধ করেছ, যা গান লিখতে গিয়ে হয়নি? বা উল্টোটা?
রূপম- না, কোনো ধারার লেখালিখিই আমার উপর কোনও চাপ সৃষ্টি করে না। সেটা কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস যাই হোক। খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে, সহজাতভাবে লেখা না এলে আমি লিখিই না। জোরাজুরি করি না, যখন যে আইডিয়া আসছে, তখন সেটা নিয়ে লিখি। অতএব লেখালিখির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের কোনো প্রশ্নই নেই।
হ্যাঁ, একমাত্র যেখানে আমি চ্যালেঞ্জ অনুভব করি, সেটা হচ্ছে আমার একক অনুষ্ঠান করতে গিয়ে। প্রথম চ্যালেঞ্জ, আমার একক অনুষ্ঠানে একেবারে গোড়ার থেকেই আমার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশী শ্রোতা এসেছেন, বরাবরই আসেন। তাই আমার দায়িত্ব, এতজন মানুষকে ধরে রাখতে হবে, আনন্দ দিতে হবে। আবার প্রয়োজনে কিছু তথ্যও দিতে হবে, যেটা কিন্তু এককের একটা দায়িত্ব হয়ে উঠেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে যা সচেতনভাবে প্ল্যান করে করা হয়নি।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ, এককে সচরাচর মঞ্চে না-গাওয়া গানই হয়, কারণ আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, যে গানগুলো সচরাচর শোনানো হয়না, সেগুলো মানুষকে শোনানো। তাই এই অনুষ্ঠানের অন্তত আশি শতাংশ গানই এমন, যা আমার অভ্যেসের বাইরের গান। এখনও এককে মাঝেমাঝেই এমন সব গান গেয়ে ফেলি যা হয়তো কোনওদিনই গাওয়া হয়নি। সেটাও একটা চাপ।
সবথেকে বড় চাপ বা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আর কেউ না থাকা। আমিই মঞ্চে একা থাকি, সমস্ত যন্ত্র আমিই বাজাই, এটা আমার মত লোকের পক্ষে একটা বড় চাপ। আরও একটা চাপ আছে বটে, তবে সেটা আমি ইচ্ছে করেই নিই: আমি কোনো খাতা ব্যবহার করিনা। যে মেজাজে আমি গান করি, খাতা দেখে গাইলে সে মেজাজটা হারিয়ে যাবে। অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল আমি হতে চাই না, বরং আমার অডিয়েন্সের সঙ্গে একটা চোখাচুখির সম্পর্কে থাকতে চাই। এবার, সেটা সবসময়ে সম্ভব হয়না; আলোকসম্পাত যাঁরা করেন, তাঁরা অনেক সময়ে এই চোখাচুখিতে বাধা সৃষ্টি করেন! তবে সেটুকুও মেনে নিতে হয়।
কবীর- চোখাচুখি না হলে অসুবিধা হয়?
রূপম- সেটা রপ্ত করতে হয়েছে। যখন অনলাইন একক করেছি, তখন তো চোখাচুখির কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। ফলে সেই সময়ে এটার অভাবেও অনুষ্ঠান করা রপ্ত করতে পেরেছি, এবং সেই শিক্ষাটা এখনও আছে। যাকগে, গানের কথায় চলে এলাম! তুই লেখা নিয়ে জিজ্ঞেস করছিলি, সেই প্রসঙ্গে আবার বলি, একক যেমন একটা চ্যালেঞ্জ, কোনও ফর্ম্যাটের লেখালিখিই আমার কাছে তেমন কোনও চ্যালেঞ্জ নয়।
কবীর- আবার আগের প্রশ্নে ফিরি- কবিতা লেখা এবং গান লেখার ফারাক নিয়ে তোমার কী মনে হয়?
