মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১২৬
কুমুদিনী ডাকুয়া (স্বাধীনতা সংগ্রামী, সুতাহাটা)
ভাস্করব্রত পতি
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় মেদিনীপুর জেলা হয়ে উঠেছিল বিপ্লবী দের আঁতুড়ঘর। ১৫৭৬ সালে রাজস্থানের হলদিঘাট যুদ্ধকে সামনে রেখে মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের লড়াই আন্দোলন এই জেলাকে 'বাংলার হলদিঘাট' নাম দিতে বাধ্য করেছিল। একসাথে উচ্চারিত হত ক্ষুদিরাম বসু, মাতঙ্গিনী হাজরা, সুশীল কুমার ধাড়া, অজয় মুখোপাধ্যায়, দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, সতীশচন্দ্র সামন্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো, সত্যেন্দ্রনাথ বোস সহ অসংখ্য বিপ্লবীদের নাম। এঁদের সঙ্গে আরও যে কয়জন স্বল্প পরিচিত বিপ্লবীদের নাম উচ্চারিত হত তাঁদের মধ্যে কুমুদিনী ডাকুয়া অন্যতম।
বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড স্টুডিওতে তোলা কুমুদিনী ডাকুয়ার ছবি
কুমুদিনী ডাকুয়ার পিতৃভূমি সূতাহাটা থানার গোওয়াডাব গ্রাম হলেও জন্মভূমি হল মামাবাড়ি রামগোপালচক। এখানে ১৯২৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দিদিমা রাজবালা বেরার কোলে পিঠেই মানুষ হয়েছেন তিনি। সম্পুর্ন সংস্কারমুক্ত মানসিকতায় বড় হয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন অকুতোভয় মনের ডাকাবুকো মহিলা। বাবা পূর্ণচন্দ্র জানা এবং মা জ্ঞানদাময়ী।
কুমুদিনী ডাকুয়া এক জায়গায় লিখেছেন, "আমার আত্মীয় পরিজন বিশেষ করে আমার মা ও দিদিমা স্বদেশী মানসিকতার মহিলা ছিলেন। তাই অনেকের বাধা সত্ত্বেও স্বদেশী করা ছেলের (যাঁকে প্রায় সময় জেলে থাকতে হয়) সঙ্গে জেনে শুনে বিয়ে দিয়েছিলেন আমার বারো বছর বয়সে। শ্বশুরবাড়ী এসেই পুরোপুরিভাবে স্বাদেশী আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে গেলাম। এঁরা সকলেই দেশসেবার কাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য আমাকে সর্বপ্রকার সাহায্য করতে ও উৎসাহ দিতে লাগলেন। ইতিমধ্যে সোনায় সোহাগার মত সুশীলদার (শ্রী সুশীলকুমার ধাড়া) সান্নিধ্য ও এই বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার ফলে কংগ্রেসের কাজকর্মের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে উঠলাম ও স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারলাম। মোটকথা, স্বামীর দেশসেবার প্রেরণা ও সুশীলদার শিক্ষাই আমাকে দেশসেবার কাজে ব্রতী হতে উৎসাহিত করেছিল ও সেইমত গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। তাই খুব সহজে 'ভারতছাড়ো আন্দোলনে' যোগ দিতে পেরেছিলাম'।
ইন্টারনেট থেকে পাওয়া ছবি
তিনি ছিলেন বাংলার মুক্তিযুদ্ধে মেঘে ঢাকা তারা। নীরবে নিভৃতে সঙ্গ দিয়েছেন বাংলার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে। জীবনের ক্যানভাসে হয়েছিলেন আরেকজন বলীষ্ঠ স্বাধীনতা আন্দোলনের সেনানী বিপ্লবী কুমারচন্দ্র জানার সহযোগী ক্ষুদিরাম ডাকুয়ার জীবনসঙ্গিনী। এই ক্ষুদিরাম ডাকুয়া ছিলেন মেদিনীপুর জেলার প্রথম সত্যাগ্রহী, যিনি ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে নরঘাট লবন কেন্দ্রে লবন তৈরি করে ব্রিটিশ লবন আইন ভঙ্গ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি বিয়ে করেন ১২ বছর বয়সী কুমুদিনীকে। বিপ্লবী স্বামীকে কাছে পেয়ে বদলে গেল কুমুদিনীর জীবন। স্বামীর মতো কুমুদিনী ডাকুয়াও বিপ্লবী কুমারচন্দ্র জানার বাসুদেবপুর গান্ধী আশ্রমে যোগ দেন এবং বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। মহিষাদলের আরেক বিপ্লবী সুশীল কুমার ধাড়ার সংস্পর্শে আসেন। তাঁর কাছ থেকে পান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসের শিক্ষা। ফলে এই লড়াকু দম্পতি সেসময় ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে তুলেছিলেন দেশমাতৃকার মুক্তি আন্দোলনের তুফান ঝড়। আগষ্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ। যেসময় ব্রিটিশ পুলিশ ক্ষুদিরাম ডাকুয়াকে গ্রেফতার করে, তখন কুমুদিনী ছিলেন মাত্র ১৫ বছরের কিশোরী।