মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১২৭
নলিনী বেরা (ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গোপীবল্লভপুর)
ভাস্করব্রত পতি
'সোউ যে বেহারাঘর দেখুটু ললিন, বেহারাবুড়ার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা তার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা পুত্র কামনায় নদীজলে সোনার থালা ভাসাই থিলা বলি না নদীর নাম হেলা সূবর্ণরেখা'।
এ কাহিনী 'সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা' উপন্যাসের। যেখানে অপূর্ব লোকায়ত জীবনের ইতিকথা চিত্রায়িত হয়েছে। আর এই উপন্যাসের মধ্যে মেদিনীপুরের লেখক নলিনী বেরার মুন্সিয়ানা প্রকাশিত হয়েছে লোকায়ত জীবন, লোকায়ত ভাষার প্রতি অমোঘ টান, মমত্ববোধ এবং দুর্নিবার ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে। দেশ কাল সমাজ সীমানা অতিক্রম করে তিনি কাহিনীকে পৌঁছে দিয়েছেন নিজের স্বদেশভূমিতে --
'আঘু তভু অনেক ইলশা উঠথায় সুবর্ণরেখায়
অখখন সে ইলশা কুঠে আছে জাআনু? কলকাতায়'!
ঔপন্যাসিক নলিনী বেরার কথায়, 'আমার জন্মভূমি গ্রামকে, গ্রামের ভূগোল ভূ প্রকৃতি গাছপালা ও মানুষজনকে তন্ন তন্ন করে দেখার মধ্য দিয়েই সমগ্র দেশকে দেখতে চাই। এ দেখা এখনও আমার ফুরোয় নি, তাই বিভিন্ন লেখায় ফিরে ফিরে আসে একই পটভূমি। তবে এক লেখা আরেক লেখার সঙ্গে মিশে যায় না, নিজ গুণে স্বতন্ত্রই থাকে'।
'আনন্দ পুরস্কার' গ্রহণ করছেন নলিনী বেরা
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোপীবল্লভপুরের কাছে বাছুরখোয়াড় গ্রামে ১৯৫২ এর ২০ শে জুলাই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। খুব ছোটবেলা থেকেই অসম দারিদ্রের সাথে লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। বাবা ছিলেন গিরীশচন্দ্র বেরা এবং মা উর্মিলা দেবী। বিয়ে করেন রত্না বেরাকে। দুই সন্তান -- তিতাস এবং ঝিলম।
প্রথমে পড়াশোনা করেছেন মেদিনীপুর কলেজে ও পরবর্তীকালে নকশাল আন্দোলনের জন্য ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে। নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা বাস্তব অভিজ্ঞতার নির্যাস নিয়ে লেখা ১৯৮১ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ছিল 'ভাসান'। নিজেও একসময় জড়িয়ে পড়েছিলেন এই আন্দোলনের সাথে। তখন মেদিনীপুর কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলা সাম্মানিক বিষয় নিয়ে। কিন্তু মাত্র ছয়মাস পরেই কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক তাঁকে জোর করেই ভর্তি করে দেন পদার্থবিদ্যায়। ইতিমধ্যে