আবীর ভট্টাচার্য
‘থাকত যদি মেঘে-ওড়া. পক্ষিরাজের বাচ্ছা ঘোড়া,তক্খুনি যে যেতেম তারে লাগাম দিয়ে কষে’...মানুষের মন তো আজন্মই পরিযায়ী। ব্যস্ত জীবনের অযুত ঝক্কির মাঝেও তার চরণছন্দে সততই বাজে চরৈবতিঃ চরৈবতিঃ…জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যাত্রাপথে এই এষণাটুকুই হয়তো তার জীবন সম্বল।
তাই কাছে দূরে যখন যেখানে সুযোগ আসে,আমরা বেরিয়ে পড়ি।সে সুযোগও না থাকলে মানস ভ্রমণ। এবং এইক্ষেত্রে সর্বোত্তম সাহায্য করে ভ্রমণ বিষয়ক বইপত্র, পত্রপত্রিকা। সম্প্রতি তেমনই একটি বই এলো হাতে। মাত্রই একশো আটান্ন পৃষ্ঠার সুন্দর একটি হার্ডবোর্ড বাইন্ডিং। লেখিকা চিত্রা ভট্টাচার্য্য,প্রকাশক জলদর্চি। প্রচ্ছদ শিল্পী শুভ্রাংশু শেখর আচার্য, রুক্ষ পর্বতগাত্রের পটভূমিকায় উড়ে বেড়ানো কয়েকটি যেন নিম্নমুখী ঝরা পাতার প্রচ্ছদ চিত্র। এবং প্রতিটি পাতাতেই কলোরাডোর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর ছবি।
হ্যাঁ। আমি চিত্রা দেবীর নবপ্রকাশিত “কালের অতলে কলোরাডো”-বইটির কথাই বলছি,যার প্রাককথনেই আছে লেখিকার সরল নির্ভার স্বীকারোক্তি, আমি লেখিকা নই,তবু.…
আমিও গ্রন্হ সমালোচক নই।তবু ঋত্বিক দাদার অনুরোধে বইটি হাতে নিয়ে প্রথমেই গ্রন্হটির অর্থবহ প্রচ্ছদ, লেখিকা না হয়েও বইটির প্রথম থেকে শেষ অবধি লেখিকার লেখনীর স্বচ্ছন্দ্য চলন,প্রাঞ্জল বর্ণনা, বেশ কয়েকটি সুন্দর ছবি,নির্ভুল বানান,ঝকঝকে বাঁধাই, সজ্জা বিন্যাস আমায় এতোটাই মুগ্ধ করলো যে কয়েকটি কথা তৃপ্তিভরে লিখতে ইচ্ছে হো’ল।
ছোটবেলার ভুগোল পাঠের দৌলতে কমবেশী আমরা সকলেই জানি,কলোরাডো হলো, আমেরিকার পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজ্য,সুনামী নদীও।দক্ষিণ রকি পর্বতমালার কিয়দংশ এবং পাশাপাশি কলোরাডো মালভূমির উত্তর-পূর্ব অংশ এবং বৃহৎ সমভূমির পশ্চিম প্রান্তকে নিয়ে যা গড়ে উঠৈছে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অষ্টম বৃহৎ ও একবিংশতম সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য এবং এই অঞ্চলটিতে আদিবাসী আমেরিকানরা ১৩,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসছে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
বিশেষ বিশেষ স্থানে খ্রিস্টপূর্ব ১১,২০০ থেকে ৩,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত প্রাপ্ত নিদর্শনগুলিও রয়েছে। যেহেতু এটি রকি পর্বতে অবস্হিত এবং রকি পর্বতমালার পূর্ব প্রান্তটি গোটা আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রাচীন লোকদের প্রধান স্থানান্তর গমনের পথ ছিল, তাই এর ভৌগলিক গুরুত্ব ব্যাখ্যাতীত। কলোরাডো উত্তরে ওয়েমিং, উত্তর-পূর্বে নেব্রাস্কা, দক্ষিণে ওকলাহোমা, দক্ষিণে নিউ মেক্সিকো, পশ্চিমে উটাহ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে অ্যারিজোনার সাথে সীমানা গঠন করেছে।
