জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোক গল্প-- ২০৯সাদা জলের ঝর্ণা কালো জলের ঝর্ণামরক্কো (আফ্রিকা)/চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস 

দূর দেশের লোক গল্প-- ২০৯

সাদা জলের ঝর্ণা কালো জলের ঝর্ণা

মরক্কো (আফ্রিকা)

চিন্ময় দাশ


এক গ্রামে থাকে এক চাষি আর তার বউ। গুনে গুণে সাত-সাতটা ছেলে তাদের। তাই ভারি ভারি সুখী দুজনে।

কিন্তু দেশে তো নিন্দুকের অভাব নাই। অন্য পড়শিরা ঈর্ষায় জ্বলে মরে। কিন্তু কী আর করে, খোঁটা দিতে থাকে চাষিবউকে—কী মেয়ে বাবা? একটা মেয়ে জন্ম দিতে পারে না। 

বউটা শোনে, কিন্তু গা করে না। এদিকে ছেলেগুলোও তো বড় হচ্ছে। গাঁয়ের ছেলেরা টিটকিরি দেয় তাদের—কী অভাগা, কী অভাগা। ঘরে একটা বোন নাই তোদের! শুনতে শুনতে তারা কিন্তু একদিন বিরক্ত হয়ে উঠল। 

আবার বাচ্চা হবে চাষিবৌয়ের। ছেলেরা মা-বাবাকে ডেকে বলল—এই আমরা চললাম বাড়ি থেকে। এবার যদি একটা বোন জন্মায় আমাদের, খবর দিও। তখন ঘরে ফিরব। তা নইলে নয়।

চাষি ব্যতিবস্ত হয়ে বলল—চলেই যদি যাস, খবর দেব কী করে?

তারা বলল—প্রতিদিন পাহাড়ের মাথায় পাহারায় থাকব একজন করে। যদি বোন হয়, নলখাগড়ার তকলি বনিয়ে এনেছি, এইটা দেখাবে। আর ভাই হলে, কাঠের মোটা লাঠিটা। দুটোই রেখে যাচ্ছি বাড়িতে। 

যেদিন বাচ্চা হবে, চাষিবৌয়ের বোনকে ডেকে নানা হয়েছে পাশের গ্রাম থেকে। সে সাহায্য করবে। 

খোদাতালার কী করুণা! এবার ফুটফুটে একটি মেয়েই হয়েছে চাষিবৌয়ের। তার বোন ছুটল, ছেলেদের খবর দিতে। গাঁয়ের বাইরে গিয়ে, এদিক ওদিক দেখে নিল ভালো করে। নলখাগড়ার তকলি লুকিয়ে রাখল বোরখার আড়ালে। কাঠের লাঠিটা তুলে নাড়াতে লাগল এদিক ওদিক।

আসলে সাতটা ছেলে দিদির, হিংসায় জ্বলে মরত সেও। এবার সে সুযোগ হাতে পেয়েছে। ছেলেগুলোর ঘরে ফেরা বন্ধ করে দিল চালাকি করে।

বাবা মা অপেক্ষা করে আছে ছেলেগুলো ঘরে ফিরে আসবে। কিন্তু অপেক্ষাই সার। ছেলেরা আসে না। দিন যায়, রাত যায়। এমনি করে মাস যায়। বছরের পর বছরও। ছেলেদের দেখা নাই।

🍂

এদিকে ঘর আলো করে বড় হয়ে উঠছে মেয়েটি। পড়শিদের বাঁকা মন্তব্য শোনে—সাত ভাইকে খেয়েছে, তবে মেয়ে জন্মেছে। 

একদিন মেয়েটা বলল—আমি যাবো আমার ভাইদের খুঁজে আনতে। 

শুনে বুড়ো বাবা-মা ভারি খুশি। একটা উট, একটা কুকুর, একটা চাকর আর একটা চাকরানি সঙ্গে দেওয়া হোল। তারা যাবে মেয়ের সাথে। দরকার মতো জামাকাপড়, খাবার দাবার সব দেওয়া হোল। মেয়ের হিজাবের সাথে, কাঠের তৈরি ছোট্ট একটা যন্ত্র সেঁটে দিল বাবা। 

মেয়ে চলেছে উটের পিঠে। চাকর, চাকরানি আর একটা গ্রেহাউণ্ড কুকুর চলেছে পেছন পেছন। হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম ছাড়িয়ে বহু দূর চলে এসেছে তারা। পিছনের দু’জন ফিসফিস করে একটা ফন্দি এঁটে নিয়েছে। 

