জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭০ / সালেহা খাতুন

আমার ভাই ও কন্যা

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭০ / সালেহা খাতুন 

আমার কন্যা তার বাবা ও মামার জীবনে ঈশ্বরের এক অমূল্য আশীর্বাদ। শ্যামনগরে থাকাকালীন গৌরীশঙ্কর জুটমিলের কোয়ার্টারের মালি সালাউদ্দিনের হাত দেখে আমাদের বলেছিলেন, “বাপ রে উনি তো রাজার হালে জীবন কাটাবেন। তবে এক্ষুনি নয়। কন্যা জন্মানোর পর। সেও এখন বছর পাঁচেক দেরী আছে”। একথা যে সত্য হবে তখন কেই বা বিশ্বাস করেছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

মেটারনিটি লিভে আছি, বাবা-মার কাছে। খবরের কাগজে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মেদিনীপুর ল’কলেজে ছাত্র ভর্তির বিজ্ঞাপন দেখে বাবা আমাকে বললেন ওবাইকে ওখানে ভর্তির ব্যবস্থা করে দে। ওবাইও আমারই মতো প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ থেকে বাংলা অনার্স পাশ করেছে। তখন মেদিনীপুর কলেজের ক্যাম্পাসেই ল’কলেজের সব কাজ হতো। আলাদা ক্যাম্পাস তখনো হয় নি। আমার চিরকালীন শুভাকাঙ্ক্ষী অধ্যাপক সুধীন্দ্রনাথ বাগকে ফোন করে সাহায্য চাইলাম। স্যার বললেন ভাইকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং নির্দিষ্ট অ্যাডমিশন ফিজসহ মেদিনীপুরে পাঠিয়ে দাও, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। 

কলেজে তখন অর্থাৎ দু’হাজার দুই সালের জুনমাসে প্রিন্সিপালরূপে জয়েন করেছেন ড. প্রবীর কুমার চক্রবর্তী। কলেজে সব অধ্যাপকের সঙ্গে তিনি সরাসরি আলাপ করেছেন কিন্তু আমি মেটারনিটি লিভে আছি, তাই আমার সঙ্গে আলাপ হয় নি। আমাকে অবাক করে একদিন দুপুরে কলেজ থেকে বাড়িতে ল্যাণ্ডফোনে ফোন এলো অধ্যক্ষের। মাতৃত্বের জন্য শুভেচ্ছা জানালেন। তিনি সদ্য জয়েন করেছেন তাও আমার খোঁজ নিলেন। আবেগে ভেসে গেলাম। সদ্য মা হয়েছি। আস্তে আস্তে ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স অর্জন করছি। একজন মাকে যে কী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি। “ঘর এবং বাহির” দুইদিক সামলায় এমন মায়েদের যাত্রাপথ যে মসৃণ নয় সে ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। একারণেই প্রাণপণে না চাইলেও অতীতের এমন কিছু ঘটনাক্রমের বিবৃতি আমাকে দিতেই হবে যা হয়তো আমার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করবে। কিন্তু নিজের কাছে নিজেই প্রতিশ্রুতি করেছি যে, সত্য গোপন করবো না। 

তখন মেটারনিটি লিভ ছিল মাত্র চারমাসের। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি কলেজে জয়েন করতে হবে। লিভ শেষ হওয়ার দুদিন আগেই জয়েন করলাম। কেননা সুজাতাদি টিচার্স কাউন্সিলের সেক্রেটারি পদে নির্বাচনের জন্য ভোটে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে ভোট দিতে এলাম। আর এর দু-একদিন আগে আগস্টের বারো তেরো তারিখ নাগাদ হারিয়ে ফেললাম আমাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধু তনুজাকে। রাত্রির দশটায় ওকে সমাহিত করা হয়। সন্ধেতে আমার বাড়িতে খবর এসেছিল। কিন্তু আমাকে পরের দিন সকালে মা খবরটা জানান। কেননা ছোটো শিশুকে নিয়ে রাতে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ট্রেনে একটা স্টেশন যেতে হলেও পথটা সহজ ছিল না। পরের দিন সকালে গেলাম। ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করলাম। ওকে শেষ দেখাটা হলো না। চৈতালীও এসেছিল। ওর মেয়ে টুম্পাকে কোলে নিয়ে। তনুজার মা বলেছিলেন, “মা তনুকে যদি ভালোবেসে থাকো আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো”। না, আর তনুজার বাড়ি যাওয়া হয়নি। কিডনি ড্যামেজ হয়ে ডায়ালিসিস চলাকালীনই ও চলে গেল। এম.এ.,বি.এড. সম্পূর্ণ করে। বন্ধুদের প্রায় সবার সঙ্গেই কিছু না কিছু কারণে কখনো না কখনো মনোমালিন্য হয়েছে কিন্তু তনুজার সঙ্গে কোনোদিন কারো এতোটুকু মনান্তর ঘটেনি।

