জ্বলদর্চি

সমাপতন নয় /বন্দনা সেনগুপ্ত

ছবি- সৈয়দ স্নেহাংশু

সমাপতন নয়
বন্দনা সেনগুপ্ত 


চোখে রোদ আর মুখে জলের ছিটা পড়তে ধীরে ধীরে চোখ খুলল উইলি, উড্রো উইলসন। প্রথম কথাই মনে হল যে "ওফফ্! কি ব্যাথা"। তার পর চোখ পড়ল চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষ জনের উপরে। তাদের মধ্যে মেয়ে পুরুষ দুইই আছে। তারা কি যেন বলছে। কিন্তু, উইলি তার কিছুই বুঝতে পারছে না। তার তো ভীষণ শরীর খারাপ লাগছে। শীত করছে। জল তেষ্টা পাচ্ছে। কিন্তু, তার কথাও এরা বুঝতে পারছে না। তবে, এরা বেশ ভাল লোক। একটা বাঁশের চালি নিয়ে এসেছে। তারা তাতে চাপিয়ে উইলিকে নিজেদের গ্রামে নিয়ে গেল। ততক্ষণে উইলি আবার জ্ঞান হারিয়েছে। 

উইলিকে ওরা গ্রামের সবচেয়ে ভালো বাড়িটাতে নিয়ে গেছে। এই বাড়িটা সাংমা আর নেপুর। নেপু গাঁওবুড়ো মংপুর মেয়ে। গাওঁবুড়ো আবার ওই গ্রামের একমাত্র হেকিম বা বদ্যি। সে জঙ্গলে পাওয়া গাছ গাছড়া দিয়েই গ্রামের সবার চিকিৎসা করে। বাপ দাদার কাছে শেখা বিদ্যে। অবশ্য, দূষণমুক্ত এই গ্রামে অসুখ বিসুখ একটু কমই হয়। নেপুও তার বাবার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছে। ওষুধ এবং সেবা, দিন পনেরোর মধ্যেই উইলিকে সুস্থ করে তুলল। তবে নিজের সম্পূর্ণ শক্তি ও স্মৃতি ফিরে পেতে আরও কিছুদিন লাগল।

উইলি ট্র্যাভেল ব্লগার। ওর স্পেশালিটি পাহাড় আর পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট গ্রাম, আর তাদের সৌন্দর্য। সে পৃথিবীর কত জায়গায়ই না গেছে! আসলে আমেরিকার লোক হলেও, ভারতেও বেশ কয়েকবার এসেছে। হিমালয়ে একা একা ‌ঘুরে বেড়াতে সে খুব ভালোবাসে। এবার সে রাস্তা হারিয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে আহত এবং অসুস্থ হয়ে এই গ্রামে এসে পৌঁছেছে। এই ছোট্ট গ্রামটি ম্যাপে তো নেইই, উইলি কারুর কাছে এই গ্রামের সম্বন্ধে শোনেও নি। অথচ, প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা এই গ্রামটি কি সুন্দর! না, শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়। নেপুর বুদ্ধি ও সাংমার পরিশ্রমও আছে। হয়েছে কি, নেপু ভারী সৌখিন মেয়ে। আর, তার মাথায় নানান রকম বুদ্ধি খেলে। প্রথমে সে নিজেদের চিরাচরিত এক কামরার বাড়িকে তিন কামরার করেছে। শোওয়া বসার আলাদা ঘর। রান্নাঘর। বড় বড় জল রাখার জায়গা করেছে। একটু দূরে ছাগল, মুরগি রাখার ঘর করেছে। কাঠ বাঁশ দিয়ে শোওয়া বসার জায়গা বানিয়েছে। বনের নানান রঙের লতা পাকিয়ে পাকিয়ে শোওয়া বসার জায়গাগুলি ঢাকা দিয়েছে। বাড়িটি খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। ওদের দেখে দেখে গ্রামের সবাই নিজেদের বাড়ি নতুন করে বানিয়ে সুন্দর করে রাখে। রাস্তাগুলিও পরিষ্কার। 

