শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭১ / সালেহা খাতুন
ফিরে এসে সালাউদ্দিনকে বললাম, মা আসতে পারবেন না। তুমি থেকে যাও। ঐ তো জুটমিলের অবস্থা। বাসের লেডিস সীটে পুরুষের বসার মতো চাকরি। এই আছে এই নেই। বছরে চারমাস চলে তো আট মাস বন্ধ। নিজেদের বিব্রত করে কী লাভ। সালাউদ্দিন বিয়ের পর থেকে বার বার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। চাকরি চলেও গেছে বার কয়েক। কিন্তু এবার বললেন, “ তোমাকে লিখিত দিতে হবে, তবেই আমি চাকরি ছাড়বো।” বললাম এর আবার লিখিত কী দেবো। আমাদের সন্তানকে আমরা দেখভাল করবো। আশ্চর্য ব্যাপার একজন মাকে লিখিত দিতে হবে সন্তানের পিতার কাছে! তবে তিনি সন্তানকে সময় দেবেন। রেগে গিয়ে বললাম তাহলে কোর্ট থেকে স্ট্যাম্প পেপার আনো, আমি লিখে সই করে দিচ্ছি। তিনি বললেন, “তুমি সামান্য ব্যাপারকে জটিল করে তুলছো। যে কোনো একটা কাগজে লিখে দিলেই হবে।”
প্রায় একশো বছর পর বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো সালেহা খাতুনের জীবনে। রোকেয়া তাঁর “সুলতানার স্বপ্ন”-এ যে নারীবাদী স্বপ্নরাজ্য নারীস্থানের বর্ণনা দিয়েছিলেন, যেখানে নারী ও পুরুষের প্রচলিত ভূমিকা বদলে গিয়েছিল; নারীরা সমাজের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান চালিকাশক্তি আর পুরুষেরা প্রায় গৃহবন্দি ছিল – যে সমাজে কোনো অপরাধ নেই, যেখানে প্রচলিত ধর্ম ভালোবাসা ও সত্যের, সেই রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলো। রাজ্য না হোক অনন্ত একটি গৃহ তো প্রতিষ্ঠিত হলো।
বেগম রোকেয়ার যে বইটি সেই সময়ে ধর্মীয় ও সামাজিক বাস্তবতায় অত্যন্ত সাহসী ও বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্ম ছিল, সেই কর্মটিকে একশো বছর পর নিজের জীবনে বাস্তবে রূপ দিতে কম যন্ত্রণা ভোগ করেনি এই অধম। ২০০২-এর দশ ডিসেম্বর ডায়েরির পাতায় লিখে দিলাম – আমাকে ও আমার সন্তানকে সুস্থভাবে বাঁচতে সাহায্য করতে, তাঁর কর্মজগত ছেড়ে চলে আসছে আমার স্বামী। কর্মজগতের সমস্ত সুবিধেই থাকবে আমাদের সংসারে। আজ থেকে নতুন সকাল শুরু হলো আমাদের। নতুনভাবে বাঁচবো আমরা। প্রভু হে, আমাদের যাত্রাপথকে কুসুমাস্তীর্ণ কোরো। শান্তি বজায় রেখো।
শান্তি বজায় রাখা অতোই কি সোজা? মাঝে মাঝেই গৃহযুদ্ধ লেগেছে। আর আমার বাবার হস্তক্ষেপে শান্ত হয়েছি আমি। সালাউদ্দিনকেও নিজের বাড়ি থেকে শুনতে হয়েছে বউয়ের পয়সায় বসে খাওয়ার নানান গঞ্জনা।
ডিসেম্বরের লাস্ট উইকে সম্ভবত আঠাশে ডিসেম্বর আমার বাবা সাহাপুরে নাতনির আকিকা দিলেন। লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন। সন্তানের নামকরণ, মসজিদে গিয়ে ইমামের হাতে ক্ষীর খাওয়া সব সম্পন্ন হলো। আমি এর ব্যয়ভার সামলানোর জন্য একটি পার্সে আমার প্রায় একমাসের মাইনে আমার বাবার হাতে দিয়েছিলাম। কিন্তু যখন অনুষ্ঠান শেষে মেদিনীপুরে ফিরছি বাবা আমার হাতে সেই পার্সটি ফেরত দিলেন। একটি টাকাও তিনি সেখান থেকে খরচ করেন নি। পরে পরে আমাদের তিন ভাইবোনের সন্তানদের আকিকা আমার বাবাই দিয়েছেন।
চলতে থাকলো দিন। এসে গেলো দু’হাজার তিন। ক্লাসে পড়ানো, নিয়মিত খাতা দেখা, ইনভিজিলেশন ডিউটি সবই চলছিল। ইনভিজিলেশন ডিউটি প্রসঙ্গে মনে পড়লো ঘনিষ্ঠ দুই অধ্যাপকের কথা। সুপারভাইজার বা ওসিরূপে কী নির্মম ব্যবহার তাঁরা করেছিলেন একজন সদ্য মায়ের সঙ্গে। ভালোমন্দ সব নিয়েই চলতে হবে। তাঁরা নিজেরা হয়তো এখনও জানেন না কতটা কষ্ট তাঁরা দিয়েছিলেন। চাকরি করছি। অর্থ উপার্জন করছি। আবার সহানুভূতিও চাই। আমারই আস্পর্দা কী কিছু কম ছিল নাকি!
🍂
চাকরিতে পদমর্যাদা এবং নিজের জ্ঞান বাড়ানোর জন্য শুরু হলো বিভিন্ন সেমিনারে যোগদানের পালা। দু’হাজার তিনের একুশ এবং বাইশ মার্চে গেলাম ভট্টর কলেজ,দাঁতন আয়োজিত ইউ জি সি স্পনসর্ড “বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের অবদান ও আধুনিক কবিতার স্বরূপ সন্ধান” শীর্ষক এক সেমিনারে। দাদা অর্থাৎ রহিমদার উৎসাহেই রিসোর্স পার্সন বীতশোক ভট্টাচার্য এবং শ্রুতিনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে গেলাম। যাত্রাপথে অনেক গল্প হলো। মেদিনীপুরের বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে অধ্যাপকদের সম্পর্কে নানান তথ্য দিয়ে আমার পথচলাকে তাঁরা সহজ করে দিলেন।
বীতশোকের লেকচার শুনে এক অন্য জগতে প্রায় হাওয়ায় ভেসে গেলাম। প্রথম দেখা হলো অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তীর সঙ্গে। একবেণী হিয়ার এমন ব্যাখ্যা দিলেন আজও অন্তরে গেঁথে আছে। সেই সেমিনারেই তিনি আমাদের উৎসাহিত করলেন, জীবনে একটা হলেও বই লিখতে। বহুদিন পরেও কোনো একটি লাইব্রেরির কোনায় বইটির মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। পরের দিন উজ্জ্বলকুমার মজুমদার এলেন সস্ত্রীক। লেকচার শোনার পর তাঁর সঙ্গে নানান গল্প করতে করতে দাঁতন থেকে খড়্গপুর পর্যন্ত এলাম। স্যার কলকাতা চলে গেলেন আমি ফিরলাম মেদিনীপুর। ফিরতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। মেয়ের বয়স তখন মাত্র দশমাস। ভাই কলেজ থেকে ফিরে কোলে নিয়ে ভোলানোর চেষ্টা করছে। কান্না থামাতে পারছে না। আমি আসার পরই কান্না থামলো। ভাই ফিরে গেল সাহাপুরে।
মেদিনীপুরের সুহৃদরা : রাজেকা-ভাবী, অর্ক,রহিমদা
দু’হাজার তিনের পঁচিশে মার্চ দাদু চলে গেলেন। দাদু আমার চাকরি পাওয়া, বিয়ে এবং সন্তানকে দেখে গেছেন। সন্তানকে আশীর্বাদ করেছেন প্রাণভরে। মেদিনীপুরে আছি। কলেজ যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি। খবর পেলাম। রহিমদার ফোনেই খবর এলো। কেননা তখনো আমার নিজের কোনো টেলিফোন কানেকশন ছিল না। রিকশা ধরে স্টেশনে যাওয়ার পথে অধ্যাপক পঞ্চানন মুখার্জির সঙ্গে দেখা। কলেজে তাঁর মাধ্যমে খবর পাঠালাম যে আজ আমি কলেজ যেতে পারবো না। বাগনানে যাচ্ছি। লম্বা শানিত ইস্পাতের মতো চেহারার দাদুকে গোসল করিয়ে কেবলামুখী করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মুখ থেকে উজ্জ্বল জ্যোতি নির্গত হচ্ছে। ঐ মৃত্যুবাড়িতেও সালাউদ্দিন তথা সব নাতজামাইদের যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করা হয়। দাদুর এতো ভালোবাসা পেয়েছি যে জীবন আমার সার্থক। তিনি পড়াশোনা ভালোবাসতেন আর যারা পড়াশোনা করে তাদের কদর তাঁর কাছে খুব বেশি ছিল।
মির্জাবাজারের যে বাড়িতে ভাড়া ছিলাম সেই বাড়ির মালিক বলেছিলেন দুবছর হলে একদিনের জন্য বাড়ি ছাড়তে হবে। জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে দু’হাজার তিনের জুনমাসে চলে এলাম মেদিনীপুর কলেজের কোয়ার্টারে। মেয়ের প্রথম জন্মদিন উদযাপন অবশ্য ভাড়া বাড়িতেই করেছিলাম। দু’হাজার তিনের পনেরো মে, সেই দিনটায় সারা বিশ্ববাসী উদযাপন করছিল হজরত মহম্মদ (সঃ) এর জন্মদিন। আর আমি কোনো অতিথি অভ্যাগত ছাড়াই সামান্য একটু পায়েস বানিয়ে মেয়ের জন্মদিন পালন করলাম। একবছরে তার শব্দভাণ্ডার পূর্ণ ছিল – আব্বু, মামমাম,দিদি,টিকটিকি, বাঘ,ছাইকেল,পাখা, ম্যাও, পাপ,তেত ইত্যাদি দ্বারা।
জীর্ণ কোয়ার্টার সারিয়ে দিলেন তৎকালীন বার্সার অধ্যাপক সুধীন্দ্রনাথ বাগ। অধ্যক্ষ প্রবীর কুমার চক্রবর্তী আমাকে এবং অন্নপূর্ণা ম্যাডামকে একসাথে কোয়ার্টারে থাকতে বললেন। কেননা কোয়ার্টার নিয়ে সে সময় অনেক জল ঘোলা হয়েছিল।
যাইহোক ভাই ও সালাউদ্দিনসহ কন্যাকে নিয়ে শুরু হলো কোয়ার্টারযাপন। অনেক বাড়তি কাজ করার শর্তে আমাকে কোয়ার্টার এলট করা হয়েছিল। কিছুটা থিতু হয়ে দু’হাজার তিনের ডিসেম্বরে পিএইচডি করার বাসনা নিয়ে আবার দেখা করলাম অধ্যাপক ড. লায়েক আলি খান মহাশয়ের সঙ্গে। তিনি বললেন, “তোমাকে ওয়েটিং এ রাখছি। যদি তুমি কাজ দ্রুত করতে পারো তাহলে জায়গা পাবে।”
0 Comments