স্বাভাবিকভাবেই কলোরাডো অঞ্চল পাহাড়, জঙ্গল,উঁচু সমভূমি, গিরিখাত, প্রপাত,মালভূমি, নদী ও মরুভূমির অভিনবত্বের জন্য জগৎবিখ্যাত।কলোরাডো ওদেশের পর্বতমালার রাজ্যগুলির মধ্যে একটি এবং এটি পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমা যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গ। ডেনভার কলোরাডোর রাজধানী এবং সর্বাধিক জনবহুল শহর। এসব তথ্য অজানা ছিল না।
তবু অবাক করলো এক প্রৌঢ়া বাঙালিনীর অদম্য ভ্রমণ স্পৃহায় সন্তান ও সন্তানসম তিনটি তরুণ তরুণী(অতনু,ইয়াম, পারভীন)-র সঙ্গে মিলে সর্বাঙ্গসুন্দর এক মায়াবী ভ্রমণবৃত্তান্ত। কখনও হিমাঙ্কের নিচে, কখনও বা শুস্ক তপ্ত আবহাওয়ায় চলেছিল যে বেশ কয়েকদিনের আরামদায়ক যৌথ আনন্দযাপন,ভ্রমণ এবং শেষে মহামারী কোভিডের আতঙ্ক মোকাবিলা।
রচনার শুরুতে,ছেলের কাছে বেড়াতে গিয়ে তার অফিস কলিগদের সঙ্গে ছেলেরই নতুন সুন্দর টেকোমা গাড়িতে ভ্রমণ পরিকল্পনা।পথে সাজানো ছিল কতো কতো আনন্দের ডালা! অপূর্ব সুন্দর সব রক্তাভ পর্বত, গিরিখাত, প্রাগৈতিহাসিক ক্যানিয়ন, অদ্ভুত গাছপালা, অভয়ারণ্য, অ্যান্টিলোপ, বিস্তীর্ণ পশু চারণভূমি, শুস্ক মরু প্রান্তর, আমেরিকার নির্জনতম অঞ্চল যেমন ছিল, অসমবয়সীদের সঙ্গে গান,মাউথ অর্গানের সুরে মন ভাসানো,সুন্দর সুন্দর হোটেলে থাকা-খাওয়া, তাদের রেঁধে বাঙালি খিচুড়ি খাওয়ানো,আবার তাদেরই পূর্বজ প্রিয়জনেদের রাঁধা খাবারের আস্বাদনও ছিল ।অবিকল্প প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসুধা হৃদয় ভরে গ্রহণ করার চাইতে যেগুলো কোন অংশেই কম নয়।
বিশেষতঃ মিঃ হ্যারির সঙ্গে আলাপন,জায়ন জাতীয় অরণ্য ভ্রমণ,বিশালাকার ডাইনোসোরাসের ফসিল দেখে জুরাসিক পার্ক সিনেমার স্মৃতি চারণায় তরুণ দলের কিশোরসুলভ উচ্ছাস, সর্বোপরি পারভীনের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোপকথন…ইত্যাদি ইত্যাদি ঘটনাবলীর মন ছুঁয়ে যাওয়া আখ্যান লেখার সময় লেখিকা হয়তো খেয়ালও করেননি, তিনি খুলে দিয়েছেন আমাদের সম্পর্ক-বুভুক্ষু মনের আগলটিকেও। যে দেশের নামে এখনও লেগে আছে ‘ইন্ডিয়ান’স্পর্শ,সে দেশের সাধারণ মানুষের তো এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক,যেমন স্বাভাবিক ব্রাইস ক্যানিয়ন,হুভার ড্যাম, অ্যারিজোনার শতাব্দী প্রাচীন সীডার,রেডউডের স্নিগ্ধ ছায়াঘেরা অঙ্গন থেকে ফিরে ক্যালিফোর্নিয়ায় সান্তাক্রুজ পাহাড়ে ছেলের বাসস্থানে নিরাপদে ফিরে আসার পরেই সন্তান এবং সন্তানসম সহ পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা মানুষজনেদের সুস্হতাকামনায় লেখিকার আকুল প্রার্থনা।
