জ্বলদর্চি

ইস্কুল ফিস্কুল/পর্ব -২২/সৌমেন রায়

ইস্কুল ফিস্কুল

পর্ব -২২

সৌমেন রায়

চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি

 সবার উপর পোর্টাল সত্য


এখন বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কিন্তু অনেক স্মার্ট। সরকারিভাবে বাংলার শিক্ষা বলে একটি পোর্টাল চালু আছে। যেখানে স্টুডেন্টদের নাম, ঠিকানা, আধার, ব্যাংক একাউন্ট সহ বিভিন্ন তথ্য নথিভুক্ত আছে। এমনকি স্টুডেন্টদের হাইট, ওয়েট পর্যন্ত। সেগুলি নিয়মিত আপডেট করতে হয়। যে কোন স্কলারশিপ পেতে, সুযোগ-সুবিধা পেতে, ভর্তি হতে এই পোর্টালের আইডি লাগে । স্টুডেন্ট সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য এখন এক ক্লিকে  সাটাক দুম, চোখের সামনে। স্মার্ট কিনা  বলুন! তবে প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীদের এটিকে নিয়ে প্রধান অভিযোগ যে পোর্টাল পেঁচার মত, দিনে ঘুমায়। যা কাজ রাতে।কখনও বা ভোরবেলা। আরও একটি অভিযোগ ডিজিটালাইজেশন এর পর অর্ডার আসে whatsapp বা মেলে।কখনও কখনও একদম শেষ মুহূর্তে।এক নবীন হেডমাস্টার  সারাদিন কাজের পর রাতে ঘুমাতে যাবেন এমন সময় অর্ডার এল অমুক তথ্য কালকের মধ্যে পাঠাতে হবে। সে তথ্য নাকি আগেই পাঠানো হয়েছিল। জানেন নিশ্চয় তথ্য অনেকটা  কর্পূরের মতো। মাঝে মাঝে উড়ে যায়। অগত্যা শিক্ষা কর্মীকে ঐ রাতেই ফোন করে সতর্ক করতে হল। যাতে সকাল বেলাতেই কাজ শুরু করা যায়। কি করতে হবে না করতে হবে সেই নিয়ে খানিক আলোচনা হল।বলা বাহুল্য তিনি  সারা দিনের পর গলাগলির পরিবর্তে প্রেমাস্পদের কাছে  গালাগালি পেয়েছিলেন।  কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা লঙ্ঘন করা মারাত্মক অপরাধ। মানবাধিকার হরণের মতোই। নির্দিষ্ট সময় কাজের অধিকার বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত। সেটা দু একদিন হলে ঠিক আছে।চলতেই থাকলে মানসিক চাপ তৈরির সম্ভাবনা থাকে। তাতে কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।

     এই পোর্টালের একটি পার্ট এস এম এস পোর্টাল। এখানে ছাত্রছাত্রীদের নম্বর এন্ট্রি করতে হয়। বর্ষশেষে মার্কসিট বেরিয়ে আসে। অতি উত্তম ভাবনা এবং ব্যবস্থার চেষ্টা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এমন একটি পোর্টাল সারা বছর কাজ করে না। কাজ করে অ্যানুয়েল পরীক্ষা নাগাদ। সারা বছরের কোন কোন সময় হয়তো বা কাজ করে। কিন্তু নিশ্চয়তা নেই যে আপনার এন্ট্রি করা নম্বরগুলি ভবিষ্যতে চর্মচক্ষুতে দেখতে পাবেন। দিব্য দৃষ্টি থাকলে আলাদা কথা।তাই সাধারণত আগেভাগে  কেউ এন্ট্রি করে না। করে বার্ষিক পরীক্ষার কাছাকাছি সময়। সেটিও কিন্তু বাংলা শিক্ষা পোর্টালের মতই দিনে কম রাতে বেশি কাজ করে। শিক্ষকদের অনেককে রাত জেগে, ভোর জেগে সে কাজ করতে হয়। কাজ করতে হয় নিজের মোবাইল বা ল্যাপটপে ।কারণ স্কুলের সময় পোর্টাল বিশ্রাম নেয়।প্রাথমিক স্কুলে  আবার কম্পিউটারের কোন ব্যবস্থাই নেই। তাদেরকে নিজ উদ্যোগে করতে হয়। তার ওপর গ্রামেরগঞ্জে ইন্টারনেট সমস্যা তো আছেই। অবস্থা অনেকটা  আছে গরু না বয় হাল।

