জ্বলদর্চি

কৌসর /মৌসুমী ভট্টাচার্য্য


কৌসর
 

মৌসুমী ভট্টাচার্য্য 

১৫ই আগস্ট সকালে কৌসর টিভি দেখছিল।প্যারেড দেখাচ্ছে,পতাকা উত্তোলন,‘সারা জঁহাসে আচ্ছা’.....টিভির সাথে সেও গলা মেলায়।হায়দ্রাবাদে থাকলে এখন স্কুলে থাকতো। একটা উৎসবের আমেজ থাকে এই দিনটাতে। মনটা উদাস হয়ে যায়। ছোট ভাই ফাহিম,বোন ফতিমা কি মজাই না করছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাতায়নে দাঁড়ায়,বিষণ্ণতা গ্রাস করে তাকে। মাত্র সতেরো বছর বয়সেই তাকে নিকা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় এই সুদূর বিদেশে,ওমানে। কিনে এনেছে তাকে  তার স্বামী মহম্মদ,তার আব্বাজানকে মোটা টাকা দিয়ে।প্রায় বাইশ বছরের বড় এক ভিনদেশীর সাথে কি করে আব্বা নিকা দিয়ে দিল!
 আরবীতে কথা বলে সবাই,কৌসর নির্বাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে দেখে। কিছুই বুঝতে পারে না, জরুরী কথাও বোঝাতে পারে না। সারাদিন বোবা হয়ে থাকা,কি কষ্টের! শহরের এক প্রান্তে পুরনো ভিলাতে থাকে মহম্মদ ও তার পরিবার, মনে হয় ইতিহাস থমকে আছে এখানে।মহম্মদের এমু পাখি,ময়ুরের শখ। বেশ কয়েকটা এমু আর ময়ুর পোষা আছে। কৌসর তাদের সাথে কথা বলে,নিজের হাতে খাওয়ায়। ওদের মত সেও বন্দী,তাকেও কিনে আনা হয়েছে।ভিলাতে মহম্মদের বৃদ্ধ মা- বাপ, এক মাঝ বয়সী মহিলা থাকে,সলমা।
আম্মী খুব কাঁদছিল,আব্বাকে মানা করছিল,কৌসরকে না বিক্রি করতে । কিন্তু আব্বা যে খুব গরীব,যখন মুনিয়া ফুফি এই প্রস্তাব আব্বাকে দেয়,তার আব্বা লোভ সামলাতে পারল না। এমনিতেই কৌসর আর ফতিমাকে দেখতে পারে না,তার আব্বাজান ইমানুল। ছোট ব্যবসায়ী ইমানুল,কোনরকমে সংসার চলে।মেয়েদের কোথাও তো বিয়ে দিতে হবে।মুনিয়া এই ব্যবসা করে অনেকদিন। কয়েকবার হিউম্যান ট্রাফিকিং এর অপরাধে এরেস্ট হয়,কিন্তু দু’দিনে বেরিয়ে আসে।
হায়দ্রাবাদে এই ব্যবসা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। আরব,ওমান,মিডল ইস্ট থেকে শেখ সাহেবরা আসে,কমবয়সী বিবি কিনে নিয়ে যায় ।

কৌসরের এখানকার তর তরিখা রপ্ত করতে তকলিফ হচ্ছে খুব ।যদিও স্বামী মহম্মদ লোকটা ভাল,নানা উপহার নিয়ে আসে,মিষ্টি হেসে কথা বলে,কিন্তু ভাষা না জানায় কৌসর বুঝতে পারে না।অস্বস্তিতে সিঁটিয়ে থাকে। রাতে যখন আদর করতে আসে,কৌসরের কান্না পায়। নোংরা ছবি দেখিয়ে নানা পোজ দিতে বলে। কৌসরের বমি পেয়ে যায়।কথা সব আকার ইঙ্গিতেই চলে।একদিন তো সে টয়লেটেই বসে ছিল,মহম্মদ খুব রাগ করেছিল সেদিন।সলমার সাথে মহম্মদের সম্পর্ক বুঝতে পারল না এখনো। ‘সবর,সবর,’ বলে সলমা কিছু মহম্মদকে বোঝাচ্ছিল।সলমা পরে কৌসরকেও বোঝায়,কিছু উর্দূ শব্দ থাকায় কৌসর বোঝে। বোঝে সে কেনা দাসী,মহম্মদ যা চায়,সেইভাবে মন জুগিয়ে চলতে হবে,নইলে আরেক বিবি নিয়ে আসলে তার মুশকিল বাড়বে বই কমবে না ।
 