চাকরটা সামনে গিয়ে উট দাঁড় করিয়ে, বলল—হলামই বা চাকর। অনেক হেঁটে আর পারছি না। এবার আমাদের উটে চড়ার পালা। তুমি নীচে নামো। 

হঠাৎই কোথা থেকে সেই চাষির গমগমে গলা হেঁকে উঠল—তবে রে, হতচ্ছাড়ার দল। এতো সাহস তোদের? আর একটি বার যদি বেগড়বাই করিস, জ্যান্ত পুঁতে ফেলব দুটোকে। কথাটা মনে রাখিস। 

ভীষণ ভড়কে গেছে চাকর চাকরানি দুজনে। মুখে রা না কেড়ে, আবার হাঁটতে লাগল তারা। কতক্ষণ পরে, সামনে দুটো ঝরণা। একটার জল সাদা, অন্যটার কালো। 

এখানেই বিশ্রাম নেওয়া হবে। চাকরানি মেয়েটাকে উটের পিঠ থেকে নামাতে গিয়ে, হিজাবে সাঁটা বাক্সটা দেখতে পেয়ে গেল। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে, লোকটাকে চেঁচিয়ে বলল—এই যে সেই যাদু যন্ত্র। এটাই মালিকের গলায় ধমক দিচ্ছিল আমাদের। 

কথা শেষ না করে, পাথরে আছড়ে ভেঙে দিল জিনিষটা। এখন ভারি সাহস দুজনের মনে। কালো ঝর্ণার জল এনে খাওয়ালো মেয়েটাকে। জোর করে সেই জলে চুবিয়ে স্নানও করালো। তাতে কুচকুচে কালো রঙ হয়ে গেল মেয়ের। 

তারা নিজেরা স্নান করে এল সাদা জলের ঝর্ণায়। জল পানও করে নিল পেট ভরে। তাতে দুজনের গায়ের রঙ হয়েছে ধবধবে ফরসা। খাওয়া সেরে, রওণা দেওয়া হবে। গায়ের রঙ পাল্টাতেই, চাকর আর চাকরানি তখন মালিক হয়ে উঠেছে। আর, মেয়েটা তাদের চাকরানি। দুজনে চলেছে উটের পিঠে, মেয়েটি আর কুকুর চলেছে পেছন পেছন। 

এবার যে দেশে এসে পৌঁছল, সেখানেই সাত ভাইয়ের খোঁজ মিলে গেল। বড়ভাই হয়েছে দেশটার সুলতান। নিজেরই ছটা রাজ্যে নবাব করে বসিয়েছে নিজের ছজন ভাইকে। খবর জেনে, এদের তো আনন্দ ধরে না। 

দিন দুই না যেতে, সুলতানের দরবারে খবর পৌঁছে গেল, একজন মেয়ে এসেছে। সুলতানের বোন বলে পরিচয় দিচ্ছে নিজের। সুলতান ভাবলেন-- তা কী করে হয়। আমাদের তো ভাই হয়েছিল আবার। সেজন্যই তো আমরা ঘরে ফিরে গেলাম না। 

স্বয়ং সুলতান চলে এলেন মেয়ের সাথে দেখা করতে। একটি কথাও খরচ করতে হোল না তাঁকে। বাড়ির উট আর কুকুর দেখেই পরিচয় পাওয়া হয়ে গিয়েছে। উটের পিঠে বসা চাকরানি মেয়েটি বলে উঠল-- আমি তোমাদের ছোট বোন। সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি। আর, এ হোল আমার স্বামী। 

সুলতানের তো আনন্দ ধরে না। আদর করে বোন আর তার স্বামীকে নামিয়ে, নিজের গাড়িতে তুলে নিল। বাকিরা চলল পেছন পেছন। 

পুরো একটা মহল দেওয়া হোল তাদের। আসল বোনের ঠাঁই হোল ছোট্ট একটা কুঠরিতে।একজন চাকরানিকে এর বেশি কী দেওয়া হবে? 