একটু ভালো হয়ে উইলি চারপাশটা ঘুরে দেখে। দুটো ঝর্না, তাঁবা আর কোসি, পাহাড়ের গা বেয়ে প্রবলবেগে গম্ভীর  নিনাদে নেমে এসে কিছুদূর বয়ে গিয়ে মিলে এক হয়ে গেছে। তারই মাঝখানের প্রায় সমতল ভূমিতে এই গ্রাম তাঁবাকোসি বা সংক্ষেপে তাশি। এই গ্রামের তিন দিকে জল আর একদিকে পাহাড়। সাধারণ ভারত ভূমি থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন বলা যায়। সাধারণ জীবন যাপন করতে যা প্রয়োজন, সেসব এরা জল জঙ্গল থেকেই জোগাড় করে নেয়, বানিয়ে নেয়। অল্প অল্প কিছু চাষ বাসও করে। উইলি কিছুদিনের মধ্যেই এদের ভাষাও একটু শিখে যায়। অদ্ভুত এবং নতুন ভাষা হলেও, ওর যেন কিছু কিছু শব্দ চেনা চেনা লাগে। পরে বুঝতে পারে, সেভেন সিস্টারের কোনও পুরোনো ভাষার সঙ্গে সামান্য মিল আছে। তাই চেনা চেনা লাগে।

শান্ত ছন্দে বয়ে যাওয়া এই গ্রামে কি কোনও রহস্যই নেই? অবশ্যই আছে। ক্রমশ প্রকাশ্য।

যাই হোক, উইলিই এই ঘুমন্ত গ্রামকে জাগিয়ে তুলল। ওর ব্লগে লিখল নিজের অভিজ্ঞতার কথা। এই গ্রামের কথা। মানুষের কথা। প্রকৃতির কথা। তারপর থেকে মানুষের আসা শুরু হল। অবশ্য, খুব দুর্গম জায়গা বলে অভিযাত্রীর সংখ্যা খুব কম। তবুও, তারা পরিবর্তন আনল বৈকি। কাঁচা টাকার ওখানে বিশেষ প্রয়োজন নেই। তারা নিয়ে যেত খাবার দাবার, জামা কাপড়, জীবনদায়ী ওষুধ পত্র। একটা দল নেশার জিনিস নিয়ে গেছিল। অভ্যাস নেই, সেসব খেয়ে গ্রামের লোক কাহিল। পরের দিন গাওঁ বুড়োর হুকুমে দলের সবাইকে হাত পা বেঁধে গ্রামের বাইরে ফেলে দিয়ে এসেছিল।

এবার আসি সমুর কথায়। সৌম্যদীপ। খুব ভালবাসে রিয়াশ্রী ওরফে তাশিকে। চাপা নাক আর ছোট চোখ হলেও অপূর্ব সুন্দরী নাতনিকে দেখে ভক্তিমতী ঠাম্মি নাম রেখেছিলেন সীতা। রাজকন্যা, রাজবধূ, রাজরানী জীবন কাটালেন জঙ্গলে, সঙ্গে ফাউ স্বামীর দেওয়া অপমান, এ আবার একটা জীবন নাকি! তাই ঠাম্মি গত হতেই সীতা হয়ে গেল ফ্যাশনেবল মায়ের তাশি। এই সমু, তাশি, দীপ, শুভ, আর দিয়া ছোট্ট থেকে বন্ধু। পড়া ও চাকরি সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেও ভিডিও কলে ভালই যোগাযোগ আছে। তাছাড়া, বছরে একবার সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়া বাধ্যতামূলক। 

উইলির ব্লগ দেখে সমু সবাইকে লিঙ্ক মেল করেছিল। ও জানে তাশি পাহাড়ের ভক্ত। একা একা ধরমশালা কৌশানী সিমলা নৈনিতাল ঘুরে এসেছে। তবে, ক্যাম্পিং, টেন্ট বা হোম স্টে, ওর সবই কমার্শিয়াল মনে হয়েছে। তাই সমুর খুব আশা যে তাশি হয়ত এখানে যেতে রাজি হবে। আর, সেখানে ওকে একটু ভাল মুডে দেখলে প্রপোজটা করেই ফেলবে। এখানে তাশি নিজেকে যেন একটা খোলসের মধ্যে মুড়ে রাখে। এই চারজন ছাড়া কোনও বন্ধু নেই। এদের সঙ্গেও মনের কথা কখনোই নয়। মেয়েদের মধ্যে অসম্ভব শক্তিশালী তাশি ক্যারাটেতেও ব্ল্যাক বেল্ট। মিশবে না অথচ, যে কোনও কারুর যে কোনও সমস্যায় জান দিয়ে লড়ে যাবে! একে কি সমু ছাড়তে পারে! 
🍂
সমুর প্ল্যান অনুযায়ী ওরা পাঁচজন রওনা হল। ট্রেন, বাস, ট্রেকার। তারপর পাহাড়ি পথে হাঁটা। এখানে এসে তাশিকে যেন চেনাই যাচ্ছে না। এক উচ্ছল কিশোরী যেন। কলকল করে কথা বলছে। পাহাড়ি ছাগলের মতই চড়াই ভাঙ্গছে। কাঠের টুকরো ছুঁড়ে অদ্ভুত কায়দায় খরগোশ আর বুনো মোরগ  শিকার করে ছাড়িয়ে রোস্ট করে খাওয়ালো। 

