আন্দোলন যখন স্বতঃস্ফূর্ত
মিলি ঘোষ
কোনও নির্দিষ্ট সংগঠনের ছত্রছায়ায় গঠিত নয় এমন আন্দোলনকে অসংগঠিত আন্দোলন বলা যেতে পারে। অসংগঠিত আন্দোলনের ক্ষেত্রে কিছু বিভাগ থাকে। যেমন, পেশাগত বিভাগ, কাজের চরিত্রগত বিভাগ, পরিষেবা সংক্রান্ত বিভাগ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আন্দোলনে ভুলভ্রান্তি কিছু থাকে। কিন্তু এই ভুল থেকেই তারা প্রতিনিয়ত শিক্ষা লাভ করে, যা আন্দোলনকে ক্রমশঃ শক্তিশালী করে তোলে। দীর্ঘদিন ধরে সহ্য করা অন্যায় জুলুম দুর্নীতি যখন সীমা ছাড়ায় তখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তার আগে যতদিন পারে মানুষ সহ্য করেন। ক্ষোভ, যন্ত্রণা, অপমান, অন্যায়ভাবে দাবিয়ে রাখা, দুর্নীতি এই সব কিছু বাড়তে বাড়তে একদিন তার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অনেক সময়েই এই ধরনের আন্দোলন আসে একটা বড়ো ধাক্কা খাবার পর। উপরিউক্ত বিভাগগুলির কোনও একটিতে বা একাধিক বিভাগে অথবা সবকটি বিভাগেই কোনও একজন বা একাধিক ব্যক্তির ওপর কোনও নির্মম বা অমানুষিক অন্যায় থেকেই অসংগঠিত আন্দোলন গড়ে ওঠে। এবার এই আন্দোলন যদি ন্যায়ের পথে হাঁটে, যদি তা সাধারণ মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় তাহলে সেই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের রূপ নেয়।
সম্প্রতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা মানুষের 'এই তো বেশ আছি' ভাবনাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক খু*ন কলকাতা শহরের বুকে আগেও হয়েছে। তখনও মানুষ নড়েচড়ে বসেছেন। কিন্তু সেটি আন্দোলনের রূপ নেয়নি। প্রশ্ন আসে, কেন তখন হয়নি? কেন এখন? তিনি ডাক্তার ব'লে? এলিট সোসাইটির ব'লে? এই প্রশ্নগুলো সমাজের মানুষের কাছে যাঁরা রাখেন, উত্তর তাঁরা নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন। তাই এই প্রশ্নবাণ। প্রশ্ন আরও আছে। যেহেতু এটি শুধু খুনের ঘটনা নয়, এটি একটি ধর্ষণের ঘটনাও তাই আঙ্গুল ওঠে আরও কিছু বিষয়ের ওপর। কেন নয় বছরের স্কুল পড়ুয়ার জন্য চিৎকার হচ্ছে না? কেন ইটভাটার মহিলা শ্রমিকের নিরাপত্তার কথা আসছে না? প্রশ্ন অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। জীবনের মূল্য প্রতিটি মানুষের সমান। বাঁচার অধিকার, সম্মান পাবার অধিকার প্রত্যেকের আছে। তবুও এই আন্দোলনকে নির্দিষ্ট তকমা দেওয়া যাবে না।
🍂
গ্রাম বা শহরতলী থেকে শহরের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছেলেমেয়েরা দাদাগিরির বলি হলে দাদাগিরি বন্ধ করতে যা যা করা দরকার প্রশাসনকে তা'ই তা'ই করতে হবে। কিন্তু কোনও মৃত্যুকে পোস্টমর্টেম করার আগেই আত্মহত্যা বলে যদি চালানোর চেষ্টা হয়, কোথায়? না, একটি হাসপাতাল থেকে, তাহলে বুঝে নিতে হবে এর পেছনে বড়ো চক্র কাজ করছে। প্রমাণ লোপাট, তড়িঘড়ি দাহ কার্য সম্পন্ন ইত্যাদি ঘটনা ঘটতে থাকলে তার পেছনে যে দুর্নীতি আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয় এবং এই হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা শূন্য ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ এই মৃত্যুটি অন্যান্য মৃত্যুর সঙ্গে তুলনীয় নয়। যদিও মৃত্যু মাত্রেই দুঃখজনক। এই জায়গা থেকেই বলা যায়, নিজের কর্মক্ষেত্রে কর্মরত অবস্থায় একজন মহিলা ডাক্তার যদি বর্বরতার শিকার হন, তাহলে গ্রামে গঞ্জের শহরতলীর মেয়েদের নিরাপত্তা কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে। সে জন্যই এই ঘটনার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে এলিট সোসাইটির আন্দোলন বা ডাক্তার বলেই এত কাণ্ড এভাবে দাগিয়ে দেওয়া যায় না।