নকশাল আন্দোলনের সূচনা হয়ে গিয়েছে। কলেজেও তার রেশ এসে পড়ে। মেসে থাকাকালীন ওয়ারেন্ট বেরিয়ে গেলে আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। এরপর ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে ভর্তি হয়ে যান ইকোনমিক্স বিষয় নিয়ে। বাংলা থেকে পদার্থবিদ্যা হয়ে অর্থনীতি। শুরু হল নতুন জীবন। নতুন দিনযাপন। ঝাড়গ্রামের মেসে থাকতে থাকতেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। উৎসাহ পেতে থাকলেন কাননবিহারী গোস্বামী, সুধাকর চট্টোপাধ্যায়, গোকুলানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়দের থেকে। একসময় (১৯৭২-১৯৭৩) তিনি ঝাড়গ্রামে থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতেন 'শালপাতা' পত্রিকা। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। ।
প্রথম লেখা শুরু কবিতা লেখার মাধ্যমে। গ্রামের স্কুল রোহিনী চৌধুরাণী রুক্মিণী দেবী উচ্চ বিদ্যালয়ে 'অঙ্কুর' নামে এক পত্রিকায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের ওপর লিখেছিলেন একটি কবিতা। সেই কবিতা পড়ে তৎকালীন বিখ্যাত কবি অমর ষড়ঙ্গী প্রশংসা করেছিলেন খুব। ইনিই হয়ে ওঠেন তাঁর সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি ধরানো পুরুত ঠাকুর। তাই জীবনের প্রথম গল্পের বই 'এই এই লোকগুলো' উৎসর্গ করেন অমর ষড়ঙ্গীকেই।
এরপর আস্তে আস্তে হয়ে ওঠেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক। এই কবিত্বশক্তি বৃদ্ধি কিংবা সাহিত্যিক হয়ে ওঠার প্রেরণা পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে। নিজের গ্রামের হরি মন্দিরে বসত কথকতার আসর। সেখানে কথকতা পরিবেশন করতেন তাঁর বাবা। পুঁথি পাঠ করতেন। যা তাঁর কিশোর মনে একটা আলাদা জগতের সৃষ্টি করেছিল। আলাদা অনুভূতি তৈরি করেছিল সাহিত্য সম্পর্কে। ১৯৭৮ সালে WBCS পরীক্ষায় এ গ্রুপে পাস করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের আধিকারিক হিসাবে চাকরি পান। ২০১৪ তে অবসরের পর তিন বছর কলকাতা কর্পোরেশনের ট্রাইব্যুনাল জজ হিসেবে কাজ করেন। চাকরি পাওয়ার ঠিক এক বছর পর ১৯৭৯ সালে তাঁর লেখা প্রথম গল্প 'বাবার চিঠি' প্রকাশিত হয় দেশ পত্রিকায়। সেই শুরু।
