জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন -পর্ব -২২ /মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব -২২

মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া 

দেড় মুনি বস্তা চেয়ারম্যানের নাস্তা 
             

নরের কাঠি বলে এই জায়গাটা যেখানে তাদের মামাবাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে যেদিকেই যাও সাঁকো পেরোতে হবে নয়তো সরু সরু ডিঙি বেয়ে ওপার যেতে হবে।সাঁকোকে এরা সবাই বলে চার। বাঁশের সরু সেই চার মাত্র দুতিনটে বাঁশ কোথাও বা  একটাই লম্বা বাঁশ খালের আড়াআড়ি বাঁধা। রেলিং হিসেবে আর একখানা বাঁশ একটু উঁচুতে হাতের নাগাল বরাবর বেঁধে দেওয়া।সেখানা ধরে এমনকি না ধরেও তার মামাতো দাদা দিদি বা এখানকার আরও যত জ্ঞাতি কুটুম ছোট বড় সবাই সরসর করে হরহামেশাই তা পেরিয়ে যায়। ছেলে মেয়ে সবাই ডিঙি বাইতেও পারে।জুতো খুলে অন্যের হাতে দিয়ে কোনোক্রমে দুহাতে রেলিংএর বাঁশ আঁকড়ে মাকড়ে খুব ভয়ে ভয়ে ঝিনি পার হয়। ডর লাগতাছে বলে হে হে করে হাসে এখানকার ছোট বড় সবাই তবে দাদারা খেপায় না বলেই বোঝা যায় ওদেরও ভয় করে।
      জন্ম ইস্তক এই সমস্ত   চার পেরোতে পেরোতে মা বড় হয়েছে। তবু মা একদিন চার থেকে পিছলে সোজা খালে পড়ল। চেঁচিয়ে উঠল ঝিনি আর তাই শুনে এপারে আরতিদির কোলে সানা তার ভয়াবহ কান্নাটা শুরু করল কাজেই  আশপাশের বাড়ি থেকে ছুটে এল লোকজন। সবাই মায়ের চেনা। হান্দাইলো কই?দ্যাহো দেহি জলের দ্যাশের মাইয়া কুমড়ার লাহান চাইর পাইরাতে খালে গিয়া পড়ছে। জল খেয়ে শাড়ি জামা ভিজিয়ে যতক্ষণ না মা সাঁতরে এপার  উঠে এলো ঝিনির বুক ঢিপঢিপ আর পড়শী কুটুমদের নানান মন্তব্য।
     সক্কাল বেলা কী কাণ্ডটাই না বাঁধালাম। শুকনো  শাড়ি পরে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে মা বলল।
      ভাগ্যিস জলেই ল্যাণ্ড করেছ আর সাঁকোটাও তেমন উঁচু ছিল না বলে ভাঙে টাঙেনি এই যথেষ্ট।  
তবে সেভাবে দেখলে বিনু,তোমার পদস্খলন কিন্তু একরকম ভালোই হয়েছে।মানে পজিটিভলি যদি ভেবে দেখো তুমি ওই খাল সাঁতরে কত না এপার ওপার করেছো তা এখন তো আর নামতে না এ একেবারে না চাহিতেই কেমন স্মৃতির গহন খালে অবগাহন স্নান হইয়া গেল। নকশা কোরো না তো মা হাতের  ছাল ওঠা জায়গায়  ডেটল লাগাতে লাগাতে নিচু গলায় ঝংকার দিল।
       দাদারাও কম যায় না। কদিন ধরে সবাইকে নাও বাইতে দেখে ওরা ভেবে নিয়েছিল দাঁড় বাওয়া ব্যাপারটা এমন শক্ত কিছু না এবং কয়েকদিন বেশ মন দিয়ে তুহিনদা তপনদাকে দেখে দেখে ওরা শিখেও ফেলেছে সেটা। একটা হাতে কলমে একটা পরীক্ষার জন্য ওরা তক্কে তক্কেই। দুপুরবেলা ছিল বাড়ির সবাই জিরিয়ে নিচ্ছে যখন,মা মাসিরা পাড়ার সব বউঝিদের নিয়ে গল্প করছিল। এ কদিন বড় বাড়ি নয়াবাড়ি ঝালোকাঠি সব জায়গা থেকেই কাছে দূরের আত্মীয় কুটুমের আসা যাওয়া চলছেই দেখাসাক্ষাৎ করার জন্য।