পুরো মূল্যায়নকে এখন দু ভাগে ভাগ করা হয়। একটা সামেটিভ আর একটা ফরমেটিভ।  সামেটিভ হল পরীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া নম্বর। ফরমেটিভ হল সারা বছরের সামগ্রিক মূল্যায়ন। প্রতি সাবজেক্টে প্রতি ইউনিটে ফাইভ পয়েন্টস এ নাম্বার দিতে হয়। পয়েন্টগুলি হল অংশগ্রহণ  (Participation), প্রশ্ন করা ও অনুসন্ধানে আগ্রহ (Questioning &Experimentation), ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের সামর্থ ( Interpretation  & Application ), সমানুভূতি ও সহযোগিতা ( Empathy & Cooperation ), নান্দনিকতা ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ (Aesthatic & creative Explanation)। কি কিউট না ?মূল্যায়ন বলে মূল্যায়ন, স্টুডেন্টের মস্তিষ্ক থেকে হৃদয় সর্বত্র উঁকি দিয়ে প্রতিভা ছেনে আনার যন্ত্র। ইলেভেনের সদ্য চালু MCQ প্রশ্ন করার ইনস্ট্রাকশন দেখলেও আপনি হতবাক হয়ে যাবেন, পড়াশোনা কোন উচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। এখন ক্লাসের ফরমেটিভের নাম্বার দিতে একজন  টিচারকে প্রতি স্টুডেন্ট পিছু, প্রতি সাবজেক্টে ফাইভ ইন্টু থ্রি ফরমেটিভ, ওয়ান ইনটু থ্রি সমেটিভ নম্বর দিতে হয়। ফিজিক্যাল ও ওয়ার্ক এডুকেশনে আবার থিওরি, প্র্যাকটিক্যাল আলাদা নম্বর। তাদের পৃথক পৃথক গড় হয়।  একেক জন স্টুডেন্ট পিছু এন্ট্রি হয় গড়ে ধরুন দেড়শো মত। পূর্বের পর্ব গুলিতে উপস্থিতি এবং অন্যান্য ব্যাপার পড়লে বুঝতে পারবেন যে এই ধরনের নম্বর প্রদান কতটা অনর্থক। শরৎচন্দ্রের মেজদাকে ( শ্রীকান্ত) মনে পড়তে বাধ্য । তাই শিক্ষকরা যেটা করেন তা হল আগে গড় নম্বরটা পোর্টালে এন্ট্রি করে দেন, তারপর খাতা গুলো ভর্তি করেন । তাও পোর্টাল নিশ্চিতভাবে সারা বছর চালু থাকলে ঠিক ছিল। কিন্তু সেটি নিশ্চিত ভাবে অনিশ্চিত। তাই ফরমেটিভ ইভেলিউশনটা  অলঙ্কারের মত   হয়ে গেছে। দেখতে শুনতে ভালো কিন্তু বাস্তবতা নেই।

🍂

 প্যারা টিচারদের একটি চাইল্ড রেজিস্টার মেন্টেন করতে হয়। সেখানে স্কুল ছুট ছাত্র-ছাত্রীদের নাম ঠিকানা, কতজন স্কুলে ফেরত এসেছে সেসব দেখানো হয়। সেটিও পোর্টালের মাধ্যমে হয়। এক প্যারা টিচার বলছেন যে তথ্য খানিকটা দুধের মত। একদম খাঁটি হলে সহ্য হওয়া মুশকিল। অগত্যা তথ্যেরও ট্রিটমেন্ট দুধের মতই হয়। উপরওয়ালারা বাস্তব পরিস্থিতি স্বীকার করবেন না।অযথা চাপ সৃষ্টি করবেন,ধমক ধামক দেবেন। কে আর পোর্টাল খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায়। তাছাড়া দুর্জনে বলে এই টোটাল সংখাটার উপর মিড ডে মিলের অ্যালটমেন্ট নির্ভর করে।সেটা কমে গেলে তো বল হরি, হরিবোল। অন্য মানে করবেন না।মানুষ তো দুর্দিনেই ভগবানকে ডাকে! 

