বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৪১
পেটারি
ভাস্করব্রত পতি
পেটারি বা টিকিফল গাছের সাথে দুর্গাপূজার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সরাসরি দুর্গাপূজায় লাগেনা এই গাছ। কিন্তু অন্যরকম ভাবে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বাঙালির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। দুর্গাযষ্ঠীর সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়িতে দুর্গার আগমনীকে কেন্দ্র করে ফোঁটা দেওয়া হয়। চালের গুঁড়ো বাটা এবং আলতার ফোঁটা লাগানো হয় দরজায় দরজায়। ফোঁটা লাগাতে ব্যবহৃত হয় পেটারি গাছের ফল। এই পেটারি গাছের ফলের বৃন্তে ধরে বাড়ির মহিলারা নতুন কাপড় পরে বাড়ির দরজায় ফোঁটা দেন। দুর্গার মর্ত্যে আগমনে তাঁকে এভাবেই প্রতিটি বাড়িতে স্বাগত জানানোর রেওয়াজ চালু। একে বলে 'দুয়ার বন্দনা' বা 'গিরি বন্দনা'।
কাঁচা ফল
MALVACEAE গোত্রের গাছ এটি। হলুদ রঙের ফুল হয়। কিন্তু ফলগুলি দেখতে খুবই সুন্দর। এর গঠন বৈশিষ্ট্য চমৎকার। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Abutilon indicum। এছাড়াও Sida indica, Abutilon asiaticum, Abutilon arborescens নামে অন্যান্য প্রজাতি রয়েছে।
শুকনো ফল ও পাতা
গ্রামবাংলায় এটি পরিচিত টিকিফল বা ঝাপা ফুল নামেও। সংস্কৃতে কলিকা, অতিবলা, নেপালিতে অতিবালু, অতিবলা, হিন্দিতে বন কুকরা, কাঙ্ঘি, বন কুইয়া, সাঁওতালিতে মিরুবাহা, মনিপুরীতে কাঙ্ঘি, মালয়লামে ভেল্লুরাম, তামিলে পানিয়ারাটুট্টি, মারাঠীতে পেটারি, আরবিতে মস্তুলগোলা, ফারসীতে দরখতশান, তেলুগুতে টুটুরাবেণ্ডা, কন্নড়ে গিডুটিঙ্গি, নিলাডুরুভি, হাগাডি, হিট্টুট্টি, মায়ানমারে ফা ফা চোক বলে। পেটারিকে বাট্যপুষ্পিকা, ভূরিবলা, বল্যা, বৃষ্যগন্ধিকা, বিকঙ্কতা, বালিকা, শীতপুষ্প নামেও অভিহিত করা হয়েছে। দেশি পেটারিকে ইংরেজিতে বলে Indian Abutilon, Indian Mallow, Country Mallow, Room Maple, Parlor Maple, Flowering Maple, Abutilon, Indian Abutilon ইত্যাদি।
এর ভেষজ উপকারও রয়েছে অনেক। পেটারি গনোরিয়া বা মূত্রথলির প্রদাহেও উপকারী। অর্শজনিত রক্তপাত বন্ধ করে। দাঁতব্যথা বা মাড়ির প্রদাহে খুব উপকারী। শ্বেতী রোগের উপশমকারী। রক্তবমি ও কফজনিত সমস্যার সমাধানে এর ব্যবহার রয়েছে। মূত্রকৃচ্ছ্রতায় এটি মহৌষধ। বিভিন্ন চিকিৎসা গ্রন্থে পেটারির গুণগত মানের বিষয়ে নানাবিধ উল্লেখ রয়েছে। যেমন - চরকসংহিতাতে পেটারি বা অতিবলাকে বলবীর্য রক্ষাকারী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুশ্রুত সংহিতাতেও