মনটা একারণে ভালো ছিল না, তার উপর কলেজে জয়েন করলে বাচ্চাকে কার কাছে রেখে যাবো এ বিষয়টি স্থির না হওয়ায় প্রচুর কান্নাকাটি করলাম। বাবা বললেন, বাচ্চাকে আমাদের কাছে রেখে যাও। আর তুমি কলেজ করে সপ্তাহান্তে চলে এসো। মা কাকীমারা বললেন, দুধের বাচ্চাকে ছেড়ে মা থাকবে কী করে? তার উপর বাচ্চা বাইরের কোনো খাবার এখনো খেতে শেখেনি।

মা চলে এলেন সঙ্গে। ভাইও এলো। ওর ল’য়ের ক্লাস তখন শুরু হয়ে গেছে। তিন বছর ও আমার কাছে থেকেই পড়াশোনা করেছে। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। এখন কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিশ করছে। দুটো বাক্যে এতো সহজে বললাম বটে কিন্তু এর পিছনে অনেক হার্ড ওয়ার্ক আছে। মানসিক যন্ত্রণা আছে। দিদি যখন ভাইকে নিজের কাছে রেখে পড়াশোনা করায়, কত রকম প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ভাই এবং দিদি দুজনেই সফলতা লাভ করে; সে গল্প উহ্য থাকলো।

মা আমার সঙ্গে এলেন বটে কিন্তু তাঁর নিজের সংসার অচল হয়ে গেল। বাবা একা হাতে সামলাতে পারলেন না। পরের মাসে বাবা এলেন, আর পাড়ারই একটি মেয়েকে সঙ্গে আনলেন। মা সংসার সামলাতে বাড়িতে রইলেন। সংসারে দেখেছি মায়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্বহীনতা। ইদের ছুটিতে বাড়িতে যেতে সেই মেয়ে আর সঙ্গে এলো না। এদিকে মেদিনীপুরে থাকাকালীন ঐ মেয়ে একদিন সন্ধেতে বাচ্চাকে আদর করতে করতে কী যে করে ফেলে বাচ্চার কান্না আর থামে না। ডান হাতটা ঝুলে রয়েছে। নাড়াতে পারছে না। তখন আমি পরের দিনের ক্লাসের জন্য পড়াশোনা করছিলাম। মুকুলবাবু বলেছিলেন মেদিনীপুর কলেজে পড়াতে গেলে অধ্যাপকদের প্রতিদিন আট ঘণ্টা করে পড়াশোনা করা দরকার। এমনিতেও শিক্ষার্থীদের থেকে অধ্যাপকরাই বেশি পড়াশোনা করেন। অল্পমতি কেউ কেউ নিজের পড়াশোনার বিস্তার নিয়ে দম্ভ করে। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানী জানেন তিনি কত কিছু জানেন না। তাই চুপ করে থাকেন।

🍂

মেয়েকে নিয়ে সেইরাতেই ডাক্তারের কাছে ছুটলাম। ইঞ্জেকশান,ওষুধ নানান কিছু নিয়ে সারারাত জেগে রইলাম। সকালে উঠেই এক্সরে মেশিনের সাহায্য নিয়ে এক্সরে করা হলো। অতোটুকু বাচ্চা! শীতের দিনে ঠাণ্ডা প্লেটের ওপর ওকে শুইয়ে দিলাম। ডাক্তার বললেন কলার বোনে মোচড় লেগেছে।