 তবে পোর্টালের আসল মজাটা কিন্তু অন্যত্র । যেহেতু পাশ ফেল এইট পর্যন্ত নেই তাই কাউকে পূর্বের ক্লাসে রাখা যায় না। অটোমেটিক পাস হয়। কোন প্রধান শিক্ষক বা অভিভাবক নিজে চাইলেও রাখতে পারবেন না । এমনকি ক্লাস ফাইভে কোন স্টুডেন্ট ভর্তি একবার হয়ে গেলে একদিনও স্কুল না এসে চার বছর পর সে এইট পাস সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে পারে। শুধুমাত্র এন্ড এক্সামটাতে বসতে হবে। তাতে সমস্ত বিষয়ে শূন্য পেলও অসুবিধা কিছু নেই। বিনা শ্রমে ডিগ্রী! এখন আবার গ্রাজুয়েট সেরিমনীর মত ক্লাসে পাস করার সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠান করতে বলা হয়েছে স্কুলে স্কুলে।  কিছুদিন পর হয়তো এই পাস সার্টিফিকেটটা মিনিসিপ্যালিটি বা পঞ্চায়েত থেকেও দেওয়া হতে পারে। কারণ এই ধরনের স্টুডেন্টদের ক্ষেত্রে স্কুলের ভূমিকা কিছু নেই। নাইনের ক্ষেত্রে এমন ছিল না। অর্থাৎ সবাই পাস ছিল না। কিন্তু গত বছর শেষ মুহূর্তে অকৃতকার্যদের এক ক্লিকে কৃতকার্য করার অভূতপূর্ব ব্যবস্থাও করে দিয়েছে পোর্টাল। এক্ষেত্রে সরকারি নিদান হচ্ছে; যে স্টুডেন্ট যে ক্লাসের উপযুক্ত সেখানেই সে পড়বে। প্রয়োজনে তাকে রেমিডিয়াল ক্লাসের মাধ্যমে সেই ক্লাসের উপযুক্ত করে নিতে হবে। সারা বছর স্কুল খুলে রেখে যেখানে শেখানো যাচ্ছে না সেখানে কয়েকটা রেমিডিয়াল ক্লাসে কিভাবে হবে? কখন সে ক্লাস হবে, হলেই বা কে আসবে? এসব প্রশ্ন করছেন কাকে? এগুলি  ঈশ্বরের কাছে প্রশ্নের মতই। আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? কি জন্য এসেছি? কোথায় ফিরে যাব? ইত্যাদির মতো, সারা জীবন খুঁজে বেড়াবেন কিন্তু উত্তর পাবেন না।

  কয়েক বছর যাবৎ শোনা যাচ্ছে যে মাধ্যমিকে স্টুডেন্ট সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এইট  নাইন পর্যন্ত  স্টুডেন্টের তুলনায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অনেক কম। তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শিক্ষাবিদ ,সরকারি কর্তারা বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তার মধ্যে কোভিডের অজুহাত একটা । অন্যতম প্রধান কারণটি হল প্রাথমিক স্কুল থেকেই ধীরে ধীরে শিশুরা ড্রপ আউট হচ্ছে। কারণ তারা শিখতে পারছে না। না শিখে শুধুমাত্র খাওয়া, পোশাক ইত্যাদির জন্য দিনের পর দিন স্কুলে বসে থাকা সম্ভব নয়। এই সরল সত্যটি সবাই তাড়াতাড়ি বুঝলে ভালো। কিন্তু বোঝার সম্ভাবনা  দেখা যাচ্ছেনা। এই যে ড্রপ আউট হচ্ছে এটা কিন্তু কোন ভাবেই পোর্টালে রিফ্লেক্ট হচ্ছে না। পোর্টাল দেখাচ্ছে সবাই উপস্থিত। তার ফলে যখন রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে তখন সংখ্যাটা ধপ করে পড়ে যাচ্ছে। কারণ যারা ড্রপ আউট তাদেরকে তো আর রেজিস্ট্রেশনের জন্য পাওয়া যাচ্ছে না। একটি বিদ্যালয়ের প্রকৃত স্টুডেন্ট সংখ্যা ৫৫০ মতো পোর্টাল খুললে দেখায়  ৬৫০ এর বেশি।

 বুঝতে পারছেন শিক্ষা ক্ষেত্রে এখন সবার উপরে পোর্টাল সত্য তাহার উপরে নাই।

Post a Comment

0 Comments