বাত সংশমনীয় দ্রব্যগুলির মধ্যে অতিবলার নাম রয়েছে। আবার ভাবপ্রকাশে গ্রন্থে বলা হয়েছে যে এটি শীতবীর্য, মধুর, বলকর, কান্তিবর্ধক, স্নিগ্ধ, মল সংগ্রাহক, বায়ু পিত্ত রক্তদুষ্টি এবং ক্ষতনাশক। ধন্বন্তরি নির্ঘণ্টতে গুণ বর্ণনায় তিনটি বলার, তথা বলা, নাগবলা এবং অতিবলা একত্রে গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। যা বাতপিত্তনাশক, সংগ্রাহী, বলবর্ধক এবং শুক্রজনন। অষ্টাঙ্গহৃদয় সংগ্রহ গ্রন্থে অশ্মরী রোগ চিকিৎসায় এই পেটারির ব্যবহারের গুণাবলী বিধৃত। চক্রদত্তে পেটারির ক্বাথ মূত্রকৃচ্ছে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
পেটারি গাছ
এটি উষ্ণমণ্ডলীয় এবং উপউষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের একপ্রকার বহুবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এটির উচ্চতা সাধারণত ৭ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত হয়। তবে গড়ে ৪ ফুটের মতো হয়। টিকিফল গাছের কাণ্ডের রং গাঢ় বাদামী এবং তা ২ থেকে ৩ ইঞ্চি মোটা হয়। কাণ্ডের একেবারে গোড়া থেকেই ডালপালা জন্মায়। এই কাণ্ড বেশ নরম, সহজেই মটকে ভেঙে দেওয়া যায়। গাছটি একটু ঝোপঝাড় ধরনের।
গ্রামের পথের ধারে, মাঠে, মেঠো জনবসতিতে পেটারি গাছ দেখা যায়। বর্ষার শেষে শরতের প্রাক মুহূর্তে এই গাছের কমলা হুলুদ রঙের ফুলের সৌন্দর্য নয়নাভিরাম। এঁদের ফুল খুব ভোরে ফুটলেও সকাল ৯ - ১০ টার দিকে ফুল মুড়ে যায়। আসলে রোদের তাপ সহ্য করতে পারে না। আবার যখন সূর্যের তাপ কমে আসে, তখন অর্থাৎ বিকেলবেলা ফের ফুলের পাঁপড়ি মেলে। গন্ধহীন ফুলে রয়েছে পাঁচটি পাতলা পাতলা পাঁপড়ি। পাঁপড়িগুলির মাঝে থাকে একগুচ্ছ হলুদ পুংকেশর ও গর্ভকেশর। যদিও এটি কৌলীন্যপূর্ণ কোনও গাছ নয়। তবে মৌমাছি, ভ্রমর, প্রজাপতিদের কাছে এটি খুব আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ফুলের মধ্যে মধু থাকায়।
পেটারি ফুল ও ফল
এই গাছের পাতাগুলির বৈশিষ্ট্য বেশ চিত্তাকর্ষক। আকারে অনেকটা হৃৎপিণ্ডের মতো। একটু সাদাটে সবুজ বর্ণের। পাতাগুলির কিনারা খাঁজকাটা খাঁজকাটা। মোটামুটি পাতার ব্যাস গড়ে ৪ ইঞ্চি মাপের। বেশ নরম তুলতুলে মখমলের মতো। অমসৃণ। পাতার গায়ে ছোট ছোট রোঁয়া থাকে। এজন্য এই গাছকে বলে Velvet Leaf। তবে ফলগুলি বেশ দর্শনীয়। এটি সৌগন্ধি প্রবলাকৃতি ফল। সুন্দর কারুকার্যময়। নৌকার মতো ঢেউ খেলানো এবং গোলাকার। ১১ - ২০ টি লোমশ কার্পেল দ্বারা গঠিত। কাঁচা অবস্থায় সবুজ রঙের হয়। কিন্তু পেকে গেলে কালচে বাদামী রঙের হয়। ঝনঝন শব্দ করে। বীজগুলি কিডনির মতো দেখতে।
0 Comments