কঠিন পথের শেষে ঝোলা পুল পেরিয়ে তাশি গ্রাম। একসঙ্গে পাঁচজন অতিথি দেখে গ্রামের লোকেরা অবাক এবং খুশি। একমাত্র সাংমার বাড়িতে প্রয়োজনের চাইতে বেশি ঘর। যারাই আসে, ওখানেই থাকে। কিন্তু, পাঁচজনের বিছানা? উপায় ছিল তাশির কাছে। ওর বুদ্ধিতে  গ্রামের লোকেদের জন্য গরম কম্বল উপহার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওরা সেগুলোই পরিপাটি করে বিছিয়ে শোয়া বসার জায়গা করে দিল। ওরা চা বানিয়ে বিস্কুট কেক ইত্যাদি শুকনো খাবার বার করে সাংমা নেপু মংপুর সঙ্গে ভাগ করে খেল। উইলি এদের ভাষা যতটুকু শিখেছিল, ব্লগে দিয়েছিল। সেই কয়েকটা শব্দ আর হাত পা নেড়েই দিব্যি গল্প করল ওরা সবাই। গ্রামের আর সবাইও এসে জুটল। তাশির মনে হল পাঁচজন মিলে খেলে, এদের উপর বোঝা হয়ে যাবে। সে বাকিদের নিয়ে কিছু শিকার পাওয়ার আশায় ঘুরতে বেরোল। সবাই অবাক হয়ে গেল যখন একটা কাঠের টুকরো আর দড়ির ফাঁস দিয়ে তাশি একটা হরিণ ধরে ফেললো। গ্রামে একটা উৎসবের মেজাজ এসে গেল। পুরুষেরা খোলা আকাশের তলায় বড় করে আগুন জ্বালিয়ে হরিণ রোস্ট করতে বসল। মেয়েরা জোগাড় করে দিয়ে নাচা গানা শুরু করল। খাওয়া শেষ হতে একটু রাতই হল। শুতে গিয়ে সমু জিজ্ঞেস করল ওরা ব্লগে এই গ্রামের রহস্য  পুরোটা পড়েছে কিনা। অত ব্যাখ্যা তো কেউই পড়ে নি। সমু বলল যে পূর্ণিমার দিন এখানে একটা গান শোনা যায়। যদি খুব জোৎস্না ওঠে তাহলে পূর্ণিমার এক দিন আগে আর পরেও শোনা যায়। যদিও সবাই শুনতে পায় না। সব পূর্ণিমায়ও শোনা যায় না। কেউ দেখেও নি কিছু।

তাই সমু পূর্ণিমা দেখেই এসেছে। যদি গান শোনা যায়, ওরা গিয়ে কি ব্যাপার দেখবে। বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে। সবাই রাজি।

যদিও কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তাশি‌ ছাড়া কারুর ঘুম ভাঙ্গে নি। সে একাই গানের উৎসের উদ্দেশ্যে রওনা হল। চারিদিক জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। গাছের পাতার উপর দিয়ে আলো যেন পিছলে যাচ্ছে। রুপোর মত চকচক করছে। নানান বুনো ফুল ফুটে গন্ধে চারিপাশ ঝিম ধরে আছে। এক একটা গাছ ফুলে সাদা হয়ে আছে। মাঝে মাঝে রাতচরা পাখির ডাক ছাড়া পৃথিবী একেবারে নিস্তব্ধ। এর মধ্যে দিয়ে তাশি‌ যেন ঘোরের মধ্যে একা হেঁটে যাচ্ছে। কি অপূর্ব এই পথ, এই পাহাড়, এই যাত্রা। অনেকটা উপরে ওঠার পর একটা ঢিপির মত উঁচু জায়গায় একটা ঝুপসি গাছ। সেখানে এক মহিলা বসে। তাঁর খোলা চুল মুখ বুক ঢেকে আছে। ঊর্ধ্বাঙ্গ ও নিম্নাঙ্গ স্বল্প বস্ত্র দিয়ে আবরিত। তিনি গান গাইছেন।