     ভর দুপুরে খালের ধারও নির্জন।এই মওকায় নাবিক হওয়ার বদ্ধপরিকর ইচ্ছেয় অরু মিতু ডিঙিতে চড়ে দড়ি খুলে দিল। কিন্তু জোয়ার ভাটার খেলে বলে ওখানে খালগুলোতেও স্রোতের যথেষ্ট টান এমনকি খালের সাথে সংযোগ আছে বলে জোয়ারের সময় পুকুরের জলও বাড়তে থাকে।কাজেই নৌকোর বাঁধন খুলে দিতেই সরসর করে তা চলতে শুরু করল স্রোতের টানে। ওরা  ভেবেছিল লগি আর দাঁড়ে ওরা এই টান সামাল দিতে পারবে কিন্তু বেসামাল নাও প্রথমেই ঘুরপাক খেয়ে গেলে ওরা ভেসে যেতে যেতে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল দুজনেই।দলে ওরা চারজন ছিল বটে কিন্তু তপনদা চয়নদা ঢুকেছিল খালধারের বেতবনে  পাকা বেতফলের খোঁজে। 
🍂
     কেডা জানি বুলাইলো না?পাকা বেথুয়া গোছা ভরে তুলতে তুলতে চয়নদা ভুরু কুঁচকে বলল। এমনিতেই  হাতে বেতের কাঁটা ফুটে যাওয়ায় ভারি বিরক্ত লাগছিল তপনদার।দুব্বো ঘাস চিবিয়ে সেখানটায় ডলতে ডলতে ভুরু কুঁচকে, কী হুনতে কী হোনছোস বলে চয়নদার কথা আমল না দিয়ে তপনদা  কটা পাকা ফল মুখে পুরে দিয়ে বেতবনের আরও গভীরে চলে গেল। দূর থেকে আবার একটা ডাক শুনেই অরে! হুনছসনি অরু মিতু চিক দিতাছে ,কোচড়ের বেতফল ছুঁড়ে ফেলে চয়নদা খালের যে দিক থেকে আর্তনাদ আসছিল দৌড় দিল সেদিক।
       আউগা তপইন্যা আউগা রেএএএ ,হেরা নাও লইয়া ডুবত্যাছে। দৌড়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে চয়নদা প্রাণপণ সাঁতরে পৌঁছে গেল দ্রুত। তারপর ডিঙি একহাতে ধরে আর একহাতে সাঁতরে আস্তে আস্তে টানতে লাগল কুলের দিকে। ততক্ষণে তপনদাও পৌঁছে গেছে খালধারে। ঝাঁপ দিল সেও।নৌকো বাঁধার জন্য দড়িটা ধরে নিল তপনদা। আস্তে আস্তে কুলে ভিড়ে ডিঙি খানা কষে বাঁধতে বাঁধতে তপনদা দাঁত কিড়মিড় করে বলল আক্কোলডা কী তোমাগো? বাইতে না জাইন্যাও নাও লইয়া ফাল দিয়া গ্যাছালা কারে কইয়া?খাড়াও বিয়দের হইছেডা কী? তোমাগো লাইগা অ্যাহনতো চুনু আর মোর  পিডে চ্যালাকাডের মাইর পড়বই পড়ব। থাউক ,অগো আর কিছু কইস না।ডর খাইয়া আ্যমনেতেই মুখ হুগাইয়া গেছে।ভেজা দুই দাদার পিছু পিছু ফ্যাকাশে মতো মুখ নিয়ে অরু মিতু চুপচাপ মামা বাড়ি ঢুকল।
       স্কুল থেকে ফিরে যথারীতি মামু পড়ল তপনদা চয়নদাদের নিয়ে।আক্কোল নাই তোগো?কই নাই তোগো অদের লগে লগে থাওনের কথা?ছোডো পোলাপান আ্যমুন আউগারি কাইজ অরা করতেই পারে।তয় তরা কই ছিলি? ক' দেহি আইজ যদি আঘটনডা ঘইডা যাইত কইতাম কী মুই? মুখ দেখাইতাম ক্যামনে?
