রজভের ভোলগা তীরে
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭৪
বিজন সাহা
রঝেভ
ভোলগার উৎস থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রঝেভ ভোলগা তীরের প্রথম বড় শহর। ভোলগার দুই তীরে বিস্তীর্ণ রঝেভ সৌন্দর্যে ভোলগা তীরের অনেক শহরকেই হার মানায়। রঝেভ একদিকে প্রাচীন শহর, আবার একই সাথে সে তরুণ। কেননা প্রায় আটশ’ বছরের পুরানো হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেই ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে ওঠে সম্পূর্ণ নতুন এক শহর। রঝেভের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১২১৬ সালের ১ মার্চের নভগোরাদের দিনপঞ্জিতে। সেখানে ভ্লাদিমির-সুজদালের যুবরাজ সভ্যাতোস্লাভ ভসেভোলোদোভিচ কীভাবে রঝেভ মস্তিস্লাভল শহর অবরোধ করেন সেই বর্ণনা আছে। এছাড়াও এই এলাকায় প্রস্তর যুগের দুই শতাধিক নিদর্শন পাওয়া গেছে যাদের বয়স ১০ হাজার বছরের বেশি। রঝেভ গড়ে উঠেছে একটি বড় জনপদের কেন্দ্র হিসেবে ভালদাই মালভুমির উত্তর পূর্বে ভোলগার উঁচু তীরে যেখানে হলীনকি নদী এসে মিলেছে। এখানকার মানুষের পূর্বপুরুষেরা সেজন্য একটি সুন্দর কিন্তু শত্রুর জন্য দুর্গম একটি স্থান বেছে নেয়। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এই শহর সেলিগার হ্রদ, সেই সময়ের অন্যতম প্রধান শহর ভেলিকি নভগোরাদ ও বাল্টিক সাগর, আরব দেশ ও গ্রীসের সাথেও বিভিন্ন নদীপথে সংযুক্ত। বিগত কয়েক শ’ বছর রঝেভ স্মলেনস্ক, তভের, মস্কো ইত্যাদি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রঝেভের দখল নিয়ে প্রায়ই লিথুনিয়ার সাথে তুমুল যুদ্ধ হত।
রঝেভে রুশ ও জার্মান সেনাদের সমাধির সামনে মেমোরিয়াল
রঝেভের নাম নিয়ে বেশ কতগুলো মতামত চালু আছে। দিনপঞ্জিতে এই এলাকাকে ডোবা অঞ্চল বলে উল্লেখ করা হয়েছে জার রুশ থেকে রঝেভ নাম হতে পারে। আজ যেখানে রঝেভ সেখানে সিশকি নামে এক নদী ভোলগায় মিলিত হয়, অন্য দিকে ঝেভা (আঝেভা বা অরঝেভা) নদী পড়ে সিশকিতে। তাই ধারণা করা হয় সেই নদীর নাম থেকে রঝেভ তার নাম পেয়েছে। অন্য এক ভার্সন অনুযায়ী এই নাম এসেছে এলাকার মরিচা ধরা জল থেকে যার রুশ নাম রঝা। আরেক ভার্সন অনুযায়ী এই নাম এসেছে রাই বা রুশে রোঝ থেকে যা রুটির অন্যতম উপাদান। অষ্টদশ শতকের লেখায় রঝেভিতিয়ান বা রঝেভবাসীদের সম্পর্কে লেখা হয়ে – এরা খর্বাকার নয়, এদের চেহারা মোটেই বোকা বোকা নয়, গাঢ় স্বর্ণকেশী, কর্মঠ এবং শান্ত। গ্লিনকা লিখেছেন এখানকার শুধু মেয়েদেরই নয় ছেলেদেরও মুখ লালাভ। এরা বিনয়ী ও লাজুক। উনিশ শতকের বিখ্যাত লেখক ও বিজ্ঞানী মাক্সিমভ রঝেভকে তিনবার রাজকীয় শহর নামে অভিহিত করেন। এটা বাস্তবেই তাই। অনেক আগে এই শহরের নাম ছিল রঝেভ ভোলদিমিরভা। অক্টোবর বিপ্লবের আগে পর্যন্ত নদীর বাম তীরের শহরের নাম ছিল রাজপুত্র ফিওদরভস্কায়া আর দক্ষিণ তীরের শহরের নাম ছিল রাজপুত্র দ্মিত্রভস্কায়া। কিন্তু শহরের নাম কেন রঝেভ ভোলদিমিরভা হল? এ নিয়ে যেসব লোককথা চালু আছে তা এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। ঐতিহাসিকরা ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে দুইজন ভ্লাদিমিরের অস্তিত্ব খুঁজে বের করেছেন – ভ্লাদিমির মস্তিস্লাভোভিচ ও ভ্লাদিমির আন্দ্রেভিচ। প্রথম জন বিখ্যাত রাজপুত্র মস্তিস্লাভ উদালির ছেলে (কারো কারো মতে ভাই) যিনি ১২২৫ সালে রঝেভে রাজত্ব করার দায়িত্ব পান। দ্বিতীয় জন ইভানা কালিতার পৌত্র, দ্মিত্রি দনস্কইয়ের কাজিন। জীবনের বড় অংশই তাঁর কেটেছে বিভিন্ন যুদ্ধে। সাহস ও শৌর্যের জন্য তাঁর সুনাম ছিল। রাজপুত্র ভ্লাদিমির আন্দ্রেভিচ সেরপুখভস্কি-খাব্রি (১৩৫৩ – ১৪১০) রঝেভের সমস্ত রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন। তাই অনেকের ধারণা তাঁর নাম থেকেই রঝেভের নাম হয় রঝেভ ভোলদিমিরভা। কিংবদন্তির রাজা রিউরিকের বংশধররা রুশ সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরাই বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলে বিভিন্ন শহর, বন্দর, ছোট বড় বিভিন্ন রাজ্য। রিউরিকের বংশধরদের একজন ফিওদর বরিসোভিচ ভোলোৎস্কি। তাঁর পিতা বরিস ভাসিলিয়েভিচ ভোলোৎস্কি ছিলেন প্রখ্যাত যুবরাজ ভাসিলি তিওমনির ছেলে। ১৪৭৭ সালে নভগোরাদ জয় করার উদ্দেশ্যে রওনা হবার আগে বরিস ভোলোৎস্কি পুত্র ফিওদরের নামে রঝেভ উইল করেন। কিন্তু পরে সেই উইল বদলানো হয়। বরিস নদী বরাবর রঝেভ ভাগ করেন। ফলে তাঁর মৃত্যুর পরে দুই সন্তান ফিওদর ভোলোৎস্কি ও ইভান রুজস্কি রঝেভের দুই অংশের অধিপতি হন। ইভানের মৃত্যুর পরে তাঁর অংশ তাদের কাজিন দ্মিত্রি উগলিৎস্কির কাছে চলে আসে। রাজপুত্র দ্মিত্রি উগলিৎস্কি মস্কোরাজ তৃতীয় ইভানের সন্তান এবং রাশিয়ার প্রথম জার ইভান দ্য টেরিবলের আঙ্কেল। এভাবেই রঝেভের দুই তীরের নাম হয় ফিওদরভস্কি ও দ্মিত্রভস্কি।
রুশ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে রঝেভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সীমান্ত শহর হবার কারণে রঝেভ ছিল ফ্রন্টলাইন সিটি। শহরবাসীরা অসংখ্য লড়াই, যুদ্ধ ও অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে। রঝেভবাসীদের প্রথম যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায় ১২৮৫ সালে। বিখ্যাত কুলিকভ যুদ্ধের একজন যোদ্ধা ছিল রদিয়ন রঝেভস্কি। মামায়েভের সাথে যুদ্ধে রঝেভের অনেকেই অংশ নেয়। এরপর ১৪৮০ সালে রঝেভ পরিণত হয় সামন্ত বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু। ইভান দ্য টেরিবলের শাসন কালে রঝেভ বিশেষ অবস্থানে ছিল। এর কারণ শুধু এই নয় যে জার সেখানে এসেছিলেন ও পার্শ্ববর্তী বনে শিকার করতেন, এ সময়ে তিনি বহুজাতিক রুশ রাজ্যকে শক্তিশালী করতে মনোযোগ দেন। ভোলগার উজানে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা সব সময়ই মস্কোর নজরে ছিল। লিথুনিয়ার সাথে যুদ্ধের সময় রঝেভ মস্কোয় গোলাবারুদ, খাদ্য ও সেনা সরবরাহ করে। সেই সময়ের দিনপঞ্জিতে এক সুতারের উল্লেখ আছে যে ভ্রাম্যমান শহর তৈরিতে সাহায্য করে। এটা ছিল কাঠের তৈরি চলমান দুর্গ যার ভেতরে ছিল কামান। ১৬০৬ সালে রঝেভ তভেরবাসী বালোতনিকভের নেতৃত্বে কসাক, চাষি ও দাসদের অভ্যুত্থান সমর্থন করে। এই সময়ের লোককথা দুনকা নামে এক সুন্দরী মহিলার কথা জানায় যে ধনীদের অর্থ লূট করত, কিন্তু গরীবের ক্ষতি করত না। তার নামেই পরে ভোলগার এক উপনদীর নাম রাখা হয় দুনকা।
যুদ্ধের মেমোরিয়াল এ দেশের প্রায় সব শহরের প্রধান স্থাপনা