পরে মা সপ্তাহে সপ্তাহে যাতায়াত করতে থাকেন। শনিবার বাড়ি গিয়ে মঙ্গলবার আসতেন। কেননা সোমবার ফুলেশ্বর থেকে একদিনের ছুটিতে সালাউদ্দিন এসে মঙ্গলবার ফিরে যেতেন। মাঝে দুইজন অ্যাটেনডেন্ট রাখা হলো। কিন্তু আমার কলিগরা ঠিকই বলেন, “সালেহা অ্যাটেনডেন্ট রাখতে জানে না”। একজন অ্যাটেনডেন্ট হার্টের রুগি, আমায় সাহায্য করবেন কী তাঁকে নিয়ে ডাক্তার,হাসপাতাল এবং ওষুধের দোকানে ছোটাছুটি। পরে শুনেছি তিনি প্ল্যান করেই এসব করেছেন। নাহলে অনেক বেশি কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়জন এক দেড় মাস থাকলেন কিন্তু তিন চার মাসের বাচ্চার গায়ে হাত তুললেন। ভিজে জামা পরিয়ে রাখতে লাগলেন। ঝিনুকে করে দুধ খাওয়াতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাচ্চার গলায় আটকে গিয়ে চোখ দাঁড়িয়ে গেলে পাশেই রহিমদার স্ত্রী রাজেকা ভাবীর সাহায্য নিলেন। দাদা, ভাবী, টুম্পা এবং অর্ক এঁদের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। এঁরা নইলে ওইটুকু বাচ্চাকে আমি রেখে কলেজে যেতে ভরসা পেতাম না।

সদ্য মাকে ব্ল্যাকমেল করতেও ছাড়তেন না সেই অ্যাটেনডেন্ট। কিছু বললেই বলতেন বাচ্চার গলা কেটে রেখে দেবো। কলেজ থেকে ফিরলে বহুক্ষণ দরজা খুলতেন না। আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। পরে মা এসে তাঁকে বিদায় জানালেন। কিন্তু মা আমাকে পুরোপুরি সাহায্য করতে পারলেন না আর আমার শাশুড়িমা তো একদমই এই সিনে নেই। ফলে অনেক কন্যা এবং বৌমার যখন এ সৌভাগ্য হয় আমি তৃষিত চাতকের মতোই চেয়ে চেয়ে দেখি সে দৃশ্য।
সেই মেয়েটি যে কলার বোনে খেলার ছলে  আঘাত হানে

একজন মনোবিদের ইন্টারভিউ দেখছিলাম একদিন, তিনি বলছেন একজন চাকরিজীবী মহিলা তাঁকে বলেছেন যে ; “দেখুন সন্তানকে মানুষ করার সময় যখন এঁদের ( শাশুড়ি এবং মা ) সাহায্য চেয়েছিলাম তখন এঁরা আমাকে সাহায্য করেন নি, তাঁদের সংসারের দোহাই দিয়ে। এখন বার্ধক্যে তাঁরা আমার কাছে আসতে চাইছেন। এ ব্যাপারটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না”। আমারও যে এমন মনে হয় না, তা নয়। কিন্তু আমি রত্নগর্ভা। কন্যা আমার মনোবিদ হয়ে বলেছে, “ মা তোমাকে যে যতটুকু সাহায্য করেছে তার প্রতি তুমি কৃতজ্ঞ থেকো। কারো কাছে বেশি আশা করো না। তাদের জায়গা থেকে ব্যাপারটা দেখো। তারা চেয়েও হয়তো করতে পারে নি। আফটার অল সন্তান তো তোমাদের। তোমাদেরই দায়িত্ব বেশি”।

বড়ো হয়ে মেয়ে যে কথা বলেছে, সেই কথাটাই একদিন আমার বাবা ফোনে বলেছিলেন। এখনও কানে বাজে। সালাউদ্দিন ফুলেশ্বর যাবেন রেডি হয়ে আছেন। মা বাউড়িয়া থেকে এলেই  বেরিয়ে যাবেন আর আমিও কলেজ যাবো। সকাল নটা বেজে গেল। ভোরের ট্রেন ধরেই মায়ের আসার কথা। কিন্তু আসছেন না। পাবলিক বুথে গিয়ে মাকে ফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, মা এখনও আসছো না কেন? বাবা ফোন ধরে বললেন, “তোমার মা আর যাবেন না। তোমাদের সন্তান তোমরা মানুষ করো”। মা এখনও বলেন, আমার কান্না কান্না গলায় বলা ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ শব্দটা তাঁর বুকে তিরের মতো বিঁধেছিল ।
( ক্রমশ )

Post a Comment

0 Comments