জ্বলদর্চি

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা : দীক্ষিত কবিতা চর্চাকারীদের আকরগ্রন্থ /অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা : দীক্ষিত কবিতা চর্চাকারীদের আকরগ্রন্থ

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায় 

কবিতা কী, এর উত্তরে জীবনানন্দ বলেছিলেন,  কবিতা অনেক রকম। আবার দেবারতি মিত্র তাঁর ‘মনে মনে’ প্রবন্ধে লিখছেন ‘ কবিতার কোনো সংজ্ঞা নেই। কবিতা আমার কাছে ঈশ্বরের মতো ধ্রুব নয়, জন্ম-মৃত্যুর মতো অমোঘ নয়। কবিতা মায়া, বিভ্রম, আলো ও ছায়া–জীবন ও জীবনাতীতের মিশ্রণ।’

পাঠক আমায় ক্ষমা করবেন, কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর কাব্যগ্রন্থ ‘কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা’ ও কাব্যগ্রন্থের আলোচনা করতে বসে প্রথমেই অগ্রজ দুই কবির কবিতা সংক্রান্ত আত্মোপলব্ধির শরণাপন্ন হতে হল বলে। অবশ্য এই লেখায় যতই অগ্রসর হবো, দেখবেন উপরোক্ত দুটি উক্তির সত্যতা বহন করছে এই কাব্যগ্রন্থ। 

একটি একক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে সর্বপ্রথম আমি কবিকে খুঁজে বেড়াই। তাঁর উপলব্ধি এবং প্রকাশের উপর আলো ফেলে দেখতে চাই কবি সৎ ভাবে কতখানি নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন। ‘কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা’ কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি এবং দেখেছি শ্রী ত্রিপাঠী প্রতিটি লেখার মধ্যে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন। এই কাব্যগ্রন্থের অনেক লেখা উত্তম পুরুষে। আবার অনেকগুলি প্রথম পুরুষে। কবি নিজস্ব বলয়ের চারপাশে ঘুরতে থাকা ঘটনাপ্রবাহকে কবিতায় রূপান্তরিত করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন। কখনো সেটি হয়ে উঠেছে স্বগতোক্তি, কখনো বা দর্শন। যেমন ধরা যাক ‘আশ্চর্য নততল’ নামক কবিতাটির কথা। শ্রী ত্রিপাঠী প্রথমে লেখা শুরুই করছেন স্বগতোক্তি দিয়ে–
‘আমার এখন আর কোনও দুঃখ নেই
হারানোর বেদনা নেই। না পাওয়ার যন্ত্রণা নেই।
অভাব অভিযোগ, নেই রাগে তেলেবেগুন হওয়াও নেই।’
কিছুটা এগিয়ে এই লেখাটিতেই তিনি ঢুকে পড়ছেন দর্শনে—
‘দুঃখ নেই ভেবেই যেটুকু দুঃখ। ফিরে যাই
পুরোনো স্মৃতির কাছে ঋণী হতে। ভাবি৷ অথচ
অতীত তো অতীতই।…’
একই লেখায় স্বগতোক্তি এবং দর্শনের এই পারস্পরিক যাপন লেখাটিকে অন্যমাত্রা দান করছে। 
আরেকটি লেখার শুরুটা পড়া যাক। লেখাটির নাম ‘প্রবন্ধসার’ —
‘ঝড়ের প্রাণকেন্দ্রে অগোচরে চিত্রিত হচ্ছে ধ্বনি ও সৌষম্য’
এক নয় দৃশ্যমান, প্রতিবিম্ব। এক নয় ভাববস্তু, সমার্থবাচক।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

সংহতিমায়ায় অনূদিত, সনির্বন্ধ লেখক পাঠক আমরা
বর্ণময় জ্যোৎস্নায় পায়ে ঠেলছি দেববাণী, নিয়ামক সূত্র’

লেখাটির ভরকেন্দ্রে প্রবেশ করলে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে কবির মানসিক অস্থিরতা। ঝড় সাধারণত তীব্রতার প্রতিনিধি। কবিতার প্রথম শব্দটিই ‘ঝড়’। তার প্রাণকেন্দ্রে যৌথভাবে অবস্থান করছে ধ্বনি এবং সৌষম্য, কিন্তু সেটি অগোচরে। কার অগোচরে? কবির, নাকি সমাজের? আমরা ধরে নিই এই ধ্বনি এবং সৌষম্য আসলে কবির অভ্যন্তরে ঘটে চলা ঝড়ের তীব্র অভিঘাত, যা একই সঙ্গে শব্দবহুল অথচ সেটি যথার্থ ব্যালেন্স রেখে চলেছে। এই ব্যালেন্সের খেলাই পরের লাইনে আরো সুস্পষ্ট হচ্ছে যখন আমরা দেখছি যেটি দৃশ্যমান তার প্রতিবিম্ব এক নয়, ভাববস্তু এবং সমার্থবাচকও আলাদা। এই পরস্পর বৈপরীত্য আসলে কবিতাটির প্রাণ, দেবারতি মিত্রের ভাষায় ‘আলো ও ছায়া’। এই দ্বন্দ্ব নিয়েই লেখাটি এগিয়ে গেছে এবং  আলো-ছায়ার সামগ্রিক পূর্ণতা বা কনক্লুসান, যাই বলি না কেন, সেটি অন্তিম সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে লেখাটির শেষে—
‘ধর্মরাজ্য এড়িয়ে আমরা খুঁজে চলেছি নিরন্তর
জ্ঞানশূন্য নিরীক্ষা, নিরস্ত্র সৈন্য, কৃষ্ণমেঘের উৎস…’
এখানে পৌঁছেও কিন্তু কবি খুব স্বস্তির কথা শোনাচ্ছে না। যে ঝড় দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছিল সেই ঝড়ের প্রকোপ কমলেও তার রেশ থেকে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত৷ 

‘জল-সম্পর্কিত রূপকথা’ কবিতাটিও একটু পড়া যাক–

‘গল্প শুনতে শুনতেই আমাদের জন্ম, স্বাস্থ্য, ঘুম
ঘুমের মধ্যে ঢোঁড়াসাপ, নিশ্বাসের তর্জন, নিন্দা
                                    স্তুতি ও বিষাদ
গোল চোখ মোম চোখ মুছে জল থেকে চিরকালের মতো
ডাঙায় উঠে বলেছি: প্রাণ, হে…

সুতরাং জলের কাছাকাছি আমাদের এই জীবন।’

একটি ভ্রূণ মাতৃগর্ভে থাকাকালীন গর্ভজলের ভেতর লালিত-পালিত হয়। গর্ভে বহন করতে করতে মা বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে, গল্প করে, যেমন আমাদের মায়েরা করে থাকে। একই সাথে কিন্তু স্তুতি এবং নিন্দাও শোনে। ভয় পায়। ফলত মনখারাপ হয়, বিষাদ ছেয়ে যায়। সংসার জীবনের এ এক চরম সত্য। এসব ঘটনা যখন ঘটে তখন কিন্তু শুধু মা-ই একমাত্র এগুলো শুনছে না, একই সাথে তার গর্ভের সন্তানও শুনছে। এভাবেই সে বেড়ে ওঠে গর্ভজলের ভেতর। অবশেষে যখন সে গর্ভজল থেকে বাইরের পৃথিবীতে বেরিয়ে পড়ে তখন যেন তার মনে হয় ডাঙায় উঠলো। এই নতুন প্রাণের নিজস্ব স্পন্দনটিকে নিজেই স্বাগত জানায়। এখানে ‘গোল চোখ’ এর পাশে ‘মোম চোখ’ শব্দটি এক অদ্ভুত ব্যঞ্জনা নিয়ে এসেছে। মোম যেমন অল্পতেই গলে যায়, হয়তো এই নতুন প্রাণের চোখটিও অল্পতেই ভিজে উঠবে। হয়তো গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন মা-কে উদ্দেশ্য করে নানাবিধ নিন্দাবাক্য তার চোখকে ভীষণ নরম করে দিয়েছে। 