রূপম- আমার মনে হয় কবিতা লেখার থেকে গান লেখা অনেক কঠিন কাজ। মানে যে কোনও লোকের যেমন-তেমন গানের কথা বলছি না, সার্থক গান লেখা। আমি যেরকম গান লিখি, সেই গানের যে সুরপ্রয়োগ, যে অভিনবত্ব, যে ভাবের ব্যাপ্তি- একটা গানে অন্তত দুরকম অর্থ বা layer of meanings থাকে আমার, অথবা তিনরকম! সেরকম গান লেখা কিন্তু বেশী কঠিন, তাতে অনেক হিসেব মাথায় রাখতে হয়। আমার কাছে সেটা কিন্তু আসলে সহজ কাজ, আমি একটু চেষ্টা করলে বা চাইলেই প্রতিদিন একটা করে গান লিখতে পারি। ইচ্ছে করে না, বা অন্য কাজ করি বলে লিখি না।
এবার, কঠিন কাজটাই যখন আমার কাছে এত সহজ, তখন কবিতা লিখতে চাপ কোথায়? কবিতায় তো অনেকটা স্বাধীনতা আছে, সেখানে আমাকে কেউ বেঁধে রাখেনা। আমি তো একেবারে ফর্ম ভেঙেচুরে বেরিয়ে যাই। কখনও আমার কবিতা একখানা গল্পের আকার নিয়ে নেয়, কখনও আবার গানের লাইনই কবিতার আঙ্গিকে পড়ার মত, বোঝার মত হয়। আবার কখনও অন্য কিছুও হতে পারে, ধর একটা কাল্পনিক কথোপকথনও হয়ে যেতে পারে। সেই আঙ্গিকের কবিতা আমি বেশ কিছু লিখেছি।
কবীর- মানে তুমি বলছ কবিতার ক্ষেত্রে গানের চেয়ে বাঁধনগুলো বেশী আলগা?
রূপম- কবিতাকে আমি একটা মুক্ত ফর্ম বলেই বিশ্বাস করি। কবিতাকে আমি সীমাবদ্ধ রাখিনা, আমার নিজেকে বেঁধে রাখতে হয়না। সেটা সুরের দিক থেকে হোক, rhyme-এর দিক থেকে হোক, বা আঙ্গিকের দিক থেকেই হোক।
তবে হ্যাঁ, যেটা থাকতেই হবে সেটা হচ্ছে একটা ছন্দবোধ। অন্ত্যমিল থাক বা না থাক, একটা ছন্দ থাকা চাই। ধর একটা মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, তার হাঁটার মধ্যে ছন্দ থাকতে পারে, আবার তার হাঁটাটা একটু ছন্নছাড়াও হতে পারে। কবিতা কিন্তু একেবারেই ছন্নছাড়া হবে না। সে যে ভাবের কবিতাই হোক না কেন, তার মধ্যে ছন্দ কিন্তু একটা জরুরী উপাদান। সেই ছন্দটা সর্বক্ষেত্রেই আমার মধ্যে আছে। কবিতার জন্য সেটা জোর করে তৈরী করতে হয়না।
কবীর- লেখাটা তাহলে তোমার কাছে সহজ, বা সহজাত?
রূপম- গান লেখাটা আমার কাছে এতটাই বেশী সহজ হয়ে গিয়েছিল, যে আমি ওটাকে চ্যালেঞ্জিং করব বলে নিজেই নিজেকে নানারকম চ্যালেঞ্জ দিতে শুরু করি। এমন অনেক বিষয় আছে, যার সঙ্গে হয়তো আমার সরাসরি সম্পর্ক নেই, সে সব নিয়ে আমি গান লিখিনি বহুদিন। আমি মনে করেছিলাম আমার গান আত্মজৈবনিক, এটাই আমার ফর্ম। কিন্তু তার বাইরে গিয়ে আমি নানা সামাজিক বিষয়ে গান লিখতে শুরু করি, সেটা কিন্তু একটা এক্সপেরিমেন্ট হিসেবেই।
আবার, আমার কোনও কোনও গানে উদ্ভট কাব্যিকতা পাবি, সেগুলোও চ্যালেঞ্জ নিয়ে লেখা। কিছু সাম্প্রতিক গান শুনে আমার মনে হয়েছিল, “এ কী উদ্ভট কাব্য রে ভাই। শুধু ভাষার মারপ্যাঁচ ছাড়া এর মধ্যে সারমর্ম কিছুই নেই!” এইসব মর্মহীন, মারপ্যাঁচসর্বস্ব গান শুনে (এবং গানগুলোকে জনপ্রিয় হতে দেখে) ভাবলাম, “আচ্ছা, এই ফর্মেই লেখার চেষ্টা করা যাক!” তাই আমিও কিছু গাঁজাখুরি গান তৈরী করলাম। এমনিতে আমি এ ধরনের জোর করে লেখা meaningless গান তৈরী করি না, তাও “আমার গান লেখার কোনও দরকার নেই, তাও আমাকে গান লিখতেই হবে,” এই মনোভাবসম্পন্ন গান কৌতুক করেই কিন্তু লিখে ফেললাম। ভাবলাম, লিখেই দেখি না। এবং মজা কী জানিস? যুগের ধর্ম মেনে সেগুলোও বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেল!