"পাহাড় ডাকে আয় 
ঝর্ণা ডাকে আয় 
মেঘের কোলে জোছনা মেখে 
চাঁদ ডাকে আয়।

আকাশ ডাকে আয় 
বাতাস ডাকে আয় 
গাছের পাতায় জোছনা সাজে 
আঁধার ডাকে আয়।

মা ডেকেছে আয় 
ওরে মেয়ে 
আয়রে ছুটে আয় 
মায়ের কোলে আয়।”


তাশি‌ সোজা গিয়ে তাঁর কোলে মুখ দিয়ে উবুড় হয়ে পড়ল।

“মা”।

তার চোখের সামনে হলোগ্রামের ছবির মত ভেসে উঠল কত পুরোনো দিনের কথা। 

কি সুন্দর গ্রাম ছিল তাদের! কিন্তু, বাইরের লোকেদের নজর পড়ল। প্রথমে বুঝতে পারে নি। কিন্তু, মেয়েদের উপর অত্যাচার আর পুরুষদের মেরে ফেলা শুরু হতে প্রাণ বাঁচাতে পালানো ছাড়া আর কোনও গতি ছিল না। এক পূর্ণিমার রাতে তারা পালিয়ে এসেছিল পাহাড়ের এই পারে। এই গাছটাই পাহাড়ের দুপারের মধ্যে সেতু ছিল, মধ্যে ছিল অতলস্পর্শী খাদ। নিজেদের লোকেদের বাঁচাতে তাশি একাই কুঠার দিয়ে গাছটা কেটে ফেলে। কিন্তু, নিজেকে বাঁচাতে পারে না। গাছের সঙ্গে সেও, তার মায়ের সামনেই, খাদে পড়ে যায়। বহু যুগের ওপার থেকে মা তার মেয়েকে ডেকে চলেছেন। এতদিনে মিলন হল। তাশিও এত দিনে নিজের অবিশ্বাস, নিজের মধ্যেই গুটিয়ে থাকা, শারীরিক ও মানসিক শক্তি, ইত্যাদি সব কিছুর কারণ বুঝতে পারে।

অন্য দিকে, এই পুরো গল্পটাই মংপু স্বপ্নে দেখছিল। দেখে ঘুমের ঘোরের মধ্যেই সে উঠে হাঁটা দেয়। তার পিছনে সমুরা আর গ্রামের আরও কয়েকজন। তখন কিকরে যে ঘুম ভাঙ্গে, ওরাও বুঝতে পারে না। মংপু ওদের ডাক শোনেও না। সোজা হেঁটে গিয়ে সটান তাশির পায়ে পড়ে। তাশির জন্যই তো ওরা আজও বেঁচে আছে। ওদের আসল গ্রামদেবী তো তাশিই। 

যেই না মংপুর হাত তাশির পা ছুঁয়েছে, অমনি ওদের দুজনেরই ঘোর কেটে গেল, কিন্তু ভুললো না কিছুই। সমুরা আরো একদিন ঐ গ্রামে ছিল। তাশির সঙ্গে ওদের সবারই খুব আদর যত্ন হল। রাতে আবার গ্রামশুদ্ধ লোক একসাথে খাওয়া দাওয়া করছে। বেশ একটা উৎসবের পরিবেশ। সমু সবার সামনে একটা বনফুল হাতে নিয়ে তাশির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলে

“সেই ছোট্ট থেকে তোমাকে ভালোবাসি। কোনোদিন ভয়ে বলতে পারি নি, পাছে বন্ধুত্বটাও খোয়া যায়। আজ বলছি। তোমাকে সারা জীবনের জন্য পাশে চাই।”

তাশি মুখে কিছুই না বলে ফুলটা নিয়ে নেয়।

শুরু হল নতুন অধ্যায়ের পথ চলা।

Post a Comment

0 Comments