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জেলা জুড়ে যখন আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, তখন মেদিনীপুরের অসংখ্য মহিলা তাতে সক্রিয় ভাবে জড়িয়েছিলেন। কুমুদিনী ডাকুয়াও তখন ঘোমটা দিয়ে ঘরে বসে থাকেননি। বেরিয়ে এসেছিলেন মুক্তকন্ঠে। চলে আসেন সামনের সারিতে। আর এজন্য তাঁকে যুঝতে হয়েছে ব্রিটিশ পুলিশের অকল্পনীয় অত্যাচার, দমন, পীড়ন এবং নিষ্পেষণ।
আসলে স্বৈরাচারী শাসকের লক্ষ্য ছিল এই আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া। ফলে নারী পুরুষ সকলের বিরুদ্ধে তাঁদের হাতিয়ার ছিল চরম লাঞ্ছনা এবং অমানুষিক অত্যাচার। নারীদের প্রতি ব্রিটিশ পুলিশের খুন, ধর্ষণ, লাঠিপেটা সহ নানা পদ্ধতিতে অত্যাচারের স্টিম রোলার দেখে থেমে থাকতে পারেননি কুমুদিনী ডাকুয়া। উল্লেখ্য, ১৯৪২ - ১৯৪৩ এর মধ্যে সেসময় মোট ৬৭ জন মহিলা ব্রিটিশদের দ্বারা নানাভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল। কুমুদিনী ডাকুয়া ১৯৪৩ এর ৯ ই জানুয়ারি ৬০০ জন ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হন। কেননা এই কাপুরুষ পুলিশের দল তিনটি গ্রাম ঘেরাও করে ৪০ জন মহিলাকে গণধর্ষণ করেছিল।
স্বামী ক্ষুদিরাম ডাকুয়া
মেদিনীপুরের কুলাপাড়ায় রাসি দাসী নামে একজন বছর চব্বিশের মহিলাকে গণধর্ষণ করেছিল বর্বর ব্রিটিশ পুলিশ। সেই অকথ্য অত্যাচারে মহিলাটির মৃত্যু হয়। যা কুমুদিনী ডাকুয়ার মনে আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন, এভাবে পড়ে পড়ে মার খাওয়া চলবে না। মহিলাদের এগিয়ে আসতে হবে। হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। পশুদের বিরুদ্ধে পালটা আক্রমণ হয়ে উঠুক প্রতিরোধের অন্যতম মাধ্যম। মেয়েদের বাঁচতে হবে। আর এজন্য দরকার শারীরিক ও মানসিক শক্তি। দরকার আত্মরক্ষার প্রশিক্ষন। তিনি গোপনে শুরু করলেন গ্রামের মহিলাদের প্রশিক্ষন দেওয়া। বিপ্লবী সুশীল কুমার ধাড়া বিদ্যুৎ বাহিনীর পাশাপাশি ১৯৪২ এর ১৬ ই অক্টোবর গড়ে তুলেছিলেন 'ভগিনী সেনা'। সেসময় এটি অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। মাসুড়িয়া, ডিহি মাসুড়িয়া এবং গাজিপুর গ্রামে চলেছিল ব্রিটিশ অত্যাচার। তখন ভগিনী সেনার অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামীণ মহিলাদের বুকের বল জোগাতেন কুমুদিনী ডাকুয়া। তিনিই পরিকল্পনা করে এলাকার কামারদের দিয়ে বানিয়েছিলেন ১০ হাজার লোহার ছোরা। যা তুলে দেওয়া হয়েছিল মহিলাদের হাতে। আত্মরক্ষার জন্য।
এভাবে চলতে চলতে একসময় তিনি হয়ে উঠলেন সুতাহাটা থানা জাতীয় সরকারের একজন অন্যতম সেনানী। তাঁকে করা হল জাতীয় মিলিশিয়া'র প্রধান। তিনি ছিলেন স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক অজয় মুখোপাধ্যায়ের বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট। স্বাধীন জাতীয় সরকারের কমান্ডার ইন চিফ সুশীল কুমার ধাড়ার পুরুষ সেনা শাখার সাথেও একমেবাদ্বিতীয়ম নেতৃ।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল মেদিনীপুরের বুকে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯৪২ এর ২৯ শে সেপ্টেম্বর সারা জেলা জুড়ে জেগে উঠেছিল বিপ্লবীদের দল। সেই আন্দোলনে কুমুদিনী ডাকুয়ার দায়িত্ব ছিল সুতাহাটা থানা দখল অভিযানে অংশগ্রহণ করা। এই ঘটনায় তিনি হয়েছিলেন দোষী। প্রাথমিক ভাবে তাঁকে গ্রেফতার করতে না পারলেও পরবর্তীতে তিনি গ্রেফতার হন। এবং বিচারে ১৫ মাস কারাবরণ করতে হয়। খড়গপুরের হিজলি বন্দী নিবাসে তাঁর স্থান হয়েছিল অন্যান্য মহিলা বন্দীদের সাথে।