      ওদের দোষ নেই দাদা ,বকবেন না আর।সব শুনে গম্ভীর হয়ে আছে তাদের বাবা। অনেকক্ষণ ঘুরঘুর করে আর করবো না বাপি। খুব ভুল হয়ে গেছে। এবার থেকে আর...ইত্যাদিতে সেদিনকার দুঃসাহসিক অভিযান পর্ব মিটল।
          রাতে দিদুনের কাছে শুলে গল্প শোনায় কত।
   দ্যাড়মুনি কৈলাসের গল্প,ডাকাইতের গল্প, তোতা তুতির গল্প। এমনকি তাদের দাদুভায়ের ভুত দেখার গল্পও।দ্যাড় মন চাইলের ভাত খাইয়া লইছিল বইলাই ব্যাবাক মানু হেয়ার নাম থুইছিল দ্যাড়মুনি কৈলাস।ধামা ধামা গুড়মুড়ি, হাঁড়ি হাঁড়ি পান্তা খাইয়াও প্যাড আর ভরত না তার। শ্যাষে নাম হুইন্যা রাজায় তারে খাওনের  নেমতন্ন  দিল কিন্তু শর্ত হইল এক পাতে আ্যক্কারে দ্যাড়মুন চাউলের বাত খাইতে হইব।পারলে রাজার সভায় খাওনদারের চাকুরি আর না পা পাইরলে গর্দান।রাজায় চিক্কুর দিয়া মন্ত্রীরে বুলাইব, মন্ত্রী ডাক দিব সেনাপতি, সেনাপতি হাঁকার দিব কোটাল, কোটাল কইবো জল্লাদ আর জল্লাদ আইসা আ্যক্কারে এক কুপে মাথা লামাইয়া দিব। কও দেহি রাজার বাড়ি খাইতে আইসা কৈলাস তয় কোন ভ্যাজালে পড়ছে গিয়া!  রাজায়  তো কৈলাসরে  ফেলাইছে এক ফান্দে।কী হইবে আ্যহন কোন দেহি?
       শেষমেশ কৈলাস পারল খেতে?হয়। হেই কতাখানই তো কইতাছি তোমাগো।হেই ব্যাডা খাইছিল একখান খাওয়া।দেড় মুন চালের ভাত হেয়ার লগে তত পরিমাণ ডাইল মাছ ব্যঞ্জনাদি খাইয়া প্যাড যহন ফাডো ফাডো হইসে তহন বড় রাণী আইয়া কইল মিষ্টান্ন তো খাওনই হয় নাই। পাকঘরে মুই  নিজে আপনের লাইগা পরমান্ন রন্ধন করসি।আ্যহন পাট রাণীর স্বহস্তে প্রস্তুত পায়েস তো ফালাইতে পারে না কৈলাস। গামলা ভরা পরমান্ন দেইখা পেটুকের চক্ষু ভইরা জল আইল আতঙ্কে। তবু গূরুর লাম লইয়া মুখ লামাইয়া দিল একখান চুমুখ ব্যাস কাম সারা!গড়াইয়া পড়ল আসনের উপর।মরে গেল নাকি? ও দিদুন, পেটটা ফেটে গেল নাকি?খাড়াও; কইতাছি তো।হগগলে তাইই ভাবছিল। কৈলাসরে অচেতন দেইখা রাজার যে কান্দন !কী কল্লা বড়রাণী!
