জ্বলদর্চি

'কালের অতলে কলোরাডো' নিয়ে কলম ধরেছেন অনামিকা তেওয়ারী


'কালের অতলে কলোরাডো' নিয়ে কলম ধরেছেন অনামিকা তেওয়ারী

জ্বলদর্চি থেকে প্রকাশিত  চিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা “কালের অতলে কলোরাডো” এমন  এক  ভ্রমণ বিষয়ক  গ্রন্থ  যেখানে  লেখিকা নিছক  ভ্রমণ  কাহিনী  লেখার মধ্যেই  থেমে  থাকেননি, বরং বলা ভুল  হবেনা  এই  গ্রন্থটি  এক  বিশেষ  সময়কে  লিপিবদ্ধ  করেছে। লেখিকার কাছে কলোরাডো ভ্রমণ নিছকই কিছু মিশ্র অনুভূতির স্মৃতিচারণা নয়, এখানে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন একটি সমগ্র জনজীবনকে ! সেই জনজীবনের সুখ, অসুখ, আচার-অনুষ্ঠান, ইয়ং জেনারেশনের জাতপাতহীন বন্ধুত্ব, জীবনদর্শন খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, ফলে গ্রন্থটি একটি গবেষণাধর্মী সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে।

যাত্রাপথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম বর্ণনার পাশাপাশি উঠে এসেছে একাধিক রীতি-নীতি,  সম্বলিত অচেনা প্রাচীন জনপদের গল্প। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ, খাদ্যভ্যাস, বাসস্থান প্রভৃতি সম্পর্কে পড়তে পড়তে কখন যেন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষজনের সাথে একটা একাত্ববোধ গড়ে ওঠে পাঠকের হৃদয়ে। মনে হয় যেন স্বচক্ষে দেখা কোনো দৃশ্যের পুনর্নির্মাণ দেখছি!  সুখপাঠ্যটি শুধুই আনন্দঘন মুহূর্তেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সেখানে খুব সহজাতভাবেই উঠে এসেছে এমন এক সময়ের কথা, যে সময় শেকড় থেকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল সারা বিশ্বকে! করোনা অতিমারীর ভয়ানক করালো গ্রাস থেকে অনেকেই রেহাই পায়নি। সেই অতিমারী কীভাবে সমগ্র মানবসভ্যতার অস্তিত্বকে সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছিল, মৃত্যুর বিভীষিকা কীভাবে মানুষকে গৃহবন্দী করে তুলেছিল, জীবনের জন্য বাঁচার আকুতি সবই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন লেখিকা।

গ্রন্থের শুরুতেই ব্রতীনের চোখে বন্য নদীর উচ্ছলতা উপভোগ করতে করতেই পাঠক অনুভব করতে পারে ঝাঁ চকচকে শহরের পরতে পরতে মিশে থাকা আধুনিকতাকে। এখানেই লেখিকার লিখনশৈলীর বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যায়। নির্জন পাহাড়ে গাছ গাছালির সবুজ শ্যামলিমায় অবগাহন করতে করতেই তাঁর কলমের অভিমুখ ঘুরে যায় কংক্রিট দানবের দুনিয়ায়!

সেই দানবীয় ঔদ্ধত্যের এক টুকরো জ্বলন্ত নিদর্শন বুঝি ব্রতীনের চকচকে কালো Tacoma গাড়ি! সেই ওজনদার গাড়ি অনায়াসে পাঠকের মনকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে সমুদ্রের গা ঘেঁষে অথবা পাহাড়ের বুক চিরে। নিরুদ্দেশের যাত্রাপথে ঘুরে বেড়ানো পাঠকের সাথে সাক্ষাৎ হয় কত কত অচেনা জনপদের। গৃহকোণে বসেই সেইসব অজানা রাজ্যের তুষার শোভিত পর্বত শিখরের অসাধারণ রূপ, বার্চ, পাইন, সিডারের নিস্তব্ধ অরণ্য, প্রশান্ত মহাসাগরীয় নীলচে জলরাশি, মরুভূমির ধূসরিমা, গিরিখাত, মালভূমি, লেখিকার চোখ দিয়েই 

ভরতে থাকে পাঠকের অভিজ্ঞতার ঝুলি। কালো হরফের সাথে পাঠকের কল্পনার রামধনু রঙ কখন যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

