জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গনে মোর শীরিষ শাখায়/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্ত্তী /একচল্লিশতম পর্ব


প্রাঙ্গনে মোর শীরিষ শাখায়
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্ত্তী
একচল্লিশতম পর্ব

কিছু কিছু মানুষ থাকে,আজন্ম না পাওয়াটাই যার ভবিতব্য।তবু আপন স্বভাবজ গুণে বঞ্চনার অস্বীকারে তারা বাঁচেন হাসিমুখেই।বিরজার জীবনটাও ছিল অনেকটা তেমনই।জন্মেই মাতৃহারা,বাবা থেকেও নেই,জ‍্যাঠাইমার আগলভাঙা স্নেহে বেড়ে ওঠা,খুব বড়ো ঘরে-বরেই বিয়ে দিয়েছিলেন জ‍্যাঠামশাই।সে সুখ কপালে সয়নি।সব হারিয়ে ফিরে এসেছিলেন একগাদা সম্পত্তি আর নিরর্থক গয়নাগাটি নিয়ে,তারপর থেকে অগাধ বই,সাদা কাপড়,অটুট স্বাস্থ্য আর সবাইকে ভালোবাসার ইচ্ছে নিয়ে বাঁচা।পরিবারের প্রয়োজনে ভাইপোদের মানুষ করা,ভাইঝির বিয়ের জন্য আত্মীয়বাড়ির পুজোতলায় মানত,বৌদিদি-বৌমাদের সংসারধর্মে সাহায‍্য,মাঝেমধ্যে তীর্থযাত্রা…এই করতে করতেই যে কবে চল্লিশ বছর পার করে ফেললেন বুঝতেই পারেননি বিরজা। ইতিমধ্যে চুলে অল্প-স্বল্প রূপোলী রেখা,তপ্ত কাঞ্চনবর্ণে খানিক মালিন‍্য,চোখের কোলে শ্রান্তি যে ধীরে ধীরে জমছে,টের পাননি মোটেও।টের পেলেন সেদিন সন্ধ‍্যেবেলা,অনেক,অনেকদিন পরে,বাল‍্যসখী কুমু দেখা করতে আসায়।
ইদানিং কেমন যেন উদাস উদাস লাগছিল বিরজার। বড়বৌদিদিকে কলকাতার অনেক বড়ো ডাক্তার দেখিয়েও বাঁচানো যায়নি। সেই অবধি চিরকালের বুঝদার সহনশীল দাদাও কেমন যেন খিটখিটে হয়ে গেছেন। খাদ্যে,পানীয়ে রুচি নেই, দুরন্ত সুগারের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মিষ্টি খাওয়ার বায়না করছেন ছেলেমানুষের মতো। কখনও কখনও মেদিনীপুরে ছেলে বৌমার কাছে গেলেও বেশীরভাগ সময়েই বাড়িতেই থাকেন,রাতে ঘুমানোর সমস্যা হয় তাঁর।মেজদাদার শরীরও যে খুব সুস্থ আছে,তা নয়।
ইতিমধ্যে বাড়ির আটটি মেয়েরই বিবাহ হয়েছে, জমি জায়গা বিক্রি করতে হয়েছে বেশ কিছু, আর্থিক অবস্থা বেশ টালমাটাল সংসারের।
তারমধ্যে সুখ বলতে,ছোট দাদার বড়ো ছেলেটি বহু চেষ্টা করে সরকারী চাকরী পেয়েছে, বংশের প্রথম সরকারী কর্মচারী। তার বিবাহের কথা শুরু হয়েছে,তবু কেন কে জানে,বিরজার মন ছুটি চাইছে জীবন থেকে, দায়িত্ব থেকে।
এমনি কোন এক দুপুরবেলা কুমু এলো তার ঘরে।ভাদ্রের পড়ন্ত বেলায়,গুমোট গরম যখন পুকুরপাড়ের চালতা গাছের পাতা ছুঁয়ে বিদায় নিতে প্রস্তুত, কবেকার সুখজাগর স্বরের ফিসফিসানি,
-’সই!ঘরে আছিস?’
-’কে!’
চিনেও যেন না চেনার সুরে বলে উঠেছিলেন বিরজা।
-’আরে আমি লো আমি! আঁধার ঘরে বসে বসে চোখের মাথাও খেয়েছিস নাকি!’
বলেই কাছে এসে গলা জড়িয়ে বললে,
-’কুমু!চিনেছিস!’
অন্যসময় হলে রাগ করতেন, 
-’এতদিন পরে মনে পড়লো আমায়!’
-’আমার কি আর আসার জো আছে রে ভাই! অনেক কাজ , অনেক দায়িত্ব যে ভাই! মাত্র কয়েকদিনের জন্য এসেছি একটা কাজে’
-’কাজে!এখানে কি কাজ তোর? শুনেছি কাকাবাবু মারা যাওয়ার পরে…’
-’আছে।’
বলেই খানিক চুপ করে বসে রইলো কিশোরীবেলার ছটপটে প্রৌঢ়া,কেমন যেন এক বিষন্ন নির্জনতা…যেন পরস্পরের নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছিল দুজনেই।
বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে বিজয়াও খানিক চুপ করে রইলেন।তারপরে হাতে হাত রেখে শুধোলেন,
-’বলবি না আমায়!’
-’বলবো বলেই তো এতদূর এসেছি। এতোদিন কাউকে বলিনি।কাউকে তো অন্তত বলে যাই!’
বিরজা তাকিয়ে দেখলেন,গা ভরা গয়না,দামী শাড়ী,কপালের টকটকে উজ্জ্বল সিঁদুরের টিপের তলায় বড়ো ক্লান্ত দুটি চোখ,
-’তোর শরীরটা কি ভালো নেই সই!’
-’না। এক ভয়ানক অসুখ বানিয়েছি, আমার দিন ফুরিয়ে এলো।’
-’কি হয়েছে?’
🍂
-’মাস কয়েক আগে, ক্যান্সার ধরা পড়েছে আমার…’
-’সেকি!’
-’হ্যাঁ রে সই। চিকিৎসা করাচ্ছেন কর্তা, তিনি মহাপ্রাণ সর্বার্থেই।তবে দিন যে ফুরিয়ে এলো,জানে আমার মন।’
-’এ কি শোনালি সই!’কেন এলি?’
কন্ঠে বিরজার বিপন্ন বিস্ময়।
হেরে যাওয়া গলায় হাসিমুখে বললে কুমু।
-’বাঁচলাম তো অনেক দিন।দেহ লয় তো হবেই।কেউ আগে,কেউ পরে।তবে একটা হিসাব বাকি আছে সেটুকু না বুঝিয়ে…বলতে পারিস তারজন্যই এসেছি।তবে তোকে একটি কাজ করতে হবে।যাবি আমার সঙ্গে?’
-’কোথায়?’
-’বিশুর বাড়ি। শুনেছি ও নাকি বাউন্ডুলে জীবন ছেড়ে দেশে ফিরেছে!’
কেমন যেন একটু অবাক লাগলো বিরজার। শুনেছিলেন, বিদেশে সুখেই আছে কুমু, এতোদিন পরে হঠাৎ…