ক্ষুদিরাম ডাকুয়া ও কুমুদিনী ডাকুয়া
'শহীদ ক্ষুদিরাম ওয়েলফেয়ার সোসাইটি' কর্তৃক প্রকাশিত 'অগ্নিযুগের অজানা কাহিনী', কলিকাতা, ১৯৯২, পৃ. ৫২-৫৩ থেকে কুমুদিনী ডাকুয়ার লেখা 'ফেলে আসা দিনগুলি' তে তিনি জানিয়েছেন, 'ভারতছাড়ো আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকারের ভারতের প্রতি বঞ্চনানীতির প্রতিবাদে আমার স্বামী ক্ষুদিরাম ডাকুয়া ১৯৪২ সালের জুন মাসে জেলে চলে গিয়েছিলেন। তাই ভারতছাড়ো আন্দোলনে সুশীলদার নির্দেশে প্রথমে গ্রামের মেয়েদের পরাধীনতার কুফল সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য গ্রামে গ্রামে মেয়েদের নিয়ে বৈঠক করতাম। ফলে স্বদেশী সংক্রান্ত মিটিং ও মিছিলে পুরুষদের মত মহিলারাও যোগ দিতেন। আর সমস্ত বাড়ীতে এ কাজে যুক্ত যাঁরা তাঁদের আদর যত্নের সীমা থাকত না। এরপর তমলুকের সেই বিখ্যাত ১৯৪২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বরের থানা আক্রমণের মহামিছিলে লোকসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ ভাগ মহিলা। আমি একদিকের মিছিল পরিচালনা করেছিলাম। এরপর আমি আত্মগোপন করে গ্রামে গ্রামে মহিলা সংগঠনের কাজে নিযুক্ত ছিলাম। ১৯ শে অক্টোবর (১৯৪২ খ্রি.) 'ভগিনীসেনা' গঠিত হওয়ার পর মেয়েদের পুলিশের পাশবিক অত্যাচার থেকে রক্ষার জন্য সুশীলদার কাছ থেকে ছোরা চালানো ও যুযুৎসু প্যাঁচের শিক্ষা নিয়ে গ্রামের মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত ছিলাম। বন্যার পর শ্বশুর শাশুড়ীকে দেখতে গিয়ে রাত্রে শ্বশুরবাড়ীতে ধরা পড়ি। সেইসময় আত্মরক্ষার জন্য ছোরা চালাতে বাধ্য হয়েছিলাম। একবছর তিনমাস জেলবাসের পর বাইরে এসে পুনরায় জাতীয় সরকারের গরমদলের সঙ্গে যুক্ত হই। জাতীয় সরকারের শেষদিন পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। জেলে থাকার সময় আমার বাবা মারা যান'।
তিনি ছিলেন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের ভগিনী সেনার অন্যতম প্রধান নেত্রী। সারা জীবন লড়াই করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। কুমুদিনী ডাকুয়া স্বাধীনতার অনেক পরে লেখাপড়া আবার শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে কলকাতার শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। তিনি ছিলেন পোস্টমাস্টার। ১৯৫১ - ১৯৭১ পর্যন্ত সুতাহাটা থানার বরদা গ্রামে নিযুক্ত ছিলেন। এই ডাকঘরটি উদ্বোধনের সময় ডিস্ট্রিক্ট পোষ্ট ইন্সপেক্টর সেদিন ঘোষনা করেছিলেন, 'মিসেস ডাকুয়া ইজ দ্যা ফার্স্ট পোষ্ট মিস্ট্রেস অফ ইন্ডিয়া'।
বিপ্লবী সুশীল ধাড়ার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। সুশীল ধাড়ার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর পাশে থেকে সেবা করে গিয়েছেন। স্বামী ক্ষুদিরাম ডাকুয়ার মৃত্যু হয় ২০০১ এর ১৪ ই এপ্রিল। আর এহেন অনুচ্চারিত, অনালোকিত এবং অপরিচিত সেনানীর মৃত্যু হয় ২০০৮ সালের ২৪ শে এপ্রিল। এই মহান বিপ্লবীর নামে মহিষাদলে তৈরি হয়েছে কুমুদিনী ডাকুয়া মুক্তমঞ্চ। নন্দকুমারে গঠিত হয়েছে কুমুদিনী ডাকুয়া প্রতিবন্ধী সেবা সমিতি। এহেন বিপ্লবী মেদিনীপুরের নয়, সারা রাজ্যের তথা সারা দেশের গর্ব।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা -- জয়দীপ পণ্ডা, ইতিহাস গবেষক, তমলুক
🍂
1 Comments
আশা করি পড়ে অনেক মহিলা অনুপ্রাণিত হবেন। সাহস পাবেন নারীবিরোধী যে সানাজিক স্ক্যাম চলতেই থাকে সেই জগদ্দল পাখরে ঘা দিতে পারবেন। হাজার ছোরা না হলেও চলবে। শুধু ইচ্ছেটা চাই।
ReplyDelete