খবর পেয়ে, বাকি ছজন ভাই এসে পৌঁছাল। সে কী আনন্দ সকলের। 

এমন সময়ে একদিন একটা ঘটনা। না বলে কয়ে, একটা চাকর পালিয়ে গেছে সুলতানের। উট চরানোর ভার ছিল তার উপর। সুলতান তার নকল বোনকে বলল—তোর ঐ চাকরানিটা উট চরাতে পারবে? মেয়েটা বলল—খুব পারবে। ঐ কাজেই লাগিয়ে দাও ওকে। বসে বসে তো খাচ্ছে দু’বেলা। 

সকাল হলে একপাল উট নিয়ে বেরিয়ে যায় মেয়েটা। ঘরে ফেরে সেই সূর্য ঢলে পড়লে। তখন দুটো রুটি জোটে মুখে দিতে। এভাবেই দিন চলতে লাগল।

নিজের দুঃখের কথা আর কাকে বলবে। চরাতে গিয়ে, উটেদের মাঠে ছেড়ে দেয়। নিজে বসে বসে কাঁদে, নিজের দুঃখের কথা ভেবে। করুণ সুরে গান গায় নির্জন মাঠে। 

হোল কী, মেয়েটার কান্না শুনে, উটগুলো মাঠ ছেড়ে উঠে আসে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তার চার পাশে। চরে বেড়াবার কথা মনেই থাকে না জীবগুলোর।

কদিন না যেতে, সকলের নজরে এল, উটগুলো রোগা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এমনটা তো আগে ছিল না। সুলতান তার নকল বোনকে জানতে চাইলেন—তোদের এই চাকরানিটাকে কি ভরসা করা যায় না?

বোন বলল—কেন বলো তো?  

সুলতান তাকে উটের কথা বললেন। মেয়েটা দেখল, এমন মওকা ছাড়া আয় না। বলে উঠল—অতো খোঁজখবরের কি আছে। কাজে ফাঁকি দিয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দাও। মিটে গেল ঝামেলা। ভেবে হয়রাণ হওয়ার দরকারটা কী? 

কথাটা মনে ধরেনি সুলতানের। ভাবলেন, আগে, কারণটা জানা দরকার। তার পর বিচার। পরদিন একটু বেলা হলে, নিজে মাঠে গিয়ে হাজির হয়েছে সুলতান। দেখলেন একটা অবাক করা দৃশ্য। দেখে ভারি চমকে গেলেন মানুষটা। এমন দৃশ্য সারা জীবনে দেখেনি কেউ।

সুলতান চেয়ে দেখছেন ফ্যালফ্যাল করে। গাছতলায় বসে করুণ সুরে গান করছে মেয়েটা। উটগুলো মাঠ ছেড়ে, গোল করে ঘিরে আছে তাকে। গানের শেষ কটা কথা কানে এল সুলতানের—“সাতজন ভাই আছে যার, খোদা আনবে সুদিন তার।“

আর তর সইল না। সুলতান গিয়ে ধরে পড়লেন মেয়েটাকে—সব খুলে বলো আমাকে। দুঃখের কারণ কী তোমার। 

হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠল মেয়েটা। সে বুকফাটা কান্না খোদাকে টলিয়ে দেবে, এমন। সব কথা এক এক করে বলে গেল ভাইকে। মাসিই যে প্রথম ভুল খবর দিয়ে, সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে তাদের, সেখান থেকেই শুরু করেছে। তার পর পথের সব ঘটনা। সেই দুটো ঝর্ণার কথাও। 

কারও করুণ কাহিনী শুনেই তো বিচার করা যায় না। সত্য মিথ্যা যাচাই করে দেখতে হয়। ন’খানা গাড়ি সাজানো হল পরদিন। সাতটা গাড়িতে সাতজন ভাই একটা গাড়িতে নকল বোন আর তার স্বামী। আর একটা গাড়িতে তাদের চাকরানি বা আসল বোন। 

সকলে গিয়ে হাজির হয়েছে ঝর্ণা দুটোর কাছে। এবার উলটো কাজ করা হোল। কালো ঝর্নার জল খাওয়ানো আর স্নান করানো হোল নকল দুজনকে। আসল বোনকে সাদা জলের ঝর্ণায়। তাতে যে যার আসল চেহারায় ফিরে এলো।  

সাত ভাইয়ের আনন্দ ধরে না। বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরল তারা। সুন্দর সাজানো একটা মহল দেওয়া হোল বোনকে। চাকর আর চাকরানিটাকে জ্যান্ত পুঁতে দেওয়ার হুকুম দিলেন সুলতান। 

তার পর? তার পর দু’খানা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নিজে। বুড়ো বাবা আর মাকে নিয়ে আসবেন তাঁর রাজধানিতে।  

Post a Comment

0 Comments