তিনি লিখেছেন অসংখ্য উপন্যাস। সেগুলি হল -- ১. ভাসান, নয়ন পাবলিশার্স, ১৯৮৩, ২. 'শবরচরিত'-এর ১ম খণ্ড প্রকাশ হয় 'শবরপুরাণ' নামে। রক্তস্বাক্ষর পাবলিকেশন, আগষ্ট ১৯৮২, ৩. খালাস, রক্তস্বাক্ষর পাবলিকেশন, ১৯৮৪, 8. ইরিনা এবং সুধন্যরা, আনন্দ পাবলিকেশন, ১৯৯৩, ৫. যে আছে অপেক্ষা করে, করুণা প্রকাশনী, ডিসেম্বর ১৯৯৬, ৬. 'ঈশ্বর কবে আসবে', প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন, ১৯৯৬, ৭. ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ফেরিওয়ালা, টিচার্স বুক এজেন্সি, ১৯৯৬, ৮. শবরচরিত-১ (১ম পর্ব), করুণা প্রকাশনী, ১৯৯৮, ৯. নাকফুল, মডার্ণ কলাম, ১৯৯৮, ১০. শবরচরিত-২ (২য় পর্ব), করুণা প্রকাশনী, ১৯৯৯, ১১. শবরচরিত-৩ (৩য় পর্ব), করুণা প্রকাশনী, ২০০০, ১২. শবরচরিত-৪ (৪র্থ পর্ব), করুণা প্রকাশনী, ২০০১, ১৩. চোদ্দমাদল, দে'জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ২০০৩, ১৪. শবরচরিত (অখণ্ড), করুণা প্রকাশনী, ২০০৫, ১৫. ফুলকুসুমা, করুণা প্রকাশনী, ২০০৬, ১৬. অমৃত কলস যাত্রা, দে'জ পাবলিকেশন, ২০১২, ১৭. দালানের পায়রাগুলি, পরম্পরা পাবলিকেশন, জানুয়ারি ২০১২, ১৮. ভৌতখামার, মিত্র ঘোষ, ২০১৩, ১৯. শালমহুলের প্রেম, মডার্ণ কলাম, ২০১৪, ২০. ঝিঙাফুল কাঁকুড়ফুল, গল্প সরণি, ২০১৫, ২১. একটি তারা দুটি তারা কোন তারাটি আরাখারা, সোপান, ২০১৭, ২২. মাটির মৃদঙ্গ, দে'জ পাবলিকেশন, ২০১৭, ২৩. সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা, দে'জ পাবলিকেশন, ২০১৮, ২৪. কাটা ঘুড়ির রং, ২৫. আমফুল জামফুলের দেশ, ২৬. ঝিঁঝিঁ পোকার জীবন ও অন্যান্য গল্প, ২৭. রোদনের ভাষা, ২৮. কাটা ঘুড়ির রঙ, ২৯.হলুদ বনের টুসু, ৩০. তিরিয়ো আড়বাঁশি, ৩১. দুই ভুবন, ৩২. কুসুমতলা, ২০০৮, ৩৩. এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, ৩৪. ভূতের বাপ, ৩৫. উড়ে যায় কারিকুরি পাখিরা, ৩৬. পাঁচকাহানিয়া, ২০২১, ৩৭. পাঞ্চালি, ৩৮. অনির্বাণ নেতাজী সুভাষ, ৩৯. দুই ভুবন, ২০০৫, ৪০. অপৌরুষেয়, ২০০৭, ৪১. শশধর পুরাণ ইত্যাদি।
এছাড়াও তাঁর কলম থেকে যেসব গল্পগ্রন্থ লেখা হয়েছে সেগুলির মধ্যে ১. কুসুমতলা, ২. হোমগার্ডের জামা, ৩. ঐ ঐ লোকগুলো, 8. আমাদের গ্রাম আওয়ার ভিলেজ, নলিনী বেরার শ্রেষ্ঠ ৫০টি গল্প, দে'জ, ২০১৫, ৬. নলিনী বেরার ৫০ টি গল্প, করুণা পাবলিকেশন, ২০০৪ উল্লেখযোগ্য। তিনি বেশ কিছু অনুবাদ গল্পও লিখেছেন। সেগুলির মধ্যে ১. মালয়ালম ভাষায় অনুবাদঃ 'শীতলামঙ্গল', ২. হিন্দি ভাষায়: 'শ্রীকান্ত পাঁচুয়া পর্ব', ৩. ইংরাজিতে অনুবাদ: 'শবরচরিত', 'সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা' প্রণিধানযোগ্য। কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ১. সে জানে শুশনি পাতা, দেশ, ২. কতদূরে আছ সুবর্ণরেখার নাম করা যায়। তাঁর লেখা কয়েকটি প্রবন্ধ হল ১. রোদনের ভাষা, ২. জয়ের জন্য একটি পালক, ৩. গুণীন বৃত্তান্ত ভূতপুরাণ, 8. উটিলা সুয়ারী বসিলা নারী। ছোটদের জন্য লিখেছেন ১. তিরিয়ো আড়বাঁশি, ২. মণ্ডলু, ৩. 'বাস্কেদাকা, 8. দিঘী তার মাঝখান থেকে, ৫. লোধা শবর উপকথা, ৬. মোদের পব মোদের গরব ইত্যাদি।