তাঁর চোখ দেখে কিছু বোধহয় টের পেয়েছিল কুমু,গলা জড়িয়ে বললে, 
-’আমার ওখানে হোটেল আছে,দেশ-বিদেশ থেকে বহু মানুষ আসে, খুব চালু ব্যবসা,জানিস বোধহয়। ওখানেই শুনেছি সাহেবরা নাকি মারা যাওয়ার আগে সারাজীবনের গোপন কথা তাঁদের চার্চে বলে যায়। আমাদের তো সে ব্যবস্থা নেই।তাই মনে হলো,বাপের ভিটেতে শেষবারের মতো দাঁড়িয়ে…’’
-’তোর আবার কি গোপন কথা রে?’
-:আছে।তাইতো এসেছি।তোর সঙ্গে দেখা করে যাই,তোকে অন্তত বলে যাই।’
তার গলায় কি যে ছিলো,কে জানে,বিরজা পূর্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-’বল!’
যেন অনেক দিনের ভুলে যাওয়া গল্প আওড়াচ্ছে,এমন আত্মগত গলায় বলে চললে কুমু
-’ আমাদের ছোটবেলায় তো সবাই একসঙ্গেই খেলা করতাম।তারপর,একে একে সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল, আমার তো  রূপ-গুণ-বাপের টাকা কিছুই ছিল না, আমার বিয়ের কথা কেউ ভাবেওনি, আমিও না।তবে তোর বিয়ের পরে,কেন কে জানে, আমার মনেও সংসার,বর এই সব ইচ্ছে হোত।চেপে রাখতাম। কাউকে বলিনি…
সে সময় বিশু এসে আমাকে এটা ওটা খাবার দিত, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতো। মিথ্যে বলবো না, আমারও ভালো লাগতো।
সেই শুরু, তারপরে আরও আরও…শেষে পেট বাধিয়ে বসলাম। বিশুকে বলতে সেই যে চম্পট দিলো, এ তল্লাটে কোথাও তাকে কেউ দেখতেও পেলোনা।কতোবার যে মরতে গিয়েছি,শেষে এক সন্ধ্যায় বাবা সব বুঝতে পেরে গেছিল।
কাউকে কিচ্ছু না বলে, তারপরেই বাবা-মেয়ে মিলে গ্রাম ছাড়ি…পথে এক তীর্থযাত্রার দলের সঙ্গে দেখা,ঘুরতে ঘুরতে হরিদ্বার, ততদিনে দেহে গর্ভলক্ষন ফুটে উঠেছে বেশ, কুমারী কন্যা, অপরিচিত হলেও নানা প্রশ্ন উঠছে…
-’এক সন্ধ্যায় ঘাটে বসে বসে কাঁদছি,মনে ভাবছি, মরা ছাড়া উপায় নেই। একপা একপা করে নামছি জলে,ভীষণ স্রোত। অপেক্ষা করছি কখন ভাসিয়ে দেয়…
এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক সামনে এসে হাত ধরলেন,
-’কে আপনি! এ কী করছেন?কাঁদছেন কেন? উঠে আসুন সিগ্গিরি!একটি বিপদ বানাবেন বুঝি’
-’মরতেই তো চাই।আপনি এসে আটকাচ্ছেন কেন আমায়?’
-’ছিঃ! ভগবানের দান এ জীবন!এভাবে কেউ…’
কি যে ছিলো সেই কন্ঠস্বরে,অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মেয়ে!যে মরতেই চায়,তারও জীবনের প্রতি এতো মায়া! জলভরা চোখে উঠে এসেছিল জল থেকে, শুরু হয়েছিল অন্য গল্প…(ক্রমশঃ)

Post a Comment

0 Comments