বরিস গদুনভের মৃত্যুর পর অরাজকতার সময়ে রঝেভ দ্রুত পরিবর্তনশীল বিভিন্ন ঘটনার ঘূর্ণিপাকে পড়ে। সেই সময় পোলিশ, সুইডিশ থেকে শুরু করে কত যে প্রতারক ভোলগার উজান এলাকায় আসে। রঝেভ ব্যাপক লুটপাটের শিকার হয়। এই শহরের ইতিহাসে «১৭০১ সালে রঝেভ বিদ্রোহ» নামে একটি বছর আছে। এই বছর রঝেভে বাজারের আয়তন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু যেসব স্থাপনা সরানোর কথা ছিল তার মালিকেরা শহরবাসীদের সহায়তায় এর বিরোধিতা করে। রঝেভের জনগণ, তীরন্দাজ, কামান চালকেরা এমন কি পিটার দ্য গ্রেটকে ভয় না পেয়ে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়। মস্কোর রাজা রঝেভের প্রশাসনের কাছে বিদ্রোহীদের শাস্তি দেবার এবং রাজার আদেশ যাতে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয় সেই দাবি জানায়। কিন্তু সেই শাস্তি সম্পর্কে দিনপঞ্জিতে কিছুই পাওয়া যায় না। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের কৃষক বিদ্রোহের হাত থেকেও রঝেভ রেহাই পায়নি। ১৭০৭ সালে তভেরের গভর্নরের রিপোর্ট জানায় পুলিশের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও স্থানীয় ক্রিশকদে শান্ত করা সম্ভব হয়নি। ১৮১২ সালের পিতৃভূমির যুদ্ধ রুশ জনগণের জন্য এক বিরাট পরীক্ষা হিসেবে দেখা দেয়। রেঝভেও দেশপ্রেমের জোয়ার দেখা দেয়। ১৮১২ সালে রঝেভ থেকে ১৭৮৬ জন লোক গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়। রঝেভের বনিকরা ত্রিশ হাজার রুবলেরও বেশি অর্থ রাজকীয় তহবিলে দান করে। ১৮১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৫০০ কৃষক ও শহরবাসীর এক স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠিত হয়। দাঁ, কুড়াল, বল্লম, তীর ধনুক ইত্যাদি দিয়ে সজ্জিত এই স্বেচ্ছাসেবকরা লুটপাটের হাত থেকে শহর রক্ষা করে। রঝেভের এক জমিদারের ছেলে সেস্লাভিনের নাম শহরের ইতিহাসে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। নিজের গেরিলা বাহিনী নিয়ে তিনি ফ্রান্স বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। একদিন তিনি অল্পের জন্য স্বয়ং নেপোলিয়নকে বন্দী করতে ব্যর্থ হন। তিনিই সর্বপ্রথম সর্বাধিনায়ক কুতুজভকে শত্রু বাহিনীর পলায়নের কথা ও কোন পথে তারা যাচ্ছে সেই খবর দেন যা নেপোলিয়নের বাহিনী বিধ্বস্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেস্লাভিন ৯ বার আহত হন। তিনি ১৮৫৮ সালে ৭৮ বছর বয়সে নিজের জমিদারি এসেমোভায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সিশকি নদী যেখানে ভোলগায় পড়ছে সেখানে সমাহিত করা হয়। রঝেভবাসীরা আজও তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। ১৯৪২ সালে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত তাঁর সমাধি শহরবাসীরা ১৯৫৯ সালে নিজেদের উদ্যোগে পুনর্নির্মাণ করে। রঝেভবাসীদের দেশপ্রেমের সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমরা পাই ১৯৪১ – ১৯৪৫ সালের পিতৃভূমির যুদ্ধের সময়। সেই গল্প পরের পর্বে।
ভিডিওতে রঝেভ
https://youtu.be/5_N1qTR5Y8A?feature=shared
ছবিতে রঝেভ
http://bijansaha.ru/album.php?tag=276
0 Comments