রাইবুর বাপ গোড়াশবরের কন্ঠে শোনা যায় ভূমিহীনদের আর্তনাদ - 'লদ্ধাদের চাষবাস শিখাতে পেথমে গরু হাল দিল শিবঠাকুর। দিয়ে বলল, চাষবাস কর। জঙল কেটে চাষের জমি তৈয়ারী কর। ত জঙল কাটতে কাটতে শব্বরের খিদ তেষ্টা পায়। কী খায়, কী খায় না, হালের বলদটাকেই কেটে খেয়ে ফেলল। কিসে করে খাইল না, হাতির কানের তুল্য সেগুনপাহায়। সেই থিক্যে জানবি সেগুনের ডগ ভাঙলেও রক্তের পারা রস গড়ায়। যাকে দিয়ে চাষবাস করবি, তাকেই কী না কেটে খেয়ে ফেললি! হায় হায়রে বোকার জাত! রাগে কাঁই শিবঠাকুর তেখন অভিশাপ দিল, বনে জঙলেই ঘুরে ঘুরে মরবি তোরা। তোদের কপালে চাষবাস নাই'। এটি 'শবরচরিত' কাহিনীর অংশ। টানা দশ বছর লেগে থেকে জন্ম নিয়েছে এই মহাকাব্যিক উপন্যাস 'শবরচরিত'। এজন্য নলিনী বেরা ২০০৮ সালে পেয়েছেন 'বঙ্কিম পুরস্কার'। এইসব শবরদের জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা নানা কিসিমের ঘটনা, দুর্ঘটনা কিংবা রটনা নিয়ে তাঁর এই উপহার। 'শবরচরিত' উপন্যাস নিয়ে নলিনী বেরার উপলব্ধি, 'শবরচরিত শুধুমাত্র 'চরিত'ই নয়, সমস্ত অন্ত্যজ জংলী মানুষদেরই চরিতমালা। তদুপরি জঙ্গাল মহাল। সে এক চিত্র বিচিত্র বনভূমি, 'শবরচরিত' আখ্যানভাগের একটা বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আমার আজন্ম পরিচিতি। সে জঙ্গল ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, জঙ্গলের জীব লোধারাও লোপ 'ইলোপ' হয়ে যাচ্ছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের মূল স্রোতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন...'। 'শবরচরিত' উপন্যাসে উঠে এসেছে সূবর্ণরেখা তীরবর্তী গ্রাম চিতরড়া, বাংধীপোষী, কয়ামাড়া, চাঁদাবিলা, রুখনীমারা দোরখুলি, নাকবিন্ধি, নাদনাগাড়িয়া, পাতিনা, সিংধুই, উদলাখুঁটি, রাইবনিয়া, গোবিন্দপুর, তিলকমাটি হুড়ি, প্রতাপপুর, সর্দারবাঁধ, অমরদা, চামারবাঁধ, নারদা, খড়িক, ধুমসাই, বড়সোল, ভালুকঘরিয়া, রুখনীমারা, ভালিয়াচাটি, লবকিশোরপুর, বড় খাঁকড়ির হাট, ঘোড়াটাপুর জঙ্গল, পাথরডহরা, খোঁয়াড়, বেতুনটি, বালিগেড়িয়া, কুলডিহা প্রভৃতি। নিজের জন্মস্থানকে ঘিরে থাকা পাড়া গাঁয়ের কথা তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে। এভাবেই সম্মান দিয়েছেন ঐসব গাঁয়ের মানুষকে, গাঁয়ের ইতিহাসকে, গাঁয়ের সংস্কৃতিকে। নলিনী বেরা রাইবুর মুখে শুনিয়েছেন - 'আমরা বিশ্বামিত্রের ছেলের ছেলে বটিন? জানিস আমরা অসুর? 'পল্লশবরী' বলে আমাদের এক দ্যাপতা আছে জানিস কী?