এবং অবশেষে নির্বিঘ্নে দেশে ফিরে আসা… মনে রয়ে যাওয়া ভ্রমণকালে সেখানকার এক ভূতত্ত্ববিদ(পলসন সাহেব)-এর আক্ষেপ ‘জীবনধারণের অপরিহার্য অঙ্গ যে নদীকে একদিন পুণ্য সলিলা প্রবাহিণী করে এক প্রাণবন্ত স্রোতস্বিনীতে পরিণত করেছিল; সেই স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিজীবি মানুষের হাতেই অবক্ষয় সয়ে সে নদী আজ মৃত্যু মুখে পতিত, মরণাপন্ন।পলির ওপর পলি জমে নাব্যতা হারিয়ে শুস্ক দূষিত এক নদী। সেখানে ক্ষীণ স্রোতের জলের বুকে মাছেরা সাঁতরে বেড়ায় না, পরিযায়ী পাখিরাও আজ আর উড়ে আসে না। আমেরিকার সুপ্রাচীন আদিবাসী যাযাবর শ্রেনীসহ ২০০০ থেকে ১০০০ বছর আগেও জলবিভাজিকাটি ছিল বৃহৎ কৃষি সভ্যতার আবাস ভূমি। কিন্তু এখন লবণাক্ত জলে চাষ আবাদ সম্ভব হয় না। নদীর ধারের জঙ্গলে আশ্রিত বন্য প্রাণীর পক্ষেও এই দূষিত লবণাক্ত জলাভূমির ধারে থাকা অসম্ভব। এক সময়ের উচ্ছল প্রাণবন্ত নদী এখন পরিত্যক্ত এক শীর্ণা জলধারা।’
পড়তে পড়তে মন বিষন্ন হয়।মনে পড়ে আমার দেশের কবির উচ্চারণ,
“নিদারুণ দুঃখ রাতে মৃত্যু ঘাতে
মানুষ চূর্নিবে যবে নিজ মর্ত্যসীমা
তখনও দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা…”
কোভিড-১৯ আমাদের যে ভয়াবহ বার্তা দিয়েছে আত্মজাগরণের।প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যনন্দিত ধনীতম পৃথিবীতে বসেও লেখিকা তা প্রত্যক্ষ করেছেন, নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন মানুষের অসহায়তা, সীমাবদ্ধতা…সেগুলিও বইটিকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। আত্মপ্রকাশেই এমন দায়বদ্ধ লেখনপ্রভা প্রকাশকের সম্পদ।
সব শেষে, নাতিপৃথুলা এই পুস্তিকাটি কিন্তু দ্রুত পঠনের জন্য নয়।র’য়ে শ’য়ে,সময় নিয়ে, নিশ্চিন্ত অবসরে পড়লেই এর মর্মার্থ হৃদয়ে পৌঁছবে।কারণ দূর দেশের অপরিচিত প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ আহরণে প্রাত্যহিক ব্যস্ত জীবনের চড়ুই নয়,হৃদয়বসন্তবনের হামিংবার্ডকেই ডাকতে হয়। অগত্যা…
এক অর্থে তাই এই ভ্রমণকাহিনী সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠেছে।শুধুমাত্র ডায়েরীর পাতায় তা সীমাবদ্ধ না রেখে সাদা কালো অক্ষরবিন্যাসে তা পরিবেশন করার জন্য লেখিকা এবং প্রকাশক উভয়কেই ধন্যবাদ। আরও লিখুন,প্রকাশ করুন। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ না পাওয়া আমরা অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই,প্রাণভরে তৃপ্ত হই।অশেষ শুভকামনা।
0 Comments