ভ্রমণ পথে অতনু শুনিয়ে যায় জীবনের জয়গান। তার চোখেই পাঠক খুঁজে নেয় কোনো এক আমেরিকান শহরের বিশাল বিল্ডিং জুড়ে বড়ো বড়ো ক্যাসিনো হাবের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, মানুষের আর্থ-সামাজিক চালচিত্রকে। বিষয় বৈচিত্রের এই বিভিন্নতায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে গেলেও পাঠকের ক্লান্তি আসেনা।  পাঠকের ধৈর্য্যর দিকটি গুরুত্ব দিয়ে দেখার লেখিকার এই প্রয়াস সমগ্র গ্রন্থেই পরিলক্ষিত হয়।

সহস্র বছর ধরে বৃষ্টি ধোয়া জল পাহাড়ি উপত্যকায় জিপসামের খনি জমিয়ে ফেললেও, মাইনাস ২ ডিগ্রির তাপাঙ্ক দমিয়ে ফেলতে পারেনি ব্রতীনদের tacoma গাড়ির গতি। আসলে কি তা অজানাকে জানার জন্য লেখিকারই মনের অদম্য ইচ্ছা! মন দিয়ে পড়লে সহৃদয় পাঠক নিশ্চয়ই তার উত্তর খুঁজে পাবেন।

ভূগোল বইয়ে পড়া কলোরাডোর থেকেও লেখিকার চোখে সদ্য আবিষ্কৃত কলোরাডো যেন আরো বেশি সজীব, প্রাণবন্ত। তারিফ যোগ্য তাঁর ভৌগোলিক জ্ঞান! দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের পরিণাম এই সরস কলোরাডো বর্ণনা পর্ব। এখানে উল্লেখ করতে হয় মাঝে মাঝে কিছু পৃষ্ঠায় রঙিন ফোটোগ্রাফি প্রাকৃতিক দৃশ্যপটকে বড়োই জীবন্ত করে তুলেছে।

অনাদিকালের অভিযাত্রীর মতো পাঠকের উৎসুক চোখ লাল গোলাপি মায়াময় কলোরাডো অববাহিকা অঞ্চলের স্বপ্নালু দৃশ্য অবলোকন করতে করতে হঠাৎই এসে পড়ে কালের অতল তলে তলিয়ে যাওয়া বিগত যৌবনা শুকনো এক নদীখাতে।

সেখানেই অতি সন্তর্পনে লেখিকার সাবধানবাণী স্পর্শ করে যায় মানবসভ্যতার প্রযুক্তিগত অহংকারের সোপানতলে। তাঁর কলম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যায় কিছু কঠিন বাস্তবকে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ নাগরিক সভ্যতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিলেও বিনিময়ে কেড়ে নিয়েছে স্রোতস্বীনির স্বাভাবিক গতি,ভেঙে খানখান করেছে পাহাড়ের নিস্তব্ধ সৌন্দর্যকে, রেহায় দেয়নি সমুদ্রের গভীরতাকেও। প্রকৃতির এই নির্মম ধ্বংসের সাক্ষী থেকেছে লেখিকার অনুভবি মন!

প্রকৃতির সবটুকু রহস্যর উন্মোচন করতে চাইলেই বুঝি তার সৌন্দর্যে টান পড়ে। কিছু রহস্য অবশিষ্ট থাকলে তার টানেই মানুষের বারবার প্রকৃতির কাছে ফেরার তাগিদ থাকে। সেই নিত্যনতুন রহস্যাবৃত সৌন্দর্যের প্রবল আকর্ষণে লেখিকা কখন যেন পাঠকের ছেলেবেলাকে জাগিয়ে তোলেন এক ঘুমন্ত উপত্যকা থেকে। তাঁর কলম টুক করে জুরাসিক পার্কের ভ্রমণ করিয়ে নেয়। সেই বর্ণনা পড়তে গিয়ে পাঠকও যেন অজান্তেই সাগরপারে ছুটতে শুরু করে ডাইনোসোরাসের সাথে। সেখানে বালিয়াড়ির আশে-পাশে পদচিহ্ন স্মৃতিস্বরূপ রেখে আবার ব্রতীনের tacoma গাড়ি চড়ে পাঠকের যাত্রা শুরু হয়  অজানা এক উদ্ভিদ রাজ্যে। সেই পার্কে পৌঁছে তার কৌতূহল জন্মায় ২৮৯ প্রজাতির পাখি,১৯ প্রজাতির বাদুড় আর ৩২ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণীর পরিচয় সন্ধানে। এখানেই খোঁজ মেলে লেখিকার পাখিপ্রেমী মনটির। দেশ বিদেশের অচেনা পাখির ছবি সংগ্রহ একসময় যার নেশা ছিল। 