ফুদিচন্দ্র বলে একজন রাজও ছিল, নাম শুনেছিস? শন্নিস নাই ত, শুন্নে রাখ। কমধেনুর গোবর থেকে আমাদের জন্ম। জানিস আমরা ক্ষত্রিয়'।
এরপর ২০১৯ এ তাঁর 'সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা' উপন্যাসের জন্য পান 'আনন্দ পুরস্কার'। এই 'সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ বইয়ের জন্য ঔপন্যাসিক নলিনী বেরার হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু বলেছিলেন, ‘আজ আত্মপ্রত্যয় নিয়ে ঘরে ফিরে যাব। যে সংস্কৃতি বাঙালির গর্ব, সেখানে আজও ভাটা পড়েনি। আমাদের সৃজনশীল কাজ ও মননশীলতা আজও অক্ষুণ্ণ'। যদিও এই পুরস্কার বাবদ প্রাপ্ত ১০ লক্ষ টাকা তিনি খরচ করেন আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মেধাবী গরিব ছাত্র ছাত্রীদের উন্নয়নের জন্য। সেই উপন্যাসের নামেই নিজের বাড়ির গ্রন্থাগারের নাম রেখেছেন। এই গ্রন্থাগারটি তিনি সর্বসাধারণের জন্য উৎসর্গ করেছেন গত ২০২৩ এর ১৯ নভেম্বর ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রাম ব্লকের বাছুরখোয়াড় গ্রামে। গ্রন্থাগারে প্রায় হাজার খানেক বই রয়েছে। বসে বই পড়া যাবে সেখানে। গদ্যকার অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকার লিখেছেন, 'নীরবে বয়ে চলা সূবর্ণরেখা এবং তাঁর আশেপাশের অসংখ্য জনপদের জীবনযাত্রা নিয়ে তিনি লিখেছেন 'সূবর্ণরেণু সূবর্ণরেখা'। কোনও নির্দিষ্ট জনজাতির কথা নয়, কোনও নির্দিষ্ট পরিবারের কথা নয়। নদীর ঢেউয়ের গতিতে বয়ে চলেছে তাঁর কাহিনী'।
'পরভা রে পরভা কী তরকারি রাঁধবা?
তাঁর রচনায় স্থান পায় গাঁয়ের কথা সাধারণ মানুষের কথা, সমাজের কথা আর পরিবেশ প্রকৃতির কথা। মেদিনীপুরের আঞ্চলিক ভাষার অজস্র শব্দচয়ন তিনি করেছেন তাঁর লেখায়। বিশেষ করে সূবর্ণরৈখিক এলাকার ভাষা তাঁর রচনার ছত্রে ছত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে। নিজের সমাজ নিয়ে লিখেছেন 'মাটির মৃদঙ্গ'। কুম্ভকার সমাজের কষ্টকর দিনাতিপাত, অপমান, জ্বালা, যন্ত্রনা, অভাব, অভিযোগ, বেদনা এবং অপ্রাপ্তির স্নিগ্ধ বিবরণ তিনি এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন। দাশনগরের বিখ্যাত ব্যক্তি আলামোহন দাশের জীবনকে সামনে রেখে লিখেছেন 'এপার বাংলা ওপার বাংলা'। এতে স্থান পেয়েছে ইতিহাস। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন 'অপৌরুষেয়'তে। এখানে 'আনন্দী' চরিত্র হয়ে উঠেছে কেন্দ্রবিন্দু। জঙ্গলমহলের টুসু গান, ঝুমুর কাঁদনা গীত, জাওয়া করমের সাথে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় তিনি লিখতে পেরেছেন 'হলুদ বনের টুসু'।
