মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১২৫
ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী (সঙ্গীতজ্ঞ, দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপির প্রবর্তক, চন্দ্রকোনা)
ভাস্করব্রত পতি
ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনাতে। সালটা ১৮১৩। বাবা ছিলেন রাধাকান্ত গোস্বামী (বন্দ্যোপাধ্যায়)। চন্দ্রকোণার এই বিখ্যাত কথক শিল্পীর বৃত্তি ছিল কথকতা। বংশপরম্পরায় তিনি তা করে আসছিলেন। একদিন তিনি ছেলেকে ডেকে বললেন, আমার ইচ্ছে, তুমি আমার মতো কথকতা বলে কথক হিসেবে খুব নাম কর! এই পবিত্র বৃত্তি তোমাকে সুখ এনে দেবে।
ক্ষেত্রমোহন কিন্তু কথকতা পছন্দ করতেন না। কথক শিল্পী হওয়ার বাসনা তাঁর ছিল না। তিনি বললেন, আমার কিন্তু সঙ্গীতের চর্চা করতে ইচ্ছে করে। আমার কাছে গানই প্রথম পছন্দ। প্রথম থেকেই ক্ষেত্রমোহনের গানের গলা ছিল বেশ সুরেলা। এটা তাঁর বাবা রাধাকান্ত জানতেন। তাই তিনি ছেলের বক্তব্যে সায় দিলেন। তবে তিনি এজন্য ছেলেকে অশেষ ধৈর্য্য বজায় রাখতে বলেন।
ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর লেখা বিখ্যাত 'সঙ্গীতসার' বই
বাবার সম্মতি পেয়ে ক্ষেত্রমোহন মনোনিবেশ করলেন সঙ্গীত চর্চায়। সেসময় বাঁকুড়া ছিল বিষ্ণুপুরী ঘরানার সঙ্গীতচর্চার পীঠস্থান। তিনি সেখানকার সঙ্গীতাচার্য রামশঙ্কর ভট্টাচার্যকে (১৭৬১ - ১৮৫৩) গুরু হিসেবে বেছে নেন। রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের কাছে তিনি মূলত ধ্রুপদ শিখতেন। ক্ষেত্রমোহনের প্রতিভা এবং অধ্যবসায় দেখে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সঙ্গীতগুরু রামশঙ্কর তাঁকে বুঝে নিলেন। জেনে গেলেন যে, এই ছেলে একসময় সঙ্গীতচর্চায় যথেষ্ট নাম করবে। রামশঙ্করের কথা পরবর্তীতে মিলে গিয়েছিল ক্ষেত্রমোহনের জীবনে।
পরবর্তীতে তিনি নিজের যোগ্যতায় এবং কৃতিত্বে ১৮৪৭ সালে হয়েছিলেন পাথুরিয়াঘাটার জমিদার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গীতসভার গায়ক। তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার দরুন তাঁকে কলকাতার 'বঙ্গসঙ্গীত বিদ্যালয়' এবং যতীন্দ্রমোহনের ভাই শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের 'বেঙ্গল একাডেমী অব মিউজিক' -- এই দুটি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। এই শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বিদ্যালয় থেকে তাঁকে দেওয়া হয় 'সঙ্গীত নায়ক' উপাধি। এই সম্মাননার পাশাপাশি তিনি পেয়েছিলেন স্বর্ণ কেয়ুর উপহার। ১৮৭৫ সালে তখনকার ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল নর্থব্রুক এসেছিলেন যতীন্দ্রমোহনের বাসভবনে। সেখানে তিনি ক্ষেত্রমোহনের সঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিশেষ প্রশংসাপত্র দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। কলকাতার বীডন স্কোয়ারের পশ্চিমে ৩০ চড়কভাঙা লেনের বাড়িতে দীর্ঘদিন তিনি কাটিয়েছেন।
এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী
১৮৬৫ সালে শৌরীন্দ্রমোহনের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গ নাট্যালয়'। আর সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ভারতের প্রথম ডক্টরেট অব মিউজিক উপাধিপ্রাপ্ত সঙ্গীতশিল্পী। শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর সহ বেশ কিছু সঙ্গীতরসিক ব্যক্তি ১৮৭১ সালে কলকাতায় স্থাপন করেছিলেন 'বঙ্গ সঙ্গীত বিদ্যালয়'। এই সঙ্গীত বিদ্যালয়ের প্রচার এবং সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে সেসময় প্রকাশ করা হয়েছিল 'সঙ্গীত সমালোচনী' নামের একটি পত্রিকা। যার সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। বিখ্যাত এই পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়িতেই তিনি সঙ্গীত সাধনা করে আজীবন কাটিয়ে ছিলেন। ক্ষেত্রমোহনের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। এক ভ্রাতুষ্পুত্র হিসেবে প্রাণকৃষ্ণ গোস্বামীর নাম শোনা যায়। পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়া জেলায় তাঁর ছোট তালুক রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
এখানে তাঁর সঙ্গে আলাপ পরিচিতি ঘটে বারাণসীর বীণা বাদক লক্ষ্মীপ্রসাদ মিশ্রের সাথে। বীণার বাদন এবং সঙ্গীতের প্রতি বিস্তারিত জ্ঞান দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শিষ্যত্ব নেন। তাঁর কাছে মূলতঃ যন্ত্রসঙ্গীতের তালিম নেন এবং ধ্রুপদও শেখেন। শুধু তাই নয়, বীণা বাদক লক্ষ্মীপ্রসাদের দুই ভাই সারদাসহায় এবং গোপালাপ্রসাদের কাছেও তিনি বিভিন্ন সময়ে নিতে থাকেন সঙ্গীতের পাঠ। বাংলার সঙ্গীত জগতের তিনজন স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর শিষ্য। এছাড়াও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন আনন্দ মিশ্র, নবীনকৃষ্ণ হালদার, ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরীশচন্দ্র ভট্টাচার্য, কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্য প্রমুখ।
১৮৫৮ সালের জুলাই মাসে শ্রীহর্ষের সংস্কৃত নাটক 'রত্নাবলী'র বাংলা নাট্যরূপ বেলগাছিয়া ভিলায় যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এবং পাইকপাড়ার জমিদার ঈশ্বরচরণ সিংহ ও প্রতাপ সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় অভিনীত হয়। এই নাটকেই ভারতের মধ্যে সর্বপ্রথম ঐকতানবাদ্য বাজানো হয়। যার নাম ছিল 'কনসার্ট'। এই ঐকবাদনের জন্য সৃষ্ট স্বরলিপি পদ্ধতিই পরবর্তীতে পরিচিত হয় দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপি হিসেবে। নাটকে আবহ সঙ্গীত ও সঙ্গীতের রচনার মূল দায়িত্ব ছিল ক্ষেত্রমোহনের ওপর। এই ঐকতানিক গানগুলি দেশীয় অক্ষরমাত্রার স্বরলিপি তৈরি করে একটি বই লিখেছিলেন সেসময়। তাঁর সৃষ্টি করা ঐকতানবাদ্য শুনে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডে সাহেব, লেডী রিপন, কন্টের ডিউক এবং ডাচেস। ১৮৫৯ সালের ৩ রা সেপ্টেম্বর 'রত্নাবলী' নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়। ১৮৬১ সালে পাইকপাড়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের মৃত্যু হলে বেলগাছিয়া নাট্যশালাটি বন্ধ হয়ে যায়।