কবীর- উদাহরণ দেবে কিছু?
রূপম- শুধু “মহৎ এবং আধুনিক গান তৈরী করা” ছাড়া লেখার কোনও কারণ নেই, এমন দুটো গানের উদাহরণ হচ্ছে— (একটু হেসে) না থাক! আগেও আমি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করায় এগুলো যাদের প্রিয় গান তারা রেগে গেছে, তাই উদাহরণ দিচ্ছি না। তবে এরকম গান লেখাও একটা চ্যালেঞ্জ। আবার একটা তৃতীয় চ্যালেঞ্জও আমি নিয়েছি। গান যখন লেখা হয়, তখন তার একটা internal ছন্দ থাকে। সুর যখন করেছি, তখন সেই ছন্দ ভেঙে দিয়ে অন্য ছন্দে বেঁধেছি। এই চ্যালেঞ্জও নিজেকে দিলাম, এটাতেও জিতলাম। কাজেই গান তৈরী করা আমার কাছে হয়ে উঠেছে একটা ম্যাজিক; কতরকম ম্যাজিক করা যায়?
এটা না করলে গান তৈরী করাটা আমার কাছে একঘেয়ে হয়ে যাবে। কত গান আর বাঁধা যায়? আরও বড় কথা, এত গান বাঁধার কী দরকার? প্রচুর গান তৈরী হয়ে পড়ে আছে, সেগুলো রেকর্ড করলে যে লোকে মন দিয়ে শুনবে তাও নয়, কারণ এত বেশী গান পৃথিবীতে তৈরী হচ্ছে, এতরকম বিনোদন, যে মানুষের গানের দরকার বোধহয় নেই খুব একটা। ধৈর্য্যও নেই পুরোটা শুনবার। তাই এই অবস্থায় একদম ঝাড়া হাত পায়ে মুক্ত কলমে (মুক্ত মনে বলবো না) যা আসছে লিখে যাচ্ছি। সেটাই আমার কবিতা।
সেটা যে মানুষের সমাদর পাচ্ছে- সেটাই একটা প্রাপ্তি। আমার কবিতা লেখার এই সংক্ষিপ্ত জীবনেই দুজন মানুষের সমাদর পেয়েছি, যাঁদের কথা বলতেই হয়; জয় গোস্বামী এবং সুবোধ সরকার। এঁরা আমার কাব্যবোধকে এতটা appreciate করেছেন, যে আমি চমকে গিয়েছি। ফূর্তিও হয়েছে আমার, সেই ফূর্তির চোটে আমি আরও কবিতা লিখছি! কাজেই চ্যালেঞ্জ তো দূরের কথা, কবিতা যে আমাকে কতটা চ্যালেঞ্জমুক্ত করে দিল, সেটাই মেপে দেখার বিষয়। মনে কর, শার্টের বুকের বোতাম খোলা রেখেই আমি বেরিয়ে গেলাম, মাঠে হাওয়া দিচ্ছে, সেই হাওয়া খাচ্ছি— এটাই হল কবিতা-জীবন!
কবীর- তাহলে তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ একক অনুষ্ঠান করা?
রূপম- এককের চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ একটা আছে, সেটা হল যোগব্যায়াম করা। সে যে কী অপরিসীম ক্লান্তিকর, কষ্টকর কাজ! খালি সময় নষ্ট! শুধু দেহের জন্য এটা করতে হচ্ছে। দেহ না থাকলে তো করতে হতো না। কিন্তু দেহ আছে, বয়স হচ্ছে, নানারকম চোট লেগে যায়। তাই একজন শারীরপ্রশিক্ষক এসে নানারকম কসরৎ শেখালেন আমাকে। তাতে ফল পেলাম, তিনি আরও ফলাফলের লোভ দেখালেন, ব্যাস! আমি জড়িয়ে গেলাম যোগব্যায়ামের একটা চক্রান্তে। এর চেয়ে বেশী চ্যালেঞ্জিং আর কিছু নেই, বীভৎস খারাপ কাজ! নেহাত একটি শরীরকে বহন করছি, তাই এটাও করতে হচ্ছে!
(এই ভয়ানক যোগব্যায়ামের সময় এগিয়ে আসছে দেখে রূপমকে আর বিরক্ত না করে তাঁর কাছে বিদায় নিয়ে সাক্ষাৎকারে ইতি টানলাম আমি।)
0 Comments