জীবন এবং জীবনাতীতকে খোঁজার এই যে প্রচেষ্টা তা করতে বাধ্য করছেন শ্রী ত্রিপাঠী তাঁর কাব্যগ্রন্থে৷ এই অন্বেষণই একটি কাব্যগ্রন্থকে পূর্ণতা দান করে।  

ছন্দোগত দিক থেকে কবি মূলত গদ্যছন্দেরই আশ্রয় নিয়েছেন। তবে কবিতার যে গতিময়তা তা ধারণ করার জন্য গদ্যছন্দই যথার্থ। লেখাগুলিকে যদি নির্দিষ্ট মাত্রায় বাঁধার চেষ্টা করা হতো তাহলে বরং তা নিজস্ব গতিময়তা হারাতো। 

বইটি নিয়ে একটি ধারণার কথা উল্লেখ করা আবশ্যক বলে মনে হচ্ছে। হয়তো এই বইটি দুর্বোধ্যতার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে। কারণ বইটির চারিদিকে একটি আপাত কঠিন অদৃশ্য আবরণ ঝুলে আছে। বেশ কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধ অতিভারি বলে মনে হতে পারে। তবে এই অভিযোগ যদি কখনও ওঠে, তার বিপক্ষে একটি যুক্তি দিয়ে রাখা সঙ্গত। ফরাসী কবি-ঔপন্যাসিক ফ্রাঁসিস কারকো বলেছেন - ‘ কবিতা ধর্মবিশ্বাসের মতো, সে আলোকিত করে শুধু তাদেরই যারা তাতে বিশ্বাসী৷’ আবার অরুণ মিত্র বলছেন দুর্বোধ্যতার অন্যতম একটি কারণ হলো অনভ্যাস। 

তবে ধারণা যাই হোক না কেন, একটি সত্য যা অন্তত আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে তা হলো পুনর্পাঠ। এই বই আমাকে বারংবার পড়তে হয়েছে ওই অদৃশ্য আপাত কঠিন আবরণটিকে পেরিয়ে কাব্যগ্রন্থের ভেতরে ঢোকার জন্য। কিন্তু যখনই প্রবেশ করেছি এক অন্য জগতের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেখানে মেটাফরের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে সত্য, স্টেটমেন্টের পাশে রয়েছে লজিক, ঘটনাকে মুভমেন্ট করাচ্ছে প্রতিঘটন। 

এই কাব্যগ্রন্থের বেশিরভাগ লেখার লাইনের শেষে কমা বা পূর্ণচ্ছেদের ব্যবহার নেই। এই যে ওপেন এন্ডেড রেখে দেওয়ার প্রবণতা আসলে প্রতিটি লাইনকে আরো বেশি প্রাবল্য দিচ্ছে কারণ কবি বিশ্বাস করছেন সম্পূর্ণ শেষ বলে কিছু নেই। যেখানে মনে হবে ইতি ঠিক তারপরেই আবার একটি নতুন শুরু অপেক্ষা করছে। 

ফিরে আসি প্রথম কথায়। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন কবিতা অনেক রকম। এই কাব্যগ্রন্থ সেই অনেক-এর সমাহারে সমৃদ্ধ। প্রতিটি পাতায় ভাব এবং তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে কবি সচেতন থেকেছেন।

এই কাব্যগ্রন্থ চিরকালীন হবে কিনা সেটি সময় বলবে, তবে এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা’ মেধাবী এবং দীক্ষিত কবিতাচর্চাকারীদের আকরগ্রন্থ হিসেবে স্থান করে নেবে।

🍂

Post a Comment

2 Comments

  1. অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা পড়লাম কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা বইটির। অসাধারণ আলোচনা করেছেন তরুণ কবি অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়।

    ReplyDelete