ক্ষেত্রমোহনের লেখা সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ গুলি হল -- ঐকতানিক স্বরলিপি (১৮৬৮), সঙ্গীতসার (১৮৬৯), গীতগোবিন্দের স্বরলিপি (১৮৭১), কণ্ঠকৌমুদী (১৮৭৫), আশুরঞ্জনী তত্ত্ব (১৮৮৫) ইত্যাদি। ঐকতান স্বরলিপি গ্রন্থে কানাড়া, বেহাগ, বাগেশ্রী, কালাংড়া ইত্যাদি রাগে এবং সুরফাক্তা, পটতাল, পঞ্চম সওয়ারী ইত্যাদি তালে ৪৮ টি গতের স্বরলিপি লেখা হয়েছে। এগুলির মধ্যে ২৯ টি ক্ষেত্রমোহনের লেখা এবং ১৯ টি শৌরেন্দ্রমোহনের লেখা। ভারতীয় সঙ্গীতকে একটা নির্দিষ্ট শৃঙ্খলার মধ্যে আনতেই উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। এজন্যই তিনি লিখেছিলেন সঙ্গীত বিষয়ক গবেষণামূলক গ্রন্থ 'সঙ্গীতসার'। এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৯ সালে। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'সঙ্গীতসূত্রসার' প্রকাশের পূর্বে এই গ্রন্থটি সেসময়কার বিখ্যাত এবং গ্রহণযোগ্য সঙ্গীত বই হিসেবে ব্যবহৃত হত।
'কণ্ঠকৌমুদী'-র ১ম সংস্করণটি (১৮৭৫) হল ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, টপ খেয়াল ইত্যাদি গানের স্বরলিপির সংকলন গ্রন্থ। এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে। বলা হয়ে থাকে ক্ষেত্রমোহনই প্রথম বাংলা ভাষায় এই ধরনের গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। 'গীতগোবিন্দের স্বরলিপি' গ্রন্থটিতে বিভিন্ন রাগ ও তাল সমৃদ্ধ জয়দেবের ২৫ টি গানের স্বরলিপি রয়েছে। যা তিনি শিখেছিলেন তাঁর গুরু রামশঙ্করের কাছেই। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, জয়দেবের গীতাবলী থেকেই তিনি গান শিখেছেন এই গুরুর কাছে। 'সংগীতসার' গ্রন্থের প্রথম ভাগে গীত, বাদ্য ও নৃত্য বিষয় এবং দ্বিতীয় ভাগে ক্রিয়া সিদ্ধ বিষয় আলোচিত হয়েছে। গীতকান্ডে রাগের উৎপত্তি, রাগ গানের সময়, বাদী, বিবাদী, সমবাদী, গীতাবলী ভারতের প্রসিদ্ধ গায়কগণের নাম ইত্যাদি রয়েছে। বাদ্যকান্ডে মিলবে তালের নিয়ম, যন্ত্রের বিবরণ, উৎপত্তি ও ক্রম পরিণতি ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা। নৃত্যকান্ডে মূলতঃ নৃত্য বিষয় আলোচনা রয়েছে। ক্রিয়াসিদ্ধ অধ্যায়ে আছে সংগীতের অবনতির কারণ, স্বরলিপি পদ্ধতির লোপ এবং প্রয়োজনীয়তা, প্রাচীন পদ্ধতির সংস্করণ করে রক্ষা করা, ইউরোপীয় সংগীতের হারমোনি ও অক্টেভ বিষয় বিচার, কন্ঠসংগীতের তুলনামূলক আলোচনা, সেতার শিক্ষা, গত ও রাগাদির আলাপ, তবলার বোল সাধবার নিয়ম ইত্যাদি। স্বরলিপির বই দেখেই বেশিরভাগ শিল্পীই অনেক সময় গান করেন। কিন্তু অক্ষরমাত্রা দিয়ে স্বরলিপি ক্ষেত্রমোহনই প্রথম করেছিলেন। সঙ্গীতের প্রচার ছড়িয়ে পড়ুক আরও। তাই তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন একটি সঙ্গীত পত্রিকা প্রকাশের জন্য।
পৃথিবী বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ তানসেনের বংশের দুই সঙ্গীতজ্ঞ বাসৎ খাঁ ও কাসিম আলি খাঁও ছিলেন ভারত বিখ্যাত। তাঁরা মেদিনীপুরের সঙ্গীত বিশারদ ক্ষেত্রমোহন সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন -- 'আমাদের সময়ে এই (সঙ্গীত) শিল্পের একজন পারদর্শী জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁকে এই শিল্পের নায়ক বলা যায়'। ১৮৯৩ সালে মেদিনীপুরের এই মহান সঙ্গীতশিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।
🍂
0 Comments