একদিন মহম্মদ বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল,বিশাল এক নিশান গাড়িতে। এত সুন্দর গাড়ি,এসি চলছে। অপূর্ব সেই সমুদ্র সৈকত!কৌসর এর আগে সমুদ্র দেখে নি। হায়দ্রাবাদের সেই গলির বাইরে কিছুই দেখে নি।বালিকাসুলভ আনন্দে সে জুতো খুলে জলে পা ভেজায়। পরনের কালো বোরখাটা খুলে ফেলে দৌড়তে ইচ্ছে করছিল।নির্জন বেলাভূমি,কিছু লোকজন ঘোরাঘোরি করছে। এক মেমসাহেব আধা ন্যাংটো হয়ে সাঁতার কাটছে। কৌসরের দেখে যদিও লজ্জা লাগছিল,কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছিল খুব।কেন যে এত সব বাধা!
বালিতে রং বেরঙী কাঁকড়াগুলি দেখে হিংসে হয়। কি মজা এগুলোর! মহম্মদ এক খোলা ডিঙি ভাড়া করে,তাতে চড়ে বসে ওরা।পড়ন্ত বিকেলে আরব সাগরে নৌকো ভ্রমণ,বেশ ভাল লাগে কৌসরের। বড় ঢেউ কাছে এলে অজান্তেই মহম্মদের হাত ধরে ভয়ে। লজ্জা পেয়ে ছেড়ে দেয়।সবই ঠিক ছিল,শুধু মহম্মদের বদলে তার পাশে যদি আদনান থাকত!তেরো বছর বয়স থেকেই পাশের বাড়ির আদনানকে তার ভাল লাগত।হায় আল্লাহ,একী ভাবছে সে!এ গুনাহ্!পরপুরুষ এখন আদনান। চমকে ওঠে ভাবে,এভাবেই কি জীবনটা কাটবে! শেষ করে দিলে কেমন হয়!না আজ থাক,আরব সাগরের জল তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।মহম্মদকে একটু হাতে রাখতে হবে। ফেরার পথে মহম্মদ ওকে হায়দ্রাবাদে ফোন লাগিয়ে কথা বলিয়ে দিল। ওখানে তো সাধারণ,সস্তা মোবাইল,শুধু কথাই বলা যায়!“আম্মী,তোমাদের দেখতে ইচ্ছে করে।কবে জানি আবার দেখব!” কৌসরের মুখ ম্লান হয়ে যায়,চোখে জল এসে যায়।যদি আম্মী,ভাই বোনকে দেখতে পেতো! আবার কবে দেখবে কে জানে!মহম্মদ তাকে মোবাইল দেখিয়ে কিছু বলল। বোধকরি কৌসর রোজই কথা বলতে পারবে বা ওকে মোবাইল দেবে,এমন কিছু, কৌসর আন্দাজ করলো।
পরের দিন মহম্মদ এক  স্মার্ট মোবাইল গিফ্ট করল। শিখিয়ে দিলো কি করে ব্যবহার করতে হয়। কৌসরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে এই উপহারের দাম তাকে দিতে হবে। কথাটা মনে হতেই সিঁটিয়ে গেল।মহম্মদের হাসি মুখে বার বার কাছে আসা,অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা,সবকিছু তাই ইঙ্গিত করছে।
কৌসর ভাবে,এই পরিস্থিতি থেকে তো তার রেহাই নেই,তবে কেন সে নিজের ফায়দা ভাববে না!মহম্মদকে দিয়ে তার সখগুলো কেন পূরণ করে নেবে না! কয়েকদিনের জন্য হায়দ্রাবাদ ঘুরে আসবে। শুধু রাতটুকু সহ্য করতে হবে।ক্রেতা,বিক্রীতের সম্পর্ক তাদের,কিন্তু সে দাসী হয়ে থাকবে না।শুধু ‘রাতের’ কথা মনে এলেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়।ঠিক করে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘আরবী’ ভাষা শিখে নিতে হবে,সলমার সাথে অন্তরঙ্গতা করে,শিখে নিতে হবে সব। কেউ যেন বুঝতে না পারে,এটা ওর অভিনয়! 

🍂
কয়েকদিন পর গভীর রাতে  মহম্মদকে খুশী করে,বাধ্য স্ত্রী হয়ে সব মেনে নেয়। ভাঙা ভাঙা আরবীতে বলে, “অনেকদিন মা বাবাকে দেখি না,খুব ইচ্ছে করছে। হায়দ্রাবাদ ঘুরে আসি,ক’দিন?”
মহম্মদ খুশী মনে ছিল,এই প্রথম কৌসর তাকে বাধা দেয়নি,আগ্রহ দেখিয়েছে।কিন্তু আজই এই আব্দার! থাক্,বাচ্চা বই তো নয়। হাসি মুখে মাথা নাড়ে,সম্মতি জানায়। কৌসরের গাল টিপে ইঙ্গিতে জানায় যে রোজই এমনভাবে খুশী করতে হবে।রক্তাক্ত কৌসর যন্ত্রণা চেপে মাথা নাড়ে,জোর করে হাসি আনে।কিশোরী মনকে মেরে এক পরিণত নারী হবার প্রচেষ্টা চালায়। ব্যাস,একবার হায়দ্রাবাদ যেতে পারলে হয়!ততদিন তাকে সহ্য করতেই হবে। জীবনের কুৎসিত দিকটাকে মানতে গেলে কিছু স্বপ্ন তো ভীষণ দরকার। হায়দ্রাবাদ গিয়ে কত মস্তি করবে এই স্বপ্নে বুঁদ হয়ে  সে তার অপরিণত কিশোরী শরীরকে প্রস্তুত করে,দলিত মথিত হবার জন্য।ভেবে নেয় হায়দ্রাবাদ থেকে আর ফিরে আসবে না,যা থাকে নসীবে,  দেখা যাবে! ততদিন....আল্লা যেন  দোয়া করে!নইলে সাগরের জল তো আছেই।

সমাপ্ত

Post a Comment

0 Comments