'কুসুমতলা'তে তিনি নগরজীবনের নানা প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার পাশাপাশি নিজের হারিয়ে ফেলা ছোটবেলার সুখদুঃখ ও জীবনের অসংখ্য স্মৃতির রোমন্থন করেছেন কাগজে কলমে। ঝাঁ চকচকে শপিং মলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তাঁর মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে কুসুমফলকে কেন্দ্র করে ছোটবেলাকার নানা অভিজ্ঞতা -- 'রোহিনীগড়, হাতিবান্ধি কুস্তুড়িয়ার ডোমপাড়ার ভিতর দিয়ে 'শর্টকার্ট' করে গড়কাটা খাল পেরিয়ে বাজে শিমূলের তলা দিয়ে কোনো নবাগত আগন্তুক যখন ডুলুং নদী পেরিয়ে খুদুপালের চর, কাঁটাপালের ঝাড়, আকন্দর ঝাড় পেরিয়ে হব্লস্ ফলস্ আওয়াজ তুলে পায়ে হেঁটে সুবর্ণরেখার জল পেরিয়ে 'নদী সেপারে' মন্মথদের কুসুমতলায় উঠে যায়, শুধু কী নবাগত আগন্তুক, হাটফেরতি গাঁফেরতি কামার কুমহার হাটুয়া ভূঁইয়া ভূমিজ সাঁওতালরাও কুসুমতলায় পৌঁছে একবার অন্তত পিছন ফিরে দেখে কোথায় ছিলাম আর কতদূর বা হেঁটে এলাম, তখন, ঠিক তখনই তার মনে হতে পারে, হবেই হ্যাঁ এবার একটু বসি, কুসুমতলায় বসে একটু হাঁপ ছাড়ি'।
অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকার মূল্যায়ন করেছেন নলিনী বেরার কাব্যলিখনের। তিনি বলেছেন, 'নলিনী বেরার গল্প উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে সুবর্ণরেখা তীরবর্তী বিস্তৃত অঞ্চল। শৈশব থেকে এই অঞ্চলের প্রকৃতি মানুষ মানুষের সংস্কার বিশ্বাস, তাঁদের যৌথ সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত ছিলেন লেখক। বলা যেতে পারে একটি ভৌগোলিক পরিসরের আত্মীয় হয়ে উঠেছেন তিনি। কত বিচিত্র নামের গ্রাম, কত বিচিত্র নামের এবং স্বভাবের মানুষ, প্রকৃতির কত বিচিত্র বৃক্ষরাজি এমনকি সুবর্ণরেখা তীরবর্তী জনজীবনের বিচিত্র সংস্কৃতিও অনায়াসে তাঁর গল্প উপন্যাসে উঠে এসেছে'।
বঙ্কিম পুরস্কার এবং আনন্দ পুরস্কার ছাড়াও তিনি পেয়েছেন সংবাদ প্রতিদিন থেকে 'বর্ণপরিচয়' পুরস্কার, নির্মল আচার্য স্মৃতি পুরস্কার, উপত্যকা পুরস্কার, মেদিনীরত্ন পুরস্কার, একলব্য পুরস্কার, বেঙ্গল কেমিক্যাল যুগান্তর পত্রিকা পুরস্কার ইত্যাদি। শুধুমাত্র পুরস্কারের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় তাঁকে। তাঁর কাব্য প্রতিভাকে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলিকে। তাঁর প্রতিটি লেখায় কাগজের পাতায় অনুরণিত হয় মাতৃভূমির কোলে বেড়ে ওঠা জীবন্ত চরিত্রগুলির সফল উপস্থাপন। ঝঙ্কিত হয় শিরশির শব্দে দুলতে থাকা শাল মুল কুরচি কুসুমের পাতার শব্দ। আস্বাদন করা যায় লাল মাটির গন্ধ। উপলব্ধি করা যায় প্রান্তিক মানুষের জীবনের আর্তনাদ, ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি আর ব্যাথা বেদনার নির্যাস। 'নারদার মোড়ে বাসটা থেমে গেলে বাস থেকে ঝপ করে নেমে পড়ল নুকু। ছাতা খুলল, ফের নুনগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এক-দু মিনিট বাদে থেমেও গেল। ওবেলা এখানেই বাস থেকে নেমেছিল নামালিয়া লোধারা। এখন নামল নুকু। সেদিন একটুর জন্য দেখা হয়নি, দেরি করে ফেলেছিল সে। আজ তাদের সঙ্গে দেখা তো হবেই হবে।
এখন শুধু দেখার কোনদিকে গেল 'সে'?
সেই টি-উ-ল টু-টু পাখিটা'।
🍂
0 Comments