জ্বলদর্চি

কাঁথি থেকে কলোরাডো /সুমনা পাল

কাঁথি থেকে কলোরাডো

সুমনা পাল


কাঁথি থেকে আমার কর্মক্ষেত্রের দূরত্ব প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ কিলোমিটার। একসময় ওখানেই ছানাপোনা নিয়ে ঘর-সংসার সাজিয়ে বসেছিলাম। এখন অবশ্য তল্পিপল্পা গুটিয়ে কাঁথিতে। তাই কাঁথি থেকেই যাতায়াত করছি। প্রতিদিন যেতে আসতে সময় লেগে যায় প্রায় চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টা। ছেলে পড়িয়ে খাই, ঘরে ফিরে আবার নিজের দুষ্টুটাকে পড়াই। বাড়িতে নিজের পড়া আর সেরকম হয়ে ওঠে না। এ নিয়ে আমার মনে বেশ অশান্তি। তার ওপরে কোনদিন বাদুড়ঝোলা হয়ে আসি, কোনদিন কারোর ঘাম মাথার উপর টপটপ করে পড়ে,  কোনদিন কেউবা তার পেল্লাই শরীরখানা নিয়ে বাসের সিটের প্রায় সবটা দখল করে বসে, আর ভাবটা এমন দেখায় যেন জায়গাখানা তার জন্মসূত্রে পাওয়া বাবার জমিদারি। কখনোবা ভিড়ের চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাই। মাঝে মাঝে মনে হয় দু-একটাকে যদি বাস থেকে কান ধরে নামিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। অগত্যা… 

এরকম অবস্থাতেও যেদিন একটু সুবিধে পাই , একটু-আধটু পড়ার চেষ্টা করি, সেটা ফোনেই হোক কিংবা কোনও বই।

একদিন ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে  জ্বলদর্চির ই-ম্যাগাজিনে চিত্রা ভট্টাচার্যের ভ্রমণ কাহিনি ‘কালের অতলতলে কলোরাডো’ চোখে পড়ল। নিছক কৌতূহল বশেই পড়তে শুরু করলাম। তখন বুঝিনি এই কৌতূহলই একদিন আমার নেশা হয়ে উঠবে। শুধু তাই নয় বখাটে ছেলের মতো ভদ্রমহিলাকে ( লেখিকা – চিত্রা ভট্টাচার্য) আমি ফেসবুকে রীতিমত স্টক করতে শুরু করলাম। 

বেশ ঝরঝরে বাংলায় লেখা ভ্রমণ কাহিনি। পড়তে পড়তে আমার পড়ার চোখ যেন দেখার চোখ হয়ে উঠছিল। আর লেখার মাঝে মাঝে কত ছবি। বড়ো হয়ে ছবিহীন বই পড়েই তো অভ্যস্ত। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল  আমেরিকা। ভেসে উঠছিল সেখানকার প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের বিভিন্ন রূপের সাজের সাথে ইউটা আরিজনার পাহাড়, কলোরাডো নদী, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, আর্চিস ন্যাশনাল পার্ক সহ জঙ্গল-মাঠ-প্রান্তরের নানা বিস্ময়কর প্রকৃতির মোহিত করা অনবদ্য রূপ এবং বিভিন্ন শহরের বর্ণময় জীবনের সাথে  কলোরাডোর জীবন। সেই সাথে মিশে যাচ্ছিল ইতিহাস চেতনা, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব এবং ভূগোল। তৈরি হচ্ছিল এক নতুন জীবনবোধ।

বামে লেখিকা। বই প্রকাশ করছেন শ্রী চন্দন বসু। 

একবারও মনে হয়নি আমি কোনও লেখা পড়ছি। মনে হচ্ছিল পাশের বাড়ির এক জেঠিমা, মাসিমা বা পিসিমা গোছের কেউ কিছুদিন বিদেশে ঘুরে বেড়িয়ে আসার পর বিকেলবেলায় আমার বাড়িতে বসে ঝালমুড়ি খেতে খেতে গল্প শোনাচ্ছেন। সেই গল্পে মিশে ছিল পৃথিবী দেখার আনন্দ, আবার মহামারি কবলিত মানুষের জন্য দুশ্চিন্তা,  কখনও ভয়,কখনও যন্ত্রণা।

সেই সাথে উঠে আসছিল মহামারি বিধ্বস্ত পৃথিবীর রূপ। আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও মানুষ বাঁচার জন্য কীভাবে ছটফট করে, প্রকৃতির রোষের কাছে মানুষ কতটা অসহায় হয়ে পড়ে,  এই রচনা যেন তারই জীবন্ত দলিল।

দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশে আছেন এক নারী। খুঁজে নিচ্ছেন বন্ধু। তবুও নিজের  দেশের মানুষগুলোর জন্য, নিজের মানুষগুলোর জন্য, ছেড়ে আসা ভিটেমাটির জন্য কী আকুল আর্তি তাঁর।

এ শুধু ভ্রমণ কাহিনি নয়, এ জীবনের কাহিনি। এ কাহিনি বিপন্ন মানুষের অসহায়তার ছবি আঁকে, সভ্যতার সংকটের কথা বলে। এ কাহিনি শিকড়ের টানকে বুঝতে শেখায়। ফিরে যেতে শেখায় নিজের অস্তিত্বের গভীরে।

🍂

Post a Comment

0 Comments