আমার অত ভালো খাওনদারডারে শ্যাষম্যাষ পরমান্ন খাওয়াইয়া মাইরা ফেলাইলা! রাজার ক্রন্দন বইলা  কতা। হেই কান্দন হুইন্যাই মন্ত্রী সেনাপতি, কোটাল,জল্লাদ,পাত্র মিত্র উপস্থিত দাসদাসী হগগলেই কুক ছাইড়া কান্দে।অকস্মাৎ সেই  পেরবল কান্দন ছাপাইয়া এমুন কড়াক্কড় আওয়াজ বাইরাইল য্যান একশ হস্তী চিক দিয়া ওঠল সরবে য্যান ম্যাঘ ডাইক্যা উঠল এমুন জোর , মনে হইল আকাশখান ভাইঙ্গা পড়ব। হুইন্যাই তো 
সেমত অবস্থায় ফাল দিয়া উইঠা রাজা মন্ত্রীর কান্ধে গিয়া পড়ল, মন্ত্রী পড়ল সেনাপতির কান্ধে, সেনাপতি কোটালের গায়ে আর কোটাল পড়ছে জল্লাদের গায় গিয়া। জল্লাদ তো চিত্তার হইয়া মাডিতে গড়াগড়ি খাইতাছে আর কইতাছে রণডম্বরু বাইজা উঠছেনি ।যুদ্দ 
 হইব নিগঘাৎ শুধু ওই খাওনের গরে যে বুড়া পাচক খাড়াইয়া ছিল হ্যায় কইল  খাড়ান আইজ্ঞা রাজাশাই।এই আওয়াজ হইল গিয়া নাসিকা গর্জন!কৈলাস গুমাইয়া পড়ছে আ্যহন  তাহার নাক ডাকত্যাছে।
       সাতদিন পরে গিয়া সে গুম ভাইঙ্গা রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেল আইর রাজসভায় খাওনদারের চাকরিও পাইল। আইর তাইরপর কী হইল কও দেহি?কী হলো ও দিদুন?আইজ না কাইল কমু আ্যহনি চক্ষুবুজো। অনেক ক্যাওম্যাওর পর দিদুন  হাই তুলতে তুলতে? বলল কী আবার হইব? রাজার ছিল পরমা সুন্দরী আ্যক কইন্যা।  দ্যাড়মুনি কৈলাসের সাথে বিয়া দিয়া জামাই করল তারে।এমা ছি!ঝিনি নাক সিঁটকোয়।ওই পেটুক আর মোটা কৈলাসের সঙ্গে রাজ কন্যার বিয়ে। কটকট করে সুপুরি চিবোতে চিবোতে আর ঘরময় জর্দার গন্ধ ছড়িয়ে দিদুন বলল আরে তহন কি আর সে মোটা ছিল? যুদ্ধ কইরা কইরা আর ঘোড়ায় চইড়া সে আ্যক্কারে ছিপছিপা রাজপুত্তুরের লাহান চ্যাহারা হইছিল তার। আইর কতা কইবা না চক্ষু বুইজা ঘুমাও দেহি বলে পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে। আরতিদি দিদুনের ওপাশ থেকে বলবে  দ্যাড়মুন চাইল আইর আ্যমন কী এ? আমাদের চেয়ারম্যানই জলখাবারে খাইয়া লয়।হোনছনি পোলাপাইনে ছড়া কয় "দ্যাড়মুনি বস্তা/চেয়ারম্যানের নাস্তা "!
    চেয়ারম্যানটা আবার কে? চেয়ারম্যান হোনো নাই? আরতিদি তার অজ্ঞতায় অবাক হয়।হে 
হইল গিয়া দেহাশুনা করে আমাগো। মাইনষে ভোট দিছে তারে।ছোডখাডো রাজার লাহান।রাজা আছে নাকি এখানে?ঘোড়ায়  চড়ে? গাড়ি চড়ে।সত্যিই সে দেড় মণ বস্তার খাবার খায়? কইব কেডা? মনে তো কয়। লুকাইয়া বেবাক খাইয়া থোয়।
    ফাতরামি কইস না ছেমড়ি। তরে কইছি না কতা কম কইবি। সোনা মামি পাশের তক্তপোষ থেকে চাপা গলায় আরতিদিকে ধমক দিল।আইর যদি হুনছি ওই ছড়া তর মুহে তো পিডে চ্যালাকাড ভাঙুম।ঝিনি মাগো রাইত হইছে ঘুমাও অহন।সব চুপচাপ হয়ে গেল।মামি কেন আরতিদিকে বকলো বোঝা গেল না। তবে চেয়ারম্যান দেখার বড় ইচ্ছে হলো আর দ্যাড়মুনি বস্তা/চেয়ারম্যানের নাস্তা কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল কখন যেন।

Post a Comment

0 Comments