🍂

সহস্র বছর ধরে কলোরাডো যেভাবে তার উচ্ছল চলার পথে বুকে বয়ে নিয়ে চলেছে পলি, বালির ভান্ডারকে ঠিক সেইভাবেই লেখিকাও যেন তাঁর ভ্রমণ পথের খুঁটিনাটি তথ্য স্মৃতির গ্রন্থাগারে জমিয়ে এনেছেন সযত্নে। তারপর সেইসব মণিমাণিক্য থরে থরে সাজিয়ে আস্ত এক ভ্রমনগাঁথা উপহার দিয়েছেন পাঠককে।

মানুষের সীমাহীন লোভ প্রকৃতি আর মানুষের এই সুপ্রাচীন প্রেমপর্বে কখন যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তা হয়ত কেউই আন্দাজ করতে পারেনি। পারেনি বলেই প্রযুক্তি আর বিজ্ঞান নির্ভর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সে নিজেকে প্রকৃতির থেকেও উচ্চাসনে বসাতে চেয়েছে! তার পরিণাম যে কতখানি প্রাণঘাতী হতে পারে তার প্রমাণ সারা বিশ্ব কোভিড কালেই পেয়েছে। লেখিকা আরো একবার উস্কে দিয়েছেন সেই কঠিন সময়ের ভয়াবহ স্মৃতি। অসহায় মানুষের দুঃসময়ের সুযোগ নিয়ে আরেকদল স্বার্থপর মানুষের পাষন্ডের মত আচরণ করে বেহিসেবি কালোবাজারির অর্থ উপার্জন করার ঘৃণ্য চক্রান্তের দিকটিও ফুটিয়ে তুলেছে তাঁর সাহসী কলম। কোভিডের করাল গ্রাসে বন্ধু বিয়োগের স্মৃতি,  বিদেশ বিভুঁইয়ে সদ্য পরিচিত সুখী পরিবারের প্রায় ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে থাকার বিয়োগান্তক কাহিনী সিক্ত করেছে পাঠকের অন্তর। ছোটো বড়ো কোনো বাচ বিচার না করেই একটি মহামারী বহু প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, সেই স্মৃতি আজও অমলিন সকলের মনে। দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন যেভাবে অচল করে তুলেছিল সারা পৃথিবীকে তেমনই কেড়ে নিয়েছিল লেখিকার মানসিক শান্তি। দেশে ফেরার অনিশ্চয়তা শুধুমাত্র তাকেই বিচলিত করেনি সেইসময়ের এই একই অনুভূতিতে বহু মানুষের সাথে একসূত্রে বাঁধা পড়বেন তিনি।

ভ্রমণের আনন্দ যতই অনাবিল হোক, শান্তির ঠিকানা একমাত্র নিজভূমে, সুখী গৃহকোণেই নিহিত আছে। লেখিকার সাথে সকলেই সহমত হবেন এখানে।

পরিশেষে দেশে মাটি স্পর্শ করার পর তাঁর মনের শান্তি পাঠকের মনকেও আশ্বস্ত করে।

পরিমিত ভাষা,  আবেগের সংযম, উপযুক্ত শব্দ চয়ন সবকিছু মিলিয়ে ভাবী প্রজন্মের কাছে এই গ্রন্থটিকে চেনা অচেনা পৃথিবীকে নতুনরূপে জানার এক জীবন্ত দলিল হিসেবে উপহার দিয়েছেন তিনি। 

 শুভ্রাংশু শেখর আচার্যের প্রচ্ছদ বরাবরই যেকোনো গ্রন্থের বিষয়কে খুব স্পষ্ট ভাবে পাঠকের সামনে উপস্থিত করে। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। 

ধ্বংসের পরেই সৃষ্টির সূচনা হয় সেই আশার বাণী শুনিয়েই থেমেছে লেখিকার কলম। তবে তারপরও পাঠকের মন কিন্তু কিছুসময় ধরে ঘোরা ফেরা করে চলে প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশির সাদা ফেনার স্তরে, অভ্রকুচির মত চিক চিক করতে থাকা দুপুরের রৌদ্রস্নাত বালুকাবেলায়। আমি নিশ্চিত ভোরের আলো ফুটলেই সামুদ্রিক পাখির তীক্ষ্ণ ডাক পাঠকের ঘুম ভাঙিয়ে যাবে বহুদিন।  লেখিকার নিরলস পরিশ্রমের সার্থকতা এখানেই।

Post a Comment

0 Comments