এই আন্দোলন যদি শুধু ডাক্তাররা করেন, তাহলে এটি অসংগঠিত আন্দোলন বলা যায় না। কারণ তাঁদের নিজস্ব সংগঠন আছে। কিন্তু আন্দোলনের শুরুতে তা অসংগঠিত আন্দোলনের পথেই হেঁটেছে এবং আন্দোলনকারীরা প্রতিদিন এর থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। নিজেদের ছোট ছোট ভুলভ্রান্তি সংশোধনের মধ্য দিয়ে এবং প্রশাসনের ধারালো আসলে ভোঁতা অস্ত্রর বিরুদ্ধে এগিয়ে যেতে যেতে এক বিরাট আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এবার এই আন্দোলন যদি দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে সর্ব সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। তখন তার ধার ও ভার প্রশাসনকে টলিয়ে দিতে বাধ্য। ছড়ি ঘুরিয়ে এই চলমান আন্দোলনের গতি রোধ করার চেষ্টা হলেও আন্দোলনের তীব্রতা বিন্দুমাত্র কমে না। বরং তা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।
যুদ্ধ যদি রাজায় রাজায় হয়, সে যুদ্ধে যে'ই জিতুক যে'ই হারুক রাজার সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকে। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখে, সম্মান দেয়। কিন্তু লড়াই যখন অসম? লড়াই যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, লড়াই যখন অমানবিকতার বিরুদ্ধে মানবিকতার, লড়াই যখন অভদ্র ভাষার বিরুদ্ধে ভদ্র ভাষার, লড়াই যখন মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সত্যের তখন সে লড়াইকে কোনোমতেই রাজায় রাজায় যুদ্ধ বলা যায় না। যায় না বলেই আন্দোলন প্রতিদিনের ঘটনা থেকে শিক্ষা লাভ ক'রে তার গতিপ্রকৃতি পাল্টায়। পাল্টাতে বাধ্য। যদি এমন একটা প্রেক্ষাপটে আন্দোলন চলে যেখানে আমরণ অনশনরত ছেলেমেয়েরা একে একে আইসিইউ'তে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে, সেখানেই আবার ঠাকুর বিসর্জনের জন্য কার্নিভাল হচ্ছে মহা সমারোহে, তাহলে ইতিহাসও একই কথা বলে-- রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন। বারবার এই বাক্যটি কেন ঘুরে ঘুরে আসে? ঘটনা ঘটে বলেই তো। নিরোর শৈল্পিক সত্তাকে কেউ মূল্য দেয়নি। মানুষ মনে রেখেছে তাঁর অমানবিকতাকে।
তবু যদি নিজের প্রয়োজনে বা নিতান্ত মানবিকতার দায় থেকে প্রশাসন কিছু দবিদাওয়া মেনে নিতে বাধ্য হন, তাহলেও কিন্তু এই আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, এটি এখন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। সমাজের যেখানে যেখানে দুর্নীতি, যে কোনও অবস্থানে থাকা প্রতিটি মেয়ের নিরাপত্তা, কর্ম-সংস্থান, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে দাবি প্রশাসনের থেকে আদায় করতে পারলে তবেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের স্বার্থকতা।
2 Comments
যুক্তিপূর্ণ ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লষণ ।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete